বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

তানিয়া গুহমজুমদার

 

সমকালীন ছোটগল্প


নন্দিনী

আকাশ একেক সময়ে কি রকম একটা অলীক জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিশেষ করে এমন মেঘলা আকাশ। ঘোর ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে থাকা পৃথিবীটাকে বড় প্রিয় মনে হয় তখন। এখন তেমনই। চরাচর জুড়ে নেমে আসছে অন্ধকার। ঘর জুড়ে। যেন তখন চিরকালের তার থাকা। যেন যা কিছু নশ্বর, তার সবটুকুর উপরে কেমন এক অন্ধকারের মায়া।

এখন দুপুর। অন্তত ঘড়ির কাঁটা তাই বলছে। অথচ আকাশ দেখে কে বলবে! দিন দুয়েক ধরে এমনই সাজে সেজে আছে সে। ছুটির দিন। তার উপরে এমন আকাশ। যে যার ফ্ল্যাটে, ঘুমে অথবা ঘুমের আবেশে। নন্দিনীই কেবল এ ঘরে জেগে। তার আর ঘুম কই! গত এগারো বছর ধরে তার ঘুম তো কেবল ঘুমের ভান। অমলের হঠাৎ চলে যাওয়ার তো এগারো বছরই হ’ল।

বৃষ্টি আবার নামলনন্দিনী এসে দাঁড়ালো জানলার সামনে। কাঁচের স্লাইড টানা আছে। চেয়ারটা টেনে গুছিয়ে বসল। কার্নিশে অথবা কোন গাছের ডালে পাখিদের ব্যস্তসমস্ত কথাবার্তা কানে আসছে। কি কথা! নাকি দাম্পত্য কলহ! একটা কাক ভেজা ডানা মেলে উড়ে গেল সামনে দিয়ে। কোথায় যে ওর বাসা, কে জানে! ওর সঙ্গিনী অপেক্ষা করছে হয়তো। -সাবধানে যাস। বলেই হেসে ফেললো ও। আসলে এতগুলো বছরে একা থাকতে থাকতে নিজের সঙ্গে কিংবা পাখপাখালির সঙ্গে কথা বলা অভ্যাস হয়ে গ্যাছে নন্দিনীর। জলের সঙ্গেও কথা বলে। এখন যেমন দেখছে, এ পোল থেকে ও পোল শুধু জলের বিন্দু কেব্‌লের তার বেয়ে টুপটাপ। আর সব নিস্তব্ধরাস্তায় একটা কুকুরও নেই। -তোদের কি মজা, তাই না! জলের ওই নিরন্তর যাওয়া দেখতে দেখতে রোপওয়ের কথা মনে পড়ল সদ্য তেষট্টিতে পা দেওয়া নন্দিনীর।

বেশ লাগছে দেখতে। জল চলেছে দুলে দুলে। ড়োপওয়ের বাক্স যেমন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। নিচে কুয়াশা, সবুজের চাদর। সেই কবে সবাই একসঙ্গে যাওয়া হয়েছিল হরিদ্বার! কতবার যে ওঠা আর নামা। আর কেবল কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া। মনে আছে, নৈনিতাল লেকের জলে ভাসতে ভাসতে কোথা থেকে প্রকান্ড এক মেঘ এসে ঢেকে দিল সবকিছু। মেঘ না কুয়াশা। আর শর্মীর সে কি চিৎকার! গেল বুঝি সবাই হারিয়ে! একদিন তো ঝোপ থেকে ফুল তুলতে গিয়ে যাচ্ছিল প্রায় খাদের মধ্যে পা স্লিপ করে। ভাগ্যিস অমল পাশেই ছিল। আর কত কিছু যে নিত্যনতুন খাওয়াদাওয়া! তিনজনের ক’টা দিন বড় আনন্দে কেটেছিল সেবার। যেন স্বপ্ন। নন্দিনীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসির ভাঁজ জেগে উঠল। আর সেই জগতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য নন্দিনীও যেন আকুল।

হঠাৎ দরজায় বেল বেজে উঠলো। এই মুহূর্তে উঠতে ইচ্ছে না হলেও উঠতে তাকে হবেই। কে এলো রে বাবা এ সময়ে! যেতে যেতে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। সবে তো সোয়া তিনটে। মিনতির তো এখন আসার কথা নাকে আসতে পারে! বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলল। একটা বছর পঁচিশের মেয়ে। কাঁধে ব্যাগ, হাতে রাইটিং প্যাড গোছের কিছু একটা।

-ম্যাম, নমস্কার। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। দু মিনিট। একটু সময় দেবেন?

-এখন একটু অসুবিধে আছে। আপনি পরে আসুন ভাই।

নাছোরবান্দা মেয়েটি হাতের তালুতে চুলের জল মোছে। বলে, শুনুন ম্যাম। একটু শুনুন। দু মিনিটের বেশি সময় নেব না।

নন্দিনীকে যেন শুনতেই হবে তার কথা। অদ্ভুত গায়েপড়া ভাব। নন্দিনীরও কেমন যেন রোখ চেপে যায়।

-সরি। সময় নেই। অন্য জরুরী কাজ আছে।

তবু মেয়েটি বলেই চলে, দুটো মিনিট আমার কথা একটু শুনুন। তা হলেই হবে। আমি কিছু বিক্রি করতে আসি নি ম্যাম। একটা সার্ভে করতে এসেছি।

-বুঝলাম। কিন্তু বললাম যে আমার কাজ আছে। আপনি এখন আসুন।

দরজাটা প্রায় ঠেলেই ওর মুখের উপর লাগিয়ে দিল নন্দিনী।

এসে বসল চেয়ারে। আবার উঠে গেল জানলার সামনে। মেয়েটা ব্যাগটা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করছে। প্রায় ভিজেই গিয়েছে। বৃষ্টিটাও বেড়েছে আবার। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। মেয়েটাকে একটু বসতে দিলেই বোধহয় ভাল হত। কেমন একটা চিনচিনে অস্বস্তি হচ্ছে। এমন দুর্যোগে কেউ বেড়োয়! হয়ত খুব দরকার মেয়েটার। না হলে কি আর এমনভাবে আসে! আহা, অমন করে না বললেই পারত সে। মেয়েটার কথা দু মিনিট শুনলে খুব কি ক্ষতি হত নন্দিনীর! বসেই তো ছিল ও। যাক গে, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। কি আর করা যাবে। যতই খারাপ লাগুক, এখন আর ভেবে লাভ কি!

পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল নন্দিনী। তবু খারাপ লাগাটা যাচ্ছেই না। কেমন একটা অপরাধবোধ। আসলে ও নিজের ঘোর থেকে বোধহয় তখনো বেড়িয়ে আসতে পারে নি। অন্য সময় হলে, এমন ধরনের ঘটনা ঘটতোই না। ধুস্‌, বিকেলটাই মাটি। বিছানার কাছে এসে ভাবে, শুয়ে নিলে হয় খানিক। পরক্ষণেই হেসে ফেলে। এখন শুলেই হয়েছে আর কি। গা ম্যাজ ম্যাজ করবে্‌ বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করবে না। আর খানিক পরেই তো মিনতি এসে পড়বে। নাঃ আজ আর ওর শোয়া হবে না। টিভিটা খুলে বসে।

কিছুক্ষণ পরেই আবার বেল। পরপর দু’বার। যেন খুব ব্যস্ত।

এবার নিশ্চয়ই মিনতি। মেঘ দেখে তাড়াতাড়ি এসেছে হয়ত। দরজা খুলতেই দেখে, ও মা শর্মী!কোলে বছর দুয়েকের ফুটফুটে মেয়ে।নন্দিনী প্রায় চমকে ওঠে।

-কি ব্যাপার! তুই! সমর কই!

শর্মী চুপ।

-তবে কার সঙ্গে এলি? সমর এলো না কেন? এই বৃষ্টির মধ্যে একা একা? একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করে ফেলে নন্দিনী।

রিক্সাওয়ালা নামিয়ে দিয়ে গেল একটা বড়ো ব্রিফকেস আর একটা বিগ শপার। শর্মী টাকাটা দিয়ে দেয়।

-আয় আয়। ছাতা নেই! দুজনেই তো ভিজে গেছিস একেবারে! ইস্‌ তুই কি রে! একটা খবর দিবি তো। বাচ্চাটার কি শাস্তি বল্‌তো।

এতক্ষণ শর্মী একটা কথাও বলে নি। মুখখানা যেন কেমন পাঁশুটে হয়ে আছে। যেন রক্তশূন্য।

-তোর শরীর খারাপ নাকি? তোয়ালে নিয়ে আগে বাচ্চাটার মাথাটা ভালো করে মোছা। ওখানে নাইটি আছে। শাড়িটা ছাড়।

-মা!

-কি রে? কি হয়েছে?

- সমর আর আসবে না।

-কেন! নন্দিনী অবাক।

এবার শর্মী আর পারে না। বাচ্চাটার সামনেই মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে।

-ডিভোর্স পেপার এখানে পাঠিয়ে দেবে বলেছে। সই করে রাখতে হবে। ওর লোক এসে কাল নিয়ে যাবে।

-কেন! এত কি হ’ল যে, এতদূর? এত তাড়াহুড়ো!

কান্নাজড়ানো গলায় শর্মী বলে, অনেকদিন ধরেই ওর অফিসের একটা বিধবা মেয়েকে জড়িয়ে অনেক কথাই এদিকওদিক থেকে কানে আসছিল। কালকে ছেলেকে নিয়ে একটু শপিং করতে বেড়িয়েছিলাম। বাড়িতে ফিরে দেখি, সেই মেয়েটা শোয়ার ঘরে...।

নন্দিনীর অবাক হওয়ার যেন আর শেষ নেই!

-আর সহ্য করতে না পেরে বলেছিলাম কিছু কথা। বলেছিলাম, আমার কথা ছেড়ে দাও। মেয়েটার কথাও কি ভাববে না!

তারপরই চেঁচামেচি, ভাংচুর, বিশ্রী গালাগালি। গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে।

নন্দিনী জানলার দিকে তাকালেন। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশটা কালো হয়ে আছে। আইন কানুন, থানাপুলিশের কথা মনে হল একবার। তারপর মনে হল, কিই বা হবে! শুধু শুধু লোক হাসাহাসি। নিম্নবিত্তের কত যে অশান্তি!

মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল একবার। একমাত্র মেয়ে শর্মীর দুচোখে কি এক ভয়!

শর্মীকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় এসে বসলেন।

বুক ভেঙে একটা নিঃশ্বাস পড়ল নন্দিনীর।

-বেশ করেছিস। ভয় কিসের? আমি তো আছি এখনও। আর আমাদের এখনো যা আছে, মা-মেয়ে-তুতুনের অনায়াসে চলে যাবে।

শর্মী মায়ের কাঁধে মাথা রাখল। নন্দিনী টের পেলেন, কান্নায় মেয়েটার সারা শরীর কাঁপছে।

শুরু হল তাহলে আবার একটা জীবন!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন