শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪

দীপক সেনগুপ্ত

সমকালীন ছোটগল্প

 

বিলম্বিত Sorry!

দক্ষতার সঙ্গে স্কুটার চালাচ্ছিল মন্দিরা। পেছনে ওর কাঁধ আঁকড়ে বসে আছে শুভাশীষ। আই হসপিটাল থেকে ফিরছে ওরা। নিজের দোষেই আজকাল চোখে ঝাপসা দেখছে শুভাশীষ। তার চোখে বেশ কিছু দিন হলো ছানি পড়েছে। অনেক আগেই ছানিটা অপারেশন করিয়ে নেয়া উচিত ছিল। আজ কোরবো, কাল কোরবো করে ক্রমাগত দেরি করে গেছে শুভাশীষ। ফলে এখন পরিস্থিতি বেশ জটিল। ডাক্তারের মত ছানি যদি হার্ড হয়ে যায় তবে রিমুভ করতে বেগ পেতে হবে। সে সবই ভাবতে ভাবতে স্কুটার চালাচ্ছিল মন্দিরা। একই ভাবনায় ভাবিত ছিল শুভাশীষও। তবে তফাৎ ছিল। মন্দিরার ভাবনায় উদ্বেগ ও কী কী করতে হবে এই সব ছিল। আর শুভাশীষের ছিল আফসোস আর ভয়।

কী ভেবে মন্দিরা স্কুটারটা মেন রোড থেকে সরিয়ে কদমা সোনারী লিঙ্ক রোডে ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এখনো এই  চওড়া রাস্তাটা ফাঁকা ফাঁকাই থাকে। ওদের জন্য এটা অনেকটা ঘুরপথ। কিন্তু ট্রাফিক থাকে না বলে এটা দিয়ে নিশ্চিন্তে স্কুটার চালানো যায়।

খানিকটা এগোতেই চোখে পড়েছিলো সেখানে একজন মহিলা স্কুটার চালানো শেখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সঙ্গে এক পুরুষ সাথী। অনেক দিন থেকেই এই অপেক্ষাকৃত শুনসান সড়কটি স্কুটার চালানো শেখার আদর্শ জায়গা। এই শহরের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এখানটাতেও নিশ্চয় কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পথটার সাবেক চরিত্র আজও একই আছে। এমনকি একই আছে পথের ধারের সেই ঝোপালো হলুদ ফুলের গাছগুলোও। কেউ লাগায় না। কেউ যত্ন করে না। তবুও তারা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে। আর রাশি রাশি ফুল ফুটিয়ে চলে। এরকমই একটা বড়ো হলুদ ফুলের ঝোপের সামনে এসে মন্দিরার হাত কেঁপে উঠেছিলো। ঠিক অনেক দিন আগে যেমন কেঁপে উঠেছিল।

তবে সে কাঁপন অনেক অনেক বেশি ছিল।

এ সময় ওর কাঁধ আঁকড়ে থাকা শুভাশীষের হাতের মুঠোটাও দৃঢ় হয়েছিলো। তারও মনে পড়ে গেছে সব।

দুটি মন একসঙ্গে পিছিয়ে গেছিলো অনেকগুলো বছর। চৌত্রিশ বছর।

------------------------------

 

চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে নিজের শরীরটা সোফার ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিলো শুভাশীষ। দু হাতে মাথার চুল  খামচে ধরে অসহায়ভাবে বসে বসে ভাবতে শুরু করেছিল। কী করবে এখন! এ যেন ভৌতিক ব্যাপার!    একসঙ্গে এক মহিলা আর তার স্কুটার, দুটোই এভাবে উধাও হয়ে গেল। কিছুমাত্র চিহ্ন না রেখে? কীভাবে?

মন্দিরার আনাড়িপনায় অনবরত বিরক্তি প্রকাশ করছিল ও। কিছুতেই শুভাশীষের ইনসট্রাকশন ফলো করতে পারছিল না মন্দিরা। বারবার ভুল করছিল। অথচ প্রস্তাবটা ছিল মন্দিরারই। ও তখন সদ্য অফিসে জয়েন করেছে। ওদের তখনকার বাসা থেকে অফিসটা বেশ দূরে। তারচেয়েও বড়ো কথা বাসা এবং অফিসের মাঝে কোনোরকম বাস যোগাযোগ নেই। সেটা অটোরিক্সার নর্মাল রুটেও পড়ে না। যেতে হলে ফুল অটো বুক করে যেতে হবে। মানে একগাদা খর্চা। মন্দিরার মাস মাইনের পুরোটাই ওতে খরচ হয়ে যাবে। তখন মন্দিরাই বলেছিল-

- ভাবছি একটা স্কুটার কিনে নেবো। সবাই বলে স্কুটার চালানো খুব সহজ। আর সেটা দু দিনেই শেখা হয়ে যায়। তুমি শিখিয়ে দিলে আমিও স্কুটারে চেপে অফিস যাবো। চমৎকার ব্যাপার হবে। খর্চাও কম হবে।

শুভাশীষ রাজি হয়েছিল। ওর নিজের পোস্টিং শহরের গা ঘেঁষে রুরাল ব্রাঞ্চ সুন্দরনগর। ও বাসে যাতায়াত করে। ওর মনেও ইচ্ছে ছিল একটা বাইক কিনবে। যদিও বাইকের তেল খরচ বাসের ভাড়া থেকে কম হবে না। সেই কারণেই হয়তো তখন পর্যন্ত সেটা কেনা হয়নি। তার আগেই মন্দিরার জন্য লাল স্কুটার এসে  গেছিল। যদিও সেই লাল রং মন্দিরার মোটেও পছন্দ ছিল না। ক্যাটকেটে খুকি খুকি রং।

মন্দিরা নিজেকে মহিলা ভাবতেই পছন্দ কোরতো।

কেনার পরদিনই ওরা গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল কদমা সোনারী লিঙ্ক রোডে। তখন সকাল। পথের নির্জনতা আরো বেশি। মন্দিরা খুশি হয়ে বলেছিল-

- এই বেশ। শিখতে গিয়ে ভুল করে আছাড় খেলে কেউ দেখবে না।

কিন্তু দেখা গেল শিখতে গিয়ে ভুল করার পরিমাণ মন্দিরার ক্ষেত্রে বেশি বেশি হতে থাকলো। সাহিত্যের ছাত্রীর অঙ্কের মাথা কমজোর। কিন্তু য়াদদাস্ত মানে মেমারি তো কম থাকার কথা নয়। তবু শুভাশীষের নির্দেশ কিছুতেই মনে রাখতে পারছিল না মন্দিরা। ক্লাচ, ব্রেক, এক্সেলেটর মাত্র গুটিকয় ব্যাপার। সিকুয়েন্স অনুযায়ী তাদের ব্যাবহার করতে হবে। তবে মেপে মেপে। যাতে কোনটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায়। শুভাশীষের বারবার করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও মন্দিরা ভুল করে যাচ্ছিল। বারবার আছাড় খেতে খেতে টলমল করে কোনমতে সামলাচ্ছিল। চওড়া পথ তবুও গাড়ি সেই পথের বাইরে চলে যাচ্ছিল। ক্রমে ক্রমে মেজাজ হারাচ্ছিল শুভাশীষ। সেইসঙ্গে ওর ধমক ধামকের পরিমাণ বাড়ছিল। তবে তার ফল হচ্ছিল উল্টো। মন্দিরার ঘাবড়ে গিয়ে ভুল করার পরিমাণ তাতে করে আরো বাড়ছিল। শেষমেষ ও স্কুটারটা সহ পথ থেকে ছিটকে গিয়ে একটা হলুদ ফুলের ঝোপের ওপর গিয়ে পড়েছিল। ঝোপ ভেঙ্গে স্কুটারটা তার মধ্যে ঢুকে পড়ে গেছিলো কাত হয়ে।

তখনো বনবন করে তার সামনের চাকা ঘুরছে। মন্দিরার ওপরেই শুয়ে আছে স্কুটারটা। স্কুটারচাপা হয়ে থাকলেও গাড়ির হ্যান্ডেল ছাড়েনি মন্দিরা। শক্ত মুঠোয় ধরে আছে। শুভাশীষও ছিটকে পড়েছে। তবে ঝোপের মধ্যে নয়। পথের ধারে। তারও হাতের কনুই ছড়ে গেছে। ফুলপ্যান্ট থাকায় বোঝা যাচ্ছে না, তবে হাঁটুতেও যন্ত্রণা হচ্ছে।

কেউ এগিয়ে এলো না ওদের উদ্ধার করতে। যাকে মন্দিরার বেশ ভালো ব্যাপার মনে হয়েছিল সেই নির্জনতাই তখন তাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। শুভাশীষ কোনোমতে উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলো। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে বিচিত্রভাবে ঝুঁকে উবু মতো হয়ে আটকে গেছিলো। তারপর ওভাবেই এগোনোর চেষ্টা করেছিলো।

মন্দিরা কিন্তু শরীরে চোট পায়নি। ঝোপটার নরম গদি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ওর গায়ের ওপরে শুয়ে আছে স্কুটারটা। মুঠো ছেড়ে দিলেও তার চাকাটা তখনো ঘুরে চলেছে একঘেয়ে একটা শব্দ তুলে। শুভাশীষ হঠাৎ বিশ্রী একটা খিস্তি দিয়ে উঠেছিল। আর সেটা শুনে সেই বিপর্যস্ত অবস্থাতেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল মন্দিরা।

মন্দিরার হাসিটা সুন্দর। মেয়েদের নাকি শব্দ করে হাসা অনুচিত। কিন্তু মন্দিরার খিলখিল হাসি শুভাশীষ পছন্দই কোরতো। কিন্তু সেই মুহূর্তে সেই হাসি যেন কাটা ঘায়ে নুনের মতো লাগলো ওর। এক ঝটকা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। তারপর ব্যথা উপেক্ষা করে বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটা দিল। ঝোপের মধ্যে শুয়ে অবাক হয়ে দেখল মন্দিরা। ওকে ওভাবে ফেলে রেখে শুভাশীষ চলে গেল। প্রথমে ওর মনে হলো বোধহয় সাহায্যের সন্ধানে। কিন্তু এটলিস্ট ওকে স্কুটারের তলা থেকে বের করে দিয়ে যেতে পারতো। ও নিজেই বের হবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হোলো। বড়ো বেকায়দায় পড়ে স্কুটারটা ঝোপটার ডালপালার মধ্যে বিশ্রী ভাবে আটকে গেছে। মন্দিরার অপেক্ষা নিঃশেষ হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ওর দু চোখ ঝাঁপিয়ে জল এলো। আর মন ভরে গেল শুভাশীষের ওপর রাগ আর অভিমানে।

হাঁটুর ব্যথা অগ্রাহ্য করে হনহন যেতে যেতে হঠাৎ হুঁস ফিরেছিল শুভাশীষের। একি করছে ও? বিপদের মধ্যে মন্দিরাকে ফেলে  কোথায় চলেছে ও? যখন চটকা ভাঙ্গলো তখন অকুস্থল ছেড়ে অনেকটা দূর চলে এসেছে।  থমকে থেমে ফিরে দেখলো। সেখান থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ও ফিরতে   গোটা এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নিঃসন্দেহে এটাই সেই জায়গা। কিন্তু সেখানে মন্দিরা বা স্কুটারটা নেই। এদিক ওদিক তাকিয়েও শুভাশীষ তাদের কারোরই হদিস পেল না। গেলো কোথায়? একজন জলজ্যান্ত মহিলা আর একটা লাল স্কুটার  এভাবে বাতাসে উবে যেতে তো পারে না। শুভাশীষ একই সাথে চিন্তিত আর ভিত হয়ে পড়লো। লিঙ্ক রোডটা ছোটখাটো রাস্তা নয়। লেংচে লেংচে বার দুই রাস্তাটা পাক দিয়ে নিল শুভাশীষ। কোনো হদিস নেই। এবার তবে কী করবে ও? থানায় যাবে? সেখানে গিয়ে কি বলবে! বউকে স্কুটার শেখাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছে আর তারপর স্কুটার সহ আমার বউ হারিয়ে গেছে! পুলিশ মানবে? তারা তো জিজ্ঞেস করবেই-

- ক্যেসে ঘুমা? তব তুম কাঁহা থা?

তার জবাবে কী বলবে ও?

ভাবনায় চিন্তায় দিশেহারা হয়ে এলোমেলো এদিক ওদিক হাঁটতে থাকলো। এক সময় ফিরে এলো নিজের বাসায়। দুজনের কাছেই চাবি থাকে। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েছিল শুভাশীষ। ঘরে ঢুকে ধপাস করে বসে পড়েছিল সোফায়।

মুঠো করে মাথার চুল খামচে ধরে বসেছিল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের ওপর ক্ষোভে অসহায় দুঃখে তার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে নেমে ছিলো জল। বন্ধ ঘরের মধ্যে সশব্দে কেঁদে উঠেছিল ও।

----------------------------------

 

মন্দিরার কান্না থেমেছিল একটি ভরাট সহানুভূতির কন্ঠস্বরে। পাগড়ি পড়া এক শিখ ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছে তার কাছে। প্রথমে তিনি এক হ্যাঁচকায় লাল স্কুটারটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর অপেক্ষাকৃত কোমল টানে হাত ধরে মন্দিরাকেও ঝোপ থেকে তুলে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে অবাঙালী টানে কিন্তু পরিষ্কার বাংলায় বলেছিলেন-

- আপনি তো লাগছে বিলকুল ঠিকঠাক আছেন। পর আপনার গাড়িটা ঘায়েল হয়েছে। রিপায়রিং করতে লাগবে। লগতা হ্যায় এ নই গাড়ি হ্যায়। তব তো আভি ওয়ারান্টি পিরিয়ড চালু আছে।

- তা হয়তো আছে। পর বো কাগজ--

হাত নেড়ে সর্দারজী বলেছিলেন-

- জরুরত নেহি হ্যায় ম্যাম। জিস কোম্পানির গাড়ি ওদের সাথে আমাদের সিদ্ধু গ্যারেজের টাই আপ আছে। গাড়ির মেরামত আমরা করিয়ে দেবো। আপনি এখন চলেন। ঘর পৌঁছা দেঙ্গে।

সর্দারজী হাতের ইশারায় রাস্তার ধারে দাঁড় করানো বাইকটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তার আগে মন্দিরার স্কুটারটাকে ঠেলে একপাশে রেখে দিয়ে বলেছিলেন-

- হ্যান্ডেল লক করে দিয়েছি। বেটা এসে নিয়ে যাবে। গ্যারেজ নজদিকেই আছে।

বৃদ্ধ সর্দারজীর সাথেই ঘরে ফিরেছিলো মন্দিরা। পথে নিজেদের গ্যারেজের সামনে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছেলেকে স্কুটারের চাবিটা দিয়ে বলে দিয়েছিলেন ঠিক কোথায় স্কুটারটা রাখা আছে।

সর্দারজীকে সুক্রিয়া জানিয়ে তার নিজের চাবিটা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েছিল মন্দিরা।

ঘরে ফিরে এসে শুভাশীষের প্রতি রাগে অভিমানে রি রি করে উঠেছিল মন্দিরার মন। মাথার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল আগুন। এভাবে নিজের বউকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যায় কেউ? যে যায় সে কি মানুষ? তার সঙ্গে ঘর করা কি সম্ভব? মন্দিরার তৎকালীন অন্তরআত্মা ওকে বলছিল। কখনই ওদের আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়। ফিরে যাবে ও বাপের বাড়ি। তারপর যা হয় হবে। ডিভোর্সই নিয়ে নেবে। বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিল মন্দিরা। কাঁদতে কাঁদতে এই সবই ভেবে চলেছিল। একসময় টের পেয়েছিল কেউ ঘরে ঢুকলো। টের পেল কেউ ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। তার কিছুক্ষণ পরে বিকৃত স্বরে কান্নার আওয়াজটাও পেল। এ তো শুভাশীষ। ফিরেছে তবে। কিন্তু এ ঘরে তো আসছে না!

একসময় কৌতুহল অভিমানকে হারিয়ে দিল। মন্দিরা বিছানা ছেড়ে উঠলো আর বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

সোফার সামনের নিচু সেন্টার টেবিলের উপর ঝুঁকে মাথা রেখে বসে আছে শুভাশীষ। হয়ত ঘুমিয়েই পড়েছে। তার গালে চোখের জলের দাগ। সেটা নিশ্চয় অনুতাপের কান্না। মন্দিরার মন নরম হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল মানুষটা বোধহয় ততটা খারাপ নয়। তাৎক্ষণিক রাগের মাথায় ওরকম কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। পরে ফিরে  এসে অকুস্থলে তাদের দেখতে না পেয়ে ঘাবড়ে গেছে। বিচলিত হয়ে পড়েছে।

ঘুমন্ত মানুষটাকে জাগানোর কথা মনে হলো মন্দিরার। সে জন্য হাতও বাড়ালো। কিন্তু তার আগেই ডোরবেল বেজে উঠলো। সেই শব্দে মাথা তুললো শুভাশীষ। মন্দিরাও এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সর্দারজীর ছেলে।

- মামুলি নুকসান হুয়া থা। আপকা গাড্ডি ঠিক কর দিয়া মৈনে। লে আয়া হুঁ।

তাল কেটে গেছিলো। কেন যেন মন্দিরার অভিমানটা ফিরে এসেছিল। স্কুটারটা দেখার আর ঠিকমতো রাখার   জন্য ও বেরিয়ে গেছিল। ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়েছিল শুভাশীষ। তার মনে প্রশ্ন, কে এই সর্দার?

গাড়িটা ঠিকঠাক রেখে ফিরে এসেছিল মন্দিরা। ওর মন বলছিল এবার নিশ্চয় কৃতকর্মের জন্য Sorry বলবে শুভাশীষ।

কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখেছিল বাথরুম থেকে ঝপ ঝপ করে জল পড়ার শব্দ আসছে। শুভাশীষ স্নান করছে কি?

এরপর কেটে গেছে সময়। সাময়িক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে দুজনের মনই শান্ত হয়েছে। সংসার করা আগের মতোই চলেছে। শুভাশীষের কাছে নয় মন্দিরা স্কুটার চালানো শেখার জন্য ভর্তি হয়েছে একটা মোটর ট্রেনিং স্কুলে। তবে তিনদিনে হয়নি শিখতে পুরো দু সপ্তাহ লেগেছিল। তারপর ও চমৎকার স্কুটার চালাতে শিখে গেছিল। বছর দুই পরে শুভাশীষও বাইক কিনে নিয়েছিল। প্রায় একই সময়ে ঘর থেকে অফিস রওনা দিত ওরা। তবে দুজন দুই দিকে।

-------------------------------

 

আজ এতদিন পরে হলুদ ফুলের ঝোপগুলোর সামনে এসে স্কুটার স্লো করেছিল মন্দিরা। অতদিন আগের সব কথা ছবির মতো ভেসে উঠেছিল। আর থম মেরে গেছিল মন্দিরা।

হঠাৎ শুনেছিল শুভাশীষ বলছে - Sorry।

মন্দিরা চমকে ফিরে তাকিয়েছিল। মনে হয়েছিলো শুভাশীষের চোখ ভেজা। তবে ছানিপড়া চোখ থেকে এমনিতেই জল পড়ে। সে কারণেও হতে পারে।

নাকি...

আর একবার শুভাশীষ বলে উঠেছিলো -  Sorry। চৌত্রিশ বছর আগে যা উচ্চারিত হবার কথা ছিল।

এতদিন পরে সেটা উচ্চারিত হলো। এবার মন্দিরার চোখও ছলছল করে উঠেছিল। যদিও reflex actionএ মুখে উঠে এসেছিল গতানুগতিক ভদ্রতার রিপ্লাই "নেভার মেনশন"। সেটা বলতে গিয়ে গলা বুজে এসেছিলো মন্দিরার।

তবে তৎক্ষণাৎ ফিরে এসেছিলো তার কর্তব্যবোধ। শুভাশীষের ছানি অপারেশন আগামীকাল। বাসায় ফিরে সে জন্য তোড়জোড় করতে হবে। বাসার দিকে স্কুটার ছুটিয়ে দিয়েছিল ও।

সে যাইহোক। একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান একটি বিলম্বিত Sorry দিয়ে হয়েছিলো।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন