থিয়েটারে থিয়েটারি
প্রতি,
রঙ্গমঞ্চ
আসলে একটা ব্যাপার। মনে মনে সংলাপ বলা নিয়েই পেরোচ্ছে বিকেল। টালিগঞ্জ থেকে মধুসূদন মঞ্চ।
ওখানেই চলছে নাট্য-উৎসব। কিন্তু
যাহ্ ভুলে গেছি
মস্ত জিনিসটাই। সেটা এখনও ধরা পড়েনি বটে। কিন্তু একটা উসিবিসি চলছে। সময়ও পেরিয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যাকাল সাড়ে ছটা। এটা কবে থেকে চলে আসছে জানা নেই তবে, এই সময়
শো শুরুর সময়। এটা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা এদিকে গেলে, থিয়েটারের জন্যে কাউনটারে টিকিট দেওয়া বন্ধ। প্রচলিত
সময় ও নিয়ম দুইই
পেরিয়ে অনিয়মিত অমার্জিত কুণ্ঠিত দর্শকের মতন প্রবেশ। সামনে সাজান বেশ। থিয়েটারের ব্যাপারটা যাঁদের থেকে শেখা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রী দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ নাট্যজীবন তাঁর। এবং সফল। এবং উন্নত। এবং শিক্ষণীয়। তাই তাঁর থিয়েটারে অনেককিছু শিখব বলেই যাই। কোথাকার চরিত্র
কোথায় রেখেছ – নাটকের
নাম। নাট্যদল শ্রীভূমি সংসৃতির প্রযোজনায় পিরানদেল্লো-র
নাটক থেকে অনুপ্রাণিত।
এদিকে ঝড় ঝড় মনে হচ্ছে।
এরই
আগে ঝড় উঠল বলে
সময় পেরিয়ে এসেছি। পাতাল রেলে। তারপর গাড়ির অযাচিত চিৎকার ছিটকে ঢুকে আসছিল। তেড়ে তাড়া দিচ্ছি। কিন্তু চার চাকার বাহন জায়গা পাচ্ছে না। এও থিয়েটারের
প্লট, ভাবতে ভাবতেই মধুসূদন মঞ্চ-এর সামনে অবতরণ করা গেল। সঙ্গের বন্ধু কয়েক লাফে পেরিয়ে গিয়ে জানালেন, আজ আর
টিকিট মিলবে না?
- কেন? হাউসফুল?
- নাহ, শোয়ের টাইম তো
পেরিয়ে গিয়েছে, তাই।
- জানি, তবে এটা
দেখব। সাতশো কাহন পেরিয়ে এলাম যে, দেরি তাই।
- কাকে বোঝাই?
সবসময়ই
থিয়েটারের সামনে কয়েকজন বন্ধু থাকেন। টিকিট মিলল। ঢোকা গেল। প্রবেশমাত্র বিষয় বুঝে ফেলব, এমনকি হয়?
তাও থিয়েটারে?
সঙ্গের
বন্ধুর কত জিজ্ঞাসা, কত
প্রশ্ন। ফিসফিস করার মতন অপরাধে তাইই করা চলল। দেখলাম, অন্ধকার সয়ে যেতে।
আগের থেকেই জানিয়ে রাখি, আমি ১০০
টাকার টিকিট।
- তো পেছনের।
দেখতে ভালো লাগবে?
সঙ্গের
বন্ধুকে বুঝিয়ে বললাম, হ্যাঁ। নিয়মিত দেখতে হয়। তাই, এই সাধ্যে।
ততক্ষণে
আরও কথা বলছেন পাশে পাশে বসিয়েরা। মানে, দর্শক। থিয়েটারের দর্শক। হ্যাঁ,
সিটে বসা ১০০ টাকার দিক থেকে সামনে দেখা সোজা। জলের মতন। দর্শক কই? এত কম
কেন? সামনে পাশে-আশে, এদিকে-ওদিকে। সবদিকেই পাতলা লাগছে। টিকিটের দামে ভাববেন না হে পাঠক
সিনেমায় বেশিতে দেখি। সিনেমাতেও কমেই দেখি। সেখানেও শতকের দিকেই, যা সবচেয়ে
কম।
আমাদের
গ্রুপ থিয়েটার। আমার পাশে বসা দর্শক-মানুষ এই প্রথম
কোনও শো দেখছেন। আমি যাবতীয়
রিনরিনে আনন্দ নেব, তাই না? আমিই এনেছি ওকে আজকে সেই সুদূর কল্যাণী থেকে টেনে। শনিবারের কলকাতা। সন্ধে কাঁধে দুচারতে তারা ফুটে উঠলেই অফিস ছুটির কথা ভাবে। তারপর সপ্তাহান্তের ছুটি। তাতে, পরিবার সামলে বেশ রাতে
সিনেমা যাওয়ার সময় মিলে যায়। কিন্তু থিয়েটারে তো অই যে
সাড়ে ছয়। তাতে,
কল্যাণী বা সুন্দরবন বা প্রান্তিক
ভূগোলে থাকা বন্ধুস্থানীয়দেরও ডেকে আনি। এবং, তা যে
কর্তব্য।
সংস্কৃতির
ছাড়পত্রে থিয়েটার এখনও সেই ‘নীলদর্পণ’ যুগের
আইনে চলে। সেখানে টিকিটের খানিকটা বাড়লেও, সময় তো
আর পালটে যেতে পারে না। যেখানে দর্শক রাত এগারোটায়
থিয়েটার দেখতে আসবেন, পানের খিলি মুখে।
গ্রুপ থিয়েটারের বয়স হল ৭৫ বছর।
সেকি, এ কোন
পরিমাপকে মাপা তো নয়,
যেদিন থেকে প্রথম দল তৈরি হল, সেই দলকে ধরেই হিসেব। সালের নিরিখে। তাতেই অই দাঁড়ায়। সেই থিয়েটারে
অনেক অনেক চাওয়া, অপরিসরে ভুগছে। আমাদের বড় চাওয়া
একটা এমন জায়গা, যেখানে ২৪ ঘণ্টা, কোন না কোন দল
অভিনয় করে চলবে। কই? জানি না, এমন চাওয়াকেই ইউটোপিয়া বলে কিনা!
গ্রুপ-থিয়েটারসংলগ্ন থাকার এই অভ্যেস মনে করিয়ে দেয় কত পড়ার বইয়ের কথা। যেখানে ভূমিকাহীনভাবে একদিন এসেছিলাম। মঞ্চের বাঁপাশের সাজঘরে ভীরু চরিত্র হয়ে। একদিন জানতাম না যে, গ্রুপ থিয়েটার এক আন্দোলনের নাম। তার
সামাজিক দায় থাকে। এবং তা বৃহত্তর সমাজের
জন্যে। আর সেই দায় থেকেই তো অবাণিজ্যিক
আদর্শে
থিয়েটার করে চলা। তাহলে, প্রশ্ন কই? লেখার ফোকাস
কই? এই তো এত্ত দল, কত নাট্য উপস্থাপনা,
কত বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে। কতরকমের। বাংলা প্রদেশে থিয়েটারের
সুবিধে হল এই যে, আপাদমস্তক থিয়েটার ঘিরে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য। গ্রহণ করে, তা থেকে
বিষয় একটা বিষয় ফোকাস রেখে প্লট লেখা যায়। একেই বলে অ্যাডাপটেশন। তাহলে, সেই প্লটে
চরিত্র-চিত্রণ কীভাবে হবে? পাশের বন্ধু-দর্শক এতকিছু জিজ্ঞেস করছেন। উত্তর দিতেই চাইছি। সেই তো সামাজিক সমস্যা। একইরকমের। একই কথা ঘুরেফিরে
লিখতে হয় নাকি?
তাকে জানালাম, ওদেশে এই একই যে হয়েছিল পরিবারে, নারীর সঙ্গে, মেয়েদের সঙ্গে – সেটা
কে জানল? সেটাই তো জানাতে দেশে-বিদেশে ভিনদেশী
নাট্যকারদের লেখা পড়তে হচ্ছে। আরও উল্লেখের যে, একই কথা ঘুরেফিরে লিখতে হয়, যতক্ষণ না তা প্রতিষ্ঠিত হয়। কখনও কি মেয়েদের নিয়ে সমাজ অন্যভাবে দেখবে না? ভাববে না?
-
হয়ত কখনও …
-
তাহলে এখন?
-
এসো নাটক দেখে শেষ করা যাক।
নাটকে কি বিরতি হয়
না?
-
হয়, নাহলে চলবে কেন?
-
মানে?
-
মানে? সংলাপ বলতে বলতে কলাকুশলীদের তো জিভ শুকাবে,
গলা শুকাবে, তারপর কায়িক শ্রম – সব পেরিয়ে গিয়েই এই বিরতি। আর তাছাড়া …
-
তাছাড়া?
-
তাছাড়া থিয়েটার তো মগজের ব্যায়াম, চিন্তারও
ব্যায়াম। সেখানে তো দুপক্ষকেই বিশ্রামে গিয়ে ফিরে আসতে হয়।
-
ঠিক ঠিক।
-
তাহলে এখানে কেন বিরতি হচ্ছে না।
-
আচ্ছা বিরতি মানে?
- মানে পর্দা নেমে যাবে। কলাকুশলীদের দেখা যাবে না। তিনটে বেল পড়বে। ফের শুরু হবে। ততক্ষণে দর্শক মগজে
ধোঁয়া, গরম পানের চা-কফি খেয়ে, চপের স্বাদে
জিভে গন্ধ নিয়ে ফিরবে।
-
তাতেই হবে। তাহলে এখানে এই কাণ্ড হচ্ছে কেন? কেউ কেউ
তো মঞ্চে।
- ঠিকই তাই, একেই বলে থিয়েটারে থিয়েটারি। শিল্পে বা আর্টে, ব্যাকরণ
রোজ তৈরি হতে পারে। এও তাই এও দেখা যাবে, দর্শকের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলার এক উপায়। আসলে এই প্রেক্ষাগৃহে
ঢুকে পড়ার পর, দর্শক যেন আর বাইরের দুনিয়াকে না পেতে পারেন।
-
সঙ্গে যে মুঠোফোন। সেটা?
-
শোয়ের শুরুতেই তো বন্ধ করতে বলা হয়ে থাকে। শোননি?
-
শুনেছি। তাতেও তো কতগুলো ফোন বেজে উঠল। দেখেছ?
-
দেখলাম। মানে, যে সমস্যাগুলো নিয়ে দেখান
হচ্ছে, মানুষ তথা উপস্থিত
নাট্য-দর্শক,
তাতে ঢুকতেই পারেননি। নারীর কতগুলো সামাজিক সমস্যা নিয়ে, এখন বৃহত্তর মানবসমাজের আন্দোলন চলে। এখানে যে ঘটনা অভিনীত হচ্ছে, তাতে আমাদের যাদের সমস্যা
নয়, সেটাতে কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করবে।
বন্ধু বলল, এত শব্দের ব্যবহারে বোঝা গেল যে, তুমি থিয়েটার
বোঝ, আর পড়েছও।
কিন্তু তাতে কই দর্শকের মাথায় আসা গেল? থিয়েটার, আদর্শের থিয়েটারের কত বুলি
আওরেছি অই সন্ধ্যায়। মনেহয়,
সঙ্গের বন্ধুটি আর থিয়েটার দেখবে না। কারন, ওকে তো হাফ টাইমে
থুড়ি বিরতিতে চাফি খাওয়াব বলে এনেছিলাম। তাহলে?
এদিকে নাট্যরূপ নিয়ে ধোঁয়াশা ঘটেছে। এই নাটকের প্রয়োগ, মঞ্চে
ভর্তি শিল্পী। তাদের মধ্যে কতগুলো বসা চরিত্র। কেম্ন যেন ভিড় লাগছিল। আর, পোশাক?
দেখতে দেখতে নাটকের চরিত্র থেকে ছেড়ে আসতে হচ্ছিল। হাটে-বাজারে চোখে পড়ে
এমনই পোশাক। নাটকের চরিত্ররা কোন সময়ের, তা বুঝিনি।
নাটকের সঙ্গে সঙ্গে একটা গল্প শেষ হচ্ছিল। খুব অসুবিধে হচ্ছিল বুঝতে। আসলে মাথামোটা কম বুদ্ধিতে কই চলে
আর থিয়েটার। থিয়েটারে থিয়েটারি বুঝতে গেলে, আরও পড়তে
জানতে শিখতে তবে।
তা
এই আলোচনা চলছে … থিয়েটারের নানা সুলুক, নানা মুলুক। বিশ্ব জুড়ে কত রকমের থিয়েটারি। তাতে উদ্দেশ্য
একদিকে পরীক্ষা করতে করতে চলা, অন্যদিকে তেমনই তো দর্শকের
জন্যেও থিয়েটার। যেখানে পরীক্ষার কারিগরি বিশ্লেষণ করতে পারবেন। এবং যা তাঁদের বোধগম্য হবে বিশ্লেষণ করার আগে। এক্ষেত্রে পাশে বসা দর্শক কতটা বুঝলেন, সেটাই প্রশ্ন। আর লেখার ফোকাসও তাইই। এদিকে পাশের দর্শক উসিবিসি করছেন। কেন তবে ৭৫ বছর? দর্শককে বোঝানোই যদি না গেল, তো।
১৯৪৮ থেকে ২০২৪ সাল – কম তো
নয়। তবে কেন দর্শককে বলতে হবে, আরেকটু দেখুন তবে বুঝবেন।
আসলে, থিয়েটারের দর্শক তো নাট্যবোদ্ধা
নন। সেই মানুষটিকে তাই কোন বিষয় বোঝাতে গেলে -– স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জ্ঞান, ধারণার মধ্যে নেমে এসে বোঝাতে হবে।
তাহলেই
তো থিয়েটারির সার্থকতা।
এই পরম্পরায় লিখিত কিস্তি নাট্যচর্চাও একুশ শতকীয় থিয়েটারে থিয়েটারি নামক এক লেখ্য উপস্থাপনা শুধু নয়। আন্দাজ করা যায়, আমরা নিজেদের জ্ঞান দেখাতে থাকলে -- থিয়েটার দর্শক কতদিন আর?
বিশেষ সূত্রে কালিমাটি পত্রিকার মাননীয় সম্পাদক লেখক কাজল সেন-এর সুবাদে নাট্য-সংস্কৃতির এমনতর আলোচনা করা গেল। থিয়েটারে থিয়েটারি_ আন্তর্জালিক দুনিয়াসংলগ্ন হতে
পারল।
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী…
খুব সুন্দর লেখনী ও ভাবনা।
উত্তরমুছুননমস্কার, দিদি, প্রাণিত হলেম। খুউব উৎসাহিত হলেম।
মুছুনগবেষণা মূলক লেখা।ভালো হয়েছে।
উত্তরমুছুনপ্রীতি জানবেন হে নামহীন __🌼
মুছুনঅনেক গুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠল। এভাবেই প্রশ্ন করা চলতে থাকলেই থিয়েটার নিয়ে থিয়েটার নির্মাণ এর কুশীলব এবং দর্শকদের মধ্যে এক নতুন আগ্রহ ও সম্পর্ক স্থাপন হতে পারে।
উত্তরমুছুনবাহ্, আমিও ঋদ্ধ হলেম। কে এই নামহীন জানতে উৎস্যুক রইলেম।
উত্তরমুছুনসুন্দর লেখনী। খুব প্রাসঙ্গিক।
উত্তরমুছুনKhub sundor
উত্তরমুছুন