ধারাবাহিক উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(১৯)
পারিবারিক চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের অভিযান শুরুর দিনগুলো থেকেই কর্ণেল
শ্যামাঙ্গীর মাথায় বিদ্যুৎ গতিতে খেলে গেল একটা কথা ‘স্থবিরতার অন্ধ জগদ্দল তো এত তাড়াতাড়ি
কখনই নড়ে উঠে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিতে পারে না। সে নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসবে।‘ কর্ণেল সি শ্যামাঙ্গী ঠিক সেই
সময়ই জরুরী ভিত্তিতে মিটিং ডাকে, যে মিটিঙের প্রধান বক্তিরা হল উপত্যকা সেন, চৈতি চট্টোপাধ্যায়, উল্কা চট্টোপাধ্যায়,
নীলনদ চট্টোপাধ্যায়, যে মিটিঙে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল বিপুল সংখ্যক দক্ষ সেনাপতি আর সামরিক
বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন বলে বেশ কয়েকটা সামরিক স্কুল ও শিক্ষা একাডেমী নির্মান করা হবে
শুধু নয়, জাহাজগুলোতে শিক্ষাদানমূলক কাজের অবস্থার উন্নয়নের দিকে, যোদ্ধাদের রাজনৈতিক
জ্ঞান বৃদ্ধির ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীর বিকাশ ও কাঠামো
উন্নতির জন্যে স্থলবাহিনী গঠন করা হলে নতুন ইনফেন্ট্রি, মেকানাইজড ও ট্যাঙ্ক ফর্মাশন,
বিমান, আর্টিলারি কাজকর্ম সম্পন্ন করা হয়। এছাড়াও বত্তমান বিমান কারখানাগুলোর পূণর্গঠন
ও নতুন বিমান ও ট্যাঙ্ক তৈরীর বেশ কিছু কারখানা তৈরী করার সিদ্ধান্তনেওয়া হল যার জন্য
আগে থেকেবেশ কিছু লক্ষমাত্রাও স্থির করা হল
এবং মানের দিক থেকেও উচ্চ জঙ্গী গুণ যুক্ত, মজবুত আচ্ছাদন, ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র, উচ্চগতি
ও সর্বত্র চলাচল করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এর পাশাপাশি আর্টিলারি কামান, তোপ ও মর্টার
কামান, সাবমেশিনগানের উৎপাদনও যাতে বাড়ানো যায় তার জন্য ব্যবস্থা করা হল। জাহাজ উতপাদনের
জন্য বিশেষ দায়িত্ব ডুবো জাহাজ এবং অবশ্যই জঙ্গী বোট ও টর্পেডো বোট। এর জন্য যে বিশাল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার শুরুর
দিকের বেশ কিছুটাই দিগন্তসেনার অর্থদপ্তর মঞ্জুর করল। এইভাবে কাজটা শুরু করে দেওয়া
এবং এই ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের ওপরেই বেশি জোর দেওয়া হল এইজন্যে যে দিগন্তসেনার রাষ্ট্রপতি
তথা প্রতিরক্ষামন্ত্রী কর্ণেল সি শ্যামাঙ্গী চায় একেবারে আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন না
করে যাতে যতদূর সম্ভব সহনশীলতা ও কম ক্ষয়ক্ষতিরমধ্যে দিয়েই যুদ্ধটা দরকার হলে করা সম্ভব
হয় আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটাও যাতে ছোট হতে পারে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে তার শিকার না
বানিয়ে। সামরিক স্কুল ও একাডেমি গুলো একটা একটা করে তৈরী কোড়েঈ চৈতির হাতে ছেড়ে দেওয়া
হল। নীলনদ, উল্কার দায়িত্বের বাইরে থাকা ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করতে শুরু করল। সেইসঙ্গে
একাডেমিতে পড়াবার দায়িত্বও খানিকটা তাকে নিতে হল। উপত্যকা এই সুযোগে তার গবেষণায় মন
দিল যার ফলাফলস্বরূপ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কিছু এমন ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন বিমান
দিগন্তসেনা পেল যা পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রের বা ডূ একটা রাষ্ট্রের হাতেই এখনো অব্দি
আছে। এগুলোর কাজ চলাকালীনই উপত্যকা সেন কেও
একাডেমির ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ কয়েকটা ব্যাপারে প্রশিক্ষন দিতে হল। সেনা একাডেমিগুলোতে
শ্যামাঙ্গী আর শকুন্তলার ছেলেরা ছাড়াও আগমনী জয়েস, ইলোরা যাজ্ঞসেনী, সাসা আর তীর্থ
আর বেদ ভর্তি হল সামরিক স্কুলগুলোতে। এছাড়াও দিগন্তসেনা থেকে প্রচুর ছেলেমেয়েরাই শুধু
নয়, মূল ভূখন্ডের থেকেও প্রচুর ছেলেমেয়েরা এসে ভর্তি হল। শকুন্তলার কুন্তল পদবীভূক্ত
মেয়েদের মধ্যে যারা ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গিয়েছিলতারা উল্কা, নীলনদ আর উপত্যকার অধীনে
গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজে লেগে পড়ল। দ্বিধা, পিপীলিকা, মহিমাও গিয়ে সামরিক একাডেমীতে যোগ
দিল যাতে যতটা বোঝা যায় বা জ্ঞান আহরণ করা যায় সেটাই কোনো কাজে লাগানো যাবে এই ভেবে।
ইতালি থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের দলটাও সেই একই উদ্দেশে একাডেমিতে গিয়ে যোগ দিল। সীমিত
আর্থিক ক্ষমতা বিচার করে একটা অধ্যাদেশ জারি করা হল যাতে বলা হল কারখানার সংখ্যা খুব
বেশি না বাড়িয়ে উৎপাদনী ক্ষমতাটা যতদূর সম্ভব বাড়ানোর কথা বলা হয় যা শ্রমিকরা বিনা
বাক্য ব্যায়ে মেনে নেয়। যে কোনো দিক থেকে ঘোষণা দিয়ে জানানো হয় যে পর পর দু দুটো ক্ষয়ক্ষতি
সহ্য করেও মানবিকতার সম্মান অক্ষুন্ন রেখে যে পাল্টা প্রত্যাঘাতের ব্যবস্থা্র নমুনা
দেখিয়েছে তা ভবিষ্যতেও যে এমন ভাবেই ধরে রাখা সম্ভব হবে তা যেন পৃথিবীর অধিবাসীবৃন্দ
আর তাদের রাষ্ট্রগুলোও মনে না করে।
আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র দিগন্তসেনার সঙ্গে যোগাযোগ
করে অত্যন্ত গোপনে জানায় যে তারা যৌথ ভাবে কাজ কোড়টে চায় শুধু এই কারণে যে দাসত্বের
অভিজ্ঞতা অতীতে তারা অর্জন করে তার বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হবার উপলব্ধিও তারা
অর্জন করেছে বলেই দিগন্তসেনার পত্তন আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই-এ তারা পাশে থাকতে
চায় যদি দিগন্তসেনার আপত্তি না থাকে। কর্ণেল শ্যামাঙ্গীর কাছে এই প্রস্তাব টা গ্রহনযোগ্য
বলেই মনে হয়। সে মন্ত্রীসভার অন্যান্যদের মতামত জানতে চায় এ ব্যাপারে। দেখা গেল প্রায়
সবাই ওই একই মত পোষণ করছে। তাই সর্বসম্মতিক্রমে তারা ওই সব দেশ গুলোকে জানায় যে সম্মানের
সঙ্গে তাদের সাহায্য পেতে দিগন্তসেনার ও ভালোই লাগবে। ফলে সেইসব দেশগুলো সামরিক খাতে
কাজে লাগতে পারে এমন বেশ কিছু ইঞ্জিনীয়ারিং দ্রব্যাদি, যুদ্ধের জন্য নানারকম অস্ত্রশস্ত্র
স্ট্রাটেজিক মালই শুধু সরবরাহ করে না, বেশ কিছু পরিমাণ অর্থও ঋণ দেয়। ডেনমার্ক, নরওয়ে,
পোল্যান্ড, হল্যান্ড, ও মঙ্গোলিয়া ও এগিয়ে আসে দিগন্তসেনাকে সাহায্য করার জন্য।
ফরাসী সরকার তখনও পর্যন্ত তাদের দিগন্তসেনার হাতে তুলে দিতেও
ব্যর্থ হয়। ইরানিরান-এ সমস্ত রাষ্ট্রের মন্ত্রী আমলা, শ্রমিক, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনীয়ার
সবাইকে বন্দি করে মগজ ধোলাই করাটাও চলছে ঘোষণা মতো। সেই সঙ্গে তাদের যাবতীয় সাজ সরঞ্জামও
এবার দিগন্তসেনা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল।
ছমাস পনের দিনের মাথায় দিগন্তসেনার হাত থেকে ইরানিরানকে রক্ষার
উদ্দেশে সন্ত্রাসবাদীরা দেশটাকে মুক্ত করার উদ্দেশে যখন বোমা ফেলল সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর
সদর কার্যালয়ে তখন কর্ণেল শ্যামাঙ্গীর বুঝতে একটুও অসুবিধে হলনা শত্রুপক্ষ তার সদস্যকে
বাঁচাতে আর মগজ ধোলাইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ না করতে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই আক্রমণ করছে।
কিন্তু র্যাডারে ধরা পড়েছে বিমানটা পশ্চিম দিক থেকে এসেছিল। ফলে কোন দেশ থেকে আসা এই
আক্রমণ তা বোঝা যায় না। ইরানিরানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর গেছে তাতে বিশেষ কিছু যায়
আসে না দিগন্তসেনার। তাই সেটা নিয়ে কিছু করারও প্রয়োজন নেই। দিগন্তসেনার বেতার ও দূরদর্শনে
কর্ণেল শ্যামাঙ্গী বিবৃতি দেওয়ার সময় একটা শ্লেষ মিশিয়ে বলল, ‘পিতৃতান্ত্রিক রক্ষাকর্তারা
দেখা যাচ্ছে খুবই দূর্বল প্রকৃতির। এখনো পর্যন্ত লোক সমক্ষে এসে সেই জন্যেই কোনো বিবৃতি
দেওয়ার মতো আত্মবল তারা সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না। পর্দার আড়ালে থেকে আক্রমণ করাটাই
তাদের একটা ধরণ।‘ অন্যান্য অনেক রাষ্ট্রনেতাই এ ব্যাপারে বিবৃতি দিয়ে দুঃখ ও ক্ষোভ
প্রকাশ করেছে।
দুদিন পর কর্নেল শ্যামাঙ্গীর
নির্দেশ মতো বিশাল সেনাবাহিনী সত্তরটি পাহারা জাহাজে করে ইরানিরানে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ল।
মাটিতে পা দিয়েই ওরা সেনাপতিমন্ডলির নির্দেশ মতো দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। তারপর শুরু
করল তাদের অভিযান। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, রেল জংশন,সরকারী ভবন, অর্থনৈতিক ও প্রশাসন
কেন্দ্রগুলো, যোগাযোগ ব্যাবস্থা উপুর্যপরি বোমাবর্ষণে ধ্বংস করে ফেলা হল। জলপথ ও আকাশপথে
সেনা টহল দিতে লাগল শুধু এই জন্যে যাতে সংশোধনাগারের কোনো মানুষ বা আবাসনগুলোতে বাইরের
কেউ এসে হামলা চালাতে না পারে। শিল্প কারখানা গুলোতে কড়া নিরাপত্তায় উৎপাদন চালান হতে
থাকল। ফুড প্রসেসিং শিল্পগুলোতে যাতে যথেষ্ট উতপাদন হতে পারে সেদিকে নজর রাখা হল। আর
সেগুলো দিয়েই সংষোধনাগারের মানুষের খাদ্যের যোগান দেওয়া হল। এইভাবে আকাশ পথে সার্বক্ষণিক
টহলদারি ও পাহারাদারির মধ্যে দিয়ে একটা সমান্তরাল শাসনব্যাবস্থা চালানোর ব্যাবস্থা
করা হল দিগন্তসেনার সেনাপতির অধীনে।
আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আগে যে দলটা এসেছিল সেখানকার রাষ্ট্রগুলোকে
বাদ দিয়ে অন্য আরো চব্বিশটা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল এসে দিগন্তসেনাকে মানবতার পক্ষে
ইতিবাচক এই আগ্রাসনের উদ্দেশে সামরিক শাসন জারি করার ব্যাপারে সর্বপ্রকার সহায়তার ইচ্ছের
কথা জানায় এই জন্যে যে মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের খাদ্য, নিরাপত্তা, পোশাকআশাক
ও অন্যান্য পরিসেবা দিতে জনবল ও অর্থ এবং অন্যান্য যা যা দরকার সেটা দেওয়ার ব্যাপারে
তাদের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাকে তাদেরো একটা দায় ও দায়িত্ব বলে তারা মনে করে। ফলে পারস্পরিক
একটা চুক্তির মধ্যে দিয়ে নাইজেরিয়া, লিবিয়া, রুমানিয়া, সুদান, কঙ্গো ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক,
ঈজিপ্ট, আলজেরিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তানজেনিয়া, আঙ্গোলা, কঙ্গো, মরক্কো, জাম্বিয়া,
নামিবিয়া, সোমালিয়া, বোতসানা, মোজাম্বিক, গাম্বিয়া,লিবেরিয়া, জর্ডন, বুরকিনা ফাসো ও
ঘানা থেকে পচিশজন করে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পাঠানো হবেযারা রাজনীতি, শিক্ষা,
স্বাস্থ্য, কৃষি ও সেচের ব্যাপারে হবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য। এছাড়াও যে কোনো ধাতু ও জ্বালানি
তারা সরবরাহ করবে।
কর্ণেল সি শ্যামাঙ্গীর পরামর্শ মতো দিগন্তসেনার বেতার ও দূরদর্শন
কেন্দ্র যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টাকে বারবার করে দীর্ঘ সময় ধরে সম্প্রচার করে তুলে
ধরল সারা পৃথিবীর সামনে। এর ফলে গোটা পৃথিবীর অধিবাসীদের কাছে দিগন্তসেনার ভাবমূর্তি
এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যে হিসেবচরিত্রচিত্তির-এর শাখা দপ্তর খোলা হলবেশির ভাগ
জায়গায়। কিন্তু গোয়েন্দা দপ্তর দূরদর্শনে আসা
সন্ত্রাসবাদী জোটের চিঠির প্রেরকদের চিনহিত করতে না পারার ফলে যে ব্যর্থতাটা তৈরী হল
তার জন্যে দিগন্তসেনার শান্তি ও নিরাপত্তা বারবার করে বিঘ্নিত হতে থাকল আর সেটা হতেই
থাকবে যতদিন না পুরোপুরি সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব জানা যাবে। তাই সেটাকে রেখেই সমান্তরালভাবে
অন্যান্য কাজও চালিয়ে যেতে হবে, এটা ধরে নিল এবং সিদ্ধান্ত নিল সেখানকার প্রশাসন।
মূল ভূখন্ডে নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দল এই প্রথম লোকসভা নির্বাচনের
মুখোমুখি হল। কর্নেল সি শ্যামাঙ্গী ছাড়া সকলেই এই নির্বাচনে কোথাও না কোথাও প্রার্থী
হয়ে দাঁড়াল আর তুমুল প্রচার শুরু করে দিল। প্রচারের কাজে কয়েকটা জায়গায়কর্ণেল শ্যামাঙ্গীও
অংশগ্রহণ করে তাদের পরবর্তী কাজকর্মের ইচ্ছের কথা তুলে ধরল জনগনের সামনে। বিভিন্ন জায়গায়
প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াল শকুন্তলা, উল্কা, নীলনদ, আগমনী জয়েস, সাসা চ্যাটার্জী, যাজ্ঞসেনী
ও ইলোরা। এছাড়াও মূল ভূখন্ডে নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব-এর অন্যান্য ব্যাক্তিরাও নানা জায়গায়
প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াল। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের কাজে নামল হিসেবচরিত্রচিত্তির
আর গোটা মূল ভূখন্ডের সবটা চষে ফেলে যুদ্ধের প্রসঙ্গ, ইরানিরানে সামরিক শাসনজারি এবং
তার ফলে গোটা বিশ্বের সঙ্গে দিগন্তসেনার সম্পর্কের ও সহযোগিতার কথা লোকের সামনে এমন ভাবে তুলে ধরে যাতে সকলেরই মনে হতে শুরু করে
নির্বাচনটা এবার নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দলেরই জেতা উচিত। একমাত্র তাহলেই তাদের আত্ম
ও সামাজিক মর্যাদায়, নিরাপত্তা ও অন্যান্য ব্যাপারগুলোতে উন্নতি হবার যথেষ্ট সুযোগ
থাকবে। কিন্তু শকুন্তলা ছাড়া তাদের পরিবারের
অন্যরা হেরে গেলেও নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দলটা একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে মন্ত্রীসভা
গঠন করল কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী হল শকুন্তলা চ্যাটার্জী। এর ফলে মন্ত্রীসভায় সে পেলপ্রচুর
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, পোড় খাওয়া, কর্মদক্ষ মন্ত্রীদের যারা কেউ কেউ বিভিন্ন রাজ্যে অথবা
কেন্দ্রেও মন্ত্রী হয়ে দায়িত্বসামলানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মধ্যমেধাচৌকনা দল বা উদারপন্থীদলের
হয়ে। আবার এমন মন্ত্রীও অনেক থাকল যারা নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব দলটা গোটা দেশের আর্থসামাজিক
কাঠামোয় একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে সমর্থ হয় যার ফলে গোটা বিশ্বের সামনে একটা নতুন
ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার উদাহরণ স্থাপন করা যায়। সেই সঙ্গে সঙ্গে নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব
তার মূল দর্শনের জায়গায় অটল থেকে অনেক কিছু দেখবার সুযোগ পায়। ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল
যে রক্ষণশীল সমাজ দল নবদিগন্তহিসেব্দলকে না
পারল গিলতে, না পারল ওগরাতে।
নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব মূল ভূখন্ডে ক্ষমতার আসা ও শকুন্তলা চ্যাটার্জির
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দিনগুলোতে দিগন্তসেনা কিন্তু কঠোরভাবে র্যাডারে পর্যবেক্ষিত তথ্যের
ভিত্তিতে আরো একবার নজর করে যে ফাজাকিস্তানের থেকে একটি বিমান উড়তে শুরু করে সেটা গিয়ে
ইরানিরানের গায়ে ওদের ওদের যে পাহারা জাহাজ মোতায়েন করা আছে আরবসাগরের জলে সেখানে কয়েকবার
পাক খেয়ে আবার পূর্ব দিকে কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়।
কয়েক ঘন্টার মধ্যে মধ্যে খবর আসে যে পাহারা জাহাজগুলোর একটির
ডেকে চার ভাঁজ করা এক খন্ড কাগজ পাওয়া গেছে যাতে অদ্ভূত সব লিপিতে কি সব লেখা আছে যার
অর্থ কেউ বুঝতে পারছে না। দিগন্তসেনায় সেই চিঠিটা পৌঁছালে তারা তার উর্দুতে লেখা প্রথমাংশের
অর্থ উদ্ধার করে বোঝে যারা এটা ফেলেছিল তারা ধর্মীয় মৌলবাদী। কিন্তু তারপরের অংশগুলোর
অর্থ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না যতক্ষণ না তুপাক ইউপানকি এসে বলে যে ওটা কিচে ভাষা
আর ওখানে লেখা আছে মানকো কাপাক যেমন তার বোনকে বিয়ে করে মামা ওক্যল্যিওকে পত্নী হিসেবে
সহবাস করতেন, দিগন্তসেনা তাদের উত্তরসূরী হিসেবে এই ধরণের জুটিদের আশ্রয় দিয়ে মানবসভ্যতার
নিয়ম লঙ্ঘন করছে। তাই তারা অবিলম্বে সাজা পেতে বাধ্য হবে। চিঠির শেষে নিজেদের নাম জানাবার
জায়গায় তারা যে দুটি জীবের চিত্র এঁকেছে, সেটা আগেরবারের চিঠিতেও ছিল। কর্ণেল সি শ্যামাঙ্গীর
নির্দেশে গোটা চিঠির ব্যাপারটাই বারবার করে দেখানো এবং তার উদ্ধার করা অর্থ বেতার ও
দূরদর্শনে সম্প্রচার করা হতে থাকলেও এই ধরনের অজ্ঞানতা আর মূর্খামিকে কর্ণেল শ্যামাঙ্গী খুব একটা পাত্তা না দিয়ে সবাই যে যার
কাজে ফিরে গিয়ে যাতে মন দিয়ে কাজ করে তার জন্য ব্যাপারটাকে ভুলে যেতে বলে। নিজেও মন
থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়।
প্রচুর কাজের চাপ থাকা সত্বেও কর্ণেল শ্যামাঙ্গীকে প্রায় গোটা
পৃথিবীটাকেই ঘুরে ফেলার জন্য সময় বরাদ্দ করতে হয় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা
দেবার আর উদ্বোধন করার জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালগুলো থেকে ডাক আসে আর সেখানে সে যেতেও থাকে ছাত্রছাত্রীদের মনে দিগন্তসেনার
পত্তনের পেছনে থাকাদর্শনটাকে তাদের মনের মধ্যে চারিয়ে দেবার জন্যে। শুধু তার সঙ্গে
দেখা করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেবারবার করে
বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের দল আস্তে থাকে। তারা এসে রাষ্ট্রপতি শ্যামাঙ্গীকে নানারকম প্রশ্ন
করে তার উত্তর শুনতে চায়। তারপর গোটা দিগন্তসেনাটা ঘুরে দেখে অবাক বিস্ময়ে। রাষ্ট্রপতির
আভরণ ও পদমর্যাদার সব কিছু ছেড়ে কর্ণেল শ্যামাঙ্গী বিনা দ্বিধায় তাদের সঙ্গে মেলামেশা
করতে থাকে এমনভাবে যেন সে তাদেরই একজন খুব কাছের মানুষ আর যার জন্যে সে তার নিরাপত্তা
ব্যবস্থার হাত থেকে অব্যাহতি চায় যদিও মন্ত্রীসভা কঠোর ভাবে তার নিরাপত্তা বজায় রাখার
জন্যে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সেগুলো প্রয়োগ করে যেতেই থাকে তাকে না জানিয়েই।
ছাত্রছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থাও কর্ণেল শ্যামাঙ্গীর অনুরোধে বিশেষ ভাবে করা হয় যার
জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো অর্থও নেওয়া হয় না।
এই রকমই একটি ছাত্রছাত্রী দলের সঙ্গে দিগন্তসেনায় একদিন চলে
আসে অভিমন্যু যদিও তখন সে কোনো ছাত্র থাকে না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলের
জন্যে অপেক্ষমান একজন যে জানে সে পরীক্ষায় শুধু পাশই করবে না। বরং সে হবে পরীক্ষায়
সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অন্যতম। দিগন্তসেনায় সে আসার সময় যে ছাত্রছাত্রীদের দলটার
সঙ্গে সে আসে এবং থাকে, ফিরে যাবার সময় কিন্তু সে আর তাদের সঙ্গে ফিরে যায় না। কেননা
ততদিনে সে পটিয়ে ফেলে মন্ত্রীমণ্ডলীর বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে। ফলে তার সেখানে থাকবার
অনুমতিটা গৃহিত হয় সেখানকার স্বরাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক আর সে থেকে যেতে থাকে ছাত্রদের
জন্যও ব্যবস্থিত একটা ঘরে। অনেক চেষ্টা করে সে বাঁধিয়ে ফেলে একটা জ্বর। একদিন কয়েকজনকে
সঙ্গে নিয়ে কর্ণেল শ্যামাঙ্গী তাকে দেখতে আসে আর তার দেখাশোনার জন্য একজন লোক রাখার
ব্যবস্থা করতে গেলে সে পেদ্রো গুয়েররেসকে হাত করে প্রথমে কিছুদিন সেখানেই থাকলেও তারপর
সে কর্ণেল শ্যামাঙ্গীর বাড়িতেই গিয়ে ওঠে। দিগন্তসেনার মন্ত্রীমন্ডলী রীতিমত চিন্তিত
হয়ে পড়ে ক্রমাগত পায়চারি করতে থাকে কর্ণেলের ওপর কোনো অন্তর্ঘাতের আশঙ্কায়। তাদের খাওয়া ঘুম কাজকর্ম সব মাথায় ওঠে। তারা যে
কোনো উপায়ে তাকে তাড়াবার জন্য কোমর বেঁধে লেগে পড়ে। ঠিক সেই সময়ই তার সেই জ্বরটা আবার
ফিরে আসে যেটা মাত্র দুদিন আগেই নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। শ্যামাঙ্গী ওকে সরাবার আর তাড়াবার
কাজে উঠে পড়ে লাগা মন্ত্রীমন্ডলীকে থামিয়ে শান্ত হতে বলে শুধু এইজন্যে যে সে ওকে অনেক
আগে থেকেই চেনে। ফলে ওর কাছ থেকে কোনো ভাবেঈ কোনো অন্তর্ঘাত আসবার সম্ভাবনা নেই। মন্ত্রীমহাদয়রা
চলে যাবার পরে পরেই তার জ্বর ছেড়ে যায়, যদিও সে এমন ভান করে যে সেটা তাকে ছেড়ে যায়নি
আদৌ। মন্ত্রীদের শেষ অব্দি পৌঁছে দিয়ে এসে কর্নেল তার বসার ঘরের একটা সোফায় বসে ডেকে
পাঠায় পেদ্রোকে আর তারপর সে তাকে বলে ওর বাড়িতে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। কথাগুলো
বলেই সে সোজা বাড়ির আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে পড়ে তার ঘোড়ায়। তারপর তাকে নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে দিগন্তসেনা টহল দিতে।
অনেক চিন্তাভাবনার পঅর কর্ণেল ঠিক করে ফেলে পারিবারিক চতূর্থ
ব্যাটেলিয়নকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে ইউরোপ পরিভ্রমণে। এই উদ্দেশে সে হাজির হয় নিহিতপাতালপুরীতে
মানময়ীর ঘরে। মানময়ীকে দেখে ফাগুন আর শ্রাবণের সঙ্গে কথা বলে সোফিয়া আর দিগঙ্গনার সাহায্যে
সে বেশ কয়েক প্রস্থ জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করে, উপমা আর লগ্নলতাকে নিয়ে চতূর্থ ব্যাটেলিয়নকে
সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইউরোপ পরিভ্রমণে। ওদের সঙ্গে যায় জঁ লুক রল্যা এবং তাদের দলের
একজন সহকারী। কথাটা দিগন্তসেনার মন্ত্রীসভার গোচরে আসতেই তারা সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ আধিকারিককে
পাঠায়। তারাও তাড়াতাড়ি গিয়ে ওদের দলটাকে ধরেফেলে ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করে।
পেদ্রো গুয়েররেস পড়ে যায় বেশ খানিকটা বিপদে। সে কিমকর্তব্যবিমূঢ
হয়ে খানিকটা খেপে যায়। সমস্ত ঘটনা শুনে অভিমন্যু তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ে বিছানায়।
তারপর স্নান খাওয়া ঘুম ছেড়ে দিয়ে ভাবতে বসে। ভেবে ভেবে ভেবে ভেবে সে বের করে ফেলে একটা
মোক্ষম পথ আর সেটা সে গিয়ে বলে পেদ্রো গুয়েররেসকে। তারপর দুজনেই বেরিয়ে পড়ে ইউরোপের
উদ্দেশে। একটা সময় তারা ধরেও ফেলে চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের দলটাকে। তারপর কোনো কিছু না
বলে তাদের সঙ্গে চলতে থাকে। কর্ণেল শ্যামাঙ্গী সৌজন্যতা বশতই অভিমন্যুকে জিজ্ঞেস করে
তার শরীর কেমন আছে এখন যার উত্তর দিতে গিয়ে অভিমন্যু খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়ে বলে সে
ভালো আছে কিন্তু আবার খারাপও। সেই কথা শুনে সকলেই হেসে ফেলে। তার উত্তরের ব্যাখ্যাচায়
শ্যামাঙ্গী কথার মানে বোঝা যাচ্ছে না এই যুক্তি দেখিয়ে। সে কিছু বলে না।
অল্প কিছুটা সময় কেটে যাবার পঅর সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে
যায়। যাবার আগে সে বেশ কিছুক্ষণ পেদ্রো কে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বুঝিয়ে বলে এর প্র
ঠিক কী কী করতে হবে। সবার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় সে সকলের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে
সত্যিসত্যিই বেরিয়ে গেলে শ্যামাঙ্গী ছেলেটার সুমতি হয়েছে ভেবে এক ধরণের একাকীত্বে ডুবে
যায়। সে তার ওই একাকীত্বে ওই ভাবেই ডুবে থাকতে থাকবে যতক্ষণ না ছেলেটি আবার ফিরে এসে
তাকে উদ্ধার করবে তার পাপবোধ ও অপাপবিদ্ধতার হাত থেকে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন