ধারাবাহিক উপন্যাস
হে নেপথ্যচারিণী
(১০)
অঙ্গম এযায়াত্ব
সকালে উঠে দেখি বসার ঘরে হোম থিয়েটারে মৃদু স্বরে বাজছে অর্ঘ্য সেনের "যে ছিল আমার স্বপনচারিনী"। মধ্যিখানে সোফায় বসে আশুদা ম্যাক্সওয়েল চাকতি, রঙ, তুলি আর প্যালেট নিয়ে একমনে কী সব গবেষণা করছে। গেল এক সপ্তাহ আমার আর আশুদার তেমন নিজস্ব কাজগুলো করা হয়নি। এই কাজ না হয়ে ওঠার কারণ অত্রির হঠাৎ গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়া, আর শহর জুড়ে একটার পর একটা রহস্যখুন, যা মিডিয়া জগত 'ত্রিনেত্র খুন' এর বাহারে তকমা এঁকে দিয়েছে। এরই ভিতর আবার নাটকের রঙ্গমঞ্চে যে নতুন চরিত্রটির আবির্ভাব ঘটেছে, তার নাম সোহরাব চক্রবর্তী। মা বাঙালি হিন্দু। বাবা মুসলমান। সোহরাব তার মায়ের পদবী রেখেছে। সে লেক টেম্পল রোডে ঘটে যাওয়া শেষ খুনের চাক্ষুস সাক্ষী। তার উপর তার আছে এক বিরল রোড। প্যালিনপশিয়া। এই সব সূত্র ধরে সেইদিনের ঘটনার পর মাঝেমাঝেই কথা হচ্ছিল সোহরাবের সঙ্গে। বিশেষত সোহরাব সম্পর্কে আশুদার উৎসাহের আরো একটা কারণ হল সোহরাবের ফিল্ম। আশুদা যাকে ফোনে তার আলো আর রঙ নিয়ে গবেষণার কথা বলেছে। সেসব কথা শুনে ছেলেটি বেশ উৎসাহী হয়ে পড়েছে। আর আশুদাও প্রবল উৎসাহে তার গবেষণায় মন দিয়েছে।
গেল এক সপ্তাহ শহর কলকাতা
নিঝুম। শান্ত। নতুন কোনও মৃত্যুর খবর নেই। তথাগত অধিকারীও নতুন কোনও তদন্তর তথ্য জানাতে
পারেনি। অন্যদিকে অনুসূয়ামাসি আসবার পর থেকে অত্রি এখন বেশ নজরবন্দি রয়েছে। তাই তার
রাতে হেঁটে রাস্তায় বের হয়ে পড়বার রোগ আপাতত নিয়ন্ত্রণে। কলেজে যতক্ষণ থাকে, মন দিয়ে
কাজ করে। অনেকগুলো উত্তর না জানা প্রশ্ন রেখে যেন হঠাৎই রহস্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে আশুদাকে বললাম, "চাকতিতে নতুন নকশা কাটছ বুঝি?"
আশুদা চাকতিতে রঙের বিন্দু দিতে দিতে বলল, "নকশা নয়। ভারসাম্য। সঙ্গীত, রঙ ও গতিময়তার
ভারসাম্য। আশ্চর্যের এটাই যে, সব মিলিয়ে একটা পরিণতি। ধূসর বর্ণ। আমাদের মস্তিষ্ককোষের
মতোই।" আমি দেখলাম ম্যাজেন্টার অংশটা আশুদা আরও গাঢ় করে দিচ্ছে।
-একটা অবাক ঘটনা। ওই
ফিল্ম ডিরেক্টর ছেলেটা। সোহরাব। ডাক্তার সবিতা আগরওয়ালের ছেলে শুভাত্রেয়। তাঁর অ্যাসিসটেন্ট
শুভঙ্কর শাসমল। এদের সকলেরই মস্তিষ্কে অস্ত্রোপ্রচার হয়েছে। এর অর্থ মানুষের হাত পড়েছে
ঈশ্বরলব্ধ কোষে। সেই কারণেই কি এরা তিনজন এতো রহস্যময়?
-সোহরাবের ক্ষতটা বছর
চারেক আগেকার। একটা পথ দুর্ঘটনা। অন্তত ও তাই বলল। আগে একধরনের ব্রেন অপারেশনের প্রচার
হয়েছিল নিশ্চয়ই জানিস। মানুষের মস্তিষ্কের একটা অংশ, যাকে বলে 'লোব', উপড়ে নেওয়া হতো
নাকের উপরের দিকে একটা ছোট গর্ত করে। ইয়ুরোপ আমেরিকা জুড়ে বেশ ফলাও করে বিজ্ঞাপনও দেওয়া
হতো।
-জানি। লোবোটমি।
-ঠিক। সেই বিজ্ঞাপনে
কী লেখা থাকত জানিস? দাবী করা হতো, লোবোটোমির পর মানুষের মনে আর অবসাদ, দুঃখ, যন্ত্রণা,
ভয় থাকবে না। পরে অবশ্য সেই অপারেশন জনপ্রিয়তা হারায়। এখনও অনেক ওষুধ আছে যা দিয়ে ওই
লোবোটোমি পরবর্তী অবস্থা কেমিক্যাল মারফত তৈরি করা যায়।
-সোহরাবই আততায়ী। এমন
তো হতেই পারে!
-পারে। কিন্তু আপাতত
আমাদের সামনে তিনটি প্রশ্ন। এক। ত্রিনেত্র রহস্যর হত্যাকারী কে? দুই। অত্রির স্বপ্নে
দেখা নেপথ্যচারিণীর রহস্য।কে সে? আর তিন। শকুন্তলাদেবীর ধর্ষণকারী অভিনন্দন শিকদার
ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কে? যে খুঁড়িয়ে হাঁটে। সে কি টপ্পাবিশারদ মনোরঞ্জন শিকদার?
নাকি অন্য কেউ! এই তিনটি প্রশ্ন এখন আমার কাছে রঙের হিউ, ক্রোমা আর ভ্যালুর মতোই। এদের
ভারসাম্য ঠিক থাকলে তবেই উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে।
আজ কলেজে সামান্য কাজের
চাপ আছে। তাই সময় মতো তৈরি হয়ে নিতে হল। জলখাবার আগের দিন রাতে ফ্রিজে ভরা থাকে। সামান্য
মাইক্রোতে গরম করে নিলেই খাওয়া যায়। বেরোবার সময় বসার ঘরে দেখলাম সোহরাব বসে রয়েছে।
সোহরাব যে আসবে, আশুদা বলেনি তো! আমাকে দেখতে সপ্রতিভ হাসলেও দেখলাম ওর চোখের মণি স্থির
নেই। মস্তিষ্কের অসুখ প্যালিনপশিয়া একদিকে ওকে দীর্ঘদৃষ্টি দিয়েছে, অন্যদিকে তেমনই
তাকে চঞ্চল করে তুলেছে। কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ কর্মযজ্ঞে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি এদের কোনওটাই।
বুঝলাম আশুদা তার গবেষণার একজন সুযোগ্য দোসর পেয়েছে এতদিনে।
রাস্তাঘাটে কেমন ছন্নছাড়া
ভাব। পুজো আসতে এখনও ঢের দেরি। তবু যেন গড়িয়াহাটের বাজার দোকান যুদ্ধকালীন তৎপরতায়
সেজে উঠছে। বিশ্ববাজারে এই টিকে থাকাটা তো অনেকটা সেই যুদ্ধেরই মতো। হঠাৎ খবর ভেসে
আসছে।ইউক্রেনের একটা প্রাণবন্ত শহর মারিওপল শ্মশান বনে গেছে। মানুষজন কাক পক্ষী, কেউ
বেঁচে নেই। এই যে এক দেশের আরেক দেশের প্রতি আগ্রাসন, এর কারণও তো সেই বিশ্ববাজারের
যুদ্ধই! ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম ডিপার্টমেন্টে। আজ পরপর ক্লাস। তার উপর কোলকাতা পুলিশের
গোয়েন্দা বিভাগের একটা ছোট অনুশীলন টিম আসবে দুপুরে। ওদের জন্য ডাযাকটাইলোগ্রাফি বা
আঙুলের ছাপ বিষয়ক একটা ক্লাস নিতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আঙুলের
ছাপ আলাদা। শুধু তাই নয়। সেই ছাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ভিতর যে ধরনটি
পাওয়া যায়, তার নাম 'লুপ'। অর্থাৎ ঢেউ খেলানো নকশার মতো। মানুষের জীবনের মতোই তার আঙুলের
ছাপের ধরন। কখনও চড়াই। কখনও বা উতরাই। ক্লাস সেরে নিজের কেবিনে আসতেই রঘুপতি জানান
দিল, একটি মহিলা দীর্ঘক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করে চলে গেছেন। রঘুপতির বর্ণনায় বুঝলাম,
সুচন্দ্রা এসেছিল। আবার অত্রির কিছু হলো? আজ তো ওর ছুটি হলো। জল্পনাকল্পনা দানা বেঁধে
উঠছিল।রঘুপতি জানাল, ফোন বন্ধ পেয়ে সুচন্দ্রা আমার জন্য একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে।
চিরকুট হাতে পেয়ে পড়তে লাগলাম। "অর্কবাবু। আমি আপনার ফোন সুইচ অফ পেয়ে মেসেজ করতে
সাহস পেলাম না। আজ রাতে আপনার আর আশুবাবুর আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রইল।বিশেষ কারণ। এলে
জানতে পারবেন। প্লিজ আসবেন। আমি অপেক্ষা করব।" চিঠির ভিতর একটা অদ্ভুত আন্তরিকতা
ও রহস্যময়তা মেশানো ছিল যা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। নিছক মোবাইলে মেসেজে এই মাদকতা থাকত না।
আমার কলেজের কাজ প্রায় শেষ। অগত্যা ঘরে ফিরে চললাম। আশুদাকে ম্যাক্সওয়েল চাকতি থেকে
সরিয়ে চালতাবাগান নিয়ে যাওয়ার গুরুভার এখন আমার কাঁধে।
সন্ধ্যা হতেই আশুদা
আর আমি চললাম অত্রি আর সুচন্দ্রার বাড়ি। যেতে যেতে পথে আশুদা শুধু বলল, "সোহরাবের
অসুখটা জেনুইন, বুঝলি। আজ ওর সঙ্গে আলোচনা করতে করতে বুঝতে পারছিলাম, সত্যিই আমাদের
সাধারণভাবে দেখা দৃশ্য সোহরাব বেশ খানিকক্ষণ তার দৃষ্টির ভিতর ধরে রাখতে পারে...
-আর কপালের কাছে কাটা
দাগটা?
-চারবছর আগে বাইক অ্যাকসাডেন্ট।
মাথায় চোট। সোহরাব তাই বলল।
-তাহলে ত্রিনেত্রর সাসপেক্ট
তালিকা থেকে সোহরাব বাদ। তাই তো?
আশুদা আর কিছুই বলল
না। শুধু তার রহস্যঘন হাসি দেখে বুঝলাম আশুদা বলতে চাইছে, কেউ কি আর তালিকা থেকে অতো
সহজে বাদ যায়?
চালতাবাগানে গাড়ি পার্ক
করতেই অত্রি আমাদের অভ্যর্থনা জানালো ভিতরে। ব্যাপার কী? বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে।
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত্রি আর সুচন্দ্রা ঘরের ভিতরে এক আদিভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে
ছোট ছোট হলুদ ন ওয়াটের এলইডি বাল্ব জ্বালিয়ে। আমি আর কৌতূহল না চেপে বলেই ফেললাম, "ব্যাপার
কী অত্রি?"
অত্রি লাজুক হেসে বলল,
"তেমন কিছু নয় স্যার। আজ সুচন্দ্রার জন্মদিন!"
বসার ঘরে সুচন্দ্রা
আর তার মাসি অনসূয়া বসেছিল। আমরা আসতে উঠে দাঁড়াল। আশুদা হাত বাড়িয়ে সুচন্দ্রার হাত
ধরে বলল, "শুভ জন্মদিন জানাই তোমাকে। খালি হাতে এসেছি কিন্তু।" সুচন্দ্রা
লাজুক হেসে বলল, "আশীর্বাদ করুন আমাদের।"
খাবারদাবারের বন্দোবস্ত
করতে অত্রি আর সুচন্দ্রা ভিতরঘরে চলে গেলে খানিকটা অনসূয়াদেবীর সঙ্গে একান্তে আলাপের
সুযোগ পেলাম আমরা। অনসূয়াদেবীর বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই। তিনি আর তাঁর স্বামী
রক্তিম বর্তমানে পেনসিলভানিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা নিয়ে অধ্যপনা করছেন। অনসূয়াদেবীর
গবেষণার বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ। প্রাচীন মানবসভ্যতার নানান সংকেত ও তার বিবর্তন নিয়ে তাঁর
এই গবেষণা। কথায় বার্তায় চলে এল তাঁর বালিকাকালের কথাও।
-চলুন না আমাদের শৈশবকৈশোর
ও যৌবনের প্রবাসে। অপূর্ব প্রকৃতির আতিশয্য ও অনুশাসন। দেখলে মন ভরে যায়।
-ছত্তিশগড়?
-হ্যাঁ। জগদলপুরে আমাদের
সকলকে যখন নিয়ে এলেন মুরারীকাকু, মানে অত্রির বাবা, তখন আমাদের বিধ্বস্ত সময়। কোনও
মতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশৃঙ্খল জীবনের টুকরোগুলো গুছিয়ে নিতে চাইছি যেন।
আশুদা সুচন্দ্রার সদ্য
রেখে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে।
-অত্রি আর সুচন্দ্রা
দুজনেই কিন্তু বলে। আপনি না থাকলে ওরা আর সামলে ঠিকঠাক বড় হয়ে উঠতে পারত না। আপনার
বোনের দুর্ঘটনাটা তো আসলে একটা ভয়ানক শক। তা রক্তিমবাবুর সঙ্গে পরিচয় হলো কী করে?
-রক্তিমের সঙ্গে ওখানেই
পরিচয়। রক্তিম বাঙালিপাড়ায় থাকত। ও আমার থেকে বয়সে বছর দুয়েকের ছোট। কিন্তু তাতে আমাদের
সমস্যা হয়নি। অত্রি আর সুচন্দ্রা বড় হয়ে যেতেই আমি আর রক্তিম বিয়ে করে নিলাম। তারপর
প্রবাস।
-পৃথিবীতে সব সভ্যতার
মূল সংকেতচিহ্ন এক। এই ভাবনায় আপনি বিশ্বাস করেন?
-করি। তার প্রমাণ আমি
আমার গবেষণার ভিতর পেয়েছি। একদিন দেখাব আপনাদের সেইসব। চলুন আমাদের সঙ্গে ছত্তিশগড়।
ওরা দুজনও তো আপনাদের উপর খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমি আর রক্তিম সন্তান নিইনি। ওদেরকেই
তো সন্তান মনে করে বড় করেছি। দিন পাঁচেকের ব্যাপার। সামনে উৎসব আসছে। চলুন। ঘুরে আসি।
কথা বলতে বলতে রাত বেড়ে
গেছে নিজের অজান্তেই। খাবারের আয়োজন অত্রি আর সুচন্দ্রা দুজনেই মিলেমিশে করেছে। খাবার
টেবিলে আমাদের সঙ্গে আরও একজন যোগ দিল। মনসুর গাজি! ওকে অবশ্য আমি আশা করিনি। অবশ্য
সুচন্দ্রা একটা সারপ্রাইজের কথা বলেছিল। মনসুর গাজিই কি সেই 'সারপ্রাইজ'। আশুদা জিজ্ঞেস
করল, "কী মনসুর? রেশমির তবিয়ত কেমন?" মনসুর মাথা নেড়ে বলল, "ভালো নাই।"
খাবার পর সকলকে অত্রিরা
নিয়ে এল ভিতরের আরও একটি ঘরে। এখানেও অল্পপাওয়ারের বাতির আলো একধরনের রহস্য সৃষ্টি
করেছে চারপাশে। ঘরের মধ্যিখানে একটি সাবেকি আমলের আবলুশকাঠের টেবিল। তার মধ্যিখানে
একটি পুরুষ্টু মোমবাতি রাখা। টেবিলের চারপাশে ছটি চেয়ার রাখা। আমাদের সবাইকে একে একে
সেই চেয়ারে বসতে বলল মনসুর গাজী। তারপর অত্রিকে ঈশারা করতেই অত্রি ঘরের টিমটিমে হলুদ
আলোটি নিভিয়ে একটি নীল আলো জ্বালিয়ে দিল। নীলাভ ভৌতিক সেই পরিবেশে মোমবাতির আলোয় মনসুরের
দুই চোখ যেন জ্বলজ্বল করছিল। সেই কথা বলছিল। আমরা পরস্পর পাশাপাশি বসে শুনছিলাম। টেবিলের
এক প্রান্তে মনসুর, অন্যপ্রান্তে সুচন্দ্রা।
-আজ কা রাত ইবলিশকা
রাত। আজ হাম শকুন্তলা বহিনকো আপনোকে বিচ বুলায়েঙ্গে।
অন্ধকারে আশুদাকে ঈশারা
করলাম আমি। মনসুর প্ল্যানচেটের কথা বলছিল কিছুদিন আগে। আজ তবে সেই আয়োজন। মনসুর বলে
চলে।
-আজ শকুন্তলা আপা কিছু
বলতে চান আমাদের। কিন্তু তাকে বলতে দেবার জন্য আমাদের একটা ইনশানি শরীর লাগবে। সুচন্দ্রাবহিন
সেই শরীর হবে। কী বহিন। রাজি?
অত্রির মধ্যে সামান্য
অস্বস্থি দেখা দিলেও সুচন্দ্রা শান্তভাবে মাথা নেড়ে জানান দিল। সে রাজি। এরপর মনসুর
দুইপাশে দুই হাত ছড়িয়ে গুনগুন করে বলতে মন্ত্র বলতে শুরু করল। সারা ঘর নিঃস্তব্ধ। শুধু
গুমগুম একধরনের গোঙানির মতো মনসুর গাজি শকুন্তলাদেবীর
আত্মাকে আবাহন করছে। এই মুহূর্ত যেন চেতন আর অবচেতনের আভ্যন্তরীণ মুহূর্ত। মনের ভিতরের
অবচেতনিক প্রবৃত্তি আলোআঁধারির ভিতর থেকে যেন ফেনার বুদবুদের মতোই বাইরে বের হয়ে আসতে
চাইছে। খানিক এইভাবে চলার পর সুচন্দ্রার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি তৎপর হয়ে উঠতে
যেতেই আশুদা খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরল। ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে শান্ত হয়ে বসতে বলল।
সুচন্দ্রা কয়েক সেকেণ্ড থরথর করে কেঁপে টেবিলের উপর ধপ করে পড়ে গেল। ঠিক তখনই টেবিলের
উপর মোমবাতিটা হঠাৎই নিভে গেল। সুচন্দ্রার ঠোঁট নড়ছে। সে যেন বিড়বিড় করে কী বলতে চাইছে।
মনসুর গম্ভীর গলায় বলল, "শকুন্তলাদেবী। আপনি এসেছেন?" সুচন্দ্রার সারা শরীর
থরথর করে কাঁপছে। মনসুর বলে চলে, "কে আপনির ওপর অত্যাচার করেছিল? বলুন আমাদের।
কে?"
সুচন্দ্রা গোঙানির মতো
বলে ওঠে, "অভিনন্দন। অভিনন্দন।" মনসুর বলে চলে।
-আর কে শকুন্তলাদেবী?
বলুন আমাদের। কে বা কারা?
সুচন্দ্রা এইবার ধীরে
ধীরে মাথা তোলে। তার দুই চোখ রক্তাভ। সে সরাসরি তাকিয়ে আছে অত্রির দিকে। মনসুর বলে
চলে, "কে? কে বা কারা?"
সুচন্দ্রার গলার ভিতর
থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে ওঠে। সে অত্রির দিকে তর্জনী তুলে চিৎকার করে ওঠে। "মুরারী।
মুরারী।"
এখানেই নিশিযাপনের যবনিকাপতন
ঘটল। মনসুর অত্রিকে ঘরের আলো জ্বালতে বলে সকলকে প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে গেল। তাকে ভিতর
থেকে অস্থির লাগছিল। সুচন্দ্রা অচৈতন্য থাকলেও তার হাতে আঙুল রেখে বুঝলাম, পালসরেট
ঠিকই আছে। অনসূয়া আর অত্রি ওকে ধরাধরি করে ভিতরঘরে নিয়ে যেতে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। নিশুতি
চালতাবাগানের রাস্তায় গাড়ি চালানো ভারি সহজ। জনমনিষ্যিহীন। শুধু আসন্ন উৎসবের তোরজোড়ে
অসম্পূর্ণ প্যাণ্ডেলগুলো নিশিপ্রহরীর মতোই দাঁড়িয়ে আছে একাকী। আশুদা গাড়ি বসে গম্ভীর
হয়ে বলল।
-কী বুঝলি?
-মন দুরকম সংকেত দিচ্ছে
আশুদা। বিজ্ঞান মানলে এটা একটা ডিসোসিয়েটিভ ফিট। সুচন্দ্রার এর আগেও এটা হয়েছে। কিন্তু...
-কিন্তু কী অর্ক?
-ওইভাবে মোমবাতি নিভে
যাওয়া। আর...
-আর?
-আচ্ছা আশুদা। সত্যিই
যদি মুরারী পালচৌধুরী শকুন্তলাদেবীর দ্বিতীয় ধর্ষক হয়? হতেই তো পারে। হয়তো সেই অপরাধ
ঢাকতেই সে অত্রি আর সুচন্দ্রার প্রতীপালনের দায়িত্ব নিয়ে নিল কাঁধে। হতেই তো পারে?
-হতেই পারে। অসম্ভব
নয়। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে এই যুক্তিস্থাপন, সেটা এই ক্ষেত্রে বেশি জরুরি। শুধুই মোমবাতির
হঠাৎ নিভে যাওয়া তো সত্যতার ভিত হতে পারে না!
-সব কিছু কী বিজ্ঞান
দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় আশুদা? হয়তো আজ সত্যিই সুচন্দ্রার ভিতর শকুন্তলাদেবীর আত্মা
ঢুকে এসেছিল।
-মোমবাতি নিভে গেল কখন
অর্ক? মনে করে দেখ।
-যখন সুচন্দ্রা জ্ঞান
হারাল।
-তখন তোদের নজর সুচন্দ্রার
উপর ছিল। আমার নজর ছিল মনসুর গাজীর উপর। মনসুর ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়। আমি দেখেছি।
সবকিছুই বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় অর্ক।
-তাহলে পুরোটাই বুজরুকি?
-না। বিজ্ঞান। মুরারী
পাল চৌধুরী শকুন্তলাদেবীর দ্বিতীয় ধর্ষক ও হত্যাকারী কিনা সময় বলবে। কিন্তু আজ এই ঘটনায়
একটা কথা স্পষ্ট হল। সুচন্দ্রা মনে মনে অত্রির পিতাকেই অপরাধী ভাবে। তার এই ভাবনা কি
শুধুই অবচেতনিক, না তার পিছনে প্রামাণ্য যুক্তি আছে, সেইটে আমাদের মেঘনাদের মতোই বের
করতে হবে অরিন্দম। বুঝলি?
-আর?
-আর ছুটির প্রয়োজন।
পাঁচদিন অ্যারেঞ্জ কর। ছত্তিশগড় যাই চল। ওখানটা ঘোরা হয়নি আমার।
কথা বলতে বলতেই ফিরে
এলাম ঘরের কাছে। নিশুতি রাতে সারা শহরটা জুড়ে যেন শুধুই রহস্য আর রহস্য। লেকটেম্পল
রোডের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মন শিউরে উঠল। এখানেই সেই মণিপুরী মহিলাটির লাশ পড়ে ছিল
মাত্র কয়েকদিন আগে! চেতন আর অবচেতনের আলোকবর্তিকায় এতোগুলো রহস্য যে এভাবে আমাদের ছেঁকে
ধরবে কে জানতো!
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন