সমকালীন ছোটগল্প |
চাকু পকাই
আমাকে যে কেউ বুঝতে পারছে না, সে কথা বোঝার পর আমি কথা বন্ধ করে দিই। কেউ যাতে আমার ছায়া না মাড়ায় তার জন্য হুদোকে ফিট করি। স্বচ্ছ অথচ হাল্কা আবরণে ঢেকে দিই বাড়ি। যোগাযোগের সবটুকু থাকে আমার হাতে, আমার ইচ্ছায়।
যারা আমাকে ঘেন্না করে অথবা ভালোবাসে
– তারা যে কেউ আমাকে বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাইছে না, সে সংকট তাদের, আত্মরক্ষার
বর্ম তৈরি করা ছাড়া – আমার কিছু করার নেই। আমাকে বুঝতে না পারার অর্থ – আমার যে এত
কথা – এতদিন ধরে বলে আসা কথা – তার কোন মানেই থাকে না। দিব্যি হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে,
ঝালে ঝোলে অম্বলে দিন পার করে, আমার পেছনে লাগতে আসার শাস্তি ওদের পেতেই হবে।
সে কারণেই হুদো। হুদো আমার সব কিছু জানে। আমাকে ভা্লোবাসে, আমার দুঃখে কষ্ট পায়, আমি খুশি হলে ওর মনও খুশ। আমার দিন কাটে না – আমার যাপন নেই – সকাল সন্ধের আলাদা রং নেই। বদমায়েশ বদমাইশি করবে, চোর চুরি করবে, খুনি খুন করবে। আমিও সে রকম। আমি একা - নিজের মতো করে একা থাকি এবং একা থাকবই।এর জন্য কৈফিয়ত দেব কেন! সে জন্যই হুদো। হুদো আরো অনেক কিছুর জন্য - এখন থেকে।
আমাদের একটাই ঘর – সেই ঘরে পাঁচ ভাইবোন আমরা – এজমালি বাথরুম-পায়খানা, কলতলা - আমি ঘরময় ঘেঁষটে ঘেঁষটে। সারাদিন চিৎকার, যা পাই ভেঙেচুড়ে তুলকালাম। সবাই দিব্যি হাঁটছে, দৌড়চ্ছে, কিছুদিন আগে আমিও তাই – কেন তবে আজ আমি ছেঁচড়ে হাঁটি!
জবাব মেলে না। বুজবুজির মায়ের ফিসফিসানি,
গুজগুজুনি – আমার জন্য ওরা প্রাণ ভরে ফুর্তি করতে পারছে না। বছরকার চড়ুইভাতি বন্ধ
– আমি কষ্ট পাব ভেবে রবীন্দ্রজযন্তী বন্ধ। আরো কী কী সব বন্ধ – এ পাড়ার আনন্দ, হৈ-হল্লা
আমার জন্য খরচের খাতায়। সে কথা বাড়ি বয়ে আমার সামনে। আমি তখন সত্যি সত্যিই পেছন ঘষটানো
জন্তু হয়ে গেলাম। যদিও হাঁটি দুপায়ে কিন্তু আমি তো জানি, পেছনে ঘেঁষটে হাঁটা আমার ভবিতব্য।
দু’পেয়ে এমন অনেককে আমি জানি যারা আমার মতো। কেউ বা হাঁটু ঘেঁষটে। হাতের কনুই ঘষটানো
মাল এক আধজন নেই তা নয়, এমনক কি বুকে চলা - সরীসৃপ অবশ্যি নয় - বেশ কয়েক পিস আছে।
মানে কী দাঁড়াল!
আমি আলাদা কিছু নই। ব্যতিক্রমীও বলা যাবে
না। অথচ যতই দলে ভেড়াও, সে চেষ্টায় আমাকে পাবে না। আমি পেছন ঘেঁষটে হাঁটি, একমাত্র
আমি, সে কারণেই হুদো। এই যে পকাই, তার এতো হুদো, কেউ বডি গার্ড দেয় আবার কেউ স্নান
করিয়ে দেয়, একজন আছে সে কান পরিষ্কার করে আর নাকের পোঁটা বের করে মুছে দেয়। এই পকাইয়ে
দান ধ্যানে খুব মন। প্রত্যেক অমাবস্যায় খাসির মাংস, বোয়াল মাছ আর পায়েস। শ দুয়েক পাশের
বস্তির বৌ-বাচ্চা-মরদ, সবার পাত পড়ে পকাইয়ের ছাদে। হ্যাঁ, প্রত্যেক অমাবস্যায়। একসময়
পকাই ওই বস্তিতেই বড়ো হয়েছে, সে ছিল পকাইয়ের দাদুর যুগ – সেই দাদু-পকাই, অমাবস্যা মানেই
পাঁঠাবলি - এ্যতো নয় - তবে লোক খাওয়াত। এই পকাই তখন হুদোর দলে সদ্য নাম লেখানো বাচ্চা
– দাদু পকাইয়ের জুতো মুছত, গাড়ি ধুয়ে দিত আর চুল আঁচড়ে দিত। তার মতো অনেক হুদো কালে
কালে পকাই হয়েছে।
আমার হুদো কোনদিন পকাই হবে না। কারণ আমার
এই হুদো আমার মতোই পেছন ঘেঁষটে হাঁটে আর পকাইরা বুকে হেঁটে বেড়ায়। ওদের সাহস খুব, ভয়
ডর নেই।
যে সব হুদো পকাই হতে চায়, তাদের পকাইদের
ইতিহাস-ভূগোল জানতে হয়। খুব কাছ থেকে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করে ধারণা তৈরি এবং সেই সব
অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর মাথা – ভবিষ্যতের পকাই হবার এটাই শর্ত। বুক ঘেঁষটে হাঁটার মতো
কলিজার জোর দরকার। কারণ এই লাইনে পকাইরা একমাত্র বুকে হাঁটে। ইচ্ছে হল, রাতারাতি পকাই
হব – সে গুড়ে বালি।
আমার হুদো যে পকাই হতে পারবে না তাই নয়,
আমিও কোনদিন পকাই মাপে পৌঁছতে পারব না। তবু হুদোকে ফিট করার পর লোকাল পকাইয়ের সঙ্গে
ছোট একটা লেগে গেল।
আমরা ছিলাম শিক্ষিত গরীব পরিবার। বড়দা ডাক্তার, মেজদা ইঞ্জিনিয়ার, বড়দি স্কুল শিক্ষিকা, মেজদি কলেজ শিক্ষিকা। আমি অন্য লাইনে এলেও পড়াশুনা ছিল। ফলে একটা মেজাজও ছিল – বই-পড়া-স্কুল-কলেজ, পরীক্ষা-রেজাল্ট, পিকনিক-গান। নিয়ম করে সব কিছু।
কিন্তু যেদিন শুরু হল আমার পাছা ঘেঁষটে
হাঁটা, সেই যে আমি কামরার বাইরে চলে এলাম, বুজবুজির মা থেকে জুরান খুড়ো, সবাই আনন্দে
ডগমগ – এত গরীব অথচ গর্বে পা পড়ে না, কী দেমাক! যে বাড়িতে পড়াশুনায় সবাই প্রথম - সেখানে
একটা তো অপগন্ড! আহ, কী শান্তি! কথায় কথায় বাড়ি বয়ে দুঃখ প্রকাশের ছলে একথা সেকথা।
আর সে কারণে, সাত তাড়াতাড়ি হুদো। হুদোকে ফিট না করলে আমি ঘষটে ঘষটে শুকিয়ে যেতাম।
পাছা ঘেঁষটে হাঁটার জন্য একের পর এক তিরস্কার –
বড়দাঃ তুই গোল্লায়।
মেজদাঃ মুখে চুনকালি।
বড়দিঃ সম্মান রাখলি না।
মেজদিঃ গলায় দড়ি জোটে না?
ছোড়দির ক্রোধে রূঢ়তা। বাকি যারা মাঝারি।
অস্ফুট হাহাকারে অন্ধকার নেমে আসছে। হাওয়া নেই, গুমোট। তরকারি, ফল, শাকসব্জি থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। চোঁয়া ঢেঁকুর থেকে টক গন্ধ, বদ হজম। কয়লার উনুনের ধোঁয়া আর কম পাওয়ারের বাল্বে কালো ঝুল জমে জমে ঘরে ভৌতিক আঁধার। ফুলগাছে ফুল নেই, ফলগাছে ফল নেই, মুখের হাসি প্রশান্তি উধাও। গোঙানি আর হতাশা। বাড়ির ছোটছেলে ভোগে গেছে।
বুজবুজির মা - আমাদের হুল্লোড় মজা কিছু রইল না।
জুরান খুড়ো - এই বয়সে ঢ্যামনা সাপ।
বুজবুজির মা- ওর জন্য পাড়াটা নষ্ট হয়ে
গেল।
জুরান খুড়ো- ভেজা বিড়াল। পেটে পেটে শয়তানি।
প্রথমে ফিসফিস গুজগুজ। আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে – আমার অধঃপতনের গল্প কান পাতলেই।
পাবলিক কিন্তু আমাকে নিল। প্রথম কেস টোটাল
সাকসেস। একটা বন্ধ কারখানার জমি আর খেলার মাঠের বেআইনি বহুতলের পাকা বন্দোবস্ত আটকে
দিলাম। লেগে গেল পকাইয়ের সঙ্গে। সেই শুরু। একদিকে পকাইয়ের হুদো বাহিনী আর আমার সম্বল
শুভবুদ্ধি, শুভচেতনা সম্পন্ন মানুষজন।
কী ভয়ানক গায়ে কাঁটা দেওয়া লড়াই হল। শুভচিন্তার
জয়। ব্যাকফুটে পকাই। প্রমাণ হল পেছন ঘেঁষটে হাঁটা আমার শক্তিই আমার অলংকার এবং অহংকার।
আমিও পারি। এখন পোঁদ ঘেঁষটে হাঁটা ব্যাপারটা জমে ক্ষীর। মানে আমি দর পেলাম। পাবলিকের রুখে দাঁড়ানোর মজা উপভোগ করলাম। রহস্য যদিও গভীরে, কিন্তু কেউ জানে না – আমার হাঁটার পদ্ধতিই এর উৎস। অনেক বড় গর্তে সেধোলে হয়তো বোঝা যেত। কিন্তু খাটনি তাতে। তাচ্চে - হুল্লোড়ে, যা পাই খামচে ধরি গোছের মনোভাব। বেশ জনগণমন হল কিছুদিন। পকাই আউট অব ফোকাস। আশপাশের মানুষেরা আমার সঙ্গে দলে দলে। অব্যর্থ পলিটকাল পার্টির লোকাল টোপ, যা এতদিন ছিল পকাইয়ের একচেটিয়া – একটা ছাগল অথবা ভেড়া, কাটমানি বা দালালি। কিছুদিনের মধ্যেই দু তিনটে মেয়েলি হাত, আঁচল, ব্লাউসের বোতাম, ব্রা-র হুক।
বুলবুলির মাঃ তোর জন্যই। তুই না থাকলে...
জুরান খুড়োঃ আমাগো ছ্যামাড়াগুলান ভ্যাড়া...
তুই বাঘের...
আমার কোমর তখন ২৬, পাছা নেই। চুমু খেয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপ্ জিভ দিয়ে আমার জিভ চেটে চেটে, ফস ফস নিঃশ্বাসে কামনায় জ্বরজ্বরে টুনটুনি রহস্য উদঘাটনে এগিয়ে যাচ্ছিল – কী আছে তোমার, বলো? পকাই, আমার এতদিনের পকাই পর্যন্ত এই ২৬ ইঞ্চির কাছে কাত - দেখি তোমার কোমর...
ঠোঁট থেকে আমার কোমরে টুনটুনি – পটাপট
প্যান্টের বোতাম, জিপ একটানে। – কী আছে তোমার এতে? কোথায় এত জোর পাও তুমি? সবাই যে
জানতে চায়?
আমি কীভাবে বোঝাব পোঁদ ঘেঁষটে হাঁটার
রহস্য। বলতে পারি না - টুনটুনি, আমার পেছনই
সব। আমার চোখ ছাপিয়ে কুয়াশা। কুয়াশায় টুনটুনি ঢেকে যায় - তবু আমি বলতে চাই, - আমার
পাছা নেই, পেছন নেই, ব্যবহারে ব্যবহারে ক্ষয়ে ক্ষয়ে... কোমরের পরে কিছু নেই, যদিও পেছন
ছাড়া আমিও জনগণ।- ওটা ঘেঁষটে হাঁটি বলেই আমি সেই আমি। তুমি যা দেখছ, ওই পুরুষাঙ্গ
– ওটাও আমার নয়, যারা পেছন ঘেঁষটে হাঁটে তাদের
নিম্নাঙ্গে কিছু থাকে না।
একটানা বলে আমি উঠে দাঁড়াই। টুনটুনির চোখে ভয়,- তবে কি তুমি মানুষ নও? তুমি তো দু’পেয়ে, পকাইও দু পায়ে হাঁটে। পকাইয়ের কোমর ৩৪, বুক৩৬, পাছা ৩৬,- পকাইকে বোঝা যায় - রহস্য নেই- সোজা সাপটা।
পাছা ঘেঁষটে হাঁটা, বুকে হাঁটা, আরো কত হাঁটা মানুষের, আমি টুনটুনিকে বোঝাতে চাই।
- তিন থেকে চার কিলোমিটার – এর বেশি যাওয়ার
ক্ষমতা আমাদের নেই, এর বাইরে অন্য এলাকা্- অন্য পকাই - অন্য আমি বা আমার মতন একজন
- আমাদের এরিয়া ভাগ হয়ে আছে।
জানি তো, টুনটুনি বলে।– কিন্তু আমি যে
তোমার সঙ্গে লেগে আছি। তোমাকে চেটে ফেলেছি। চেটে চেটে লেপটে আছি গো। আমাকে ভালোবাসো
না কেন গো। খারাপ হবে না, একটু মানিয়ে গুছিয়ে...
পকাইয়ের এরিয়া ছোট হতে হতে এক কিলোমিটারে, আমার তিন। পকাইয়ের ঘ্যাম পলিটিকাল শেলটার, আমার শুধু জনগণ। পাবলিক। বুজবুজির মা, জুড়ান খুড়ো। রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত। লাইব্রেরি, রক্তদান, বসন্তে ফুল গাঁথল - প্রভাতফেরি। আমার এরিয়া বেড়ে আরো আধ কিলোমিটার, - পকাই দুটো গাড়ি বিক্রি করে দিল। ওর হুদোরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কাম কাজ নেই - কামাই নেই - পকাই সরু হতে হতে যায় যায়।
শেষে পকাই এলো আমার কাছে। একা। আমি পকাইয়ের
বুকে চাকু গুঁজে দিলাম। বিনিময়ে পকাই জানিয়ে দিল বুকে হাঁটার গুপ্তবিদ্যা।
পকাই বলল, আমি তো মরে যাব। আমার হুদোদের
দেখিস।
এখন আমার আয়ত্বে বুকে হাঁটার গোপন সূত্র। একজনের মধ্যেই পেছন ঘেঁষটে হাঁটা এবং বুকে হাঁটা। হুদোরা এগিয়ে আসতে থাকে। আমিও টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াই। হাত, কোমর, কাঁধের পেশি টানটান। পকাইয়ের শক্তি পেয়ে আমার জিভ সপসপ করে ওঠে। পকাইয়ের বুকের চাকু এখন আমার বুকে, টেনে খুলতেই গভীর গর্ত, অথচ রক্ত নেই।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। হুদোরা বলল, মেঘ ডাকছে।
আমি আরো জোরে। হুদোরা বলল, বাজ পড়েছে।
আমি আনন্দে নেচে উঠলাম। হুদোরা বলল, ভূমিকম্প।
আমি বললাম, আমি চাকু পকাই।
হুদোরা চাকু পকাই, চাকু পকাই বলে আমাকে ঘিরে নাচতে থাকল। তারপর পজিশন নিল।
আমি বললাম - অ্যাকশন।
সেবার ২৫শে বৈশাখ নবরূপে। প্রভাতফেরি।
সুকান্ত, নজরুল। রক্তদান। পুরনো দিনের বাংলা গান। চার কিলোমিটারে চারটে লাইব্রেরি।
আটটা ক্লাব। ষোলটা ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প আর হাজার হাজার বত্রিশ পাটি। ঝকঝকে বিকশিত।
পাশাপাশি দুর্বিনীতের জন্য উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে উদোম ধোলাই - কেস বুঝে কপালে দানা ভরে
দেওয়া। সন্ধ্যায় সেখানেই বসন্তের ফুল গাঁথা অথবা সংকোচের বিহ্বলতায় ম্রিয়মাণ না হবার
আহ্বান।
একদিন পকাইকে ঘুম পাড়িয়ে টুনটুনির বুকে মুখ রাখলাম।
টুনটুনি বলল, না-
কি হল?
তোমার মন আছে - কিন্তু শরীর নাই। পকাইয়ের
শরীর আছে। আমাকে শরীর দাও। পকাই ছাড়া তুমি আমার কাছে এস না।
আমি টুনটুনির বুকে চাকু গেঁথে দিলাম।
টুনটুনির চোখে জল।– আমি মা হতে যাচ্ছিলাম।
মা! সন্তান!- আমি আর্তনাদ করে উঠি।– কার
সন্তান?
তোমার –
পকাইয়ের শরীর চাও – সন্তান আমার?
হ্যাঁ তোমার-
আমি চাকু ধরে টানি- বের করতে পারি না।
টুনটুনি মরে গেল। বুক থেকে, হৃদপিন্ড
থেকে টুনটুনির রক্ত। সেই রক্তে মাখামাখি আমার শরীর।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। হুদোরা দূর থেকে
বলে উঠল, ঝড় উঠেছে।
আমি আরো জোরে।
হুদোরা বলল, বাজ পড়েছে।
শোকে দুঃখে নেচে উঠলাম।
হুদোরা বলল, ভূমিকম্প।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন