বর্ণমালার সাতকাহন
(১৬)
যে পথে যেতে হবে
রাসবিহারী এভেন্যু থেকে মুদিয়ালির দিকে বাড়িটা। গলির নাম আর মনে পড়ে না। ঝাঁ চকচকে বিশাল বাড়ি। রবি ঠাকুরের জ্ঞাতি ওঁরা। স্বামী স্ত্রী ও একটি মেয়ে।
কাগজের বিজ্ঞাপন
দেখে যাওয়া। ছোট্ট একটি মেয়েকে গান শেখাতে হবে। সপ্তাহে দুদিন। প্রথমে একশ পরে দু'শ টাকা দিতেন তাঁরা। সঙ্গে সরবত লম্বা কাঁচের গ্লাসে। একটি সন্দেশ। বিবর্ণ পোষাক পরে
ততোধিক ম্লান মুখে বর্ণমালার মেয়েটি যেত। মেয়েটির গানের হাতেখড়ি আমার কাছে। আমি
আর কে। কেউ নয়। নিজেই দুই গুরুর কাছে গান শিখতে যাই সেই সময়। অতুলপ্রসাদ, ডি এল রায়,
দ্বিজেন্দ্রগীতি শিখতে গুরু সুপ্রতীম বাগচী এবং বালিগঞ্জ প্লেসে গুরু মায়া সেনের কাছে
রবীন্দ্রনাথের গান। যোগ্যতাহীন সেই কলেজ পড়ুয়া হয়ে গেল সঙ্গীত শিক্ষক।স্রেফ আর্থিক
অনটনে।
চৈত্রের গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে পলাশ গাছটা। রবীন্দ্রসদনের সামনে। একান্তে চেয়ে থাকলে গায়ে কাঁটা দিত। ফুলে ফুলে রক্তাক্ত হয়ে আছে একা পলাশ। সংলাপময় শব্দহীন আড়ম্বর। যেতে আসতে, দিনে দুপুরে দেখার লোভে যাওয়া।
চার ঘন্টার
পরীক্ষা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে সবসময় বলা যেত, ওহে শোনো পৃথিবীটা
আজ থেকে আমার।
কলেজ লাইফ জীবনের এক আশ্চর্য পর্ব। অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ শিবনাথ শাস্ত্রী বাণিজ্য শাখার। ফাইনান্স অনার্স, প্রভাত বিভাগ। কলেজের পেছনে ছিল অভিনেতা চিরঞ্জীবের বাড়ি। সরাসরি শোবার ঘর। মেয়েরা হামলে পড়ে দেখত দাড়ি কাটছে নায়ক।
আসত ইংরেজি অনার্স ইন্দ্রাণী মুখার্জি পরে অভিনেত্রী, গাড়ি চড়ে চড়া মেকাপ, সখী সহযোগে কখনও পথ ভুলে কলেজে আসত। দু জোড়া লেসবিয়ান ছাত্রী। মোটামুটি ওখান থেকে ছাল ছাড়ানোর শুরু। এই বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েদের শিখে আসা যাবতীয় নীতিকথার আবরণগুলো খসে পড়ার শুরু কলেজ। কলেজ গিয়ে প্রথম ধারণা বহু বিন্যাসের যাপন চিত্র সম্পর্কে। কলেজের প্রিন্সিপাল, নেতাজি পরিবারের বধূ ইংরেজির অধ্যাপিকা কৃষ্ণা বসু। শান্ত সৌম্য ছোটো খাটো মহিলা। ধীর নিম্ন স্বরে ইংরেজি পড়াতেন। তেমন কখনও চিৎকার করতেন না নিজের কক্ষে বসতেন। তবু কী এক অসামান্য ব্যক্তিত্বের আভিজাত্য ঠিকরে পড়ত। স্কুল ম্যাগাজিন ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি পত্রিকায় লেখার সূত্রে কলেজের বছর তিনেক আলাদাভাবে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। ক্লাস বাংক করে অনেক মেয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে যেত রবীন্দ্র সরোবরে প্রেম করতে। আমার কোনও প্রেম ছিল না কোথাও, গোপন কোণে আত্মসম্ভ্রমহীন কপর্দকহীন এক ভিখারি মন বাস করত ওপরটা স্মার্ট যুবতীর পরিধানে।
ডিন মণিলাল দাশের একাউণ্ট্যান্সি বই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া ছিল। এখানে মূল কয়েকটি ক্লাস তিনি নিতেন। লবি দিয়ে হেঁটে গেলে সমস্ত কলেজ পিন পড়া নিঃশব্দ এমনই ছিলেন কঠিন অথচ ততটাই জনপ্রিয় ছিল তাঁর ক্লাস।
মাড়োয়াড়ি
মেয়েরা অতি সংক্ষিপ্ত পোষাক পরে আসত দল বেঁধে, যেগুলি বাঙালি পরিবারে তখনও চলন ছিলো
না। কলেজে সকলেরই ক্রাশ থাকে। বিবাহ পরবর্তী সংঘাত জনিত পাংশু হৃদয় সত্ত্বেও এই হিরো
ওয়ারশিপ আমাকেও আক্রান্ত করেছে। বিদেশের উনিভার্সিটি ছেড়ে দেশের কলেজে পড়াতে এলেন
অর্থনীতির কমলেশ স্যর। ছিপছিপে গঠন, নুন মরিচ চুল, শ্যামবর্ণ কাঁধে খাদি ঝোলা, প্রায়
প্রৌঢ় কমলেশ সেনগুপ্ত গোটা কলেজের হার্টথ্রব হয়ে গেলেন কেন সে এক রহস্য। অসামান্য
পড়াতেন, তাঁর লেকচার শুনতে এমনকি অন্য শাখা থেকেও মেয়েরা আসত। অথচ ছাত্রীদের ক্লাসে
টানার জন্য ডি কে সি ট্যাক্স পড়াতে গিয়ে লিপ্সটিক প্রসঙ্গ এনে ফেলেও ক্লাস ভরাতে
পারতেন না। নিজে শিক্ষকতা করতে এসে এইসব কথা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে, নিজেকে গড়ে তুলতে
সাহায্য করেছে।
বাকি দিন ঘরে ফেরার সংঘাত এড়াতে চলে যেতাম রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরি। বইয়ের অগাধ সমুদ্র তীরে টেমপেস্ট যেন। কত ধরনের বই সে সময় পড়া হয়েছে। আর্কিটেকচার থেকে পাখি বিজ্ঞান, সাহিত্যের ইতিহাস থেকে সঙ্গীত ।
তেতলার ধ্যানঘরে
তখন ঘনঘন যাওয়া। লাল আলোকবিন্দু কি জাগাতে পেরেছে আত্মশক্তি? রেলিজিয়ন আর স্পিরিচুয়ালিজম
দুটি অবশ্যই আলাদা। প্রথমদিকে উপাচার আর অন্ধতার শ্যাওলা রুদ্ধ করে উত্তোরণের স্রোত।
ক্রমাগত মনঃসংযোগ বা ধ্যান কোনো পেনকিলার বা অম্বলের ওষুধ নয় যে তৎক্ষণাৎ ফল মিলবে।
সারাজীবন পর পেছনে তাকালে বোঝা যায় ফলশ্রুতি।
যাইহোক, এসময় আরো একজনের সান্নিধ্য পাওয়া হয়েছিল। তিনি স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজ। প্রায় সন্ধ্যার দিকে কথা হতো। ধর্ম ছাড়া অন্য নানা বিষয়ে। অপার জ্ঞান ছিল, সরলভাবে গল্প করতেন, ভুলেও ধর্মোপদেশ দেননি কখনও।
“জীবন বহিয়া যায় নদীর স্রোতের ন্যায়,
ধরিতে তায়
কে পারে ভাই
ধরিতে তায়
সে পারে ভাই আলস্য যার শরীরে নাই।”
আমার বাবা এসব
কোটেশন খুব বলতেন ছোটোবেলায়। সদ্য বিবাহের যৌনতৃষ্ণা প্রশমিত হলে পড়াশোনা ও সংসারের
আর্থিক সমস্যায় ব্যস্ত হতে হলো। জামির লেনে একটি ছোট্ট অফিসে প্রথম চাকরি। মাইনে ৭০০।
সঙ্গে দুটি টিউশনি। ঠিকাদারের চাকরি। হাসপাতাল অফিসে ইন্টিরিয়ার ও পরিচ্ছন্নতা মায়
কম্পিউটার হার্ডওয়ার পরিষ্কার অবধি লোক নিয়ে গিয়ে কাজ করানো। সম্ভবত সেই ছোট কোম্পানিটি
গত হয়েছে স্পিক ন স্প্যান বা অমন কিছু। পিয়ারলেস হসপিটাল, এপোলো গ্লেনেগেলস গড়িয়াহাটে,
সব জায়গাতেই সারাদিন কাটত। সঙ্গে চারটে ছেলে। তখন বয়স একুশ বাইশ। রোগ ভোগ কখনও দেখতে
হয়নি। চাকরির কল্যাণে চাক্ষুষ হলো সব।
একদিকে লাইন
দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর লাইন দিয়ে কটা দিন বেশি থাকার প্রাণপণ আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে
মল মূত্র বমি দিনভর প্রত্যক্ষ করে বাড়ি ফিরে যদি বা ডাল ভাত জুট্ত, মুখে উঠত না শরীর গুলোত। তবু অসীম তখন প্রাণশক্তি।
এর মধ্যেই রেজাল্ট বেরোবার পর সংসার সমরাঙ্গণ ছেড়ে ভর্তি হওয়া গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বাড়িতে এম.কম পড়তে। সেদিন দীর্ঘ লালিত একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। আশুতোষ ভবনে ক্লাস হতো। দুটি মেয়ে বাকি সব ছেলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এক আশ্চর্য জায়গা। আধো অন্ধকার হল, কাঠের লিস্ট, বিরাট লম্বা ধূ ধূ করিডর, ঘোরানো সিঁড়ি, সব মিলিয়ে অদ্ভুত প্রাচীন এক গন্ধ। এ এক বড় প্রাপ্তি। যাইহোক, চাকরিটি করা কালীন অনেক বড় বড় ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয়, স্নেহ করতেন তাঁরা। একবার আলাপ হলো গায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, তিনি এসেছিলেন চিকিৎসা র জন্য। অনেকেই ভাবতেন আমি হয়ত সরাসরি এপোলোর কর্মচারী,পি আর ও। একবার গোয়েঙ্কা পরিবারের ছোটো পুত্রবধূ এসেছিলেন। কী অমায়িক আর সাধাসিধে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এত ধনী ঘরের বউ। অনেক গল্প হলো। ফোন ছিলো না। মোবাইল নয়। তবে নং দিলেন যেতে বললেন বাড়ি। একবার বাড়ি ফিরে এক কাণ্ড হলো।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন