ধর্ষণ সংস্কৃতি ও ধর্ষকের
মনস্তত্ব
অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, বিদ্বান, সাধারণ বা অপরাধপ্রবণ আসামাজিক পুরুষ কমবেশি সকলেরই প্রায় এক অবস্থা (আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসার অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের একাংশকে অনেক বেশি সহমর্মী করে তুলেছে, একথা আলাদা করে পরে আলোচনার প্রয়োজন। কেননা এটাই আমাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ বিকাশের ক্ষেত্রে একমাত্র আশার আলো।) তারা জানে না কীভাবে নিজের অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া বা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আবার এও জানে না কীভাবে আশেপাশের অন্য মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হয়। কেননা এ প্রশিক্ষণ সমাজ, পরিবার বা বাবা মা কেউই তাদের দেয় না। বরং উল্টো প্রশিক্ষণের একটা ট্র্যাডিশন অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।
ভারতীয় বা পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যিক উপাদানগুলোকে পর্যালোচনা করলে এটা আমরা খুব সহজেই নির্ণয় করতে পারব জ্ঞানী ও বিদ্বান ব্যক্তি মাত্রই যে তিনি খুব উচ্চ মানবিক গুণসম্পন্ন বা মানবতাবাদী তেমন নয়। ভারতীয় মহাকাব্যদ্বয়ের বিভিন্ন পুরুষ চরিত্র এবং নারীদের প্রতি তাদের আচার আচারণ বিশ্লেষণ করলেই আমার বক্তব্য উপলব্ধ হবে। বিদ্যা বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ রাবণের সীতা হরণ বা যুধিষ্ঠিরের দ্রৌপদীকে পাশাখেলায় বাজী রাখা দেখলেই বোঝা যায় মানুষ হিসেবে এরা কতটা মানবিক গুণসম্পন্ন বা মানবতাবাদী ছিল। আবার সীতার অগ্নিপরীক্ষাকামী রামের চরিত্র গুণাগুণও পুরুষশ্রেষ্ঠ হওয়ার পক্ষে যুক্তিযুক্ত হলেও যথেষ্ট মানবিক গুণসম্পন্ন নয়। এই সব পৌরাণিক চরিত্রগুলোর কীর্তির কথা স্মরনে এলে ইথিওপিয়ার সেইসব প্রথা ও পৌরুষের রোমহর্ষক বিভিন্ন ঘটনার কথাই (ধর্ষণ সম্পর্কিত অন্য প্রবন্ধে এর স্পষ্ট বিবরণ আছে। দয়া করে পাঠক সেই আলোচনা ও তথ্যগুলো দেখে নেবেন সেই আশা রাখছি।) আমার মনে আসে। অথচ যুগে যুগে এরা পূজিত হয়েছে মানুষের কাছে উদাহরণ হিসেবে।
একটা মানুষ যখন তার বিদ্যা, বুদ্ধি, ইত্যাদিকে ব্যাক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি, আত্মপ্রচার কিম্বা অন্য মানুষকে পদানত করে রাখার কাজে ব্যয় করে মানবধর্মকে নগন্য করে রাখার কাজে ব্যয় করে তখন সেই মানুষ যত বড়, যত সম্মানীয়ই হোক না কেন তার অস্তিত্বের তেমন কোনো মূল্য আর থাকে না সমাজ সংসারে। বিদ্যান, বলশালী রাবণ তেমনটাই করেছে, রামায়ণে আমরা তেমনটাই দেখতে পাই। যদিও এ সাহিত্য অনেক শত বছর আগেকার পৃথিবীকে রিপ্রেজেন্ট করছে, তবু একটা কথা তো সত্যি, মানবীয় আবেগসমূহ, অনুভূতিসমূহ স্থান কাল পাত্র ভেদে সার্বজনীন। ক্ষমতা ও আধিপত্যবাদের পরাকাষ্ঠা এইসব যুগোতীর্ণ চরিত্রগুলো, সে রাম, রাবণ, যুধিষ্ঠির বা অন্যান্যরা যেই হোক না কেন, সামগ্রিকভাবে সুবিধেজনক অবস্থানে থাকা স্বত্বেও তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসেবে না নিজেদের আবেগ অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতায় প্রশিক্ষিত ছিল, না অন্যের আবেগ অনুভুতি, ভালোলাগা মন্দলাগা, এইসব কিছুর ব্যাপারে সহমর্মী ছিল। যে কোনো সাহিত্যেই চরিত্রগুলো যেহেতু নির্মিত হয় সেই সমাজেরই নানা চরিত্রের আদলে, তাদের আবেগ অনুভুতিগুলোও সেভাবেই দিক নির্দেশিত হয়। আর এইজন্যেই সাহিত্যিক উপাদানগুলো এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যে কোনো মানবীয় গুণ ও সত্য উন্মোচনে। যে সব সাহিত্যে সাধারণ মানুষ বা অপরাধপ্রবণ চিত্ত প্রতিফলিত হয়েছে, সেখানেও বিদ্বান বা পন্ডিত পুরুষদের চারিত্রিক প্রতিফলনের পুনরাবৃত্তিই পরিলক্ষিত হয়। এই জন্যই বলছিলাম মানবীয় আবেগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা বা অন্যের আবেগকে গুরুত্ব দেওয়া না দেওয়ার শিক্ষায় সমাজের আপাদমস্তক সর্বত্রই মুড়ি মিছরির এক দর। এর একটাই কারণ আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী বা গোটা সমাজ সভ্যতা জুড়েই হাজার হাজার বছর ধরে একটাই সংস্কৃতি চলে এসেছে – নারী অবদমনের সংস্কৃতি। কিন্তু সভ্যতার ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য নির্মোহ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব কিছুর পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরী। এবং এটা একটা সময়ের দাবী। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই দর্শনের চর্চা পৃথিবী ও সভ্যতায় একরকম অমোঘ বলা যায়।
যাইহোক আবার পুরনো আলোচনায় ফিরে আসি। যে কথা বলছিলাম, পাশাপাশি আর একটা ব্যাপারও হিসেবেরই মধ্যে রাখতে হবে আমাদের – সাধারণ অনুন্নত, মধ্যমেধার যে কোনো মানুষ ঐতিহ্য বা প্রথা দ্বারা অনেক বেশি পরিচালিত হয় যে কোনো নব্য, আধুনিক জ্ঞান বা সত্যের তুলনায়। অর্থাৎ আমি এটাই বলতে চাইছি মানুষ পঞ্চাশ, একশো বা দুশো বছরের জীবনযাপন বা ধ্যানধারণা, আদবকায়দা দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত, পরিচালিত হয় তার বর্তমান সময়ের ধ্যানধারণার তুলনায়। এর একটা কারণ সাধারণভাবে মানুষ চিন্তাভাবনা করে কম, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে কম। এর কারণ গোটা সমাজের প্রায় পুরোটাই প্রায় সবসময়েই প্রাচীন, পুরোনো ধ্যান ধারণা আদবকায়দা ও জীবনদর্শন দ্বারা পরিচালিত হয়। নতুন চিন্তাচেতনার দ্বারা পরিচালিত যে কোনো মেধা থেকে এরা দুরত্ব বজায় রেখে চলে। তাকে আঙুল উঁচিয়ে সর্বদা কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। তাকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার পক্ষে বিপদজনক, ক্ষতিকারক বলে মনে করে। এটাই সংস্কৃতির মধ্যে বহমানতার অভাব তৈরী করে মানুষকে শতাব্দির পর শতাব্দি, যুগের পর যুগ একই জায়গায় আটকে রাখে শুধু নয়, ঐতিহ্য আর অতীতচারী হতে এবং তাতে গর্ববোধ করতে শেখায়।
পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন এতক্ষণ ধরে ওপরে আমি এই যে এত সব বিষয় ও বক্তব্যের অবতা্রণা করলাম তার সঙ্গে ধর্ষণ বা ধর্ষণসংস্কৃতির যোগ কি সত্যিই আদৌ আছে? থাকলেও তা ঠিক কতটা? কোথায়? এবার আমি সেই বিষয়টাই আমার পরবর্তী লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব ধর্ষণ সংস্কৃতির সুদূর প্রসারিত শাখাপ্রশাখারও একটা হালহদিস যথাসম্ভব তুলে ধরার।
আমাদের সমাজে পরিবারগুলোতে রোজ প্রতিদিন অজস্র ঘটনা ঘটছে
যেগুলো আমাদের দৈনন্দিন যাপনকে একটা নির্দিষ্ট মানে ও মূল্যবোধে বেঁধে রাখে। এগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পূর্বপরিকল্পনা
থাকে না। যদিও এগুলো আসলেই একটা বড় সড় পূর্বপরিকল্পনার অংশবিশেষ। এবার পাঠক আসুন সেইসব টুকরো টুকরো যাপনচিত্রগুলোকে আমরা একবার দেখে নিই।
তার আগে একটা কথা বলে নিই, যেহেতু সেগুলোর বেশির ভাগই আমার দৈনন্দিন পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে
তুলে ধরব, তাই সেগুলোকে আমি স্থানকালপাত্র উল্লেখ না করে যথা
সম্ভব সেগুলোর বাস্তবতা অক্ষুন্ন রেখে বলার চেষ্টা করব।
যাপনচিত্র একে আমি উল্লেখ করতে চাইব একটা ঘটনার কথা যেখানে একজন মা জানাচ্ছেন তাঁর ছেলে এবং স্বামীকে রেখে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাওয়া ও ফিরে আসার পরের অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর বক্তব্য অনুসারে বেড়াতে যাওয়ার আগে স্বামী ও ছেলের প্রতিদিনের সম্ভাব্য ব্যবহারের পোষাকগুলো তাদের একেবারে হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে যেতে হয় এবং ফিরে এসে তাঁকে শুনতে হয়, ’কোথায়, কই, কিছুই তো খুঁজে পেলাম না’। অর্থাৎ এই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিজেদের জামাকাপড় নিজে সামলাতে পারেন না। সব সময় সব কিছু তাদের হাতে হাতে দিতে হয় শুধু নয়, এই অকর্মন্যহীনতার মধ্যে বাপ ও ছেলে একধরনের পৌরুষের মর্যাদা দেখতে পায়। এই আত্মনির্ভরতাহীনতার মধ্যে তাদের কোনো লজ্জ্বা তো দেখাই যায় না। বরং পাওয়া যায় এক আত্ম অহংকার যে অহংকারে তাদের অস্তিত্ব গর্বিত। ছেলে ও বাবা দুজনেই কর্মক্ষেত্রে ভালো পেশায় নিযুক্ত যা নির্দেশ করে তাদের উঁচুমানের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে। এঈ পরিবারটি রক্ষণশীল বনেদিয়ানায় চালিত। স্বাবলম্বনের চর্চা সেখানে নেই। যে মা তাঁর জীবনের এই তথ্যগুলো দিয়েছিলেন তিনিই নিজে হাতে তাঁর ছেলের শিক্ষার বুনিয়াদ স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু হয়তো তিনি এটা ভাবেন নি প্রথাগত বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি তাঁর উচিত ছিল দৈনন্দিনে প্রয়োজন কিছু ঘরের কাজও ছেলেকে শিখিয়ে রাখার কথা, স্বাবলম্বনের সংস্কৃতি ছেলের রক্তের ভেতরে চারিয়ে দেবার কথা। আর ঠিক এই কারণেই তাঁর স্বামীর পরে ছেলের হাতেও তিনি বন্দী হয়ে গেছেন।
এখানে অবশ্য কতগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। এই যে একটা ছেলেকে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বনের সংস্কৃতি রপ্ত করানো গেল না বা হল না সেটা দুভাবে এখন হতে পারে। এক, মা তার ছেলেকে সেই শিক্ষা দিলেন না। কেননা তাঁর মনে হয়েছে জীবনে ওটি না হলেও চলবে। বা তাঁর এমনটাও মনে হতে পারে পুরুষমানুষের ওসব দরকার নেই। আবার এমনটাও হতে পারে বাবা চান না তার ছেলে ঘরের কাজ করুক। এই মানসিকতা আসলে পরিবারে ও সমাজে পুরুষ আধিপত্য বজায় রাখার বহু পুরনো একটা ব্যাবস্থা যা শেষ পর্যন্ত সংসারে একধরণের লিঙ্গ অসাম্য তৈরী করে ছেলেদের উচ্চস্থানে বসাবার একটা প্রক্রিয়া যা শেষ পর্যন্ত কখনও কখনও ধর্ষণ অব্দি পৌঁছে যায় , আবার কখনও কখনও বা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ততটা দূর যায় না। তবে ধর্ষণকে শনাক্তকরণে এ ঘটনার শনাক্তকরণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে। ছেলেদেরকে ঘরের কাজে ব্যাস্ত রাখাটা, বাইরের জগতে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করাটা, বর্তমান প্রেক্ষিতে তাদের স্বাধীনতার গণ্ডিটাকে সীমিত করে দেওয়াটা উল্লম্ফন তৈরী করবে আমাদের সমাজে। এই সব কিছুই একটা ছেলের মানসিক পরিকাঠামোকে এমনভাবে নির্মাণ করবে যা শেষ পর্যন্ত এক নতুন সামাজিক চেতনারও জন্ম দিতে সাহায্য করবে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন