সমকালীন ছোটগল্প |
বিচারকাণ্ড
প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আলীমকে দেখতে হাসপাতালে যাই। বাইশ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের। তার ব্যাপারে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিয়েছে। সে প্রশাসনে বহুদিন কাজ করেছে। শরীরে যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে সে তখন সিলেটে জেলা প্রশাসক ছিল। আলীমের স্ত্রী তিলোত্তমা সেইসময় দিনরাত্রি তার চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি করেছে, তার পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। আলীম সন্দেহ করে তার স্ত্রী সম্প্রতি কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারি ড্রাইভার আর্দালি দিয়ে যত্ন করে খাবার পাঠায়। নিজে হাসপাতালে আসে হয়তো দিনে একবার। আর যখন আসে, মোবাইল ফোনে টেক্সট মেসেজ চালাচালিতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে।
তিলোত্তমা তাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে,
কথাগুলি
বলতে বলতে আলীমের দু’চোখ পানিতে ভরে
ওঠে। সন্তানদের কাছে শোনে তাদের মা প্রায় প্রতিসন্ধ্যায় বেরিয়ে যায়। কখনও রাতে
বাড়ি ফেরার পথে তাকে হাসপাতালে দেখে যায়। আলীম বলে, “কী নিখুঁত তার সাজগোজ,
চোখে
আইলাইনার, পাপড়িতে মাসকারা। চেষ্টা
করে আমার সাথে প্রগল্ভ আর আন্তরিক হতে। সম্ভবত অপরাধবোধ থেকে করে। তিলোত্তমাকে
শেষমেষ আমি মাফ করে দিই। আমার ক্যান্সার ধরা পড়ার শুরুর দিনগুলোতে তিলোত্তমা উন্মাদের মতো অস্থির ছিল, আমাদের উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিতে
চেয়েছিল আমাকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠাতে।”
আমি বলি, “হ্যাঁ, আমারও মনে পড়ে তিলোত্তমা ভেঙে পড়েছিল।” আলীম বলে, “তিলোত্তমাকে নিয়ে আমার মা, ভাইবোনেরা যখন বাজে মন্তব্য করে, আমার ভালো লাগে
না। টানা তিন-চার বছর ধরে আমাকে নিয়ে হাসপাতালে টানাটানি আর হতাশা তাকে
ক্লান্ত করে তুলেছে।”
মৃত্যুর আগে আলীম কালো মলাটবাঁধা একটা ডায়রি আমার হাতে তুলে দেয়। আমি জিজ্ঞাসা
করি, “এটা কি তোর
ডায়রি, নাকি ক্রিয়েটিভ রাইটিং?” সে হেসে বলে, “ডায়রি বা আত্মজীবনীও তো ক্রিয়েটিভ রাইটিং, তাই না?” ডায়রির প্রথম পৃষ্ঠায় পাবলো নেরুদার কবিতা, পর-পর কয়েক পৃষ্ঠায়
তার প্রিয় কবিতা এবং কোটেশন। তারপর বেশ অনেক পৃষ্ঠা টানা টেক্সট:
বর্ষাকালে সুনামগঞ্জের
এসপি সহ টাঙ্গুয়ার হাওর, জাদুকাটা নদী ঘুরে
ট্যাকের ঘাট পৌঁছাই। প্রায় বিকাল হয়ে গেছে তখন। এককালে এখানে চুনাপাথর উত্তোলন প্রকল্প
ছিল। এখানে মানুষ গমগম করত, চুনা পাথর
প্রকল্পের ম্যানেজার, শ্রমিক, কর্মকর্তা নানা শ্রেণীর মানুষ। চারপাশে
উন্মুক্ত, অবারিত লালচে পাথুরে মাঠ, পাথুরে পাহাড় আর পুরনো পরিত্যক্ত লাল-দালান।
বিকালে পুলিশ সুপার মাহমুদ-সহ পুরো এলাকা
হেঁটে বেড়াই। সন্ধ্যায় পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে ঘাসের মখমলে ছাওয়া খোলা মাঠে চেয়ার পেতে
বসি। আমগাছের অন্ধকারে তাকিয়ে বিয়ের আগে আমার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা নাইমার গল্প
করি। মাহমুদের বড়ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। পরে মাহমুদের সাথে
সম্পর্ক তার বড়ভাইয়ের চেয়েও বেশি গাঢ় হয়।
নাইমারা নাটোরে মাহমুদদের
পড়শি ছিল বহুবছর। আড্ডার সুবিধার জন্য আর্দালি, বডিগার্ড সবাইকে দূরে পাঠিয়ে দিই। অন্ধকারে আমাদের
সিগারেটের টকটকে লাল আগুন জ্বলতে থাকে। কয়েকটা
গাছে অগণিত জোনাকপোকা ঝিকমিক করে। রাতজাগা পাখির তীক্ষ্ণ কণ্ঠ সন্ধ্যার
নিস্তব্ধতায় মিলিয়ে যায়। আঁধার ফুঁড়ে দাড়িওয়ালা একজন প্রৌঢ় আমার ঠিক গলার কাছে
চাপাতি ধরে বলে, “একটা শব্দ করবি
না, করলে এক্ষুনি লাশ পড়ব।” আরও আট দশজন লুঙ্গিপরা মানুষ আমাদের ঘিরে
ধরে। কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুখ,
হাত বেঁধে তাদেরকে অনুসরণ
করতে বলে। এদের সাথে অন্ধকারে ঠিক কত মাইল হেঁটে যাই ঠাহর করতে পারি না।
আমাদের মুখ, হাতের বাঁধন যখন খুলে দেয়া হয় তখন ভোর হয়ে
গেছে। চারপাশে পাথুরে মাঠ আর পাহাড়। যারা আমাদের ধরে নিয়ে এসেছে সবাই লুঙ্গিপরা, চোয়ালভাঙা, জীর্ণ, অপুষ্ট তরুণ, প্রৌঢ়,
যুবক, নানা-বয়সী
লোকজন। পান-খাওয়া জীর্ণ প্রৌঢ় মানুষটি আমাকে বলে, “এইবার আমরা তুমরার বিচার করমু।” সম্ভবত সে দলের প্রধান। মাহমুদ ফিসফিসিয়ে
বলে, “এই ফকিরের বাচ্চাগুলা কী
কারণে আমাদের এখানে নিয়া আসছে? পান-দোকানদার, রিকশাওয়ালা, পিয়ন-মার্কা চেহারা এদের। এইখান থিকা শুধু বের হই, সবগুলা বাস্টার্ডকে ক্রসফায়ারে দিব।”
পাথুরে মাঠের অদূরে একটা
জলাভূমি। অর্ধেক শরীর ডোবানো প্রকাণ্ড একেকটা গাছ গুম হয়ে বসে
আছে জলাশয়ের এখানে সেখানে। জলের ধারে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে আধা-উলঙ্গ নারীপুরুষ।
এদের বেশিরভাগেরই শীর্ণ শরীর, দারিদ্রক্লিষ্ট
মুখ। মাঝে মাঝে তারা উলুধ্বনি দেয়,
তাদের কণ্ঠস্বর ফেটে পড়ে উৎসবের আমেজে। এইসব
উৎসব-উল্লাসের মাঝে নতমুখে মাটি খুঁটছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিন, তার পাশে এসপি রুম্মান, জেলা জজ রাকিব ভাই, চেনামুখ সাংসদ, এমন কয়েকজন
সরকারি কর্মকর্তা এবং তরুণ রাজনীতিবিদ্ বসে আছেন। আমিনের মলিন পোশাক, দীর্ঘদিন শেভ-না-করা কাঁচা-পাকা দাড়ি। যখন চিটাগাংয়ে
আমার পোস্টিং ছিল, আমিন ছিল
সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিটে কমান্ডিং অফিসার। আমার সাথে চোখাচোখি হতে
আমিন চোখের ইশারায় তার পাশে যেতে বলে। “এখানে প্রতিদিন
তামাশা চলে, এক বেশ্যা
প্রতিদিন বিচার করতে বসে। চোর ডাকাত ছ্যাঁচোড়রা সাক্ষী দেয় দিনমান। সাংসদ, মন্ত্রী, মিলিটারি অফিসার,
পুলিশ, জজ,
ম্যাজিস্ট্রেট
সবার বিচার করে এইসব চোর ছ্যাঁচোড় আর বেশ্যারা। এখানে খাবার বলতে কলা। কোত্থেকে বিশাল-বিশাল
কলার কাঁদি ফেলে রাখবে কে জানে, পানি খেতে হলে
ওই জলাশয়ের পানি খেতে হবে।” আমিন বলে।
বিচারকের আসনে একটা বড়
পাথরের উপর উঠে বসে প্রধান বিচারক লিন্ডা রহমান। ডাকসাইটে সুন্দরী। উন্নত নাক, কোমর-ছাপানো দিঘল চুল, টকটকে ফর্সা মুখে উজ্জ্বল, আকর্ষণীয় একজোড়া চোখ। তিনি ঢাকা শহরের
নামকরা পতিতা ছিলেন। বিরোধী দলের এক নেতার বান্ধবী হবার কারণে পুলিশ তাকে
পতিতাবৃত্তির দায়ে জেলে পাঠায়। দুর্নাম আশঙ্কায় বিরোধী দলের নেতা, যিনি একজন
বিখ্যাত লেখকও, লিন্ডার জামিন পেতে কোনও চেষ্টা-তদবির করে না। এমনকি
লিন্ডার পুত্র, কন্যা ওই
রাজনৈতিক নেতাকে ফোনে যোগাযোগ করলে তার অফিসে, বাড়িতে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি লিন্ডার সন্তানদের সাথেও
যোগাযোগ বন্ধ করেন।
দীর্ঘদিনের প্রণয়, দম্পতির মতো সম্পর্ক রক্ষা করে শেষকালে
প্রেমিকের বেইমানি লিন্ডা মেনে নিতে পারেননি। জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। লিন্ডা
একজন গায়িকাও ছিলেন। প্রতি-ভোরে নিয়ম ক’রে গানের রেওয়াজ করতেন। বিচারকের আসনে ব’সেও প্রতিদিন
চার-পাঁচটা রবীন্দ্রসঙ্গীত অথবা নজরুলগীতি গেয়ে শোনান বাদী, বিবাদী, আসামি, সবার উদ্দেশে। কোনো-কোনো গান তাঁর রাজনীতিবিদ্ প্রেমিকের কথা
মনে পড়িয়ে দেয়। গাইতে-গাইতে বিচারকের আসনে ব’সেই কখনও অঝোরে
কাঁদেন। বিচার শুরু করার ঠিক আগে তিনি পুলিশ,
আমলা, মন্ত্রী, এমপি, সবাইকে তাদের পিতা-মাতা-বোন-ভাগ্নি-কন্যা সবার নাম
নিয়ে অকথ্য গালাগাল করেন।
বাদী হাফিজুর রহমান।
মায়াবী একজোড়া চোখের কুচকুচে কালো রঙের পনেরো বছর বয়সী
কিশোর। পুলিশ ইন্সপেক্টর হামিদের দিকে তার অভিযোগের তীর।
হাফিজ হাজারিবাগ এলাকায়
জুতার কারখানায় কাজ করত। দুপুরে পাশের হোটেলে ভাত খেয়ে কারখানায় ফেরার পথে
মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসে সাদা-পোশাকের একদল পুলিশ। তার হাতে তারা অস্ত্র দিয়ে
চারপাশে লোকজন জড়ো করে জানায় অস্ত্রসহ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে, বর্ণনা করে কীভাবে শার্টের ভিতর অস্ত্র
লুকিয়ে সে রাস্তা পার হচ্ছিল, ইনফর্মারের কাছে
খবর পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পাশের দোকানদারকে হুমকি এবং ভয়
দেখিয়ে মামলায় সাক্ষী করে, অস্ত্র জব্দ
করে। পুলিশের ভয়ে জব্দ তালিকায় আরও দু’চারজন লোক
স্বাক্ষর করে।
হাফিজ ভীত কাঁপা-কণ্ঠে
ইন্সপেক্টর হামিদকে বলে, “আমারে যখন
অ্যারেস্ট করছিলেন স্যর, আমি মনে করছিলাম
আমারে তহনই গুলি কইরা মাইরা ফেলবেন। আমার হাতে যদি দশটা পিস্তল দিয়া কইতেন আমি
ওইগুলা হাতে নিয়া ঘুরতেছিলাম, তাইলেও আমি টুঁ-শব্দ করতাম না।
আপনাগো সবার হাতে অস্ত্র দেইখা আমার খালি আম্মার কথা মনে হইতেছিল। জানে বাঁচার
লাইগা ‘আমার হাতে অস্ত্র ছিল, আমি সন্ত্রাসী,’ যা-যা আপনেরা শিখায়া দিছেন, যেমনে শিখায়া দিছেন আমি সেইভাবে স্বীকার
করছি। খালি মনে হইছে থানা হাজতে আপনেরা কখন গুলি কইরা মাইরা ফেলেন। আমার আম্মা
হয়তো তখনও শুনে নাই আমারে পুলিশে নিয়া গেছে।
“আম্মাও আমারে
অবিশ্বাস করছে। হাজতে দেখতে আইসা জিগাইছে,
‘কারখানার
কার লগে তর বন্ধুত্ব হইছে? তুই এইভাবে নষ্ট
হয়্যা গেছস। মদ, গাঞ্জা, অস্ত্র এই বয়সেই ধরলি?’ আম্মা কোনোদিনও বিশ্বাস
করে নাই পুলিশ আমারে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাইছে। কামরাঙ্গির চর থেকে জেলখানায় আসতে
অনেক খরচ লাগে বইলা আম্মা তিন চারমাস পর-পর জেলখানায় আসত। জেলখানায় এক পুরানা সন্ত্রাসী
টিটন সারাদিন আমারে আদর করত তার সন্তানের মতো। রাতে আমারে সে বলাৎকার করত। টিটন কোথা থিকা জানি
ভালো-ভালো খাবারদাবার আনাইত। শেষদিকে আম্মা ছয়মাসে হয়তো একবার আসত। জেলখানায় থাকার সময়ই
আম্মা, ছোটবেলা, বাড়িঘর, সব ভুলে
গেছিলাম।”
হাফিজের অভিযোগ শেষ হলে
বিচারকের হুকুমে সবাই মিলে হামলে পড়ে হামিদের ওপর। কুৎসিত গালাগাল করে, তার শরীরে থুথু ছিটায়, চুল টানে, গায়ে কাদা ছুঁড়ে মারে। এটাই এখানকার বিচারের নিয়ম। বিচারক
নিজেও কাদা ছিটিয়ে দেয় পুলিশ ইন্সপেক্টরের গায়ে, মাথায়, মুখে।
একেকটা বিচার শেষ হলে
সমবেতভাবে সবাই গান গায়, নাচে, কেউ কেউ প্রকাশ্যে চুমু খায়। আনন্দে
বিচারককে থুথু ছিটায়। বিচারক প্রতি-উত্তরে রাজনৈতিক নেত্রীর মতো চারিদিকে ঘুরে-ঘুরে
দু’হাত মাথার উপর তুলে
নাড়ায়। আনন্দ এবং ঘৃণা প্রকাশে এরা একে অন্যের গায়ে থুথু ছিটায়।
আমিন আমাকে ফিঁসফিঁসিয়ে
বলে, “এই নরকে ব্যভিচার, সমকাম সব চলে। আর এদের নিজেদের মধ্যে মারধর, চুলোচুলি এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। বিচারক
এই মহিলা আমাকে প্রতিদিন সকালে, বিকালে নিয়ম করে
গান শোনায়। এখানকার নিয়মকানুন সে-ই আমাকে বলেছে। ব্যভিচার-ট্যভিচারের ফলে
যেসব শিশুর জন্ম হয় তাদের তারা মেরে ফেলে। বাবা-মাকেই তাদের নিজেদের সন্তানকে মেরে
ফেলতে হয়। এটাই এখানকার দস্তুর।”
ঘোড়া ছুটিয়ে, বাতাসে ধুলা উড়িয়ে চারজন যুবক এসে থামে বিচারকের
ঠিক সামনে। বিচারক তার আসনে গিয়ে ফের বসে। ঘোড়া থেকে চার যুবক একসাথে নেমে আসে।
ঘোড়ার পিঠে আসীন থাকার সময়ে তাদের চেহারায় যে উদ্যত, অহঙ্কারী ভাব ছিল, নামামাত্র তা হারিয়ে যায়। পুলিশ এবং সেনা
কর্মকর্তাদের দেখে তাদের চেহারায় ভয় ফুটে ওঠে। চারজনের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন, সিনেমার নায়কের মতো দেখতে যুবকটি মাহমুদকে
বলে, “চিনতে পারছেন স্যর আমাকে? আমি আফতাব আহমেদ। আপনারা গভমেন্ট অফিসাররা
আঠার মতো আমার সাথে লেগে থাকতেন যেন রাফাত আহমেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। রাফাত
আহমেদের ঘনিষ্ঠ ছিলাম বলে আপনারা সরকারি অফিসাররা কত যে তেলতোয়াজ করতেন আমাকে, কত দামি উপহার
পাঠাতেন আমার জন্য। তরুণ রাজনীতিবিদ্ রাফাত আহমেদ অসীম ক্ষমতাধর ছিলেন।
“ইলেকশনের আগে
দিনরাত আমি রাফাতের জন্য পরিশ্রম করি। তিনি আমার জেলার মানুষ— এ নিয়ে আমার গর্বের শেষ নাই। ইলেকশনের আগে
কাকে ভয় দেখাতে হবে, কাকে খুন করতে
হবে, কাকে মিথ্যা মামলায়
ফাঁসাতে হবে— সব করি। তবু আমার
পার্টি জিতুক। নেতা জিতুক। এ-ভালোবাসা প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার চেয়ে কম না।
মানুষ খুন, মিথ্যা মামলায়
ফাঁসানো—দুনিয়ার সব অন্যায়
জাস্টিফাই করতে পারি দলের প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে, নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে।
“নানাভাবে রাফাত
ভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করি জেলার প্রবীণ নেতাদের সাথে তার দূরত্ব বাড়ছে। সিনিয়র নেতারা
ঠাণ্ডা মাথার এত খুনাখুনি সহ্য করতে পারছেন না। আমার কোনও কথা রাফাত আহমেদ কানে নেয়
না। পার্টির ভালোর জন্য এবং তাকে ভালোবাসি ব’লে তার মুখের
ওপর একদিন বলি, ‘আপনার বুঝতে হবে
সিনিয়র নেতারা কেউ আপনার সাথে নাই। ইউ হ্যাভ টু উইন দেয়ার হার্টস।’
“এরপর আমার সাথে
তার দূরত্ব তৈরি হয়। আমাদের জেলায় এসে জুনিয়র ছেলেদের সাথে মিটিং করে, আমাকে ডাকে না। আমার অভিমান হয়। মনে-মনে
প্ল্যান করি, রাজনীতি চিরতরে
ছেড়ে দিব। তার সাথে আর যোগাযোগ করি না। এর মাঝে কেউ সম্ভবত আমার বিরুদ্ধে তার কান ভারি করে। জেলার
কয়েকজন সিনিয়র নেতা আমাকে বলেন,
‘রাফাত
আহমেদ তোমাকে দল থেকে বের করে দিতে পারে। তোমার ওপর ক্ষুব্ধ। তুমি নাকি তার
বিরুদ্ধে সবাইকে খেপিয়ে তুলছ।’
তার দুই দিন পরই আপনাদের
বাহিনীর লোকেদের দিয়ে আমার বাড়ি থেকে আমাকে তুলে আনেন। আমাকে চোখ আর হাত বেঁধে
মাইক্রোবাসে তোলা হয়। আমার চারপাশের মানুষদের বার বার জিজ্ঞাসা
করি, ‘প্লিজ বলেন আমার অপরাধ
কী।’ কেউ একজন শান্তকণ্ঠে বলে, ‘রাফাত আহমেদ চান আপনাকে মেরে ফেলা হোক।
আমাদের কিচ্ছু করার নাই।’
মাইক্রোবাস থেকে নামানোর
সময় আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি দু’হাত খুলে ফেলতে।
শরীরে বাতাসের ঝাপটা লাগলে নিশ্চিত হই আমাকে কোনও খোলা মাঠে নিয়ে আসা হয়েছে। সমস্ত
শক্তি দিয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে রাখা হাতগুলো ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করি। অনুনয় করি, ‘স্যর,
আমাকে
মারবেন না। আমার কোটি-কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। এমপি সাহেবের পিএস হিসাবে কাজ করার
সময় পঞ্চাশ-ষাট কোটি টাকা বানাই। সম্পত্তি বিক্রি করে সব টাকা আপনাকে দিব। আমাকে বাঁচান
শুধু।’ তরুণ কণ্ঠের কেউ একজন
বলে, ‘রাফাত আহমেদকে কনফার্ম
করতে হবে যে আপনি মারা গেছেন। আজকেই মারা গেছেন। সত্যি কথা বলতে, রাফাত আহমেদের
চাপ না থাকলে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে হয়তো আপনাকে ছেড়ে দিতাম। অবশ্য টাকা নিয়েও আমরা
মানুষটাকে মেরে ফেলি। ক্যারিয়ার আর মানসম্মান নষ্ট হবার ঝুঁকি কে নেয় বলেন! আপনি ভাগ্যবান যে আপনার কাছ থেকে টাকা আমরা নেই নাই, শুধু আপনাকে মেরে ফেলছি। আপনার ফ্যামিলির
লোকেরা আপনার সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে। ইনফ্যাক্ট, আপনার কাছ থেকে টাকা নেয়ার সময়ও আমাদের নাই। আজকের মধ্যে
আপনাকে মারা না-হ’লে রাফাত আহমেদ আমাদের ক্যারিয়ার শেষ করে দিবে।’
‘আমার চোখগুলো খুলে দেন, মরার আগে একবার দুনিয়াটা দেখি।’ আমি অনুরোধ করি।
তরুণ কণ্ঠের অফিসার বলে, ‘এখন আর দুনিয়া দেখে লাভ কী!’ একথা বলেই আমাকে মাটিতে ফেলে আমার বুকের ওপর
তার পা দিয়ে চেপে ধরে।
‘পায়ে ধরি, স্যর। আমাকে মাইরেন না।’ আমি চিৎকার করে বলি,
‘স্যর, আমাকে বাঁচান। আমার কোনও অপরাধ নাই। একেবারে বিনা
অপরাধে আমাকে খুন করতেছেন।’
কেউ একজন আমার চোখের
বাঁধন খুলে দেয়। চোখ খুলতেই দেখি পঁচিশ,
ছাব্বিশ
বছর বয়সী এক তরুণ আমার বুকের ওপর পা দিয়ে আমার মাথা বরাবর পিস্তল তাক করেছে। তাকে
ঘিরে রাখা তার সশস্ত্র সহকর্মীদের সে বলে,
‘আমি
প্রথম গুলি করব। এরপর তোমাদের যার-যার ইচ্ছা সবাই এসে গুলি করবে।’
যুবকের অভিযোগ শুনে
লিন্ডা বিচারকের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছু একটা বলে। তার
অভিব্যক্তিগুলো দেখা যায়। কিন্তু শব্দগুলো বাতাসে উড়ে যায়। নষ্ট মাইকে ভেঙে-যাওয়া শব্দের
মতো। টুকরো-টুকরো স্বরবর্ণ ভেসে আসে। আ ও শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয়। কাছে ব’সে থাকা দুয়েকজন
বুঝতে পারে সে কী বলছে। আমিনের কাছে কেউ একজন বলে, বিচারক গালাগাল করছে।
হাড়জিরজিরে এক তরুণ দু’হাত মাথার উপর তুলে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ
করতে চেষ্টা করে। “ম্যাডাম, আমাকে কথা বলতে পারমিশন দেন।” দুই হাত মাথার উপর তুলে সে নাড়তে থাকে। “এসপি স্যরকে দুইটা কথা শুধু বলতে চাই।” বিচারক ইশারায় অনুমতি দেয়।
জড়োসড়ো ভঙ্গিতে মাহমুদের
দিকে তাকিয়ে বলে, “স্যর, আমি একটা লুঙ্গি আর বিছানার চাদর চুরি করি
একটা একতলা বাসার খোলা জানালা দিয়ে। পরে শুনি ওটা নাকি জজ সাহেবের বাসা ছিল। এর
আগেও সহজে করা যায় এমন অনেক চুরি করি। কিন্তু কোনওদিন ধরা পড়ি নাই। চুরির কথা
স্বীকার করানোর জন্য থানার দারোগা আমাকে ভীষণ পিটায়। জজ সাহেবের বাসায় চুরি নাকি
পুলিশের জন্য বেইজ্জতির বিষয়।
“দারোগা স্যর বলে, ‘চুরির কথা স্বীকার কর আর বল চাদর কই রাখছিস।
আমার চাকরি থাকব না তোর এই মগড়ামির জন্য,
আমি
জানি তুই চুরি করছোস।’
“আমার মুখ থেকে
যখন কোনো কথাই বের হয় না, দারোগা স্যর
আমার দুই পা সিলিংফ্যানে বেঁধে ফ্যান ছেড়ে দেয়। আমার চিৎকারে থানার অন্যসব পুলিশ
এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়ায়। আমাকে ফ্যান থেকে নামানোর পর বলে, ‘চুরির কথা স্বীকার কর আর চাদর বের করে দে।’ প্রায় বেহুশ তখন আমি, বলি,
‘চুরির
কথা কিছু জানি না।’
“চারপাশে অফিসার, কর্মচারী, সিপাই জমে যাওয়াতে দারোগা স্যরের মনে হয় আরও
বেশি জিদ চাপে। আমার মুখ, মাথা কাপড় দিয়া
বাইন্ধা নাকে মুখে পানি ঢালতে থাকে। পশুর মতো আমি গোঁ-গোঁ করি। নিঃশ্বাস
নিতে পারি না। জড়ো-হওয়া সবার উদ্দেশে দারোগা বলে, ‘এই এলাকার সব চুরিচামারি এই হারামজাদা করে। এত টর্চারের
পরও কুত্তার বাচ্চা কোনো কথা স্বীকার করতেছে না।’
“আবার আমাকে
ফ্যানে ঝুলায়। বমি করতে শুরু করলে ঝুলানো অবস্থা থেকে নামিয়ে আনে। বেহুশ হয়ে যাবার
আগে আমি পানি খেতে চাই। কেউ একজন পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে আসে। দারোগা স্যর তাকে
বাধা দেয়। বলে, ‘পানি দিস না।
মুখ দিয়া ফেনা বাইর হইতেছে। পানি দিলে এখন মইরা যাইব। তারপর সাংবাদিকরা পুলিশের
চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করব।’ শেষ মুহূর্ত
পর্যন্ত আমি পানি দেন বলে অনুরোধ করতে থাকি।”
মাহমুদের দিকে তাকিয়ে
বাদী তরুণটি বলে, “স্যর আপনের
জেলায় ওই দারোগা স্যর চাকরি করত। আপনি তখন গাজীপুরের এসপি ছিলেন। বাদীর কথা বলা
শেষে বিচারক লিন্ডা মাহমুদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মাহমুদ আনতমস্তকে
মূর্তিবৎ বসে থাকে।
আকাশ কমলা রং ধারণ করে।
সন্ধ্যা নামলে বিচার-কাজ স্থগিত হয়ে যায়। লিন্ডা বিচারকের আসন থেকে নেমে ধবধবে
সাদা-শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দিগন্ত-পানে হেঁটে যায়। কমলা আকাশের নীচে একসময় একটা
অপস্রিয়মান সাদা বিন্দু হয়ে যায়। তার সঙ্গীসাথিরা তখনও জটলা বেঁধে হৈ হুল্লোড় করছে। জটলার মধ্যে দুই
মাঝবয়সী নারী উচ্চস্বরে কলহে জড়িয়ে পড়ে। আমিন আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে, “যে-দুইটা মেয়ে ঝগড়া করছে, এরা বেশ্যা। যে-কয়টা খুনি আর বেশ্যা মেয়ে এখানে আছে, তারা নিজেদের মধ্যে
প্রায়ই চুলোচুলি করে। বিশেষ ক’রে এদের কারও ভাগে পুরুষ কম পড়লে বা একেবারেই না-জুটলে একে-অন্যকে
মেরে রক্তাক্ত করে দ্যায়।”
রিরংসাকাতর
এদের দেখলে খোদ ঈশ্বরও ভয় পাবে। আশপাশের পুরুষেরা চারপাশে গোল হয়ে, হাততালি দিয়ে তাদের কলহ, চুলোচুলিকে উৎসাহিত করে।
কিছু নারী-পুরুষ স্থবির
দাঁড়িয়ে দিনভর বিচারকের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক না-দেখলে তাদের দেখে কারও
ভাস্কর্য ব’লে ভুল হতে পারে। বিচারক কোনো হুকুম দিলে তারা নিঃশব্দে তা পালন করে। বাকিসময়
নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। কোনোকালে তারা চা-বাগানের শ্রমিক ছিল। সন্ধ্যা নেমে এলে
চা-বাগানের প্রাক্তন কুলিকামিনেরা যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। টকটকে
কমলা চাঁদ। সন্ধ্যা হতেই লালচে কমলা আলোয় দল বেঁধে বা একাএকা
মানুষজন দ্রুত এ-জায়গা ছেড়ে চলে যায়। যেন কোনো অভিশপ্ত স্থান ছেড়ে যাচ্ছে।
নিস্তব্ধ রাতে আমাদের
ঘিরে চাপাতি-হাতে লুঙ্গিপরা প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকে। মাহমুদ-আমিন-সহ সাংসদ, পুলিশ কর্মকর্তা, জজ,
সেনা
কর্মকর্তারা হাত-পা কুঁকড়ে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুম আসে না। চোখের ওপর হাত
রেখে অন্ধকার তৈরি করি যেন এই অন্ধকার কোনো জাদুবলে আমাকে এই কমলা চাঁদের নরক থেকে
মুক্তি দেবে। কমলা কুয়াশার চাদর পৃথিবীকে আবৃত করে রাখে। কেউ-কেউ ঘুমের ঘোরে
বিড়বিড় কথা বলে। হয়তো ঘুমের মাঝে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়।
সকালে ঘুম ভাঙে মানুষের
কোলাহলে। গতকালের মতোই বিচার বসেছে। আমার চারপাশে অফিসার এবং রাজনীতিবিদ্রা সবাই বসে
বিচারকের দিকে একঠায় তাকিয়ে আছে। লিন্ডার সামনে এক দেড় বছর বয়সী শিশু কোলে এক
মাঝবয়সী নারী নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে মানুষের ভিড়। বিচারক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে
বলে, “মিথ্যা বলা এবং প্রতারণা
করা সবচে’ বড় অপরাধ। এটা সবাই জানে, এই পৃথিবী শিশুদের জন্য না। এখানে কোনো শিশুকে বাঁচতে দেওয়া হয় না। কোন্ দুঃসাহসে মা তার
বাচ্চাকে দেড় বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখল! মা এবং শিশুকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হোক।” এ-কথা শুনে সবাই মিলে সন্তানসমেত মাকে খোলা
মাঠে বসিয়ে তাদের চারপাশে ছোট বড় নানা আকৃতির পাথর দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে। বিচারক
প্রথমে পাথর ছুঁড়ে মারে শিশুটির মাথায়। মা এবং শিশুর চিৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ
হয়। চারদিক্ থেকে সবাই মিলে বৃষ্টির মতো পাথর ছুঁড়ে মারে তাদের দিকে। কিছু সময়ের মধ্যে দু’টি রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকে। মৃতদের কবর
দেয়ার হুকুম দিয়ে বিচারক স্ব-আসনে ফিরে আসে।
অসংখ্য পাখির কলকাকলি।
অথচ বড় কোনো বৃক্ষের চিহ্ন আশেপাশে নাই। কোনো গাছ,
জঙ্গল, পাখি, কোনোকিছুই নাই। অথচ সারাদিন, অগণিত পাখির কিচিরমিচির। আমিনকে জিজ্ঞাসা
করি, “পাখির শব্দ কোথা
থেকে আসে?” আমিন পায়ের কাছে একটা পাখি দেখায়,
“এই
যে, একটা ছোট সিঁদুর রঙের
টকটকে-লাল পাখি। এক আঙুলের সমান দৈর্ঘ্য। গলায় কালো একটা চিকন রেখা। এটা সম্ভবত
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখি। এইরকম কিছু পাখি এখানে আছে।”
ফর্সা, মাথায় ছোট-ক’রে-চুল-ছাঁটা এক
প্রৌঢ় উঠে দাঁড়িয়ে আমিনের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ তুলে ধরে। বলে, “স্যর, আমার কথা মনে
আছে? আমি রিকশাওয়ালা খবির
মিয়া। আপনি আমাকে দশ খুনের আসামি কাইল্লা শহিদ নাম দিয়ে খুন করছিলেন।” আমিনের মনে পড়ে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং
ছোটভাই ক্রাইম রিপোর্টার পারভেজকে নিয়ে একবার একটা অপারেশনে গিয়েছিল।
পারভেজের দীর্ঘদিনের
অনুরোধ উপেক্ষা করতে না-পেরেই তাকে নিয়ে যায়। সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার পারভেজ
আহমেদ এক বিখ্যাত দৈনিকে কাজ করে। আমিন দুর্নীতিমুক্ত কর্মকর্তা বলে ক্রাইম
রিপোর্টার মহলে প্রায় সবার তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। সাংবাদিক, ক্রাইম রিপোর্টার নিয়ে সাধারণত এই ধরনের
অপারেশনে কেউ যায় না। খুনাখুনিতে গোপনীয়তা রক্ষায় পারভেজের প্রতিশ্রুতির ওপর
আমিনের আস্থা ছিল। পারভেজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন আমিন ভাই। ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজে
আমিন তার তিন-ব্যাচ সিনিয়র ছিল।
ইটভাঁটার পাশে খোলা-মাঠে
আমিনের সাথে গাড়ি থেকে নামে পারভেজ। পিছনেই অন্য একটা মাইক্রোবাস থেকে চার-পাঁচ-জন
প্যান্ট-শার্ট-পরা যুবক অস্ত্রসহ নামে। তাদের একজন শার্টের কলার ধরে নামায় ছোট-ক’রে-চুল-ছাঁটা, কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা. লুঙ্গিপরা
প্রৌঢ় এক লোককে।
লোকটা আমিনের সামনে
দাঁড়িয়ে করুণ মুখে বলে, “স্যর, আমি গরীব রিকশাওয়ালা, আমার বাচ্চারা পড়ালেখা করে। আমিই একমাত্র
রোজগার করি। স্যর, আমি জীবনে কারও
কোনো ক্ষতি করি নাই।”
পারভেজ জিজ্ঞাসা করে, “এই লোকটা অপরাধী?”
আমিন বলে, “হ্যাঁ,
এটাই
কাইল্লা শহিদ। দশ খুনের আসামি। টাকা দিলে সে যে-কাউকে খুন করবে। ডোন্ট ট্রাস্ট
হিম। পুলিশ ধরলে খুনি, ডাকাত সবাই গরিব
রিকশাওয়ালা হয়ে যায়।”
—“স্যর,
আল্লাহর
কসম, আমি কাইল্লা শহিদ না,” প্রৌঢ় আকুল কণ্ঠে বলে।
আমিনের সহযোগীদের একজন
সজোরে তার দুই গালে থাপ্পড় দেয়,
“হারামজাদা, কথা কইলে গুলি করমু। তুই কে আমরা জানি।”
কোনো কথা লোকটার কান
পর্যন্ত পৌঁছায় বলে মনে হয় না। তার চোখ, মুখ মাথা ঐ
থাপ্পড়ের ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে সময় নেয়। এলোমেলো বাতাসে
সবার চুল ওড়ে। দাড়িওয়ালা ‘কাইল্লা শহিদ’ উপুড় হয়ে আমিনের পায়ে পড়ে বলে, “স্যর,
আমি
জীবনে কোনো মানুষ খুন করি নাই। আল্লাহর কসম স্যর। আমার মেয়েরা ব্র্যাক স্কুলে পড়ে।
আমার বস্তিতে দশটা মানুষরে জিগান স্যর। ব্র্যাক স্কুলে খোঁজ নেন স্যর, আমি জীবনে কোনো মানুষ খুন করি নাই। আমার
বাচ্চার কসম স্যর।”
আমিন তার ঊরুতে গুলি
করে। পারভেজকে বলে, “এই শুয়োরের
বাচ্চা একটা ঠাণ্ডা মাথার খুনি। এ যাবৎ দেখা সব কিলারকেই দেখলাম তারা কোনোদিন
অপরাধ স্বীকার করে না। তুমি তো জানো যে আমার হাতে প্রচুর টপ টেরর ধরা পড়েছে। একটাও
ধরা পড়ে স্বীকার করে না এরা কোনো অপরাধ করে।”
‘কাইল্লা শহীদ’ গুলি খেয়ে কুঁকড়ে যায়। তারপরই আবার হাঁচড়ে-পাছড়ে এসে আমিনের
পায়ে জড়িয়ে ধরে। “স্যর, আমার বাচ্চাগুলি না খায়া মরব। আমার সন্তানের
কসম আমি কোনও মানুষ খুন করি নাই কোনোদিন। আমারে বাঁচান। আমারে হাসপাতালে পাঠান।” তার পা দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরে।
আমিন তার মাথার কাছে পিস্তল
ধরে পরপর দুইবার গুলি করে। আমিনের একবার মনে হয়েছিল হয়তো লোকটা সত্যি নিরপরাধ কোনো
রিকশাওয়ালা। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। সে বেঁচে গেলে সংবাদপত্রে জানাজানি
হবে। ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আর রিকশাওয়ালাই কেন হবে। তার টিমের সবচেয়ে বিশ্বস্ত
অফিসাররা নিশ্চিত করেছে সে দশ খুনের আসামি কাইল্লা শহিদ।
মৃত নিথর ‘কাইল্লা শহিদ’ তখনও দু’হাতে তার পা জড়িয়ে থাকে। আমিন নুয়ে তার পায়ে আঁকড়ে থাকা দু’হাত সরিয়ে
বন্ধুসহ তার গাড়িতে ওঠে। অন্য অফিসারদের বলে,
“তোমরা
সামলাও।” গাড়িতে উঠে একজন অফিসারকে দেখিয়ে বলে,
“যার
সাথে আমি কথা বললাম, আমার দেখা হি ইজ
দ্যা বেস্ট অফিসার। তাকে যদি টার্গেট দাও কোনো ক্রিমিনালকে খুঁজে বের করতে সে কবর
থেকে হলেও তারে বের করে আনবে। সাত মাস আমরা ওয়েট করি। গতকাল সে কাইল্লা শহিদকে
ফাইনালি ধরতে পারল।” মাস-ছয়েক পর
আমিন নানা ভালো কাজের জন্য, খুনি
সন্ত্রাসীদের দমন করার জন্য প্রেসিডেন্ট পদক পায়, তাছাড়া সরকারে বাকিসময় মন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তা— সবার প্রিয়
মানুষ হয়ে ওঠে।
রিকশাওয়ালার অভিযোগ শুনে
লিন্ডা আবারও এসপি, ডিসি, সেনা কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ সবাইকে অশ্রাব্য গালাগাল করে।
তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলে, “এইসব সরকারি
লোকেরা যে লাখ লাখ কোটি টাকা ঘুষ খায়,
চুরি
করে এদেরকে কয়দিন ফ্যানে ঝুলায়া পিটানো হইছে?
এদেরকে
কেন ক্রসফায়ারে মারা হয় না!”
আমাদের, অর্থাৎ আসামীদের লঘুদণ্ড, গুরুদণ্ড সব ধরনের
শাস্তি দেয়া হবে ঘোষণা করে। তবে নিশ্চিত করে আমাদের মেরে ফেলা হবে না। এখানকার
লঘুদণ্ড হচ্ছে গায়ে কাদা, পানি ছুঁড়ে মারা, চুল টানা, চড়-থাপ্পড় দেয়া। আর গুরুদণ্ড সমবেত থুথু-নিক্ষেপ। রায়
ঘোষণা-মাত্র সবাই পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। লুঙ্গিপরা চাকরবাকর
টাইপের লোকজন আমাদের চুল টানে, কিল ঘুষি থাপ্পড়
দেয়। নাকে মুখে কাদা-পানি ছিটিয়ে দেয়। বিচারক প্রথমে সবার গায়ে মাথায় থুতু ফেলে।
তার দেখাদেখি বাকিরা এসে থুতু নিক্ষেপের বন্যা বইয়ে দেয়। লিন্ডাকে ঘিরে সবাই নাচ-গান-উৎসবে মেতে
ওঠে। লিন্ডা আসে, আমাদের কাছে
ফেরে। কাউকে নির্দেশ দেয় আমাদের গায়ে পানি ঢেলে দিতে। সবার গায়ে, মাথায় পানি ঢালা হলে সে আমাদের প্রত্যেককে
আলাদা করে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দ্যাখে। এসপি রুম্মানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আপনি দেখতে খুব সুন্দর। এমন আকর্ষণীয় পুরুষ
আমার জীবনে কম দেখেছি।” লিন্ডা তার
লোকজন ডেকে এনে আমাদের চারপাশে বসায়। সে আবার বিচারকের আসনে গিয়ে বসে। ঘোষণা দেয়, সে দশটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। সোনালি রোদের
মৌতাত মেখে লিন্ডা গান গেয়ে যায়। শুষ্ক বাতাসে আমাদের ভেজা শরীর, মাথা শুকিয়ে যায়। ‘আমার সকল দুঃখের
প্রদীপ’ গানটা গাওয়ার সময়
লিন্ডার গলা ধ’রে আসে। শাড়ির সাদা-আঁচলে চোখ মোছে সে। গান গাওয়া-শেষে
সে আমাদের সামনে আসে। রুম্মানের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে তার পোশাক খুলে সম্পূর্ণ
নগ্ন হয়ে যায়। তারপর সে রুম্মানকে বলে,
“আসো”। আমার পাশে বসা মাহমুদ বলে, “হার বটম ইজ গরজিয়াস। কিম কারদাশিয়ান, রিয়ান্নার চেয়ে কম কিছু না।” সমর্থনের আশায় রুম্মান নার্ভাস ভঙ্গিতে
আমাদের দিকে তাকায়। বলে, “আমি না-গেলে
আমাকে হয়তো এরা পাথর ছুঁড়ে মেরেও ফেলতে পারে।”
বিকালে বাদী, আসামি,
বিচারক, সবাই উৎসবে
মেতে ওঠে। আমার তখন মনে হয় এটাই পালানোর উপযুক্ত সময়। কারণ চাপাতিওয়ালা কেউ
পাহারায় নাই। মাহমুদকে বলি। সে রাজি হয় না। “পালাতে পারবেন
না, ইটস আ ডিফরেন্ট
ওয়ার্ল্ড। পালাতে চেষ্টা করলে চাপাতিওয়ালারা ঠিকই খুঁজে বের করবে এবং মেরে ফেলবে।” ব’লেই মাহমুদ নাচে যোগ দেয়। এই বর্মহীন, আবরণহীন, সামাজিক অনুষ্ঠান আর আচারবিহীন জীবন মাহমুদের কাছে আকর্ষণীয়
হয়ে ওঠে নাই তো? কিছুদূর হেঁটে
গিয়ে আমি পশ্চিম দিকে দৌড়াই। কয়েকটা পাথুরে টিলা ডিঙানোর পর কমলা
রাত্রি নেমে আসে। রাতভর আমি দৌড়াই, কোনদিকে যেতে হবে না জেনেই। ভোরের দিকে
একটা নদী এবং পাহাড়ের কিনারে পৌঁছাই। একপাশে পাথুরে পাহাড় আর অন্যপাশে অবারিত
জলরাশি। হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে নদীর কিনারে এবং পাহাড়ের গায়ে বৃক্ষেরা একে অন্যের গায়ে
আছড়ে পড়ে। এলোমেলো বাতাসে আমার ভেসে যাবার দশা। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি
নামে। বাতাস, বৃষ্টি কোনো
কিছুতেই আমার দৌড়ানোর গতি কমে না। এক মুহূর্তের জন্য না-থেমে আমি দৌড়াতে থাকি।
দুইজন জেলে আমাকে উদ্ধার করে, আমাকে দেখে
প্রথমে মৃত ভাবে। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে আমি
বেহুশ। কাছে এসে আমাকে জীবিত দেখে তাদের নৌকায় তুলে নেয়। চোখ মেলে আমি বুঝতে পারি
না আমি আবার ওদের হাতে ধরা পড়েছি কিনা। আমি কোনো কথার জবাব দেই না, শুধু জিজ্ঞাসা করি এটা কোন্ জায়গা। তারা
জবাব দেয়, এটা হাওড়, সুনামগঞ্জ জেলা। তাদের অনুরোধ করি, আমাকে কোনো পুলিশফাঁড়ি বা থানায় নিয়ে যেতে।
সবার কাছে আমি মিথ্যা গল্প বলি, আমাকে
দুর্বৃত্তরা ধরে নিয়ে গিয়ে দিনরাত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ফেলে রেখেছে। পুলিশ বা
প্রশাসনে আমার ঘনিষ্ঠ যাদেরকেই আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি, কেউ আমাকে বিশ্বাস করে না। বরং কেউ-কেউ আমার
মানসিক সুস্থতা নিয়েও সন্দেহ করে । কিন্তু ওই অফিসারদের কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই ধরে
নিচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদ্রা সরকারের কোনো গোপন
তথ্য জানত, যা ফাঁস হয়ে যেতে পারে আশঙ্কায় সরকার নিজেই তাদের গুম করে ফেলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন