‘কালিমাটি’ পত্রিকা ও প্রয়াত মলয় রায়চৌধুরী
‘কালিমাটি’ পত্রিকা
ও প্রয়াত মলয় রায়চৌধুরী লিখব বলছি বটে, কিন্তু লেখা অত সহজ নয়।
সমীর রায়চৌধুরীকে
নিয়ে এর আগের কিস্তিতে
যেটুকু লিখেছি সেটা কঠিনে-সহজে, সাদা-কালোয় মিলেমিশে ছবির মত অনেকটা। সমীর রায়চৌধুরীকে
স্বচক্ষে দেখেছি, কথা বলেছি ওনার সঙ্গে, একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে হাসিঠাট্টাও করেছি। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তা
হওয়ার সুযোগ ঘটেনি।
আমি ছা-পোষা সংসারী-করণিক, দুয়ে দুয়ে চার করতেই গলদঘর্মগ, সাহিত্য পড়া, সাহিত্য চর্চা ওসব আমার কাছে চিরকেলে শৌখিনতারই নামমাত্র, তবে হ্যাঁ পড়ার ক্ষেত্রে কোনো বাছ-বিচার ছুঁতমার্গ ছিল না, হয়ত সেজন্যই কোনো এক শীত-বিকেলে কোনো এক
প্রত্যন্ত গাঁয়ে দরমা দেওয়া চা-দোকানে বসে চা খেতে গিয়ে
একটুকরো ছেঁড়া কাগজে ছাপার অক্ষরে লেখা “…যোনি মেলে
ধরো শুভা…” পড়েছিলাম, পোড়েছিলাম, পো-ড়ে-ছি-লা–ম এবং টুকরোটা
উলটে পাল্টে খুঁজে দেখতে চেয়েছিলেম কে এই কবি?
তেলমাখা ছেঁড়াকাগজ (দোকানী কোন এক খদ্দেরকে চপ মুড়িয়ে
দিয়েছিল এবং চপ ও ছেঁড়াকাগজ
নিজের নিজের জায়গায় অর্থাৎ
বিবর্ণ দোমড়ানো কাগজ কাঠের বেঞ্চের তলায়) কোনোক্রমে কবিতার ঐ একটি দুটি
লাইনকে তখনো বাঁচিয়ে রেখেছে, কিন্তু কবির নাম নেই, জায়গাটা ফর্দাফাঁই…।
মলয়বাবুর নিজের কথায় – “কবিতার
কাগজগুলো গেঁড়েমিতে ভর্তি। পড়তে পারি না। আসলে কবিতা লেখার পেছনে থাকে আবেগ, সমস্ত জিনিসটা ওখান থেকে উঠে আসে, আবেগ যার আছে তার আছে সে লোকে নিক,
না নিক, লোকে যেদিন জুতোপেটা করবে সেদিন থেকে তোমার চুল পাকবে জানবে…”।
মলয় রায়চৌধুরীর ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়েছিলাম সেই ২০১৩ সালে। আমার প্রোফাইল পিকচার দেখে বয়স শুধিয়েছিলেন, সত্যি শুনে বলেছিলেন, মানে মেসেঞ্জরে লিখেছিলেন – “সত্যি বয়স তোর কত এখন যা,
মা’কে শুধিয়ে আয়”। উত্তরে
লিখেছিলাম – “মা হারিয়ে গিয়েছেন আজ বছর
বারো, তল্লাশি করছি
খুব, আপনাকে আমার নিজের সত্যি বয়সই বলেছি, সে আপনি বিশ্বাস
করুন, বা নাইই করুন!”
সেটা ছিল ডিসেম্বরের সন্ধ্যে আর আমি শুধিয়েছিলাম – প্রচন্ড
বৈদ্যুতিক ছুতার লেখার পেছনের ইতিহাসটা কী? বলুন না একটু…
…আগে বল্ কবিতাটা কোথায় পড়লি?
আমি- চা –এর দোকানে…
…এখনো অব্দি তুই কী কী পড়েছিস?
অরূপ
তোমার এঁটোকাঁটা পড়েছিস?
আমি – আপনার
বড়দাদা সমীর রায়চৌধুরী, ছোটবেলায় আপনি দাদাকে ভয় করতেন?
…করতুম বৈকি! এখনো ভয় করি…
লেখা আর লেখা-ব্যবসা এক নয়। কখনোই
এক নয় বরং উলটো।
ব্যবসায় কোনো মৌ্লিক চিন্তার ঠাঁই নেই। ওদিকে একেবারে কড়কড়ে নতুন কিছু লিখছেন যিনি তিনি কারুর কাছে লেখা শিখে তারপরে লিখতে বসেননি, এক, আর দুই নম্বর -
নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকাই শিল্পীর উচিত।
কনটেন্ট প্রথমে আসে, রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন – আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তারপরে সৌন্দর্য্যনিষ্ঠ। “ফর্মটা কিছু না ওটা আকার
মাত্র, কবিতা গদ্য ইত্যাদি লেখা তো খ্যাতি, ছেলের পড়ার টাকার
যোগাড়ের জন্য লেখা নয়, লেখার তাগিদ একেবারেই ভেন্ন। ভেন্ন, ঠিক সেকালে যৌথ মধ্যবিত্তের পরিবারে অশান্তির কারণে লোকে বৌ-ছেলে নিয়ে উঠোনে মাঝ বরাবর দরমার পাাঁচিল তুলে ‘ভেন্ন’ হতো, সেইরকম…।
মলয় রায়চৌধুরী কবিতার ভাষা কার কাছে শিখেছিলেন কে বলবে তা? একটা ভোর দেখছি, সেটা নিশ্চই কোনো বই পড়ে বা অঙ্ক কষে দেখতে বসি না, মনে করি ভোর দেখলে ভাল লাগে তাই দেখছি।
মলয় রায়চৌধুরীর লেখা উপন্যাস আমার ভাল লাগে না, ভোর কিন্তু মেঘলাটে। কিচ্ছু দেখা যায় না, এক পা এগোনো
মুশকিল। ছোটলোকের ছেলেবেলা তিনশো পাতার চটি বই, অণুগল্প, লেখাটা শুরু হল, এগিয়ে এগিয়ে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পগার পার হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ইত্যাদি সব পেরিয়ে আবার এসে থামল ফের স্টার্টিং পয়েন্টে। অর্থাৎ লেখাটা দেখিয়ে দিল মানব জীবনে যাবতীয় উত্থান পতন জাগরণ নির্বাচন entire Life Hazard dogoma is bogus, সেই যে জীবনটা প্রথম যখন শুরু হয়েছিল সেই শুরুটাই আসল। বাদবাকি চুলোয় যাক…।
বাঁশদ্রোণীর ব্রহ্মপুরের বাড়িতে মলয় একবার দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দোতলায় নিজের খরচে ঘর তৈরী করে সস্ত্রীক থাকবেন বাদবাকি জীবনটা। দাদা রাজি হননি। নানান কারণ অবশ্যই ছিল, মলয় রায়চৌধুরীর মুম্বই-এ ফ্ল্যাটে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করব বলে যখন ঠিক করলাম, দেশে লক ডাউন ঘোষণ হল। আমি মেয়ে নিয়ে একা দিল্লীতে, উনি রেগুলার মেসেঞ্জারে আমার খবরাখবর নিতেন, আমিও ওনাদের খবর জানতে চাইতাম। বলেছিলাম, এবার লক ডাউন উঠে গেলে আর নিজেরা রান্না-বান্না করবেন না, একজন রান্নার দিদিকে রাখবেন!
জবাবে বলেছিলেন – এসব কাজের জন্য মিনিমাম দশ হাজার মাইনে দিতে হবে আর আমাদের ফ্ল্যাটে যত বুড়োবুড়ি
সবাই হোম ডেলিভারি খায়। আমি আর আমার স্ত্রী
ঘরে সাফ সাফাই রান্না বাসন ধোয়া সব নিজেরাই করি। কেউ
দেখা করতে এলে চা জল দিই,
আজ অব্ধি কারোর সেরকম অসুবিধে হয়নি…”। বাইশে জুন, ২০১৬, সমীর রায়চৌধুরী
মারা যাওয়ার পর ভাই মলয়
রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, হাসপাতালে যাবার দুদিন আগে বলতে চাইছিলে কি, দিতে চাইছিলে ইশারা, তৈরী থাকার? বলতে চাইছিলে কি, হ্যাঁ তোদের প্রস্তাবে আমি রাজি, ওপরতলাটা তোরা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারি্স এখন! যে সৃজনশীল সে নিজের
অসম্ভাব্যতা সৃষ্টি করার ওপর জোর দেয়, পৃথিবীতে কোনো কিছু আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে, এই কোনোকিছু প্রত্যভিজ্ঞার বিষয় নয়,
তা এক বুনিয়াদি সংঘর্ষ। দাদা বলেছিল,
আমার মষ্তিষ্ক আমার বিষয়বস্তু।
দাদা সমীর রায়চৌধুরী ভাইকে নিয়ে বিশেষ যে বক্তব্য রেখেছেন – “মলয় কবিতায়
রৈখিক পদ্ধতি বর্জন করেছেন, জীবনের বাস্তব রৈখিক নয় … মলয়ের ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি ও নামগন্ধ কিংবা নখদন্ত, অরূপ তোমার
এঁটোকাটা ইত্যাদির বিষয়বস্তু ও প্রকরণে যে নবাঞ্চলের
সন্ধান উপস্থাপিত হয়েছে তা হল পৃথক
জঁর।
এই যে এত স্মৃতি এত কথকতা টেলিফোনিক স্পর্শ, এর কোনো ছবি নেই। কোনো হার্ডকপি নেই, কারণ কখনো কী ভেবেছি এসব নিয়েও লিখব, বা লেখার সময় আসবে? ভাবিনি। ঝড়–বৃষ্টির পূর্বাভাস হয়, সভা–সমিতির দিন সময় আগে থাকতে নির্ধারিত করা হয়, মনুষ্যজীবনের প্রেডিকশন কে কবে করে দিতে পেরেছে? আমার ভাঁড়ারে তাই কোনো ছবি নেই। কিংবা মননে আমার যে ছবি রয়ে গেছে তা শুধু একা আমারই, আর কারুর সঙ্গে ভাগাভাগি হবে না…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন