ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৩৪)
আর তখনই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল।
হৃদয়কে দেখে যেন ফেটে পড়ে সমিধা। চেঁচিয়ে বলে ওঠে, এতক্ষণে সময় হল? এই সময় হল আসার?
কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। এত দেরি কেন? কেন এত দেরি করলি?
হৃদয় একটু থমকে যায়। সমিধা কখনও এভাবে
কথা বলে না। অত্যন্ত নম্র, বিনয়ী, সংযত স্বভাবের মেয়ে সে। তার উপস্থিতিতে ভরসা হয়।
নিশ্চিন্ত থাকা যায়। কিন্তু হঠাৎ ও ওরকম অমার্জিত হয়ে উঠল কেন? নিশ্চয়ই কোনও কারণে
খুব উদ্বেগে আছে। হৃদয় সেটা বুঝতে পারে। সে শান্তভাবে অপেক্ষা করে। সমিধার কথা শেষ
হওয়ার পর বলে ওঠে, কাজ ছিল।
কাজ? কী কাজ? আবার ধৈর্য হারায় সমিধা।
কখন থেকে বসে আছি। অন্তত একদিন একটু আগে আসা যেত না? এত কাজ? কতবার ফোন করেছি।
সমিধার মেজাজ দেখে অবাক হয় হৃদয়। একটু
দেরিই হয়েছে ওর। কিন্তু তার জন্য ভেতরে ভেতরে এত রাগ পুষে রাখার কী ছিল?
পরে অবশ্য হৃদয় কারণটা বুঝতে পারে।
সমিধা টের পেয়েছিল, ও যেমন হৃদয়কে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে, ওর জন্য হৃদয়ের মনে
তেমন কোনও ব্যাকুলতা নেই। থাকলে, যেভাবে হোক হৃদয় আরও আগেই আসত। অন্তত আসার চেষ্টা
করত। মেজাজ দেখিয়ে এই কথাটাই হৃদয়কে বোঝাতে চেয়েছিল সমিধা। কিন্তু হৃদয় কিছুই বোঝে
নি। সমিধা আছড়ে পড়েছিল ওর ওপর। হৃদয় শান্তভাবে সেই ঝড় গ্রহণ করে। হৃদয়কে নিজের মনের
কথা জানানোর আগেই সমিধা যেন হৃদয়ের মনের কথা টের পেয়ে যায়। বুঝতে পারে, সে হেরে গেছে।
কিন্তু তাতে সে আরও মরিয়া হয়ে যায়। একদিন নিজের বাবাকে পাশে চেয়েও সে পায় নি। এখন এই
পুরুষটিও বুঝিয়ে দিচ্ছে, ওর ওপর এর কোনও মায়াদয়াই নেই। সব পুরুষই কি এরকম? সমিধা স্পষ্ট
ভাষায় নিজের মনের কথা হৃদয়কে জানায়। কিন্তু আবারও বুঝতে পারে হৃদয় সামান্য বেসামাল
হয়েছে মাত্র। যেন ওর প্রস্তাবটা উটকো এক বিপদ ছাড়া কিছুই নয়। বেকায়দায় পড়ে পরিস্থিতি
সামলানোর চেষ্টা করছে মাত্র। হৃদয়ের মনকে যেন পরিষ্কার দেখতে পায় সমিধা। বৃথাই সে মেজাজ
দেখিয়েছে! অধিকারবোধ দাবী করেছে! কোনও অধিকারই তার নেই। বন্ধুত্বের ভরসাটুকু ছাড়া আর
কিছুই হৃদয় তার কাছ থেকে চায় না। হৃদয় কিছুদিন সময় চায়। সমিধা শান্ত হয়ে যায়। ভালো
বন্ধুর মতো হৃদয়ের আদর আপ্যায়ন করে। কিন্তু হৃদয় চলে যাওয়ার পর সে ভেঙে পড়ে। ফুঁপিয়ে
ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদে। বালিশে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলে, আমার মতো এমন করে আর কেউ তোকে
ভালোবাসতে পারবে না হৃদয়। কেউ না! তুই জানিস না, তুই কী হারালি! কাকে হারালি!
সমিধা চুপচাপ হয়ে যায় একদম। পরদিনই
আগ্নেয়র কাছ থেকে হৃদয়ের সিদ্ধান্ত জেনে যায়। ভেতরে প্রবল ধাক্কা খেলেও বাইরে সে কিছুই
প্রকাশ করে না। হৃদয়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখে। নিজের বাবার কাছ
থেকে যেভাবে আত্মমর্যাদাবোধ দেখিয়ে সরে গেছিল, হৃদয়ের কাছ থেকেও সেভাবে মাথা উঁচু করে,
নিজের মর্যাদা বজায় রেখে, সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফুলের বাগানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
করে না। কিন্তু সেখান থেকে একটু একটু করে সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
আগ্নেয়র প্রতি একটা গভীর কৃতজ্ঞতা ছিল
সমিধার। খবরটা সে-ই ওকে দিয়েছিল। হৃদয় যে নিষেধ করেছে, সেটাও জানিয়েছিল। সমিধা খুব
রেগে গেছিল শুনে। ফুঁসে উঠে বলেছিল, ও তাহলে আমাকে করুণা করতে চায়! ও ভুল বুঝেছে আমাকে।
আমি করুণা চাই না। ওকে আমি ভালোবেসেছি। ভালোবাসা কোনও দুর্বলতা নয়। ও আমাকে দয়া দেখাতে
চায়। প্রত্যাখ্যান করে মহৎ সাজতে চায়। দেখাতে চায়, ও কত উদার। কিন্তু কেন ও এসব চাইছে?
আমি ভালোবাসাই শুধু চেয়েছি। ওর করুণা, দয়া বা উদারতা তো চাইনি। আমি যা চেয়েছি সেটা
ও আমাকে দিতে পারে নি। সেটা ওর অক্ষমতা। তার জন্য ও আমাকে দুর্বল ভাবছে কেন? আমি তো
কোনও দুর্বলতা দেখাইনি।
আগ্নেয়র কয়েকটা মন্তব্য যেন ওর ওপর
আগুনের ফুলকির মতো উড়ে এসে পড়েছিল। ওর ঠোঁট দেখলে চুমু খেতে ইচ্ছে করে না। হাসলে খুব
বোকা বোকা দেখায়। ওকে দেখতে ভালো নয়। ওর মাথা তেমন ধারালো নয়। ওর মন পুড়ে গেছিল এইসব
কথা শুনে। হৃদয় ওকে এত নীচু চোখে দেখে?
দাঁতে দাঁত চেপে সমিধা বলেছিল, হৃদয়
যে এত বুদ্ধিমান, আমার ভেতরে যে একটা আগ্নেয়গিরি আছে, সেটা দেখতে পেল না? বুদ্ধিমান
হয়েও হৃদয় অন্ধ। ও শুধু ওপরটাই দেখতে পায়। ওপরের চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়। কিন্তু একদিন
ওর চোখ ফুটবে। ওকে আমি দেখিয়ে ছাড়ব, আমি কী পারি।
এরপরই আগ্নেয়র সঙ্গে আরও বেশী করে ঘনিষ্ঠ
হতে শুরু করে সমিধা। ও বুঝতে পারে, হৃদয়ের সৌভাগ্যকে ঈর্ষা করে আগ্নেয়। হৃদয়ের কর্তৃত্বকে
চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়। ও শুধু উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় আছে। হৃদয়ের চোখ ফোটাতে গেলে
আগ্নেয়ই হতে পারে ওর সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। আগ্নেয়কে ও কৌশলে ব্যবহার করতে শুরু করে।
ওদের সঙ্গে যুক্ত হয় বিহান। বিশ্রুতই
নিয়ে এসেছিল বিহানকে। কিছুদিনের মধ্যেই আগ্নেয় প্রেমে পড়ে সমিধার। সমিধার প্রশ্রয়েই
আগ্নেয়র সঙ্গে বিহানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওরা তিনজনে মিলে একটা চক্র গড়ে তোলে।
কখনও সেখানে থাকে মেহুলী।
এই চক্রের এক বৈঠকেই হঠাত নিজেকে মেলে
ধরতে শুরু করে সমিধা। সে বলে, ছোটোবেলা থেকেই মাকে সামনে রেখে আমি বড়ো হয়েছি। খুব ভালোবাসি
আমার মাকে। আমার মা বড়ো নরম মানুষ। নরম মাটি পেলে সবাই আঁচড়ায়। আমার মা আঁচড়ে আঁচড়ে
ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সারাজীবন। মুখে টুঁ শব্দটি করে নি। মা-র কাছ থেকেই আমি ফুলকে ভালোবাসার
শিক্ষা পেয়েছি। গান কবিতা, ছবিকে ভালোবাসতে শিখেছি। সারাজীবন ধরে মা আমাকে কত শিক্ষাই
দিয়েছে। কিন্তু নিজে কী পেয়েছে? কোনও স্বীকৃতি, সম্মান, ভালোবাসা? নাঃ। করুণা ছাড়া
আর কিছুই জোটে নি তার। ওটাই তার ভালোমানুষীর দাম। যে যত বেশী ভালোমানুষ হবে, তার তত
বেশী করুণা জুটবে। ভালোমানুষকে কেউ সম্মান করে না। সবাই তাকে দুর্বল ভাবে। তার ভালোমানুষীর
সুযোগ নিতে চায়।
কী বলতে চাস তুই? আগ্নেয় জানতে চেয়েছিল।
পুরোটা শোন আগে। সমিধা একটু বিরক্ত
হয়। তারপর বলে, আমার মধ্যে এতদিন মা-ই রাজত্ব করেছে। তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি ভোগ করেছি
আমি। সবচেয়ে বড়ো শাস্তি, হৃদয়ের প্রত্যাখ্যান। হ্যাঁ, ভেবেচিন্তেই কথাটা বলছি। আমার
বাবা থেকেও ছিল না। সেই শাস্তিকেও ছাপিয়ে গেছে এটা। গোটা ফুলের বাগানে এটা একটা বেশ
রসালো চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। যেন আমি খুব দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলেছি। আমি খুব দুর্বল।
আর হৃদয় খুব উদার। সে আমার প্রতি অপার মহত্বে কৃপাবর্ষণ করে চলেছে। কেউ একবার ভাবল
না, হৃদয়ের ওই উদারতা আমি মোটেই চাই নি। ওকে আমি শুধু ভালোবেসেছি। আর, ভালোবেসে কেউ
দুর্বল হয়ে যায় না। কিন্তু কেন এই ভুল বোঝাবুঝি? এর জন্য কি হৃদয়ই দায়ী নয়? এই শস্তা
গল্পটার কোনও প্রতিবাদ সে করে নি কেন? যদি করত, তাহলে তার উদারতা কি কমে যেত? কিন্তু
হৃদয় ওইটুকু ছাড়তেও রাজি নয়। নিজের মহত্বে ও অন্ধ হয়ে গেছে। এবার ওর চোখ ফোটা দরকার।
মেহুলী জানতে চায়, তুই কী করতে চাস?
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন