সিনেমার পৃথিবী – ৩৮
এই পর্বে আমরা ইউরোপের বাকি ছ’জন পরিচালককে নিয়ে ঘষামাজা করব - ড্রেয়ার, ল্যাং, ফেলিনি, গোদার, অ্যাঞ্জেলোপাউলোস, হেনেকা। এবং চেষ্টা করব একদম শেষে কুস্তুরিকা-কেও একবার ছুঁয়ে যেতে। আরেকটা কথা, ইউরোপ নিয়ে আমাদের এই আলোচনার সবথেকে প্রবীন দুজন পরিচালক কিন্তু ড্রেয়ার এবং ল্যাং। উনবিংশ শতকে জন্ম। ফলে ওনাদের বেশিরভাগ ছবি নিউ ওয়েভ জমানার বহু আগের ছবি এবং বেশ কিছু ছবি নির্বাক। সেটা মাথায় রেখেই কিন্তু ওনাদের এই সেরার লিস্টে রাখা হয়েছে। কেন, সেটা দেখতে পাবেন।
ডেনমার্কের বিখ্যাত পরিচালক কার্ল থিয়োডোর ড্রেয়ার (১৮৮৯-১৯৬৮) -কে নিয়ে আমরা এই লেখার ২৯ নং পর্বে খানিক আলোচনা করেছি। বিশেষ করে ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’ এবং ‘অর্ডেট’। ওনার তৈরি ১৪টা সিনেমার ভেতর উল্লেখযোগ্য – দ্য পার্সনস উইডো (১৯২০), লিভস ফ্রম দ্য বুক অব স্যাটান (১৯২১), মাইকেল (১৯২৪), মাস্টার অব দ্য হাউজ (১৯২৫), দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক (১৯২৮), ভ্যাম্পায়ার (১৯৩২), ডে অব র্যাথ (১৯৪৩), টু পিপ্ল (১৯৪৫), অর্ডেট (১৯৫৫), গারট্রুড (১৯৬৪) ইত্যাদি। আমি এর আগে বলেছিলাম যে ড্রেয়ার ছিলেন একদম শুরুর দিকের ড্যানিশ সিনেমার, শুধু ড্যানিশ কেন, পুরো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সিনেমার পথিকৃত। ওনার ক্যামেরা স্লো, খুব কাছ থেকে মানুষের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতেন। মূলত মনঃস্তত্ব ফুটিয়ে তুলতেন। সেখান থেকে সামাজিক অবক্ষয় হয়ে ভয়, অশুভের ছায়া এবং মৃত্যু। এবং একটু খুঁটিয়ে দেখলে বুঝবেন, এর পেছনে রয়েছে ওনার নিজের জীবনের অনিশ্চয়তা। অবৈধ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ, সেখান থেকে অনাথালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর এক টাইপিস্ট কার্ল থিয়োডোর ড্রেয়ার ওনাকে দত্তক নেন। যেহেতু বহু বছর আগে ডেনমার্কে বাবা ও ছেলের নাম একই রাখা হত, তাই বাবার নামেই উনি পরিচিত হন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই উনি এক ভয় ও অনিশ্চয়তায় ভুগতেন। ওনার দত্তক বাবা শৈশবে রোজ ভয় দেখাতেন, বুঝিয়ে দিতেন এই দত্তক জীবনের জন্য, বাঁচিয়ে রাখার জন্য, ড্রেয়ার যেন সেই দত্তক বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন। সেই ভয় ওনাকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে ড্রেয়ার ছিলেন কনজার্ভেটিভ, কোনদিন বিদ্রোহের চিন্তা মাথায় আনেনকনি, শুধু ভয় আর অনিশ্চয়তা সিনেমার ক্যানভাস থেকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। কি, ত্রুফোর একদম উল্টো, তাই না? কিন্তু ভুলবেন না, নির্বাক চলচ্চিত্রের জমানায় যে কটা সিনেমা একদম প্রথম সারিতে থাকবে, ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক’ তাদের মধ্যে একদম আগে। এই সিনেমার জন্য ড্রেয়ার অনেক রকম কলাকুশলীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ছবিতে এক্সপ্রেসনিস্ট লাইটিং, আলোছায়া। স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স নামক টেকনিক, অদ্ভুত এক অ্যাঙ্গল থেকে শুরু করে। নিঃশ্বাসের খুব কাছাকাছি, যখন নায়িকা ফ্যালকোনেটিকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এক সেটের সঙ্গে আরেক সেটের যোগসূত্র, যখন ক্যামেরা এক সেট থেকে আরেক সেটে মসৃণ চলে যাচ্ছে। ক্লোজআপে নায়িকা ফ্যালকোনেটির মুখের ওপর যখন ক্যামেরা যাচ্ছে, তখন একসঙ্গে যন্ত্রণা আর স্বাধীনতার আনন্দ। অনবদ্য মাস্টারমিস। আবার উল্টোদিকে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলের আরেক ছবি দেখুন, ‘অর্ডেট’। ড্রেয়ারের শেষ ছবি দেখুন, ‘গারট্রুড’। প্রায় ১০ মিনিটের এক লং শট। স্লো মোশনে ক্যামেরা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, উনি পরের প্রজন্মকে শিখিয়ে গেছেন।
জার্মান পারফেকশন আর এক্সপ্রেসনিজম বললে প্রথমেই ফ্রিজ ল্যাং (১৮৯০-১৯৭৬)-এর কথা মাথায় আসে। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট ওনাকে ‘মাস্টার অব ডার্কনেস’ আখ্যা দিয়েছিল। উৎসাহী পাঠকের নিশ্চয়ই মনে থাকবে, ল্যাং-এর ‘মেট্রোপোলিস’ নিয়ে আমি ১১ নম্বর আর ‘এম’ নিয়ে আমি ১৬ নম্বর পর্বে আলোচনা করেছিলাম। ল্যাং অনেক ছবি বানিয়েছেন, কিন্তু তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর ভেতর মোটামুটি – ডক্টর মাবুসে, দ্য গ্যাম্বলার (১৯২২), মেট্রোপোলিস (১৯২৭), ওম্যান ইন দ্য মুন (১৯২৯), এম (১৯৩১), ফিউরি (১৯৩৬), ইউ অনলি লিভ ওয়ান্স (১৯৩৭), দ্য ওম্যান ইন দ্য উইন্ডো (১৯৪৪), হাউজ বাই দ্য রিভার (১৯৫০), র্যাঞ্চো নটোরিয়াস (১৯৫২), হোয়াইল দ্য সিটি স্লিপস্ (১৯৫৬), বিয়ন্ড এ রিজনেবল ডাউট (১৯৫৬)। আমি সমালোচক হিসেবে ল্যাং-কে সায়েন্স ফিকশন ছবির জনক হিসেবে আখ্যা দিতে চাই। পড়াশুনো সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং নিয়ে, সেই ফলিত বিজ্ঞানের দর্শন উনি বিভিন্ন ছবিতে অপূর্ব ব্যবহার করেছেন। এমনকি ‘ওম্যান ইন দ্য মুন’ ছবিতে উনি রকেটের লঞ্চপ্যাড, কাউন্টডাউন ক্লক এবং মাল্টি-স্টেজ রকেটের ব্যবহার দেখিয়েছেন, যেগুলো পরবর্তীকালে একে একে বাস্তব হয়েছে। আবার দেখুন, ১৫৩ মিনিটের মাস্টারপিস ‘মেট্রোপোলিস’। সিনেমার ইতিহাসে প্রথম সাই-ফাই ছবি। যেহেতু তখন টেকনোলজি উন্নত ছিল না, তাই প্রায় বাস্তবসম্মত করার জন্য কি কি করা হয়নি এই ছবিতে? প্রায় একশ বছর আগে এক্সট্রা অভিনেতাদের জার্মানির ঠান্ডায় জলের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত তাদের রোবটের মত চলাফেরা করানোর জন্য বা নায়িকাকে উঁচু জায়গা থেকে লাফ মারতে বাধ্য করা হয়েছিল বা তার গায়ে সত্যিকারের আগুন লাগানো হয়েছিল বা সেটের ভেতরে আয়না রেখে লোকজনকে ছোট দেখিয়ে মিনিয়েচার সেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হত যাতে এক শটেই পুরোটা টেক করা যায় – এগুলো এখন শুনলে অবাক হতে হয়। জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর সাথে সাথেই আলোছায়ার মাঝে আসল ও নকল মুখের ভঙ্গি, ভয়ার্ত মুখ – পুরোটাই উপভোগ্য। ল্যাং-কে সেরাদের একদম ওপরের সারিতে না রাখলে সাই-ফাই জেনারেশনকেই অস্বীকার করা হবে।
উৎসাহী পাঠক জানেন, বাংলা ছবির স্বর্ণযুগে কোন এক সময় সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও মৃণালের ছবি একসঙ্গে রিলিজ করত, বাঙালি উইকেন্ড কাটাত সেইসব ছবির ভেতর বিভোর হয়ে। জার্মানেও কোন একসময় রবার্ট ভিন, মুর্নাউ এবং ল্যাং-এর ছবি একসঙ্গে রিলিজ করত, দর্শকরা সেইসব ছবিতে বিভোর হয়ে থাকত।
ফেদেরিকো ফেলিনি (১৯২০-১৯৯৩)-র ‘লা ডোলচে ভিটা’, আগেও বলেছি, আমার কাছে সিনেমা হিসেবে দশে দশ পাবে। এবং খুব কাছাকাছি থাকবে ফেলিনির স্ক্রিন-প্লে লেখা ১৯৪৫-এর ছবি ‘রোম, ওপেন সিটি’। যা ইতালি থেকে গোটা পৃথিবীতে প্রথম নব্য-বাস্তবতার ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছিল। ফেলিনির মনে রাখার মত ছবিগুলোর মধ্যে - আই ভিটেলোনি (১৯৫৩), লা স্ট্রাডা (১৯৫৪), নাইটস অব ক্যাবিরিয়া (১৯৫৭), লা ডোলচে ভিটা (১৯৬০), এইট অ্যান্ড হাফ (১৯৬৩), জুলিয়েট অব স্পিরিটস (১৯৬৫), স্যাটাইরিকন (১৯৬৯), রোমা (১৯৭২), আমাকর্ড (১৯৭৩), ফেলিনি’জ ক্যাসানোভা (১৯৭৬)। এর মধ্যে ১৩ নম্বর পর্বে ‘লা দোলচে ভিটা’ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি। ব্যক্তিগত জীবনে ফেলিনি ছিলেন খুব অমনোযোগী, স্কুল প্রায় যেতেন না বললেই চলে। কিন্তু ছবি আঁকার প্রতি ছিল অসীম কৌতুহল। সেই ভালবাসা বড় বয়সে গিয়ে লেখালেখির প্রতি দাঁড়ায়, রোসেলিনির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সিনেমার স্ক্রিন-প্লে লিখতে শুরু করেন। তারপর ছবির পরিচালনা। ফেলিনির বেশ কিছু ছবিতে কেউ কেউ তার নিজের জীবনের শৈশব ও কৈশোরের ছায়া খুঁজে পান, যদিও ফেলিনির কথায় সেগুলো তার নিজের আবিষ্কৃত স্মৃতি, “extrasensory perceptions” দিয়ে। হয়ত স্বপ্ন, হয়ত অবচেতন মনের মনঃস্তত্ব। কিন্তু সুররিয়েলিজম, হ্যালুসিনেশন ফেলিনির সিনেমার ছত্রে ছত্রে। এখানেই তিনি আলাদা। লা ডোলচে ভিটা-কে কেউ কেউ বলেছিল, পাপ। ফেলিনিকে বলা হয়েছিল, জনগনের কাছে পাপী। কিন্তু উনি দমে যাননি, হার স্বীকার করেননি, বরং ‘বোকাচ্চিও’৭০’ নামক এক ছবির ‘টেম্পটেশনস অব ডক্টর অ্যান্তনিও’ পর্বের মধ্যে দিয়ে আবার চাবুক মেরেছেন। চূড়ান্ত স্যাটায়ার। ধর্ম মানতেন না, রাজনীতি পছন্দ করতেন না, টিভি-তে সিনেমা চলাকালীন অতিরিক্ত অ্যাড দেখানো নিয়ে বিরক্ত হয়ে পরিষ্কার বলেছিলেন, “don’t interrupt an emotion”। এক ইন্টারভিউতে সোজাসাপ্টা লিখেছিলেন “I go to church only when I’ve to shoot a scene in church, or for an aesthetic or nostalgic reason. For faith, you can go to a woman. Maybe that is more religious”। তাও ১৭ বার আকাদেমি পুরস্কারের জন্য নমিনেটেড, এবং ৪ বার অস্কার পুরস্কার। ফ্যান্টাসি ও নব্য বাস্তব মেশানো, খানিক বারোক স্টাইল, এই হল ফেলিনি। ‘লা ডোলচে ভিটা’য় যেমন ফেলিনি বলেছেন, আসলে ‘সুইট লাইফ’ বলে কিছু হয় না। পুরোটাই এক মরীচিকা বা প্রহেলিকা। তেমনি ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ ছবিতে এক শিল্পীর জীবনে, যখন সে কিছু করতে চাইছে কিন্তু পারছে না, তার ব্যক্তিগত জীবনেও ঘেঁটে গেছে, কি কি সমস্যা আসে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। জীবনের এক টুকরো, তার মধ্যে দিয়ে অর্থ খুঁজে নেওয়ার অনবদ্য চেষ্টা। ফেলিনির মৃত্যুর পর ওনার বন্ধু এত্তোরে স্কোলা ওনাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি বানিয়েছিলেন ‘হাউ স্ট্রেঞ্জ টু বি নেমড ফেদেরিকো’ - পারলে একবার সময় করে দেখে নেবেন।
ফ্রান্সের দুজন সেরা পরিচালকের মধ্যে একবন্ধু ত্রুফোকে নিয়ে আগের বার বলেছি, এবার অন্যবন্ধু জাঁ-লুক গোদার (১৯৩০-২০২২)। তবে তফাতটাও চোখে পড়ার মত। ত্রুফো যেমন ছিন্নমূল, কেয়ারলেস, গোদার আবার খুব অভিজাত পরিবারের সন্তান, বাবা-মা দুদিক থেকেই। কিন্তু পড়াশুনোয় মন বসেনি। খানিক ছবি আঁকা, লেখালেখি। ত্রুফো যখন ১৯৫৯-এ ‘400 ব্লোজ’ বানিয়ে খ্যাতি পেয়ে গেছেন, গোদার তখনো পায়ের তলায় মাটি খুঁজছেন, হোটেল ঘরে বসে ১০ মিনিটের শর্ট ফিল্ম বানাচ্ছেন। শট কাউন্টার-শট টেকনিক নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। তারপর ব্রেথলেস তৈরি হল। জাম্প কাট, এডিটিং-এর আইলাইন নিয়মানুবর্তিতা না মানা, ঋত্বিক ঘটকের মত শুটিং স্পটে বসে যা মাথায় আসে সেই দিয়ে সিন তৈরি করা, প্রতিদিন সেটে বসে ডায়লগ তৈরি করে অভিনেতাদের হিমশিম খাওয়ানো। এক বিখ্যাত সিন মনে করুন। প্যারিসের রাস্তায় প্যাট্রিসিয়া ‘ট্রিবিউন হেরাল্ড নিউ ইয়র্ক’ বিক্রি করছে। এক লং আনকাট শট। তারপর মাইকেল আর প্যাট্রিসিয়া গাড়িতে চড়ে ঘুরছে। সেখানে পরপর জাম্প-কাট। এত কাছাকাছি যে আপনাকে ভাবতে হবে কোথা থেকে কি হল। এটাই নব্য বাস্তবতা, তারুণ্যের প্রাণশক্তির প্রতীক। কিন্তু এটা ঠিক, ব্রেথলেস রিলিজ হওয়ার পর গোদারকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মোট ৪২টা ছবির মধ্যে ওনার সফল ছবিগুলো মোটামুটি - ব্রেথলেস (১৯৬০), টু লিভ মাই লাইফ (১৯৬২), কনটেম্পট (১৯৬৩), ব্যান্ড অব আউটসাইডার্স (১৯৬৪), আলফাভিল (১৯৬৫), পিরো দ্য ফুল (১৯৬৫), মাসকুলিন ফেমিনিন (১৯৬৬), উইকেন্ড (১৯৬৭), গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৪)। বার্গম্যান গোদারের ছবির কট্টর সমালোচক ছিলেন। তবে সমালোচক রজার এবার্ট গোদারের ব্যাপারে বেশ কিছু কথা বলেছেন, যা আমার মতে মানানসই – “Like Joyce in fiction or Beckett in theatre, he is a pioneer whose present work is not acceptable to present audiences, but his influence on other directors is gradually creating and educating an audience that will, perhaps in the next generation, be able to look back at his films and see that this is where their cinema began.”। একজন সমালোচক হিসেবে এটাই বলতে পারি, একবার দেখে তাঁর সিনেমা বোঝা যাবে না, আমিও বুঝিনি। নিজের মত করে বুঝতে গেলে একাধিকবার দেখতেই হবে। একচোখ বুজে দেখুন, একরকম মনে হবে। অন্যচোখ বুজুন, আরেক রকম ধারণা তৈরি হবে। পিরো দ্য ফুল দেখুন, বুঝবেন, আর্ট-এর সঙ্গে কি কি মিশিয়ে উনি একটা সিনেমার স্ট্রাকচার বদলে দিয়েছেন।
গ্রীসের পরিচালক থিয়োডোর অ্যাঞ্জেলোপাউলোস (১৯৩৫-২০১২) মানে প্রথমেই সাইলেন্ট ট্রিলজি - ভয়েজ টু সিথেরা (১৯৮৪), দ্য বি-কিপার (১৯৮৬) এবং ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট (১৯৮৮)। এছাড়াও দ্য ট্রাভেলিং প্লেয়ার্স (১৯৭৫), আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট (১৯৮০), ইউলিসিস গেজ (১৯৯৫), ইটার্নিটি অ্যান্ড এ ডে (১৯৯৮), দ্য উইপিং মিডো (২০০৪) ওনার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি। প্রশ্ন, অ্যাঞ্জেলোপাউলোসের ছবি কিভাবে আলাদা? কি তার বৈশিষ্ট্য? কিভাবে পৌঁছবেন তাঁর কাছাকাছি? পাঠক, ধরুন, আপনি ক্যালকুলাস বোঝেন। এবং এটা জানেন যে ভগ্নাংশের নিচে হরে যখন খুব ছোট পরিবর্তন হয়, শূন্যের কাছাকাছি, তখন ডিফারেন্সিয়েশন করতে হয়। তাহলে আপনি অ্যাঞ্জেলোপাউলোসের ছবির কাছাকাছি যেতে পারবেন। কারন ওনার ছবিতে খুব ছোট কোন পরিবর্তন, সেটা স্থান বা গতি বা নড়াচড়া হোক, এবং স্লো-মোশনে লং শট, ছবির বৈশিষ্ট্য তৈরি করে দেয়। আবার ধরুন আপনি রিলেটিভিটি জানেন। স্পেস-টাইম ডুয়ালিটি বোঝেন। তাহলে অ্যাঞ্জেলোপাউলোসের ছবিতে একটা শটের মাঝে হঠাৎ যখন অ্যাকশন বা মিউজিক বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি বুঝবেন সেই স্পেস কিভাবে সময়ে পরিবর্তিত হল। জটিল মনে হচ্ছে? না, মোটেও না। এই লেখার ৩১ নম্বর পর্বে ওনাকে নিয়ে কি বলেছিলাম? যার সিনেমায় সূক্ষ্ম চলাফেরা, সূক্ষ্ম বদলে যাওয়া, সূক্ষ্ম সময়ের হেরফের, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সব অদ্ভুত ধরা পড়ে - তিনি হলেন অ্যাঞ্জেলোপাউলোস। লং শট এবং যৌগিক দৃশ্যের জাদুকর। দেখতে বসলে মনে হয় হিপনোটিক এফেক্ট ধরা পড়ছে। ছবি দেখতে বসার আগে এটা মাথায় রাখুন, তাহলেই হবে। ভাবতে অবাক লাগে, যে লং শট নিয়ে শিক্ষকদের সাথে বাদানুবাদের জন্য ছাত্রাবস্থায় ওনাকে সিনেমার কোর্স অপূর্ণ রেখে ফিরে চলে যেতে হয়েছিল, সেই লং শট ওনাকে পৃথিবী বিখ্যাত করল। দেখতে শুরু করুন ‘ইটার্নিটি অ্যান্ড এ ডে’। দেখুন ক্যামেরার দীর্ঘ শরীরি ভাষা কখন সিনেমার ভাষায় বদলে গেছে। শুধু একটাই কথা ছবির পর দর্শকের মনে রয়ে যায় – “Tell me, how long does tomorrow last?”। দেখুন ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’। দুটো বাচ্চা তাদের বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। আর এই জার্নিতে তারা শিখছে ভালবাসা কি, কষ্ট কি, মৃত্যু কি, সত্যি মিথ্যে, সৃষ্টি ধ্বংস, সুন্দর কুৎসিত। জীবনকে খুব কাছ থেকে বুঝতে শিখছে। পুরোটাই ক্যামেরার স্লো লং শটে। আর এজন্যই সমালোচকরা অ্যাঞ্জেলোপাউলোসের ছবির ভাষাকে বলে থাকেন ইটার্নিটি অ্যান্ড হিস্ট্রি।
মাইকেল হেনেকা (১৯৪২-) বললেই অস্ট্রিয়ার সেই পরিচালকের কথা মনে আসে যিনি সাহসী ছবি দ্য পিয়ানো টিচার (২০০১) বা দ্য হোয়াইট রিবন (২০০৯) বা আমোর (২০১২) বানিয়েছেন। কিন্তু তারও আগে হেনেকা তার বুরোক্র্যাসি ট্রিলজির জন্য প্রদীপের আলোয় এসেছিলেন – দ্য সেভেন্থ কন্টিনেন্ট (১৯৮৯), বেনি’জ ভিডিও (১৯৯২) এবং ক্রনোলজি অব চান্স (১৯৯৪)। মুশকিল হল, এরকম শক্তিশালী একজন পরিচালক অস্ট্রিয়ান ছাড়াও ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষাতেও ছবি বানিয়েছেন, দুরন্ত সব ছবি, এবং রিলিজ করেছেন সেইসব দেশে। ফলে ওনাকে কোথায় রাখব বুঝে ওঠা কঠিন। যেমন ধরুন, ওনার ‘দ্য হোয়াইট রিবন’ আমি এই লেখার ১৬ নং পর্বে উল্লেখযোগ্য জার্মান ছবি হিসেবে আলোচনা করেছিলাম। আবার ১৪ নং পর্বে ওনার ‘আমোর’ সেরা ফ্রেঞ্চ ছবির তালিকাতেও রেখেছিলাম। ওনার ডাইভার্সিটি এবং পায়ের তলার সর্ষে এত বেশি যে অস্ট্রিয়ান না বলে ওনাকে ইউরোপিয়ান বলাই বেশি সঙ্গত। যাইহোক, ওনার অন্যান্য নামি ছবিগুলোর মধ্যে ফানি গেমস্ (১৯৯৭), কোড আননোন (২০০০), ক্যাসে (২০০৫) এবং হ্যাপি এন্ড (২০১৭) মনে রাখার মত। ওনার এক বিশেষ দিক হল, ছবিতে সাধারণত নিষিদ্ধ কিছু থাকে, যেমন নিষিদ্ধ যৌনতা, খুন, হিংসা, নেশা ইত্যাদি। একমাত্র ‘আমোর’ সেই ছবি যেখানে উনি এক শক্তিশালী ভালবাসা ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে ওনার কালো দিকগুলো নেই বললেই চলে। আর এইসব শক্ত থিম নিয়ে কাজ করার জন্যই ওনার ছবির ফিনিশিং বেশ ধাঁধাঁলো। ওনার নিজের ভাষায় “Films that are entertainments give simple answers but I think that’s ultimately more cynical, as it denies the viewer room to think. If there are more answers at the end, then surely it’s a richer experience”।এমির কুস্তুরিকা (১৯৫৪-) আমার দেখা আরেক শক্তিশালী পরিচালক যার ছবি আমি প্রথমবার দেখেছিলাম যাদবপুরে পড়াকালীন। আন্ডারগ্রাউন্ড (১৯৯৫)। আমার মতে গত শতকের অন্যতম সেরা সুররিয়েল আর্ট ফিল্ম যা যুদ্ধের পর ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণা ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছিল। পরবর্তীকালে ওনার আরো দুটো সিনেমা দেখেছি – হোয়েন ফাদার ওয়াজ অ্যাওয়ে অন বিজনেস (১৯৮৫) এবং দ্য টাইম অব জিপসিজ (১৯৮৯)। পরের ছবিটা ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে যা আমাকে আরো আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই একুশ শতকে ওনার হাত থেকে আমি আর তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পাইনি, তাই ওনাকে নিয়ে এর বেশি কিছু বলতে চাই না।
তাহলে পাঠক, সিনেমা পরিচালকদের
নিয়ে পরিক্রমা শেষ হল! মোট ৩৩ জন বিশ্বসেরা (আমার বিচারে) পরিচালকের কাজ আমরা তুলে
ধরলাম [ইউরোপ ১৩, হলিউড ১০, বাকি পৃথিবী ১০]। আপনাদের দ্বিমত থাকলে জানাবেন কিন্তু।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন