শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪

দীপ্তেন্দু জানা

 

সমকালীন ছোটগল্প

ব্রহ্মপুর

কত জায়গায় ঘুরেছি, কত লোককে জিজ্ঞেস করেছি-- অথচ কেউ বলতে পারল না। গুগল ম্যাপেও নেই। মাঝে মাঝে নিজেরই সংশয় হচ্ছে মানবের--  সে কি তাহলে এতদিন বৃথাই অন্বেষণ করেছে, তাহলে কি সবটাই মিথ্যে? আবার পরমুহূর্তেই সংশয় কাটিয়ে তার মন বলে উঠছে-- না না, মিথ্যে কেন হবে! একদিন ঠিক খুঁজে পাবে সে। একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে।

ট্রেন থেকে নেমে পায়ে পায়ে একটু এগোতেই মানব এক চা-দোকান দেখতে পেল। মানবের মনে হল এখানে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি-- এরা নিশ্চয় জানবে। তাই দেরি না করে চা-ওয়ালার কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল সে-- ভাই, ব্রহ্মপুর কোথায় বলতে পারেন? ব্রহ্মপুর? এমন নাম তো আগে শুনিনি। চা-ওয়ালা কিছুটা অবাক হয়ে উত্তর দিল। মানব বলল, হ্যাঁ। ব্রহ্মপুর। সে এক ফুলের দেশ, যেখানে ব্রহ্মকমল ফোটে, যেখানে পরীরা বাস করে।

লোকটা দাঁত দিয়ে নিজের কালো ময়লা ভরা নখ কাটতে কাটতে বলল- ফুলের দেশ? ব্রহ্মকমল ফোটে? পরীরা বাস করে। এমন জায়গা কোথাও আছে নাকি? পৃথিবীতে এমন জায়গা কোথাও আছে বলে তো শুনিনি। কথা শেষ হতে না হতেই লোকটা এবার মানবকে ভুরু কুঁচকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল। মানবের বুঝতে অসুবিধে হল না তার দিকে ওইভাবে ভুরু কুঁচকে তাকানোর অর্থ কী হতে পারে। সে ভালোই বুঝতে পেরেছে লোকটা তাকে নির্ঘাত পাগল ঠাউরেছে।

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যে নামতে দেরি নেই। মানব ভাবল দ্রুত রাত কাটানোর একটা আস্তানা জোগাড় করে নিতে হবে। কতদিন ধরে সে খুঁজে চলেছে ব্রহ্মপুর। কাল সকালেই আবার বেরিয়ে পড়তে হবে।

ঘুমের মাঝে আবার স্বপ্নটা দেখল মানব। মিছিল চলেছে। লম্বা এক মিছিল। যার শুরু আর শেষ কোনটাই দেখা যাচ্ছে না। হিমালয়ের ঢালুপথ বেয়ে মানবও হাঁটছে সেই মিছিলে। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে লোকজনের নীচু স্বরের কথাবার্তা কানে আসছে। কেউ বলছে-- আর কত দূর? কেউ বলছে-- আর চলতে পারছি না। কেউ বলছে-- বড় ক্লান্ত। কেউ বলছে-- চলো চলো। আর বেশী দূর নয় ব্রহ্মপুর।

সকাল হতেই যে বাসগুলো হিমালয়ের আরও কাছে যায়, তারই একটায় চেপে বসেছিল মানব। এখন দুপুর। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই পাহাড়ি জনপদে নেমে পড়েছে মানব। এর ওর কাছে ব্রহ্মপুরের ঠিকানা খুঁজতে দেখে একজন লোক মানবকে বলল, এদিকে আসুন। মানব লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে যেদিকটা লোকজন একটু কম, একটু নির্জন-- সেদিকে হাজির হল। তিনজন লোক একটা সিমেন্ট বাঁধানো গাছের তলায় বসেছিল। পরনের পোশাক আশাক দেখে মনে হয় সাধু-সন্ন্যাসী হবে। যে লোকটা মানবকে এখানে ডেকে নিয়ে এল সে বলল, আপনি ব্রহ্মপুর যেতে চান-- ব্রহ্মপুরের খোঁজ এদেরকে জিজ্ঞেস করুন। এরা আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।

ব্রহ্মপুর কোথায় বলতে পারেন আপনারা? লোকটার কথামতো সেই তিনজনের উদ্দেশ্যে মানব প্রশ্ন করল। সাধুদের প্রথমজন বলল, বলতে পারি কিন্তু কেন? মানব বলল, আমাকে যে যেতেই হবে সেখানে। ছোট্ট নন্দনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সে বলল, আমার যে ব্রহ্মকমলের ভীষণ প্রয়োজন। একথা শুনে দ্বিতীয় সাধু বলল, ব্রহ্মপুর কি সবাই যেতে পারে? ব্রহ্মপুর যেতে হলে সাধনা লাগে। আত্মাকে শুদ্ধ করতে হয়। সাধনা লাগে? কীসের সাধনা? মানব অবাক হয়ে জানতে চাইল। এবার তৃতীয় সাধু বলল, আমি খ্রিস্টান ছিলাম। ব্রহ্মপুর পুরে যাব বলে নিজের ধর্মত্যাগ করেছি। দ্বিতীয়জন বলল, আমি মুসলিম ছিলাম। আমিও ইসলাম ত্যাগ করেছি। প্রথমজন বলল, জন্মসূত্রে আমি হিন্দু ছিলাম। ওদের মতো আমিও আমার মিথ্যে ধর্ম ত্যাগ করেছি। আমরা যিনি পরম সেই প্রকৃত সত্যের সাধনা করি। তুমি কার সাধনা কর? মানব এই সব শুনে মুচকি হেসে বলল, আমি তো কারও সাধনা করিনি কখনো। আমি নাস্তিক। নাস্তিক! সাধক তিনজন সমবেত স্বরে বলে উঠল। তারপর প্রথম সাধক বলল, কিন্তু তুমি যদি নাস্তিকই হবে তোমার ব্রহ্মপুরে কী কাজ? ব্রহ্মপুর তো ব্রহ্মকমলের দেশ। একজন নাস্তিক হয়ে তুমি সেখানে যেতে চাও কেন? তাছাড়া আমরা কত বছর ধরে পরম ব্রহ্মের সাধনা করে আসছি, অথচ আমরাই এখনো ব্রহ্মপুরে পৌঁছাতে পারিনি। তুমি কীভাবে যাবে সেখানে! বড় বিপদে পড়ে আমি এসেছি। আমাকে যে যেতেই হবে ব্রহ্মপুর। দয়া করে আমায় সেখানে নিয়ে চলুন। মানবের নাছোড় জেদের কাছে হার মেনে সাধক তিনজন বলল, ঠিক আছে আমাদের সাথে চল। তিনদিন পায়ে হেঁটে পাহাড়ে চড়তে হবে। তারপর ব্রহ্মপুর। সেই ফুলের উপত্যকা।

তিনদিন চড়াই-উতরাই পথ পার হয়ে মানব দেখল চারপাশে পাহাড় ঘেরা এক উপত্যকা। ভেতরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কত রকমের ফুল, কত রকমের রং, কত রকম আকার। একেবারে দূরের দিগন্ত অবধি। এমন অপরূপ সৌন্দর্য্যের সামনে কেউ খুন করে গেলেও আরামই হবে-- যন্ত্রণা নয়।

কী শান্ত পরিবেশ! প্রকৃতি এতটাই নীরব মনে হচ্ছে যেন ফুল ফুটলে সেই ফুল ফোটার শব্দও শুনতে পাওয়া যাবে। নীরবতা ভেঙে মানবই প্রথম কথা বলে উঠল, এই তাহলে ব্রহ্মপুর?

এতক্ষণ পথ দেখিয়ে আগে আগে হাঁটছিল সাধু তিনজন। তাদের থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল মানব। কিন্তু এ কী! কীসের সাথে ধাক্কা খেল সে?  সামনে উন্মুক্ত ফুলের উপত্যকা, অথচ সে সামনে এগোতে পারছে না কেন? আবার একবার চেষ্টা করল মানব সামনে এগোনোর। কিন্তু আবার ধাক্কা খেল সে। মানব এবার পিছিয়ে এল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সাধুদের দিকে তাকাল। একজন সাধু নিজের মনেই বলে উঠল, হাওয়ার প্রাচীর। ধীরে ধীরে সাধু তিনজন এগিয়ে এল। একে একে হাঁটুমুড়ে বসে হাতজোড় করে প্রণাম করল। মানব অবাক হয়ে দেখল সাধুদের সম্মুখে একটা হাওয়ার দরজা প্রকাশিত হল। তারপর

সাধুরা মানবকে বলল, এসো প্রবেশ করি। সাধুদের পিছু পিছু হাওয়ার দরজা দিয়ে মানবও ব্রহ্মপুরে প্রবেশ করল। ভেতরে ঢোকা মাত্র মানব মিষ্টি একটা সুগন্ধ টের পেল। সে প্রাণভরে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে মনে  মনে বলে উঠল, এই তো ব্রহ্মপুর। আমার স্বপ্নে দেখা ব্রহ্মপুর। কিন্তু ব্রহ্মকমল কোথায়? স্বপ্নে দেখা ব্রহ্মকমল? ব্রহ্মকমলের জন্যই তো এই ব্রহ্মপুরে আসা।

চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মানব সাধুদের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। কতক্ষণ এভাবে হেঁটেছে মানবের আর খেয়াল নেই। হঠাৎ দেখতে পেল সে সামনে এক সরোবর। কাঁচের মত স্বচ্ছ, শান্ত তার জল। স্বচ্ছ সরোবরে ফুটে আছে নীল বর্ণের পদ্ম। কোন কোন পদ্মের উপর বসে আছে ধ্যানমগ্ন পরী। এমন অপার্থিব সুন্দরের মুখোমুখি হবে মানব কোনদিন কল্পনাও করেনি। এত নীরবতা, এত শান্ততা চারিদিকে বুকের ভেতর স্পন্দমান হৃৎপিণ্ডের 'ডুব' 'ডুব' শব্দে মানবের মনে হচ্ছে যেন পরীদের ধ্যান ভেঙে যেতে পারে। একজন সাধু মানবকে বলল, দেখতে পাচ্ছ ব্রহ্মকমল? দ্রুত মানব দৌড় দিল সরোবরের দিকে। সাধুদের পিছনে ফেলে সে নেমে পড়ল হাঁটুজলে। মানবের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে একজন সাধু চেঁচিয়ে উঠলো, এ কী করছ? খবরদার! ব্রহ্মকমল তুলো না যেন! মানব চেঁচিয়ে উত্তর দিল, কেন? সাধু আবার চেঁচিয়ে উঠলো, যে মানুষ কোনদিন  পাপ করেনি একমাত্র সেই ব্রহ্মকমলের স্পর্শ সহ্য করতে পারে। ফিরে এসো। স্পর্শ কোরো না ব্রহ্মকমল। তুমি মারা পড়বে। ছোট্ট নন্দনের বুড়ো হয়ে যাওয়া মুখটা মনে পড়ল মানবের। মনে পড়তেই  দাঁতে দাঁত চেপে একটা একটা করে নীলপদ্ম তুলতে শুরু করেছে মানব। সে বুঝতেই পারেনি কখন তার চোখে জল এসে গিয়েছে।

হন্তদন্ত হয়ে সাধু তিনজন এগিয়ে এল। মানবের উদ্দেশ্যে বলল, এ কী করলে তুমি? সতর্ক করলাম এত করে তোমায়, তবুও ব্রহ্মকমলে হাত দিলে? তোমার কি মৃত্যুভয় নেই? তুমি তো ছাপোষা সংসারী মানুষ। পাপে তাপে ডুবে থাকা মানুষ। কেন ব্রহ্মকমল তুললে বারণ করা সত্ত্বেও? মানব কোন উত্তর দিল না। সে শুধু চোয়াল শক্ত করে মনে মনে বলল, এছাড়া যে আমার কোন উপায় নেই!

-- মা, আমি কি আর বাঁচব না?

-- ছিঃ! অমন কথা মুখেও আনতে নেই।

-- না মা, আমি সত্যিই আর বাঁচব না।

-- কে বলল তোকে এ কথা?

-- মা, বাবা কোথায় গেছে?

-- ব্রহ্মপুর।

-- ব্রহ্মপুর কোথায় মা?

-- সে অনেক দূর।

-- বাবার জন্য আমার মন কেমন করছে। বাবা আমায় ছেড়ে কেন গিয়েছে মা?

-- ব্রহ্মকমল আনতে।

-- ব্রহ্মকমল কী হবে মা?

-- তোর বাবা স্বপ্নে দেখেছে ব্রহ্মকমলের মধু খেলে তোর এই প্রজেরিয়া রোগটা ভাল হয়ে যাবে।

-- এক্কেবারে ভাল হয়ে যাব? আর আমি ছোট্ট বয়সে বুড়ো হয়ে যাব না? আর আমি মারা যাব না?

-- না। এক্কেবারে ভাল হয়ে যাবি।

-- আমাকে ব্রহ্মকমলের মধু দাও মা। আমি বুড়ো হতে চাই না। বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতে চাই। প্লিজ, আমায় ব্রহ্মকমলের মধু দাও।

-- বাবা আসুক। বাবা নিয়ে আসবে তো ব্রহ্মকমল।

-- বাবা কবে আসবে মা?

-- কাল আসবে সোনা।

-- তুমি  রোজই বলো 'কাল আসবে বাবা'। গতকালও বলেছিলে। কিন্তু আজও বাবা এল না। কাল ঠিক আসবে তো মা?

নন্দনকে এবার বুকে টেনে নিল তার মা। বুকে জড়িয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, হ্যাঁ। তারা জানতেই পারল না কবেই মানব নীলপদ্ম নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পাহাড় থেকে খাদে  পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন