শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০২৪

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরজী ছবি

 


কলকাতায় আরও ৭০ মিমির প্রেক্ষাগৃহের উদ্ভবঃ এলিট

ষাটের দশকের মাঝামাঝি দাদা একদিন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের ‘এলিট সিনেমায় Becket ছবিটি দেখে এসে বললেন, “জানিস, ‘এলিট’টাও ৭০ মিমি করছে!” এলিটে প্রথম কয়েকটি দেখা ছবি ৩৫ মিমিই ছিল, অবশেষে ১৯৬৬-তে বাবা-মার সঙ্গে রাত্রির শোতে দেখি ৭০ মিমির হাসির ছবি, ১৯৬৫ সালের The Great Race। আরম্ভেই পর্দায় লেখা ফুটে উঠল For Mr Laurel and Mr Hardy! আমি তো দারুণভাবে উৎসাহিত! ঐ জুটি ততদিনে আমার অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে! মোটরগাড়ির ‘রেস’, নিউ ইয়র্ক থেকে প্যারিস, মূল দুই প্রতিযোগী দুঃসাহসিক সব খেলা দেখিয়ে বিখ্যাত লেসলী (ভূমিকায় টোনি কার্টিস) আর তার প্রতিপক্ষ পাগল বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক প্রোফেসার ফেট ও তার আজ্ঞাবহ ম্যাক্স (ভূমিকায় জ্যাক লেমন ও পিটার ফক) – এই দুই চরিত্রই লরেল-হার্ডি অনুপ্রাণিত। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাহসী মহিলা সাংবাদিক ম্যাগী দুবোয়া (অভিনয়ে ন্যাট্যালি উড)। ১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত বাস্তবিক এরকম একটি মোটর-দৌড় ছবির কাহিনীর উৎস। সাম্প্রতিক-দেখা যন্ত্রণাদায়ক ৭০ মিমি ছবি Lawrence of Arabia (এর আগের পর্ব দেখুন)-র পর এই মজার ছবিটি ছিল তাজা হাওয়ার ঝাপটা! দ্বিতীয়বার ছবিটি কয়েকদিন পরেই আবার দাদার সঙ্গে এলিটে দেখি। দাদা তো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, “আবার দেখব! এত ভালো!” কাহিনির দ্বিতীয়ার্ধে মোটামুটি মিনিট-কুড়ির মধ্যে যে ভাবে বিখ্যাত, এবং ততদিনে অন্তত তিনবার হলিউডে চলচ্চিত্রায়িত, The Prisoner of Zenda-র (আমাদের ঝিন্দের বন্দী) পুরো ঘটনাসমূহ হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে তা ছবির অন্যতম আকর্ষণ। সত্তরের দশকে ছবিটি তৃতীয়বার দেখেছিলাম বাবার সঙ্গে, তবে এবার প্রেক্ষাগৃহ ছিল নিউ মার্কেটের ‘গ্লোব’ সিনেমা, যার কথা পরে বলব।

এলিটে এরপর ৭০ মিমিতে ১৯৬৭ সালে ২ বার দেখি (প্রথমে দাদা, তারপর বাবার সঙ্গে) সম্ভবত আমার দ্বিতীয় যুদ্ধের ছবি, ১৯৬৫ সালের Battle of the Bulge। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির ভয়ঙ্কর ‘টাইগার ট্যাঙ্ক বনাম আমেরিকার, তুলনায় ক্ষুদ্রকায় ‘শার্মান’ ট্যাঙ্কের যুদ্ধ এই ছবির মুখ্য আকর্ষণ। একাধিক দৃশ্য এখনও মানসচক্ষে ভাসেঃ একের পর এক টাইগার ট্যাঙ্ক দিয়ে জার্মান সৈন্যদলের রাস্তায় পড়া একটি ছোট্ট শহর সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া; মিত্রপক্ষের জন্য অস্ত্র নিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন, একের পর এক ‘টানেল’ পড়ছে রেলপথে, হঠাৎ একটি টানেল থেকে বেরোবার মুখে কামান উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে টাইগার ট্যাঙ্ক! প্রাণপণে ‘ব্রেক’ টেনেও রক্ষা পেলো না দীর্ঘ ট্রেনটি – পর্দা অন্ধকার করে ধোঁয়া আর কান ধাঁধানো বিস্ফোরণের শব্দ। এছাড়া মুগ্ধ হয়েছিলাম জার্মান কর্নেল হেসলারের ভূমিকায় রবার্ট শ-র অভিনয়ে। যে শহরটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, তার ধ্বংসস্তূপ দর্শন করছেন হেসলার। হঠাৎ তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বন্দুকের গুলি। ভাঙা বাড়ির আড়াল থেকে তাঁকে তাক করেছে এক ক্ষুব্ধ কিশোর। জার্মান সৈন্যরা  ছেলেটি ও তার বাবাকে ধরে নিয়ে এলো হেসলারের সামনে। ছেলেটিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হেসলার ঠাণ্ডা গলায় হুকুম দিলেন, “ছেলেটাকে ছেড়ে দাও। কিশোর চরিত্রটির সঙ্গে দর্শকও হাঁপ ছেড়ে বাঁচছে, অমনি এল দ্বিতীয় হুকুম, “বাবাকে গুলি করে মারো!”

মনে হয়, ঐ একই বছরে এলিটে দেখি টমাস হার্ডির উপন্যাস অবলম্বনে ঐ ১৯৬৭ সালেরই ছবি Far from the Madding Crowd। ছবিটি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়রের হওয়াতে মেট্রো সিনেমায় এর ট্রেলর দেখেছিলাম, অন্য কোন ছবি দেখতে গিয়ে। ৭০ মিমি ছবি, তাই মেট্রোর বদলে, এবার জ্যোতি নয়, নতুন ৭০ মিমি প্রেক্ষাগৃহ এলিট। উপন্যাসটি দাদাদের কলেজে পাঠ্য ছিল, তাই বাবা-মার সঙ্গে তিনি এবং আমি গেলাম। হার্ডি আবার আমার মার প্রিয় ঔপন্যাসিক! হার্ডির উপন্যাসসমূহের কালানুক্রমে Far from the Madding Crowd অপেক্ষাকৃত আগের দিকে লেখা। তাঁর নির্মম বিয়োগান্তিক বিশ্ব-দর্শনের ইঙ্গিত এখানে আছে বটে – নায়িকা বাথশেবার তিন প্রেমিকের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু ঘটবে। আদপে মিঃ বোল্ডউড বাথশেবাকে বিয়ে করার প্রাক্কালে বাথশেবার প্রেমিক-স্বামী সার্জেন্ট ট্রয়কে অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে আসতে দেখে (ঘটনাচক্রে সবাই মনে করেছিল ট্রয় মৃত) নিজের প্রেম ব্যর্থ হবার সম্ভাবনায় দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে গুলি করে হত্যা করবেন তাঁর প্রেমের প্রতিদ্বন্দীকে। অবশেষে বাথশেবাকে লাভ করবে কৃষক গেব্রিয়েল ওক।

মা-বাবার ছবিটি পছন্দ হয়নি একেবারেই, বিশেষ করে নায়িকার চরিত্রে জুলি ক্রিস্টীর অভিনয়। আমি সেই ১০ বছর বয়সে এ কাহিনীর মর্ম কি আর বুঝব? পরে, কলেজে পড়াকালীন বাবার সঙ্গে ছবিটি আরেকবার ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে অবস্থিত প্রেক্ষাগৃহে দেখেছিলাম। সেবারেও তেমন ভালো লাগেনি।

পরের বছর, ১৯৬৮-তে এলিটে দেখলাম ১৯৩৯ সালে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত, আর এখন ৭০ মিমি প্রোজেকসানে, হলিউডের যুগান্তকারী ছবি, মার্গারেট মিচেলের উপন্যাস-ভিত্তিক Gone with the Wind। দাসপ্রথা-বিলুপ্তিকরণের জন্য আমেরিকার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই কাহিনী আজও বিতর্কিত। সে প্রসঙ্গে না গিয়েই বলছি যে এক দ্বাদশ-বর্ষীয় কিশোরের পক্ষে Gone with the Wind ছিল এক চোখ-ধাঁধানো অভিজ্ঞতা। যেমন অসাধারণ চিত্রগ্রহণ, তেমনই অভিনয়! যথারীতি, মেট্রোতে এর ট্রেলর দেখানো হয়েছিলো। পরে ৮০-র দশকের শেষে বা ৯০-এর শুরুতে ছবিটি নিউ এম্পায়ারে আবার মুক্তি পায়, কিন্তু আর ৭০ মিমিতে নয়। সেই চৌকো ৩৫ মিমি প্রোজেকসান।

সম্ভবত ১৯৬৯-এ এলিটে দেখি ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে সঙ্গীতবহুল ১৯৬৮ সালের Oliver। নাম-ভূমিকায় শিশু-অভিনেতা মার্ক লেস্টারকে খুবই ভাল লেগেছিল। আর পিঠ দিয়ে আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন অপরাধী বিল সাইকসের ভূমিকায় অলিভার রীড। এছাড়া উপভোগ্য অভিনয় করেছিলেন ফ্যাগিনের চরিত্রে রন মুডি, আর ‘আর্টফুল ডজার-রূপে জ্যাক ওয়াইল্ড। ১৯৭২-এ বাবা-মা এলিটের ম্যানেজার মিঃ দারুওয়ালার সম্মতি নিয়ে আমাকে দেখতে নিয়ে গেলেন ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ নির্দিষ্ট ১৯৬০ সালের Spartacus। আমার বয়স তখন ১৫! প্রাচীন রোমে দাস-বিদ্রোহের এই রোমহর্ষক চিত্রায়নে ছিলেন একাধিক স্বনামধন্য অভিনেতা। তাছাড়া তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপট খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। ‘এ্যাডাল্ট মার্কার কারণ মূলত নায়িকা ভারিনিয়ার (জীন সিমনস) সঙ্গে নায়ক স্পার্টেকাসের একাধিক – তখনকার বিচারে – রগরগে প্রণয়-দৃশ্য।

সত্তরের দশকে এলিটে আরও দেখেছি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত সুপারহিট ১৯৬৯ সালের ছবি Mackenna’s Gold। প্রিন্ট শতছিন্ন হওয়ায় এত জমাটি ছবি তেমন জমেনি। প্রথম যখন এই এলিটেই ছবিটি মুক্তি পায়, শুনেছি টিকিটের অবাধ কালোবাজারী চলেছিল। বলা উচিত যে এলিটে ৭০ মিমি ছাড়াও অসংখ্য ৩৫ মিমির অসাধারণ ছবি দেখেছিঃ প্রিয় অভিনেতা জন ওয়েন অভিনীত একাধিক ছবি, তার মধ্যে ১৯৭০ সালে ২ বার দেখেছি ১৯৬৯ সালে যে ছবির জন্য তিনি জীবনের একমাত্র ‘অস্কার’ পান, সেই True Grit। ছবির শীর্ষবিন্দুতে মার্শাল কগবার্ন-রূপী ওয়েন একা চারজন ডাকাতকে আক্রমণ করছেন, ঘোড়ায়  চড়ে, লাগাম নিজের দাঁতে নিয়ে, একহাতে পিস্তল, আরেকহাতে রাইফেল! অবিস্মরণীয় দৃশ্য! এই ছবি বাবা রাতের শো তে দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার আগে চার দিনে ১০৪-টি অঙ্ক কষিয়ে আমাকে নাকের জলে-চোখের জলে ভাসাবার পর! তবে ঐ ১০৪-টি অঙ্ক কষার সুফল পেয়েছিলাম সেবার ইস্কুলের অঙ্ক পরীক্ষায় ৮০% নম্বর পেয়ে। এর পর সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে True Grit-এর পরবর্তী কাহিনীচিত্র, ১৯৭৫ সালের Rooster Cogburn দেখি এলিটেই, ৭০ মিমি প্রোজেক্সানে। তবে মূল ছবির তুলনায় জন ওয়েনের সঙ্গে ক্যাথারিন হেপবার্নের মতো শক্তিশালী সহ-অভিনেত্রী থাকা সত্বেও ছবিটি আমাকে হতাশই করেছিল।

৩৫ মিমির আরও ছবি এলিটে, পুনর্মুক্তির পর, ১৯৬৫/৬৬ সালে দেখেছি বিখ্যাত পরিচালক সেসিল বি ডি মিলের সার্কাস নিয়ে ১৯৫২ সালের The Greatest Show on Earth যাতে প্রথম দেখি অভিনেতা চার্ল্টন হেস্টনকে। পরে ১৯৬৯-এ দেখব ঐ পরিচালকের আরেক যুগান্তকারী ছবি, ১৯৫৬ সালের The Ten Commandments, যাতেও চার্ল্টন হেস্টন ছিলেন, মোসেসের ভূমিকায়। সত্তরের শেষে দেখেছি ডি মিলের ১৯৪৯ সালের আরেক বাইবেল-ভিত্তিক ছবি Samson and Delilah। Ten Commandments-এরপর এই ছবি অতিদীর্ঘ আর ক্লান্তিকর লেগেছিল।

(ক্রমশ)

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন