"...মনে পড়লো বিষ্ণু আর পূরবী"
(এক)
"...অনেক কিছুই চাইনি কিন্তু অনেক কিছুই পেলাম।
যেতে বললো, যাইনি, কিন্তু শেষ অবধি তো এলাম
এই শ্মশানে, কারখানায়,
মানুষ মেরে এরাই নাকি লৌহ ভালো বানায়।
লৌহ বলতে মনে পড়লো বিষ্ণু আর পুরবী মধ্যিখানে বরেন।
আচ্ছা, আপনি কলকাতাতে বসে কী কী করেন…?"
কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় জামশেদপুরে তাঁর যে তিনজন পরিচিত মানুষের উল্লেখ এই কবিতায় করেছেন, তার প্রথম দুজন অর্থাৎ ড: বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী পূরবী মুখোপাধ্যায়ের নাম একসময় ওই ভাবেই হয়তো এই লৌহনগরীতে উচ্চারিত হত। প্রথমে বিষ্ণু, তারপরে পূরবী। আমাদের ছেলেবেলার জামশেদপুরে এই ক্রম অনুযায়ী দুজনের নাম উচ্চারিত হবার একটা কারণও অবশ্য ছিল। শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসেবে এবং নানারকম সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মতৎপরতায় যুক্ত হবার সুবাদে ডঃ ব্রহ্মপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম বাঙালিসমাজে সুপরিচিত ছিল। সেই হিসেবে তাঁর সূত্র ধরেই তাঁর সুযোগ্য পুত্র বিষ্ণুপ্রসাদ ও তাঁর স্ত্রী পূরবীর নাম পর পর আসত। আরো পরবর্তীকালে অবশ্য সাংস্কৃতিক জগতে পূরবীর খ্যাতি ক্রমবিস্তৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপরই যেন পাদপ্রদীপের আলো বেশি করে আসতে থাকে এবং বিষ্ণুপ্রসাদের শান্ত অনুগ্র ব্যক্তিত্ব পূরবীর সেই খরদীপ্তির আড়ালে অনেকটা যেন চাপা পড়ে যেতে থাকে। আমরা যে-সময়টায় বড় হয়ে উঠেছি, সে-সময় তাই স্বাভাবিকভাবেই জামশেদপুরের বঙ্গসমাজে পূরবীর নামটাই আগে উঠে আসা শুরু হয় আর ব্রহ্মবাবু বা বিষ্ণুপ্রসাদের নাম অনেকটা যেন পূরবীর সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্র ধরেই উচ্চারিত হত। এতে কোন অস্বাভাবিকতা না থাকলেও স্বীকার করতেই হবে যে, বিষ্ণুপ্রসাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা ও তৎপরতা সেই সময়টাতে জামশেদপুরে অনেকটা যেন সংকুচিত হয়েই ছিল। যা-ই হোক, আমার এই স্মৃতিচারণা হবে আমার দেখা সেই ক্রম অনুযায়ী অর্থাৎ আগে পূরবী তারপরে বিষ্ণু।
● পূরবী মুখোপাধ্যায় (১৯৩৩-৭৮)
পূরবী মুখোপাধ্যায়কে আমার যে দেখা, সেটা অন্তরঙ্গ যোগাযোগের উষ্ণতা থেকে তো নয়ই, ব্যক্তিগত পরিচয়ের সান্নিধ্য থেকেও নয়। এই দেখাটা হচ্ছে প্রধানত ও প্রথমত বাইরের লোকের দেখা -- অনেকটা নিরাসক্ত ভঙ্গীতে (তবে আবশ্যিকভাবে নিরবেগ নয়) এবং সেটাও জামশেদপুর নামক এক শিল্পশহরের সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডলে বসে দেখা।
এই লৌহনগরীর উক্ত পরিমণ্ডলে আমার যাতায়াত ছিল ছাত্রজীবন থেকেই, বলা যায় আমার জীবনের সেই হাফপ্যান্ট-বেলা থেকে। এখানকার সাহিত্য-মহলে কোনদিনই লোহা লক্করের আওয়াজ খুব একটা শোনা যেত না। সভা-সমিতি-সম্মেলন-চক্র এসব ব্যাপার আর পাঁচটা জায়গার মতো এখানেও ছিমছম টেবিলচেয়ার-বিজলীবাতি -পাখা ও মাইক শোভিত হলঘরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হত। সেখানে আলোচিত হত অন্য যে কোনো সভার মতই গুরুগম্ভীর সব বিষয়! এসব ছবির সঙ্গে পূরবী মুখোপাধ্যায় যে কবে থেকে মিলেমিশে গিয়েছিলেন সেটা ঠিক মনে করতে পারি না। অর্থাৎ সভা-বক্তৃতা-মাইক-আলোচনা সঙ্গে ওই ভদ্রমহিলাও এই 'লৌহপুরী'র বাসিন্দাদের কাছে কবে থেকে যেন অপরিহার্য ও অনিবার্যভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
সেই
সে কতকাল! সেই সব দিনগুলোর সুতোয় গাঁথা হয়ে আছে আমার সোনালী কৈশোর! মনে পড়ে না,
কোন সভায় কবে পূরবী মুখোপাধ্যায়
ছিলেন না! বেঙ্গল ক্লাব, টেগোর সোসাইটি, ইভিনিং ক্লাব বা সবুজ সংঘ -- কোন্ চত্বরে দেখা
যায়নি বিদ্যুৎশিখার মত ঝকঝকে সেই মহিলার প্রবল উপস্থিতি! আর তিনি তো উপস্থিত থাকতেন
সর্বদাই প্রচণ্ডভাবে! যখন শরীরী ভাবে তিনি সভায় থাকতেন তখন তো বটেই, কোন কারণে না আসলেও
আরো ভীষণভাবে বোঝা যেত তাঁর অনুপস্থিতি।
তবে সেসব সভাগুলিতে তিনি থাকতেন না, এরকম কদাচিৎ হত। যে কোন বিষয়ের
অনুষ্ঠান ও আলোচনায় পূরবী মুখোপাধ্যায়কে দেখা যেতই এবং বোঝা যেত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ
কথাটার মানে। আর কখনও বা থাকতেন বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ও। আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের ওইসব সভা-সমিতিতে
যোগদানটা অবশ্য কোন যৌথ ব্যাপার ছিল না। পূরবী মুখার্জী তো আলোচনা-বক্তৃতায় সভা গরম
করে রাখতেন। আর বিষ্ণুবাবু হয়তো সভাপতিত্ব করতেন তাঁর ঠান্ডা ব্যক্তিত্ব নিয়ে। মনে
আছে, তিনি ধৈর্য ধরে সব বক্তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতেন। আর সভার শেষে তার সুন্দর সারসংক্ষেপ
উপস্থিত করতেন। অর্থাৎ দুজনের যেন বিপরীত ভূমিকা -- অনেকটা পরস্পরের পরিপূরক। অবশ্য
এঁদের এই অংশগ্রহণে মনে হত না যে, এ দুজনের উপস্থিতির কোন পূর্বনির্ধারিত যোগাযোগ আছে।
তবে দুজনের চোখ দেখে, প্রবল নিমগ্ন অংশগ্রহণ দেখে আমার কেমন যেন মনে হত, এঁদের মধ্যে
পূর্বেই যেন চুক্তি হয়ে গেছে -- "আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর
ভাঁড়ার"!
(দুই)
"আমি কিন্তু ইচ্ছে করলে রাজ্য বসাতে পারি
এক্ষুনি,
তোমার চোখের সামনে
দেখবে,
দেখবে তুমি
কি
প্রচণ্ড শক্তি আমার
নখের
ডগায়, ঠোঁটের বাঁকে, চোখের কালোয়
চারিদিকে
ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র কুটিলতা
তার
ওপর ফুলের মত পা ফেলে হাঁটতে পারি
আমি,
ক্যাথারিন ডি মেডিসি..."
--
পূরবী মুখোপাধ্যায়
বিষ্ণু আর পূরবী -- জামশেদপুরের সারস্বত জীবনে এই দম্পতি ছিলেন নিজেরাই একটি অচ্ছেদ্য ইতিহাস, দুয়ে মিলে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি কবিতা! সে সময়কালটিকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের এ সম্পর্কে বেশি বলা নিষ্প্রয়োজন। তাই "লৌহ বলতে মনে পড়লো বিষ্ণু আর পূরবী" - সমকালের সেই কবি কিছুটা লঘুভাবে তাঁর কবিতার মধ্যে এমন কথা লিখলেও আমাদের এই লৌহনগরীর অনেক বাঙালির কাছেই লৌহ নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি বলতে ওই যুগলকে মনে পড়াটা তখন কিন্তু অস্বাভাবিক ছিল না। বিশেষত পূরবী! প্রথম দর্শনে অদ্ভুত বুদ্ধিদীপ্ত মুখমণ্ডল চারপাশের সবাইকে যেন সচকিত করে দেয় মুহূর্তে:- 'হুঁশিয়ার'! শ্যামলা অথচ সতেজ অবয়বের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যেত জড়তাহীন একটা প্রখর ও সজাগ মন আর শাণিত একটা ব্যক্তিত্ব, যেটাকে আটপৌরে বঙ্গীয় প্রয়োগে 'দেমাক' বলে মনে হওয়া বিচিত্র ছিল না। এই পোড়া ভারতবর্ষে, যেখানে মেয়ে হয়ে প্রথম সারিতে আসতে চাইলে বা খোলামেলা আলো হাওয়ায় বাঁচতে চাইলে, পুরুষের সঙ্গে সমানে সমানে চলতে চাইলে লোকে তো বাঁকা চোখে দেখবেই! গার্গী মৈত্রেয়ীদের তো আজও অনেকে বইয়ের পাতাতে দেখতেই ভালোবাসেন! শুধু এ কারণেই মনে হয়, লৌহপুরীর নাগরিকসমাজে সেদিন বৃদ্ধ বা বয়স্করা অনেকেই তাঁকে ঠিক পছন্দ করতে পারতেন না। ওই মহিলার নির্ভীক নিঃসংকোচ ভঙ্গী তাঁদের তথাকথিত পৌরুষকে আহত করত কিনা জানিনা, তবে পূরবীর ক্ষেত্রে অবজ্ঞা বা অস্বীকারকেই তাঁরা নিজেদের বয়সোচিত পরিণতির পরিচয় বলে ভাবতে চাইতেন মনে হয়।
আমাদের
ক্ষেত্রে এসব বালাই না থাকলেও ক্বচিৎ বিরক্তি আসত অন্য কারণে। পূরবী সব সভা সমিতিতেই
বাঁধা বক্তা হয়ে উঠেছিলেন আরো কয়েকজনের মতো। আর সেকালের জামশেদপুরের বিচিত্র প্রথা
যেমন, যে কোন সভায় যে কোন বিষয়ে বলার জন্য এই বাঁধা বক্তাদের খুঁচিয়ে তোলা হবেই এবং তাদের সেসব বিষয়ে কিছু বলার না থাকলেও, এমনকি জানা না থাকলেও তাঁরা বলবেন। বস্তুত অনেক বক্তা মুখিয়ে থাকতেন এবং এদের বাইরে সত্যি কারও কিছু বলার থাকলেও সে কথা শোনার কারো আগ্রহ থাকত বলে মনে হত না। আলোচনাচক্র নাম দিয়ে যে-অনুষ্ঠানগুলো এখানে দীর্ঘদিন ধরে হয়ে এসেছে সেখানে এই তামাশা দেখে এসেছি আশৈশব!
পূরবীর
ক্ষেত্রে অবশ্য না জানার প্রশ্ন ততটা ছিল না, তবে তিনিও প্রথম প্রথম বলার ডাক পেলে
বেশ উৎসাহের সঙ্গে সাড়া দিতেন এবং স্বতঃস্ফূর্ত বলার ক্ষমতা তো তাঁর ছিলই। আমাদের
মনে হত, সে ক্ষমতার প্রকাশে তাঁর কোনোরকম মিতব্যয়িতা ছিল না। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে
যাবার স্বাধীনতা বেশি পরিমাণে নেওয়া হত। ফলত পূরবী কথায় কথায় চলে যেতেন কাফকা-ক্যামু-ভালেরি-মালার্মে-বোদল্যেয়ারে
অনেকটা যেন অবধারিত ভাবেই। আমার সেই বয়সের বিচারে মনে হত, প্রসঙ্গ-বিষয়ের নিরিখে সেই আলোচনা সবসময় জরুরি ছিল না। সে কারণে এটাকে
অধীত বিষয়ের পরিধি জাহির করার একটা চেষ্টা বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না।
মনে
আছে, একবার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক এক আলোচনাচক্রে আমন্ত্রিত সভাপতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
এক অধ্যাপক বক্তাদের ওরকম প্রসঙ্গ বিচ্যুতির বাড়াবাড়ি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিচারের কষ্টিপাথর কিছু বিশেষ ফরাসি বা জার্মান সাহিত্যিককেই
হতে হবে এই জবরদস্তি মেনে নিতে অসুবিধা হত। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এই জাতীয় সভা সমিতি
ও সাহিত্যচর্চার প্রতি কোন্ বিতৃষ্ণা থেকে পরে এই লোহা-শহরে 'কৌরব'-এর মতো সম্পূর্ণ
পৃথক ধরনের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। আরেকটা কথাও মনে হয়। এই প্রথাগত সাহিত্যচর্চার সংস্কৃতি
সম্পর্কে ক্রমসঞ্চিত বিরাগ ও বিরক্তি থেকেই পুরবীও হয়তো বেশি করে সেই সব বেখাপ্পা
তরুণদের গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।
শেষের
দিকে একটা সভার কথা মনে পড়ছে। বেঙ্গল ক্লাবে এক সকালবেলা কলকাতা থেকে সাহিত্যিকরা
এসেছেন। বোধহয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছিলেন আরও কে কে যেন! মনে আছে পূরবীকে তাঁর
ভক্তরা মাঝে মাঝে মাইকের সামনে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন আর তিনি বিরক্ত হয়ে ইশারায়
'না' বলছেন! অবশেষে দাঁড়াতে অবশ্য তাঁকে হয়েছিল। তবে মনে হয়েছিল অত্যন্ত অনিচ্ছায়।
চেহারায় ফুটে উঠেছিল ক্লান্তি! পূরবীর মতো মহিলারা পাদপ্রদীপের সামনে দাঁড়াবার জন্যই
আসেন, তবে দশ বছরের মধ্যে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে এই তফাৎটুকু এসে গিয়েছিল। কোনো অবসাদের
মুহূর্তে এই বিষণ্ণ বিবিক্ততাই কি তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল নীচের লাইনগুলো?
"আমাকে জলের অতলে তলিয়ে যেতে দাও--
কারণ
জল ভাসায় আবার রাখেও।
লম্বা
দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি --
কাঁচ
বেঁধানো দেওয়াল রক্তাক্ত পা
এই
মুহূর্তে আমাকে ঝর্ণার আরাম
অনুভব
করতে দাও।।"
[তিন]
●"প্রিয় হেমন্তের ঊষা, তুমি জানো সে এখানে ছিলো।
প্রিয়
হেমন্তের ঊষা, তুমি জানো এত ভোরবেলা ঘুম ভেঙে কখনো উঠিনি আমি,
কখনো
দেখিনি এমন মায়াবী চাঁদ হিমে ভেজা তোমার আকাশে।
আমি
স্পষ্ট টের পাই, এইমাত্র সে এখানে ছিলো।
ওই
শুকতারা জানে, তুমি জানো, তোমার নীলিমা --
প্রিয়
হেমন্তের ঊষা, তুমি জানো, সে এখানে ছিলো,
তার
দুঃখহীন বাঁচা, স্মৃতিময় স্বপ্নময় দিন
তরল
আলস্যময় যেন দূর বনে পাতা ঝরা
যেন
হেমন্তের ঊষা, প্রিয় হেমন্তের ঊষা, তুমি।।"
--তারাপদ
রায়
মনে আছে, মাঝে কিছুদিন পূরবীকে জামশেদপুরের সভা সমিতিতে দেখা যায়নি। একদিন কারও কাছে শুনলাম, পূরবী মুখার্জি হাসপাতাল রয়েছেন। মারাত্মক একটা রোগের নাম শুনলাম। বেশ মনে পড়ে, ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় তখন পর্যন্ত না থাকা সত্ত্বেও মনে যে ভাবটা ঝাপটা মেরেছিল সেটা বিষাদেরই! কী জানি সেটা সংস্কার কিনা! অর্থাৎ জামশেদপুরের সারস্বত পরিমণ্ডলের চেনা ছবিটার একটা অবিচ্ছেদ্য উপাদান দেখতে না পেয়ে ছবিটা ক্ষুন্ন হবার আশঙ্কা যেন! পরে আবার যখন তাঁকে দেখা যেতে লাগল, মনটা আবার সেরকমই অনির্দেশ্য কারণে কেমন যেন খুশিয়াল হয়ে উঠেছিল। আপাতদৃষ্টিতে এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কারণ তখনও তাঁর সঙ্গে আমার কোন ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না।
ব্যক্তিগত
পরিচয়ের কথা যখন উঠেই এল তখন সেই সূত্র ধরে আমার সেই স্বল্পপরিসর স্মৃতিটুকু এখানে
রোমন্থন করাই যেতে পারে যদিও দিন মাসের হিসেবে সেটির পরিমাণ হবে যৎসামান্য ছ সাত মাসের
বেশি নয়।
সেটা ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। একদিন বন্ধু অরিন্দম গুপ্ত (বাবলা) আমার বাড়িতে এসে জানাল, বেঙ্গল ক্লাবে ‘কৌরব' আর 'উদ্দীপ্ত' — জামসেদপুরের এই দুই পত্রিকার উদ্যোগে বেঙ্গল ক্লাবে এক কবিতা-আসরের আয়োজন করা হয়েছে, আমাকে ছাপানো আমন্ত্রণপত্রও ধরিয়ে দিল। কার্ডের নীচে রয়েছে সতর্কীকরণ: "নিয়মিত কবিতা পাঠ না করা সামাজিক অপরাধ''। নির্দিষ্ট দিনে সভাস্থলে পৌঁছে দেখি জমজমাট আয়োজন, শহরের নামী শিল্পী, গুণী আবৃত্তিকারেরা উপস্থিত। কৌরবের একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, দাম এক টাকা লেখা থাকলেও পাঁচ টাকায় সেটি বিক্রি করা হচ্ছে 'সাহায্য' হিসেবে। ঘোষকের ভূমিকায় কমল চক্রবর্তী। তিনি তখন এমনিতেই অমিতবাক্, তার ওপর হাতে মাইক পেয়েছেন! আমার মনে হচ্ছিল কবিতাপাঠের আসরে এত ভীড়! জামশেদপুরে আশ্চর্য ঘটনা বটে।
সভায়
স্বরচিত এবং পররচিত কবিতা আবৃত্তি করা হচ্ছিল। কিন্তু নিয়মটা বেশ অদ্ভুত, স্বরচিত
কবিতা খাতা বা পান্ডুলিপি দেখে পড়া যাবে কিন্তু অপরের রচিত কবিতা বই দেখে পাঠ করা
চলবে না, স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে হবে! এসবের মধ্যেই কমলের ঘোষণা আর ভাষণ ও গানের
নাম করে অদ্ভুত চীৎকার চলছিল। বেশ কয়েকজন ভালো আবৃত্তি করলেন, এক যৌথ আবৃত্তিতে (সুধীন
দত্তের 'শাশ্বতী') বাবলা গুপ্ত ও পুরবী মুখোপাধ্যায়কে দেখা গেল। এর মধ্যেই হঠাৎ আমাকে
অপ্রস্তুত করে কমল কবিতা বলার জন্য আহ্বান করে বসলেন ও আমাকে ‘গুপ্ত' কবি’ বলে (হায়
ঈশ্বর গুপ্ত!) বিশেষিত করলেন! "কে একজন 'দেশ' পত্রিকায় মাঝে মাঝে বিতর্কিত চিঠি
লেখে" - আমার সম্পর্কে কমলের এমন উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গেই পূরবীর চীৎকার – ‘'কোথায়
সে? তাকে দেখতে আমাদের ভীষণ ইচ্ছে।''
আমার কোনো কবিতা পুরোটা মুখস্থ না থাকায় আমি মৃদু আপত্তি জানাতে থাকি, কিন্তু তা গ্রাহ্য হয় না। বাবলা, পূরবী - এঁরা একরকম ঠেলেই আমাকে মঞ্চে তুলে দেন। কবিতা মুখস্থ বলা যে আমার পছন্দ নয় -- একথা বলেও অগত্যা মঞ্চে উঠে আমাকে জানাতে হল, আমি শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করার চেষ্টা করব। পূরবীর তখনই পরপর প্রশ্ন বা মন্তব্য:- "কোন কবিতা?" 'বাবরের প্রার্থনা'? ''ভালো। এবার একাডেমী পেয়েছে'' ইত্যাদি। কবিতাটি আবৃত্তির চেষ্টায় আমি মাঝে মাঝে আটকে গেলেই সামনের সারি থেকে পূরবী উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন। সেদিন আমি ছিলাম সর্বশেষ কবিতা-বলিয়ে। এরপর পূরবী মাইকের সামনে গিয়ে 'বাবরের প্রার্থনা' কবিতাটি সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন। এছাড়া আর কী কী বলেছিলেন, সভার হট্টগোলে আমার শোনা হয়নি ভালো করে। সভা ভাঙার পর বিদায় নেবার সময় তিনি আমার কাছে এসে বলেছিলেন, "তুমি আমার বাড়িতে নিশ্চয়ই যাবে কিন্তু। একা যেতে ভয় পেলে বাবলাকে নিয়ে যেও।" এরপর সেখানে দাঁড়িয়েই কিছু কিছু কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, এর আগে বহু বছর ধরে আমার লেখা নানা চিঠিপত্র দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখে তিনি নাকি আমার অনেক খোঁজ করেছেন। এছাড়া বলেছিলেন, "চিঠিগুলো বেশ পড়াশোনা করে লেখা বোঝা যায়। আমি তো ভেবেছিলাম কোন বয়স্ক লোক হবে!" তারপর আবার আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, "অবশ্যই আমার বাড়িতে যাবে। তোমার থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার আছে, শেখার আছে।" এই শেষ কথাটিতে আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছিলাম, অর্ধস্ফুটভাবে এই উচ্চ ধারণার প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম আর পুরস্কৃত হয়েছিলাম তাঁর সর্বশেষ মন্তব্যে, "আজকের সম্মেলনে আমার সবচেয়ে বড় লাভ অলকরঞ্জন বসু চৌধুরী"!
পূরবীর
বাড়িতে যাবার ব্যাপারে সেদিন আমি স্বীকৃত হলেও আমার অবশ্য তাঁর জীবনকালে ওই বাড়িতে
যাবার আর সুযোগ হয়নি।
(চার)
●"বাইরে যাচ্ছো? যাও।
তুমি
অনেকদিন আমাদের সঙ্গে ছিলে।
জানতে
ইচ্ছে করে,
কার
কার কবিতার বই
পোর্টম্যান্টো
ভরে নিয়ে চলে যাচ্ছো আশ্চর্য প্রবাসে;
ঈর্ষা
হোক --
তবু
সেই ভাগ্যবান কবিদের নামগুলো বল।
বাইরে
যাচ্ছো? যাও।
তুমি
অনেকদিন আমাদের সঙ্গে ছিলে।"
--- অমিতাভ দাশগুপ্ত
পূরবীর বাড়িতে যাবার সুযোগ না হলেও কবিতা-সভার কয়েকদিন পরেই কমলের এগ্রিকোর কোয়ার্টারে এক সান্ধ্য পাঠচক্রে কৌরবের আরও কিছু সদস্যের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমার ডায়েরি বলছে, সেদিন ছিল ১০ই জানুয়ারি ১৯৭৮। সেই সভায় বারীন ঘোষাল, শংকর লাহিড়ী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, শম্ভু লাহা, ও এরকম কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন।
দেশ
পত্রিকায় প্রকাশিত আমার চিঠিপত্র পড়ে এর আগে তিনি কীভাবে আমার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা
করেছেন, আমার সঙ্গে আলাপের সূত্রে সেই প্রসঙ্গ উঠল। তিনি আমার বাবা ও মা'র নাম জিজ্ঞাসা
করলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, ''চিন্ময়ী বসুচৌধুরী তোমার কে হন?" আমি জানালাম,
তিনি আমার ছোট ঠাকুমা অর্থাৎ বাবার ছোট কাকিমা। পূরবী দি' বললেন, তিনি নাকি আমার এই
ঠাকুমার কাছ থেকেও আমার হদিশ পেতে চেষ্টা করেছেন। কৌরব-এর ছেলেদেরও এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা
করেছেন।
প্রসঙ্গত,
জামশেদপুরে আমাদের বৃহত্তর বসুচৌধুরী পরিবারের তিনটি অংশ বসবাস করত। আমার দাদু ক্ষিতীশচন্দ্র
বসুচৌধুরী ও তাঁর কনিষ্ঠ দুই ভাই অর্থাৎ আমার মেজ দাদু ও ছোট দাদু পূর্ব বাংলা থেকে
জীবিকার সন্ধানে এসে এই জামশেদপুরেই স্থায়ী হয়েছিলেন আমার জন্মেরও আগে। আমাদের মতোই
বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের পরিবারও ছিল তিন পুরুষ যাবৎ জামশেদপুরের বাসিন্দা। সেই সূত্রে
জামশেদপুরে বাঙালি উপনিবেশের সেই আদি যুগে বসুচৌধুরীদের কোনো কোনো শাখার সদস্যদের সঙ্গে
এঁদের পূর্ব পরিচয় ছিল স্বাভাবিকভাবেই। এই ইতিহাস কিছুটা বলবার পরও পূরবীদির ধন্দ কাটছিল
না। এই ধন্দের কারণ আমার ছোটদাদুর মেয়ের (অর্থাৎ আমার পিসি) নাম ছিল কৃষ্ণা, যাকে পূরবী চিনতেন। আমার মায়ের নামও
কৃষ্ণা, এ কথা শুনে উনি সম্পর্ক ও বয়সের হিসেব মেলাতে পারছিলেন না। আমি তখন জানিয়েছিলাম,
তিনি আমার মায়ের চেয়ে বযছোট হলেও ঘটনাচক্রে দুজনের নামই এক। (ইতিমধ্যে আমাদের পরিবারের এইসব গল্প শুনতে শুনতে কেউ একজন টিপ্পনিও কেটেছিলেন
:- "বসুচৌধুরী খানদান"!)
যা-ই
হোক, সেদিনের আসরে কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, শংকর লাহিড়র স্বরচিত কবিতা পাঠ আর
অরিন্দম গুপ্তের কবিতা আবৃত্তি শোনা গেল। আর শম্ভু লাহা পড়লেন ভ্রমণকাহিনী। আমি ‘দুই
অরবিন্দ' নামে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম, যাতে আশ্রমগুরু শ্রীঅরবিন্দের কিছু রাজনৈতিক
মন্তব্যের কঠিন সমালোচনা ছিল। একমাত্র পূরবীই এই লেখাটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন আর আমরা
গরম সিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে শুনেছিলাম মনে আছে।
অরবিন্দ
যে-সময় চরমপন্থী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তখনকার নিরিখে তাঁর পরবর্তী যোগী-জীবনের নানা
মতবাদের বৈপরীত্য প্রসঙ্গে আমার বক্তব্যের সূত্রে পূরবীদি উনিশ শতকের বাঙালি মনীষীদের,
বিশেষত ডিরোজিয়ানদের জীবনের নানা অসঙ্গতির কথা তুলেছিলেন। আমি এই দুই জাতীয় বৈপরীত্যের
তফাৎ নির্দেশ করার চেষ্টা করেছিলাম। অরবিন্দ প্রসঙ্গে গুরুবাদ নিয়েও কিছুটা আলোচনা
হয়েছিল মনে আছে। পূরবীদি বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের মধ্যেই গুরুবাদের প্রচলন দেখে দেখে
তিনি বহুদিন ধরে এ ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত। অবশ্য এই পরিবার বলতে তিনি তাঁর বাপের বাড়ি,
না শ্বশুর বাড়ি -- কোন পরিবারের কথা বুঝিয়েছিলেন বলতে পারব না।
আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়ে অবশ্য এই আসরের আর কারও তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয়নি। এই সূত্রে কমলের প্রশ্নটিও আমার মনে আছে -"আপনি সাহিত্যিক বিষয়ে লেখেন না!" আমি অবশ্য উনিশ-বিশ শতকে আমাদের রেনেসাঁর পুরো ইতিহাসটাকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, সেটাকে রাজনীতি, ধর্ম বা সাহিত্য এ জাতীয় আলাদা আলাদা খোপে ভরে সঙ্কুচিত করে নয়। (অবশ্য ওই প্রশ্ন সত্ত্বেও তাঁদের পত্রিকা কৌরব-এ লেখার জন্য কমল আমাকে অনুরোধ করেছিলেন)।
আমার
তখনকার ডায়েরী থেকে দেখা যাচ্ছে, সেদিন আড্ডার সূত্রে সদ্যবিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সঞ্জীব
চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গও উঠেছিল। দেখা গেল, আমার মতো পূরবীদিও এঁর লেখা পছন্দ করেন।
অন্যান্য আলোচনার মধ্যে কৌরবের আর্থিক অনটনের প্রসঙ্গও ছিল এবং তার থেকে অনিবার্যভাবে
এসেছিল পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড় করার কথাও। এই প্রসঙ্গে কোন শাঁসালো গোষ্ঠীর
কথা উঠতেই পূরবী সেখানে বিজ্ঞাপন চাইতে বারণ করেছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে ওই গোষ্ঠীর
এই মন্তব্যের উল্লেখ করেছিলেন :- "পূরবী কতগুলো চ্যাংড়া ছেলের সাথে মিশে নিজেকে
নষ্ট করছে!"
এরপর
এক বনভোজনের পরিকল্পনার কথা উঠেছিল। পিকনিকের প্রস্তাবিত দিনটিতে আমি থাকতে পারব না
বলে আমি নীরব ছিলাম আর ওই কথাবার্তা বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করছিলাম না। এ ব্যাপারটা লক্ষ
করে পূরবীদি অন্যান্যদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "তোমরা অলককে কিছু জিজ্ঞাসা করছ না
কেন ওর সুবিধা অসুবিধার কথা!"
সেই
আসরে উপস্থিতজনদের মধ্যে সেদিন পূরবী ছিলেন একমাত্র মহিলা, তবু সবার সঙ্গে মিশে যাবার
তাঁর সাবলীল ক্ষমতা আমার মনে একটা মুগ্ধতা ও বিস্ময়ের রেশ এনে দিয়েছিল। সেখানে রঞ্জিতদা
ছাড়া আর প্রায় সকলের সঙ্গেই তাঁর বয়সের অনেকটাই ব্যবধান ছিল। তাঁর ও রঞ্জিতদার পারস্পরিক
কথাবার্তার মধ্যেও যে সহজ বন্ধুত্বের ভাষা ফুটে উঠেছিল সেটা আমার মনে এখনো উজ্জ্বল
হয়ে আছে! (পূরবী- স্মৃতিসংখ্যা কৌরব-এ একটি আশ্চর্য সপ্রতিভ স্মৃতিকথা লিখেছিলেন রঞ্জিতদা!) এই ছিল পূরবীদির সঙ্গে আমার শেষ আলাপ। সেদিন ফিরে
আসার সময় তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে আসা হয়নি, কারণ তখন তিনি কমলদের ঘরের ভেতর চলে গিয়েছিলেন।
আমার ডায়েরিতে ওই বছরের ১৪ই মে' রবিবার আমবাগান স্কুলের প্রাঙ্গণে কৌরব-দের (কৌরব পত্রিকা গোষ্ঠীর ছেলেদের তখন কৌরব বলে উল্লেখ করার চল ছিল) উদ্যোগে ভুবনমেলার আয়োজনের উল্লেখ আছে। সেটি ছিল প্রথমবারের ভুবনমেলা। তাতে ছবি ছিল, পত্রিকা ছিল, বই ছিল, খাবার ছিল, পালকি ছিল বাউল ছিল, বটতলায় নাটকও ছিল। কিন্তু ওখানে গিয়েও দেখতে পাইনি 'কৌরব'দের সেই প্রাণ-প্রতিমাকে! মনে হয়তো আশা ছিল যে পূরবীদিকে দেখতে পাব, কিন্তু শুনলাম যে, তিনি অল্পক্ষণের জন্য এসেছিলেন, শরীর খুব অসুস্থ থাকায় কিছুক্ষণ পরেই ফিরে গেছেন বাড়িতে।
এরপর ডায়েরির পাতা যে-দিনটিতে নিয়ে যাচ্ছে সেটি ১৫ই জুলাই ১৯৭৮ শনিবার। কৌরবের ২১ তম সংখ্যা হাতে পাওয়া গেল। পত্রিকাটি অরিন্দম গুপ্তই আমাকে বাড়িতে এসে দিয়ে যান। মলাটে টাটা কারখানার স্কেচ, ভেতরে লেখা ‘জামশেদপুর বিশেষাঙ্ক', (বাংলা পত্রিকায় হিন্দি ধরনের এই ‘বিশেষাঙ্ক’ শব্দটা অবশ্য আমার পছন্দ হয়নি) এবং উৎসর্গে লেখা - 'জামশেদপুরের সাহিত্য-বিপ্লবী পূরবীদির হাতে'!
(পাঁচ)
● "...সমস্যার খুলতে হবে জট
চতুর্দিকে
আমূল পালটাতে হবে দৃশ্যপট
বৃদ্ধ
যাতে ভোলে শোক
হাসতে
হাসতে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠে সমস্ত বালক
আর
মাছি না পড়ে কারো ভাতে
তারই
জন্য দিনে রাতে
ছুটতে
হবে গ্রামে গঞ্জে সমস্ত জায়গায়
আয়
।
এই
আমার শেষবারের মতো ছুটে যাওয়া। ভোরবেলার হাওয়া
পাগলা
ঘন্টি বাজাতে বাজাতে এসে বললো তুমি কাকে
ডাকছো
সে তো সুবর্ণরেখার বাঁকে
মিলিয়ে
গেছে আমরা কজন
তাকে
নিয়ে তরঙ্গে দিয়েছি বিসর্জন
তার
প্রগল্ভ হাসি আর বাজবে না কখনো কোনখানে
শ্রাবণের
বৃষ্টি ধারা আনে
অশথ
পাতার
ঝরঝর
গানের শব্দ জানালার
পর্দাটা
সরালে
দেখা
যায় জামরুলের ডালে
খেলা
করছে তিনটে চারটে পাঁচটা ছ'টা পাখি
তবু
তাকে ডাকি, আজও ডাকি আসবে না জেনেও তাকে ডাকি।"
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
অরিন্দমের মারফত কৌরবের একুশ-তম যে-সংখ্যাটি আমার হাতে এসেছিল, সেটিতে আমার একটি প্রবন্ধ ছিল। কৌরবের পাতায় আমার এই প্রথম লেখাটিকে কে কীভাবে নিয়েছিলেন জানি না, তবে পূরবী এটি সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন বা আদৌ লেখাটি দেখেছিলেন কিনা, কেন জানি না সে কথা জানবার জন্য আমার মনে কিছুটা কৌতূহল ছিল। জামশেদপুরের সভাসমিতির গড্ডলিকায় কৈশোর থেকেই তুখোড় বক্তা ও তীক্ষ্ণচেতা এই মহিলাকে দেখেছি, তাঁর মন্তব্যে মনোযোগ না দেওয়াটা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এ কারণে তাঁর প্রতি এক ধরনের যে-সমীহ অবচেতনায় সঞ্চিত ছিল, তা থেকেই হয়তো তাঁর মতামত সম্পর্কে ঐ বিশেষ কৌতূহল জন্মে থাকবে।
পূরবী
মুখোপাধ্যায়কে উৎসর্গীকৃত এই সংখ্যায় স্বয়ং পূরবীদি'রও একটি লেখা ছিল ("যেখানে
শালের সমারোহ")! বস্তুত এই সংখ্যাটির সব লেখকই ছিলেন জামশেদপুরের এবং আমার ধারণা,
আমার মতো আরও অনেকেরই এই সংখ্যাটিতেই তাঁদের এই পত্রিকার প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিল
(যেমন অরিন্দম গুপ্ত বা শঙ্কর লাহিড়ী)। পূরবীর ক্ষেত্রে অবশ্য এই সংখ্যায় ছিল তাঁর
শেষ লেখা। এখানে লেখাটি থেকে কিছু অংশ যদি এখানে তুলে দিই, তা হলে বোঝা যাবে কী রকম
ঋজু ও স্বাদু ছিল তাঁর গদ্য, যা তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খুব মানানসই।
● "এখানে শালের সমারোহ। কেঁদ, মহুয়া, করমের ছড়াছড়ি।একদিকের আকাশ জুড়ে দলমা, ভ্যালাই পাহাড়ী, টোগো পাহাড়ের সীমারেখা, উত্তরে সুবর্ণরেখার রূপোলী উঁকিঝুঁকি। বছরে তিনমাস পলাশের দাবানল। তারই মধ্যে পাহাড় কেটে শহর। বিশাল এক কারখানাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বিচিত্র এক জনপদ; যার আদি, মধ্য এবং অন্তে ওই কারখানা। এ শহরের মেজাজে কবিতা কোথায়!..."
পূরবী জামশেদপুরের মেয়ে ছিলেন না, এ শহরে এসেছিলেন বউ হয়ে -- কিন্তু তবু এখানকার ইতিহাস ভূগোল সবকিছুতে তিনি কী রকম দুরস্ত ছিলেন সেটাই লেখাটিতে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এখানকার মাটি ও মানুষের প্রতি অনুচ্চার এক ভালোবাসা:- "বিভূতিভূষণ ছিলেন পাশের শহর ঘাটশিলায়। জামশেদপুরকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে আশপাশের সব বনজঙ্গলে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ, বিশেষ করে সারান্দার জঙ্গলে। এদিকের প্রতিটি ঘাস পাতা, ফুল-ফলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কথা, কত মমতায় তিনি লিখেছেন। বিভূতিভূষণ স্বভাবতঃ অরণ্যপ্রেমিক, এই নির্জন শ্যামলিমায় ঈশ্বর তাঁর কাছে প্রকাশ হতেন। কিন্তু ছোটনাগপুরের অরণ্য বোধহয় অবিশ্বাসীকেও টানে। আজকে যাঁরা কবিতা আন্দোলনের পুরোভাগে, সেইসব প্রতিষ্ঠিত কবিকেও এ অঞ্চল বারে বারে টেনেছে।
"বিশেষ
গল্পকাররা অনেক সময় পশ্চিমে বেড়াতে এসেছেন। ‘পশ্চিম’ শিমুলতলা, মধুপুর, ঝাঝা ইত্যাদি
থেকে গালুডি, ঘাটশিলা, জামশেদপুর, রাঁচীকে ঘিরে সুদুর পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত। এই
ছোটনাগপুর ছিল তাদের বিশেষ প্রিয় পটভূমি।"
এছাড়াও
পুরবীর লেখার ছত্রগুলির ফাঁকে ফাঁকে ঠিকরে উঠেছে তাঁর অসামান্য রসবোধের হীরকদ্যুতি
:- "হায় সেইসব বিদ্যুৎলতার মত নায়িকারা আজ কোথায়! যাঁরা বাঁকা সিঁথি কেটে লম্বা
বেণী বাঁধতেন, হেলিওট্রাপ রঙের শাড়ী পরতেন, (কোনো অজ্ঞাত কারণে উজ্জ্বল হলুদ রঙ লেখা
হতো না) চাঁপার কলির মত আঙুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে রাখতেন মরক্কো বাঁধানো শেলী, কীটস্ কিংবা
ব্রাউনিং-এর কবিতার বই। তাঁরা যখন এখানে বেড়াতে আসতেন, প্রায়ই তাঁদের জীবনে একটি
অঘটন
ঘটে
যেত। শালবনের পথে কিংবা কোনো টিলার চূড়োয় তাঁরা কোনো বিপদে পড়তেন এবং পায়ে লাল
মখমলের চটি থাকায় দৌড়তে পারতেন না। এই সংকট থেকে তাঁদের বাঁচাতেন নায়ক।...."
(ছয়)
●"অন্ধকার বলেছিল - এসো।
কবিতা
ডেকেছে -- কাছে আয়।
পক্ষপাতহীন
পদক্ষেপ
দু-নৌকায়
রাখার আগেই
সাঁড়াসাঁড়ি
উচ্চণ্ড জোয়ারে
আমাদের
কৃষ্ণা ভেসে যায়।"
-- অমিতাভ দাশগুপ্ত
অরিন্দমের থেকে পত্রিকাটি হাতে পাবার সময়ই জানতে পারি যে, পূরবী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছেন। সেদিন বিকেলে কৌরবের ছেলেদের সঙ্গে রওনা হয়েছিলাম মেহেররবাই ক্যান্সার হাসপাতালে। তখন প্রচুর হাঁটতাম, আমরা পায়ে হেঁটেই রওনা হয়েছিলাম। সাকচিতে পৌঁছে দেখি, স্থানীয় ভিক্ষাজীবীদের রথের শোভাযাত্রা বেরিয়েছে। যারা কাঁধে সুসজ্জিত ডুলি নিয়ে জগন্নাথের উদ্দেশে নাচ গান করছিল, তাদের চোখেমুখে ভক্তি ও অঙ্গভঙ্গীতে শিল্পের অভিব্যক্তি দেখে কমল চক্রবর্তী মুগ্ধ! বারবার বলছেন, "দেখুন, ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এরা সবাই আর্টিস্ট!'' সত্যিই তো শিল্প তো জীবনকে ছাপিয়ে যায়! কথায় বলে, 'আর্স লঙ্গা, ভাইটা ব্রেভিস!
● ডায়েরি -১৫ই জুলাই ১৯৭৮ শনিবার:-
আমরা যখন মেহেরবাই হাসপাতালে পূরবীদির কেবিনের সামনে পৌঁছই, তখন তাঁকে প্রচুর লোক ঘিরে ছিলেন। এক ঝলক সেই সাক্ষাতে তিনি আমাকে দেখে পরিচিত ভঙ্গীতে অল্প হেসেছিলেন, আবছাভাবে এরকম মনে হলেও আমাকে তিনি সত্যিই চিনতে পেরেছিলেন কিনা জানিনা। শুনেছিলাম তখন চোখের তিনি আবছা দেখেন, একবার কী যেন বলতে গেলেন, সবাই থামিয়ে দিল, কথা বলা বারণ।
শুভানুধ্যায়ীদের
ভিড়ে বেশিক্ষণ রোগশয্যার পাশে দাঁড়াতে পারিনি, কৌরবের লেখা সম্পর্কে আলোচনা দূরস্থান,
তিনি আমার লেখাটি দেখেছেন কিনা সেকথা জিজ্ঞাসা করারও তখন সুযোগ ছিল না।
হাসপাতালের
বাইরে এসে দেখি প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম, যেন মেলা বসেছে! যাঁদের আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল, তাঁদের
কয়েকজন ছিলেন ধীরাজ জানা (নাট্য সমাচার পত্রিকার সম্পাদক), বাদল গুপ্ত (সঙ্গীতশিল্পী
মীরা গুপ্তের স্বামী) প্রদীপ গাঙ্গুলী (চিত্রশিল্পী ও নাট্যকর্মী) আর ড: বিষ্ণু মুখার্জি।
সত্যিই
মেলা, কারণ সমাগতদের মধ্যে যতটা যান্ত্রিকতা ততটা আন্তরিক দুঃখ নেই, এমনটাই আমার মনে
হয়েছিল। পত্রিকার আলোচনা পরিকল্পনা হাসিতামাশা সব চলছে! শংকর লাহিড়ীর স্কুটারে সাকচির
দিকে ফিরতে ফিরতে এসব কথাই মনে হচ্ছিল। বুঝেছিলাম নীরবে নির্বাপনের জন্য অপেক্ষা করতে
হবে ভয়ংকর রকম সরব একটা জীবনকে! গোলাপী পোষাকে ঢাকা তাঁর সেই শায়িত শেষ ছবিটি আমার
মনে আজও আঁকা রয়ে গেছে। গোলাপী তো জীবনেরই স্বাক্ষর!
● ডায়েরি ১৯শে জুলাই ১৯৭৮ বুধবার:-
মনে পড়ে গেল, আমাকে আসতে বলেছিলেন এই বাড়িতে আলাপ আলোচনা আড্ডার জন্য। কিন্তু এ বাড়িতে তাঁর কাছে এই প্রথম এলাম শেষবারের মতো। অনুষ্ঠানিক যান্ত্রিকতায় কমল চক্রবর্তী, বাবলা, বাজী প্রভৃতির সঙ্গে মাল্যার্পণ ইত্যাদি সমাধা করে ফিরে এলাম। শুনেছিলাম, শ্মশানে নিয়ে যেতে দেরি হবে। বিকেলে শ্মশানে গিয়ে দু'ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে এলাম, ওরা কেউ পৌঁছয়নি।
পূরবীর মৃত্যু হয় জুলাইয়ে ও তাঁকে স্মরণ করে কৌরবের ২৩-তম সংখ্যাটি বের হয় ১৯৭৮-এর ডিসেম্বরে। তাঁর স্বামী ডা. বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় পূরবীর শেষ দিনগুলোর বর্ণনা দিয়ে একটি দীর্ঘ রচনা এই সংখ্যায় লেখেন, তাতে কৌরবের জামশেদপুর সংখ্যাটি সম্পর্কে এরকম উল্লেখ ছিল:- "কৌরবের ২১-তম সংখ্যা বেরুলো। হাতে নিয়ে ঐ অবস্থাতেই উৎসাহে উঠে বসেন পূরবী। উল্টে পাল্টে দ্যাখেন। মতামত দ্যান। ‘বাঃ, অলকের লেখা বেরিয়েছে? Rope in করতে পারলে তা হলে? নতুন লেখক এলো গোষ্ঠীতে?' প্রায় শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ..."
যদিও
লেখাটি সম্পর্কে তাঁর মতামত এখানে নেই, তবু সে সময়ে আমার কল্পনা করতে ভালো লেগেছিল
যে, পুরোটা না পড়লেও আমার লেখাটি কিছুটা হয়তো তিনি পড়েছিলেন। তা ছাড়া এটিকেই কৌরব-এ
আমার প্রথম লেখাটির একমাত্র প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া বলা চলে। আর এ সম্পর্কে আমার জমে
থাকা পুরানো কৌতূহলের আংশিক নিরসন হয়েছিল এরকম অদ্ভুতভাবে!
কৌরবে
আমার প্রথম লেখাটির সূত্রে পূরবীর মন্তব্যের ঐ ‘rope in’ শব্দ ক’টি নিয়ে পরেও অনেক
ভেবেছি। এর সঠিক বাংলা কি হওয়া উচিত দলে টানা? কৌরব গোষ্ঠীর দিক থেকে হয়তো সে তাগিদ
ছিল, যার কথা তিনি সম্ভবত জানতেন, কিন্তু আমার দিক থেকে তাহলে একে কি বলা উচিত? দলে
ঢুকে পড়া বা কৌরব-ব্যূহে প্রবেশ? কে জানে! কৌরবব্যূহে প্রবেশ তো সহজ কর্ম নয়, প্রবেশ
করে বের হবার কৌশল না জানলে নিধন অনিবার্য।
পূরবীদি'র ঐহিক জীবনাবসানের পর মনে হয়েছিল, এখন তো তাঁকে দেখতে পাবার আর কোনো উপায় নেই, কারণ কোন হাসপাতালেই তাঁকে পাওয়া যাবে না। মানুষ তো এভাবেই ইতিহাস হয়! পূরবী জীবনকালই ইতিহাস হয়েছিলেন, সেই ইতিহাসের পূর্ণ সমাপ্তি হল। এইসব চিন্তার ফসল হিসেবে প্রসূত হয়েছিল একটি কবিতা, যা আরো ছ' বছর পরে একটি ছোট পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কবিতার খাতায় দেখতে পাচ্ছি, 'এতদিনে নিরাময় হলে' শিরোনামে লেখা কবিতাটির নিচে তারিখ দেওয়া আছে ১৩-১- ৭৯।
◆ এতদিনে সুস্থ হলে তুমি!
এই
বুঝি চলে যাও হাত পিছলে আঁধার সমুদ্রে --
বুকে
চেপে বসে থাকা সেই ভয় থেকে
এতদিনে
আমরাও নিরাময় হলাম।
রোগ
যা করতে পারে, যতদূর, সবচেয়ে বেশি
করে
গেল এ ক'দিনে আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে --
এখন
মিটবে শুধু আমাদের আকাঙ্ক্ষা যা কিছু।
এখন
থাকবে তুমি হারানোর অতীত পুঁজি হয়ে!
বুকের
মধ্যে সেই জল্লাদ বসে নেই আজ
প্রাণ
ভরে শ্বাস নিয়ে দেখব তোমাকে --
নক্ষত্রের
ভুবনে যেন জেগে আছ তুমি
ব্যাবিলন,
মিশরের সেই সব রূপসীর মতো!
এত
রক্ত, অভিজ্ঞতা, বিষণ্ণ গোধূলি পার হয়ে
এতদিনে
নিরাময় হলে!
(সাত)
● "তখনও দেখেছি জয়ী দুরস্ত তারুণ্য দেহ জুড়ে
খোলা
শুধু রেখেছে পা দুটি—
মৃত্যু
এসে ছোবে বলে!
বাদবাকী
অবয়বে জীবনের গোলাপী স্বাক্ষর
সেখানে
প্রতিটি ফ্রণ্টে পর্যুদস্ত জরার কামড়;
অটল
তাচ্ছিল্য দিয়ে কিনেছে কী অর্থহীন ক্রুর আক্রমণ,
সর্বগ্রাসী
কৃতান্তকে যুঝেছে কী স্বচ্ছন্দ মহিমায় --
যার
নাম যৌবন সর্বজয়ী!
কেন
মিথ্যে ডাক দাও যোগ দিতে যান্ত্রিক গড্ডলে—
শোক-ব্যথা-বিয়োগের
অভ্যস্ত মিছিলে প্রথামতো!
যাবোনা
জ্বালতে দিয়া ম্লানমুখে মূক নদীতীরে।
যে
নদী স্বর্ণরেখা—সে নদী তো কীর্তিনাশা নয়—
সোনালী
আঁচড় তার জেগে থাকে নিরবধিকাল
যে
ভুবনে, আমি তার ঠিকানা সম্প্রতি পেয়ে গেছি।
জেনেছি
সে রম্যভুমি—যেখানে প্রাণের সমারোহ,
যে
দেশের অধীশ্বরী জরা নয়— জীবনের অনন্তরাগিণী!"
- বৈনতেয় বর্মন
●
ডায়েরি ২৪শে জুলাই ১৯৭৮ সোমবার-
বাজী
(প্রতীক দে) এসে পূরবীদি'র স্মরণসভার নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে গেল। আমার সঙ্গে পুরবীদির
সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছিল মাত্র ছ' সাত মাস আগে। তখন তাঁর রোগের কথা জানতাম, তবে পরিচয়
যে এত তাড়াতাড়ি চুকে যাবে, সেটা আমার জানা ছিল না। তাঁর নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু যতদূর
জানি তিনি রোগের কথা কাউকে বলতেন না। জীবনকে তার সমস্ত মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করবার জন্য
তিনি সবসময় প্রস্তুত ছিলেন! .....
●
ডায়েরি ৩০ শে জুলাই ১৯৭৮ রবিবার-
বেঙ্গল
ক্লাবে সন্ধেবেলা পূরবী মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিসভায় ঢুকেই হঠাৎ যেন চমকে উঠেছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে সে সভা ছিল জামশেদপুরের এই জাতীয়
আর পাঁচটা সভার মতই -- সেই সব পরিচিত লোকজন। কিন্তু এরকম এক সমাবেশে সেই প্রথম পূরবীদিকে
দেখতে না পেয়ে মনে যেন অজান্তে একটা ধাক্কা লেগেছিল! সেই অনুভূতিকে প্রকাশ করতে গেলে ব্যবহার করতে হবে সেই রবীন্দ্রনাথেরই
একটি কবিতার অংশ (যে- কাব্যগ্রন্থের নামও ছিল 'পূরবী'), সেই যে -- '' আজ হতে হায়, /
জানি মনে, ক্ষণে ক্ষণে চমকি উঠিবে মোর হিয়া/ তুমি আস নাই বলে, অকস্মাৎ রহিয়া রহিয়া/
করুণ স্মৃতির ছায়া ম্লান করি দিবে সভাতলে/ আলাপ আলোক হাস্য প্রচ্ছন্ন গভীর অশ্রুজলে।..."
পূরবীর
পরিবারের মানুষজনদের রবীন্দ্রগীতি, কৌরব-এর পুরানো সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর কিছু লেখা
থেকে পাঠ (তিনি কবিতাও লিখতেন এই প্রথম জানলাম), দু'জন ট্রেড ইউনিয়নওয়ালার (সিটু)
রাজনৈতিক কচকচানি (বিষ্ণুদার সূত্রে পূরবীর যে একটি রাজনৈতিক ভূমিকাও ছিল, সেটাও এই
প্রথম জানলাম), অধ্যাপক প্রণব মিত্রের রবীন্দ্ররচনা থেকে দীর্ঘ পাঠ ও পূরবীদির এক বাল্যবন্ধুর
স্মৃতিচারণ এবং সবশেষে সন্দেশ খাইয়ে সমাগতদের আপ্যায়ন - এই ছিল অকালপ্রয়াতার প্রতি
শেষ কর্তব্য সম্পাদনের অনুষ্ঠানমালা।
এই
স্মরণসন্ধ্যায় পূরবীদির যেসব রচনা পাঠ করা হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য। 'এ
পরবাসে' লেখাটি থেকে বোঝা যায়, প্রবাসী বাঙালীদের বিভিন্ন শ্রেণী সম্পর্কে তাঁর সুগভীর
সন্ধিৎসা ছিল। এর আগে আমার পড়া তাঁর একমাত্র রচনাটিতেও ('এখানে শালের সমারোহ') সেটাই
দেখেছি। আর একটি রচনা কমলের কাছে চিঠির ভঙ্গীতে লেখা, তাঁর নিজের অতীতের কথা মাঝে মাঝে
চমক দিয়েছে, সেটিও সুন্দর!◆
এইখানে
ডায়েরি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পূরবীর একটি চিঠি থেকে কিছু নমুনা উপস্থিত করার তাগিদ সংবরণ
করতে পারছি না। ১৯৭৩ সালে একটি চিঠিতে কমলকে লিখেছেন,".... তোমার ফরমায়েশ -- প্রবন্ধ
চাই শুক্রবারের মধ্যে। আমার হাতে কি আলাদীনের জাদু আছে? অথচ আমি ভেবেছিলাম তোমাদের
জন্য একটু খেটে লিখবো। যেমন ধর, কৌরবের প্রতিষ্ঠা থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কবিতার ক্রমবিবর্তন,
প্রকৃতি এবং মানুষের ওপরে লেখা কবিতাগুলির মোটামুটি শ্রেণীবিভাগ -- তাছাড়া ডিটেলস্-এ
গিয়ে, কি বিশেষ ইমেজ বা প্রতীক তোমরা ব্যবহার করেছ, আঞ্চলিক ভাষা কেমন করে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সমসাময়িক ঘটনা কি তোমাদের আচ্ছন্ন করেছে অথবা কি
একেবারে করেনি, কোথায় তোমরা কোলকাতার ছেলেদের থেকে আলাদা, আর কোথায়ই বা তোমরা সাড়ে তিন হাত ভূমির সম্রাট -- এইসব কথা আর কি। এখন এগুলি লেখার জন্য আমার হাতের কাছে এক্ষুনি দরকার কৌরবের লেখার একটি সংকলন, কিছু পুরোনো কিছু নতুন। কোথায় পাবো বল? বল তো আমি ব্যক্তিগত লেখা একটি লিখতে পারি। আমার কৌরবকে কেমন লাগে ইত্যাদি। চলবে?"
আবার
ফিরে যাই পুরানো ডায়েরির পাতায়। ৩০ শে জুলাইয়ের বেঙ্গল ক্লাবের সেই শোকসভা।
● তাঁর সম্পর্কে যাঁরা বলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মধ্যে পুরবীদির
সেই বান্ধবীর বক্তব্য ছিল সত্যিই উল্লেখযোগ্য। তিনি বললেন, "পূরবীর রোগ ও তার
পরিণতি সম্পর্কে সে সবকিছুই জানত, তবু একদিনের জন্যও হা হুতাশ করেনি। মৃত্যু নিয়ে
আমরা খোলাখুলি আলোচনা করেছি। সে বলতো, কলকাতার পথে পথে কত তরুণ যুবক অকালে মারা গেছে
-- তাদের ,তাদের মা-বাবার অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার তুলনায় আমরা তো অনেক পেয়েছি! তাদের কথা
ভাবলে আমাদের ক্ষোভের কিছু থাকে না।"
সেই
ভদ্রমহিলা আরো বলেছিলেন, "এক শ্রেণীর মেয়ে আছে, যারা সন্তান না থাকলে জীবন ব্যর্থ
বলে মনে করে। সেরকম ভাব পূরবীর মধ্যে কখনো দেখিনি। অথচ সে যত্ন করে অন্যের সন্তানের
নানা ঝক্কি ঝামেলা পোয়াত, যেগুলো আমরা নিজেদের সন্তান সম্পর্কেও অনেক সময় সহ্য করতে
বিরক্ত হই! আরেকটা জিনিস দেখেছি তার মধ্যে ছোটবেলা থেকে --- যখনই অন্যায় দেখেছে, অগ্রপশ্চাৎ
না ভেবে তার প্রতিবাদ করেছে।
"মৃত্যুর পরে অমৃত আছে কিনা আমাদের জানা নেই। তবে যদি না থাকে, তাহলে ওই প্রাণবন্ত চেহারা, ওই হাসি মুখ, এসবের কোন চিহ্ন আর থাকবে না এটা ভেবে কোন সান্ত্বনা পাওয়া যায় না।"◆
মনে আছে, আমাকে ওই সভায় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, পূরবী সম্পর্কে কিছু বলতে চাই কিনা। আমি কিছু বলতে চাইনি, কারণ সভায় বলার মতো তাঁর সম্পর্কে কতটুকুই বা জ্ঞান কিংবা ঘনিষ্ঠ স্মৃতির সঞ্চয় আমার ছিল! আর যদি দূর থেকে যতটুকু তাঁকে দেখেছি, তা বলার চেষ্টা করতাম, তাহলেও আমি কী বা বলতে পারতাম! আমাকে হয়তো রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা থেকে ধার করেই বলতে হত: - " আজও যারা জন্মে নাই তব দেশে/ দেখে নাই যাহারা তোমারে, তুমি তাদের উদ্দেশে/ দেখার অতীতের রূপে আপনারে করে গেলে দান/ দূর কালে। তাহাদের কাছে তুমি নিত্য গাওয়া গান/ মূর্তিহীন। ...."
সেদিনের সভায় কিছু না বললেও কয়েকমাস পরে আমি পূরবী সম্পর্কে আমার সেই একান্ত নিজস্ব পর্যবেক্ষণের কথা লিখেছিলাম -- আমার সেই দূর থেকে দেখা পূরবীর ছবি! কিন্তু সে লেখা আমি কাউকে পড়তে দিইনি বা দেখাইনি, কোন পত্রিকায় পাঠাইনি ছাপার জন্য। কিছুটা সংকোচ তো ছিলই আমার সেই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণকে জনসমক্ষে তুলে ধরার, তাছাড়াও মনে হয়েছিল যে কোনো মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য কিছুটা সময়ের ব্যবধান দরকার। আজকে ওই লেখার পর চার দশকের বেশি পার করে মনে হল, এবার সময় হয়েছে যারা পূরবীকে "দেখে নাই কখনো", তাদের উদ্দেশে তাঁর সেই 'দেখার অতীত' ছবিটিকে রেখে যাবার। তাই এই লেখায় তুলে আনা গেল সেই পুরনো লেখাটির, কিছু কিছু অংশ। আমি জানিনা কতদূর পেরেছি সেই আশ্চর্য মানুষটির অনন্য ব্যক্তিত্বের কিছুটা আভাস দিতে, যাঁরা তাঁকে দেখেছেন ও যাঁরা কখনো দেখেননি, তাঁদের সবার কাছে।
রক্তমাংসের পূরবী মুখোপাধ্যায় ছবি হয়ে যান ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে। সে-বছরই ডিসেম্বরে সাকচি হাই স্কুলের প্রাঙ্গণে কৌরব গোষ্ঠীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় ভুবনমেলা। সেখানে কৌরবের স্টলে টাঙানো ছিল পূরবীর স্মরণে আমার তৈরি এক পোস্টার। সেই পোস্টারটি যদিও সংগ্রহ করে রাখা সম্ভব হয়নি তবুও তা পূরবীর মতোই বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। সেই স্মৃতিতে ভর করেই সেটির একটি কম্পিউটার নির্মিত নমুনা এখানে পেশ করা গেল। এই পোস্টারে ছিল পূরবী স্মৃতি সংখ্যা কৌরবের মলাট থেকে নেওয়া পূরবীর ছবিটির সঙ্গে এক গোছা রজনীগন্ধা আর নিচে লেখা ছিল:- ''আমরা মনে রেখেছি!'' আর ছিল
শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েকটি পংক্তি:-
●"পূরবী তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন....
মুখশ্রী
মৌলিক, দুই চোখে ছিল তর্ক অভিমান
দুই
হাতে ছিল বৃষ্টি, খরা ছিল দুর্গ-কেশদামে
নিঃশ্বাসের
বাষ্পে ছিল যুথীগন্ধ, কেশর, সন্ন্যাস
আমরা
গ্রীষ্মের রাজ্যে থেকে কোনদিন সন্ধ্যা রাতে তোমার দুয়ারে গিয়ে বলেছি ও বন্ধু জল দাও।
বৃষ্টি
দাও, সন্ন্যাসিনী মেঘের ভূমধ্য থেকে দাও
প্রকৃত
কাজল যাতে কালো হতে পারি।..."
(আট)
● ডাঃ বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় (১৯২৯ --২০০২)
"আপোসকামীর
মুখোশ পরে
বলতো
যারা ‘সহিষ্ণুতা’,
তীক্ষ্ণ
কলমে দিতেন ছিঁড়ে
'উপাধ্যায়
জিষ্ণু' তা।......
রাজনৈতিক
‘বিসংবাদ’-এ
রংবদলের
ঢং যত
নগ্ন
করেন যুক্তি দিয়ে,
ভাষায়
শালীন সংযত।.....
সাম্প্রদায়িক
হানাহানি
মৌলবাদী
ঈগল নখে
ধূষর
কোষে রক্তক্ষরণ,
রক্ত
ঝরায় তাঁর বুকে।
দিনবদলের
স্বপ্ন চোখে,
হৃদয়ে
আবেগ উষ্ণতা।
পৃথিবীর
সব অসুখ নিয়ে
চলে
গেছেন বিষ্ণুদা।"
-রাজেশ দত্ত
পূরবী
মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে তারাপদ রায় :কয়েকজন' নামে এক পত্রিকায় লিখেছিলেন,
"আমাদের প্রথম যৌবনের স্মৃতিতে কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাত, কফি হাউস, জানা আড্ডায়
ও বিতর্কের মধ্যে এক নবীন প্রেমিক যুগলের উজ্জ্বল ছবি আছে, সময়ের ধূলোয় বা দূরত্বের
কুয়াশায় পুরবী-বিষ্ণুর সেই ছবি আজো মলিন হয়নি। 'কর্কট’ রোগের অমানুষিক ক্লেশ অমল
হাসিতে তুচ্ছ করে বিজয়িনীর মতো পূরবী চলে গেলেন। বিষ্ণুকে আমরা সমবেদনা জানাবোনা,
সে ভাষা আমাদের আয়ত্ত নেই। পুরবীর মৃত্যুর পরে বিষ্ণুকে দেখে আমরা জেনেছি কিভাবে মহৎ
শোকের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়।" ['একটু বিরাম দিন স্যার']
সত্যিই,
বিষ্ণু এবং পূরবী এদের দুজনের মধ্যে যে কোন একজনের কথা প্রসঙ্গে আরেকজনের প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই
চলে আসে। দুজনের মধ্যে কার নাম আগে উচ্চার্য, সে-বিচার অবশ্যই ব্যক্তি- সাপেক্ষে আলাদা
হতে পারে, সেটি কোন সমস্যা নয়। আমরা যেহেতু পূরবীকে দিয়ে শুরু করেছি সুতরাং তাঁর
সূত্র ধরে এবার বিষ্ণুর কথা হতেই পারে।
পূরবীর
মত বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত আদান-প্রদানের পরিসর ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত
এটা হয়তো কিছুটা দীর্ঘতর হতে পারত। তা যে হয়নি, তার কারণ পূরবীদির মৃত্যুর কয়েক
বছরের মধ্যেই বিষ্ণুদা জামশেদপুর ছেড়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। আরেকটি
কারণ ছিল আশির দশকের শুরুর দিকে আমি জীবিকার সন্ধানে জামশেদপুর ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি
দিই ও সেখানে বেশ কয়েক বছর আমাকে থাকতে হয়। সেই পর্বে বিষ্ণুদার সঙ্গে আমার মোলাকাতের
দুই একটি টুকরো ছবি মনে পড়ে।
সত্তরের
দশকের শেষ দিকে কৌরব পত্রিকার তরুণদের উদ্যোগে বার তিনেক জামশেদপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল
ভুবন মেলা। এর পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিষ্ণুদাও ছিলেন। কৌরব-এ লেখালেখির সূত্রে আমিও তখন এসব উদ্যোগের
সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছি। দু'দিনের মেলার জন্য প্রবেশপত্র বিক্রি করা হয়েছিল। একদিন
সন্ধ্যাবেলায় আমবাগান স্কুল-পরিসরে (যেখানে মেলাটি হয়েছিল) মেলা যখন খুব জমজমাট,
তখন একমাত্র প্রবেশপথে হঠাৎ করে প্রচুর জনসমাগম
হয়। শোনা যেতে থাকে বহু লোক নাকি প্রবেশপত্র ছাড়াই মেলায় ঢুকে পড়ছেন। সেসময় প্রবেশপত্র
পরীক্ষা করে দেখে সেই জনতার ধাক্কা সামলিয়ে তাদের ভেতরে ঢোকানোর দুরূহ কাজ যে দু'
তিনজনের ওপর দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। ভিড়ের তখন এতই চাপ যে, কে
বা কারা ঢুকছেন, সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখারও সময় ছিল না। যাঁদেরই আয়োজক বা স্বেচ্ছাসেবীদের
জন্য নির্দিষ্ট ব্যাজ ছিল না, তাদের কাছেই প্রবেশপত্র দেখতে চাওয়া হচ্ছিল। এই অবস্থায়
এক ভদ্রলোকের ব্যাজ বা হাতে প্রবেশপত্র না দেখে আমি তাঁকে 'কার্ড আছে?' প্রশ্ন করতেই তিনি 'এক মিনিট' বলে সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে
কার্ড বের করে দেখালেন। তখন মুখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি তিনি বিষ্ণুদা! আমি তো
অপ্রস্তুত! লজ্জিত হয়ে তাঁকে জানালাম যে, আমি খেয়াল না করে ভুলবশত তাঁকে প্রশ্নটা
করে ফেলেছি।
আশির
দশকে জামশেদপুরে আমার অনুপস্থিতি কালের কয়েক বছরের মধ্যে কোন এক সময় এখানকার কোন
এক সাহিত্যসভায় বিষ্ণুদার সঙ্গে আমার বাবার দেখা হয়েছিল। সেখানে তিনি আমার লেখা নিয়ে
প্রশস্তিসূচক কিছু কথা বলেছিলেন, যা বাবা আমাকে আনন্দিতচিত্তে পরে জানিয়েছিলেন।
পূরবীর
মৃত্যুর পরে তাঁর স্মরণে কৌরব পত্রিকার যে-সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল), তার 'শহর সংস্করণ'
কলমে লেখা হয়েছিল, "পূরবী মুখার্জি মারা গেছেন। তিনি একসময় ২/৩ নাটকের অভিনয়
করেছিলেন। ল্যাবরেটরি ও কলকাতার ইলেক্ট্রা মনে আছে। কবিতা লিখতেন, গদ্য, সমালোচনা।..."
ইত্যাদি। পূরবীদির জীবনের এই নাটক-পর্বটি অবশ্য আমার চোখে দেখা বা জানা ছিল না। সেরকমভাবে
বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের জামশেদপুর-জীবনেও একটি অজানা পর্ব ছিল, অর্থাৎ আমার অজানা। তিনি
এখান থেকে কলকাতা চলে যাওয়ার পরে
জেনেছিলাম, তিনি একবার কিছুদিনের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন,
অবশ্যই তা বামপন্থী রাজনীতি। একবার ভোটেও দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁকে জেতাবার সেই অসফল
প্রয়াসে নাকি পূরবীদিও শামিল হয়েছিলেন।
যা-ই
হোক, জামশেদপুর নামক গ্রাম থেকে বেরিয়ে কলকাতায় গিয়ে স্থিতিলাভ করার পর স্বভাবতই
বিষ্ণুদার মেধা ও কর্মতৎপরতা যোগ্যতর ও প্রশস্ততর ক্ষেত্রে স্ফূর্তিলাভ করেছিল। সেখানে
তিনি গণবিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট চরিত্র, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার
রক্ষার সংগ্রামে এক নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী হিসেবে ক্রমে ক্রমে এক অনস্বীকার্য ব্যক্তিত্ব
হয়ে ওঠেন। সেসব খবর আমাদের এই টাটাগ্রামে কদাচিৎ পৌঁছত, পৌঁছলেও ঢেউ উঠত না। এছাড়াও
'আজকাল' দৈনিকপত্রটিতে তিনি স্বনামে 'আরাম ব্যারাম' নামে স্বাস্থ্যবিষয়ক এক জনপ্রিয়
কলমলেখক হিসেবে এবং 'জিষ্ণু উপাধ্যায়' ছদ্মনামে রাজনীতি বিষয়ক কলম 'বিসংবাদ'-এর লেখক
হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সেই লেখাগুলো অবশ্য আমাদের সাগ্রহ মনোযোগ আকর্ষণ করত,
কলকাতায়ও জনপ্রিয় হয়েছিল (স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখাগুলি 'অসুখ-বিসুখ' নামে পরে বইও হয়)। বিষ্ণুদার এই নতুন রূপটি দেখেই উদ্বুদ্ধ
হয়ে এই পর্বের প্রারম্ভ-কবিতাটি বিষ্ণুদার স্মরণে লিখেছিলেন তরুণ কবি রাজেশ দত্ত।
বলা বাহুল্য, তাঁর এই রূপটি জামশেদপুরের বহু মানুষের কাছে ছিল প্রায় অচেনা।
বিষ্ণুদার জীবনের এই নবীন পর্বটিতেও জামশেদপুরে তাঁর আনাগোনা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। সে সময়ে দু'বার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবার কথা মনে পড়ছে। একবার তাঁকে কমল চক্রবর্তীর বাড়িতে দেখি পূরবীর বোন পূবালীর (তখন তাঁর স্ত্রী) সঙ্গে। আর একবার বেঙ্গল ক্লাবে আয়োজিত এক আড্ডায় তিনি আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, এই আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল কারগিলের যুদ্ধ। ১৯৯৯ সলের মাঝামাঝি আয়োজিত এই সভায় বিষ্ণুদা বা অন্যান্য বক্তারা কে কী বলেছিলেন সে বিষয়ে আমার আজ আর বিস্তারিত কিছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, আমি কারগিলের ভারত-পাক লড়াইয়ের একটি তুলনা উপস্থিত করেছিলাম -- ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সঙ্গে। (দুটি ক্ষেত্রেই আক্রমণ ছিল অতর্কিত -- ভারতের অনেকটা ভূখণ্ড শত্রুসৈন্যের দখলে চলে যাবার পরেই ভারত সরকার তা জানতে পেরেছিল এবং সে কারণে যুদ্ধে বেশ নাকাল হতে হয়েছিল। এই ব্যাপার দুটি আমার তুলনাযোগ্য মনে হয়েছিল।) যাইহোক, সেই আড্ডায় জামশেদপুরের সুপরিচিত নাট্যপ্রেমী ধীরাজ জানার তোলা বিষ্ণুদা'র সঙ্গে আমাদের একটি ছবি আজও আমার সংগ্রহে রয়ে গেছে।
১৯৭৮ সালের সেই জুলাইয়ের পর পূরবীকে আমি বা অন্য কেউ চর্মচক্ষে দেখিনি বটে, কিন্তু পরের বছরগুলোতে অনুভব করেছিলাম, তিনি অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছেন। কৌরব-এর পাতায় তিনি বারবার উঠে এসেছেন কমল চক্রবর্তীর কলমে। বিশেষ করে 'শিরোনামায় পাঠক' ও 'শহর সংস্করণ' - এই দুটি বিভাগে বারবার দেখা গেছে দুই আশ্চর্য নারীর আনাগোনা! এদের একজন সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র - তুতান নামে এক কিশোরী, যাকে সবসময় মনে হয় একটি নির্ভেজাল বাস্তব চরিত্র! আরেকজন বাস্তব চরিত্র হয়েও যেন মানসপ্রতিমা। তার নাম পূরবী মুখার্জি। পরে কৌরব-এর এক সংক্ষিপ্ত পাঁচালী লিখতে গিয়ে কৃষ্ণগোপাল মল্লিক উল্লেখ করেছিলেন এই দুই নারীর কথা:- "পূরবী মুখার্জি নামের সেই দিদিটি অমর;/ তুতান নামে ওই কিশোরী চিরন্তনী অজর;/ পুজো-সংখ্যা শিরোনামায় থাকেই ওদের খবর।" কৌরবের পাতায় সত্যিই এই দুই নারী অজর অমর হয়ে আছে, এদের কখনো আর বয়স বাড়েনি।
কিন্তু এই লৌহপুরীর বাসিন্দাদের মনে সেভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ বোধ হয় বিষ্ণু মুখার্জি পাননি। তবুও ২০০২ সালে তাঁর একদা-বাসভুমি এই জামশেদপুরেও তাঁর প্রয়াণ সংবাদ এসে পৌঁছেছিল, এমন কী একটি স্মৃতিসভাও আয়োজিত হয়েছিল মিলনী প্রেক্ষাগৃহে। না, কৌরব গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই সভা আয়োজিত হয়নি, বিষ্ণুদা'র পুরানো পরিচিতজনেরাই এই সভা ডেকেছিলেন এবং বিষ্ণুদার পরিচিত ও অনুরাগীজনেরাই এখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সে সভায় আমি গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু সেখানে কে কে বলেছিলেন এবং কী বলেছিলেন, সেসব কিছু এখন আর আমার খুব পরিষ্কার মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, কৌরব গোষ্ঠীর আর কেউ না গেলেও গোষ্ঠীপতি স্বয়ং সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে তাঁকে মঞ্চে এসে বিষ্ণুদা সম্পর্কে কিছু বলতে অনুরোধ করা হয়েছিল। সেই অনুরোধে তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন বটে, তবে এতে তাঁর অনিচ্ছা ও অনীহা শরীরী ভাষায় এমনভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল, যা শ্রোতাদের বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। মঞ্চে উঠে তিনি শুধু একটি বাক্যই বলেছিলেন যে, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর কিছুই বলার নেই! এটুকু বলে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে যান। শোকসভায় প্রয়াত-স্মরণের একটি বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে এই ঘটনাটি আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। বিষ্ণুদার মত একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর এককালে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার পরেও কৌরব পত্রিকায় তাঁর স্মরণে এক লাইন বা দুই লাইন লেখা হয়েছিল বলে মনে পড়ে না! বিষ্ণুপ্রসাদের সেই স্মরণসভার আর একটু বিস্তারিত সংবাদ এখানে দেওয়া গেলনা, কারণ সে-সময়কার ডায়েরিটি আমি খুঁজে পেলাম না।
শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতির ওপর নির্ভর না করে এই লেখাটির উপকরণ সংগ্রহ করেছি আমার ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ বিবরণ থেকে। এছাড়াও ব্যবহার করেছি আমার অপ্রকাশিত লেখা "জামশেদপুরের পূরবী: এক তরুণ পর্যবেক্ষকের চোখে'', কৌরব-৯৯-এ প্রকাশিত আমার স্মৃতিচারণ ''নিরানব্বই-এর ফের অথবা ব্যূহপ্রবেশের বৃত্তান্ত'' ও কৌরব পত্রিকার নিম্নলিখিত সংখ্যাগুলির বিভিন্ন রচনা :-
কৌরব
২১ - জামশেদপুর বিশেষাঙ্ক, জুলাই, ১৯৭৮
কৌরব
২৩ - পূরবী মুখোপাধ্যায় সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৭৮
কৌরব
৮১ - স্মৃতি সংখ্যা, অক্টোবর, ১৯৯৮
কৌরব
৯৯ - ডিসেম্বর, ২০০৪
বিষ্ণু
মুখোপাধ্যায়ের ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা:- রাজেশ দত্ত ও প্রয়াত ধীরাজ জানা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন