সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(১৪)   

প্রজাপতি

এক একটা দিন আসে যখন শুধুই রাত। সইতে সইতে সহন ডুবতে ডুবতে খড়কুটো আঁকড়ে ধরি। আরও ভুল আরো ব্যর্থতার পাঁকে ডুব। খারাপ দিন শুরু হয় শেষ হয় না। মনের ক্ষতগুলো আরও গভীর হয়। আপনকে পর করি আর পরকে আপন করি। দুই খানেই ধাক্কা খাই। তবুও জীবন... মা বলতেন, সর্বদা হাসিমুখে থাকো। laugh and the world laughs with you weep and you weep alone. তাও কি হয়! ছোটোবেলার অভ্যাস ছিল, একবার হাসতে শুরু করলে সে হাসি আর থামত না। শৈলশৃঙ্গের দেহ ভেদ করে  ঝর্ণার অনাবিল তরঙ্গের মতো সেই হাসিতে আলো হয়ে যেত পৃথিবীর মাঠ।

সেই হাসতে হাসতে চোখে জল আসা দিনের শৈশব শেষ হয়ে গেল। নটে গাছটি মুড়োল। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর জীবনের মানচিত্র গেল বদলে। নতুন স্কুল নতুন বইয়ের গন্ধে কয়েক মাস বেশ কাটল। প্রাচীন সাহিত্য কথার মতো বিধাতা অলক্ষ্যে হাসলেন। বালিগঞ্জে একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সেই সময় ইস্টার্ন বাইপাস ছিল না। রেলপথ বলতে গেলে একমাত্র সহায়। বাসরুট একটাই। একাই যাতায়াত করতে হতো। নয় বালিগঞ্জ থেকে গোলপার্ক গিয়ে বাস, নয় বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে বাদুড়ঝোলা ট্রেন। বন্ধুরা বেশিরভাগ সে সময় প্রেম করে। উচ্চ বিদ্যালয়ে বা কলেজে পড়াকালীন প্রেম একটি অলিখিত যোগ্যতার মাপকাঠি। সেই প্রেম যে সতত পরিণয়ের লক্ষ্যে, তা নয়। ফুল আপনিই ফোটে ফোটার আহ্লাদে,  তাতে ফল ধরুক আর নাই ধরুক। প্রেম করতে পারা মানে সে সুন্দর সে স্মার্ট সে তুখোড়। পাশের রেজাল্ট যাই বলুক কেরিয়ার যাই বলুক বান্ধবসমাজে একটি সমান্তরাল সাফল্যের মাপকাঠি চিরকাল ছিল, আছে এবং থাকবে। এই সমান্তরাল সমাজে আমি ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়লুম। দেখা গেল পড়াশোনা গান বাজনাসহ যতই সুশীলা হই, তা বাস্তবে নিরেট বিবেচিত হয়। পাড়াতে বন্ধুবৃত্ত তাই ভেঙে গেল। বিদ্যালয়ের বন্ধুরা গোপন চিঠি চালাচালি করে। তখন কালো ল্যান্ডফোন থেকে রঙিন ফোন পাওয়া যেতে শুরু হয়েছে। মোড়ে মোড়ে এস টি ডি, লোকাল ফোনবুথ। সেখানে সারাদিন অল্পবয়সীদের ভিড়। আমার মতো মাছরাঙা আর সাপ। গাছে ওঠা, পুকুরে কচুরি পানা সংগ্রহ করা মেয়ের প্রতিভা নেই প্রণয়ে। কিন্তু আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলুম প্রেমের। আমারও উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো প্রেম করার। এবারে নিয়তি ক্রুর হাসলেন। কোচিং সেন্টারে পড়াতে আসতেন দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ মাথাভরা চুল সুদর্শন এক অবিবাহিত মানুষ। বয়সে কিছুটা বড়োই। তবু অনেকেই মোহগ্রস্থ হলো। আমিও। জালে মাছ পড়েছে তা পরে বোঝা গেল। বাড়ি ফেরার সেই দীর্ঘ পথ তিনি অযথাই পৌঁছে দিতে লাগলেন। আমার মতো নীরস একটি ছেলেলি মনের বালিকাকে তিনি শব্দ বাক্য তুখোড় অভিনয়ে বাজেয়াপ্ত করে ফেললেন।

মুখে সদাই জ্ঞানের কথা, তাঁর জীবন যুদ্ধের কল্পিত রূপকথা। আমিও ভাসলুম বেশ স্রোতে। তবে বইয়ের অক্ষর চিরকালই মানুষের চেয়ে বেশি আকর্ষক ছিলো, তাই পরীক্ষা পড়াশোনা নিয়ে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু নাছোড় ছায়ার মতো সে বাড়িতেও আসা শুরু করল। জরুরি অবস্থার সময় নোট প্রস্তুত করে। এমত কাণ্ড অবশ্যই দৃষ্টিকটু তা বোঝার মতো বুদ্ধি সৃষ্টিকর্তা দেননি আমায়। মা এক নিভৃত দুপুরে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটিকে পছন্দ করি কিনা! এভাবে ঘন ঘন আসা, হাত ছোঁয়া প্রভৃতি স্বাভাবিক তো নয়! আমিও হালকা ভাবেই মাকে বললুম, নিশ্চয়ই পছন্দ করি। হায়! পৃথিবী স্তব্ধ হলো না কেন সেই দিনই? হাওয়াহীন জলহীন হয়ে গেল না কেন এ গ্রহ? আমি পরীক্ষা দিলাম। গোপনে আমার বিবাহের তোড়জোড় পাকা হয়ে গেল দুই বাড়ির ষড়যন্ত্রে। ব্রাহ্মণ পুরুষ। তিনমহলা বাড়ি শহরের বুকে, হলোই বা তা ধ্বংসস্তুপ! মরা হাতি লাখ টাকা। আমার বিবাহ হলো। তখনও কুড়ি হতে ঢের দেরি। আমার মাতা-পিতা কন্যাদায় মুক্ত হলেন। কন্যা দায়গ্রস্থ মনে করার মতো পিছিয়ে পড়া মানসিকতা আমাদের বাড়িতে ছিলো না। ভালো লাগা এবং ভালোবাসার মধ্যেও কিছু সময়ের ব্যবধান থাকে। পড়াশোনা বাকি। স্বাবলম্বী হবার স্বপ্নপূরণ বাকি। মানুষটিকে বুঝে নিতে বাকি। সে সময় পাওয়া গেল না। মঙ্গল অমঙ্গলের গ্রহ বিকারে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। শশুরবাড়ি এসে টের পেলাম, আমার কত দোষ ত্রুটি। আমি অব্রাহ্মণ বলে আমার বামপন্থী শ্বশুরমশাই আমায় মনে মনে গ্রহণ করতে পারেননি। শাশুড়িমা মানুষটি ভালো হলেও ব্যক্তিত্বহীন। তিনি তাঁর সমস্ত পরাক্রম আজীবন কোথাও না পেয়ে আমার ওপর প্রয়োগ করলেন। কিন্তু প্রকৃত রহস্য তখনও গোপন ছিল।

 (ক্রমশ)                    

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন