সমকালীন ছোটগল্প |
ফ্লাইট ক্যানসেল
শ্রাবণ। সে তো বারে বারে ফিরে ফিরে আসে। শ্রাবণী ব্যাখ্যানার ঝরো ঝরো মুখর নিয়ে তার আসা। কিন্তু যে গেল সে কি আর ফিরে আসে! যেমন গেছিলো ঠিক তেমনটি ফিরে আসা হয় কি? এসেছে কেউ তেমন ভাবেই কখনো? মনের ভেতর শচিনকত্তার গুমরে ওঠা সুর। মনে পড়ে। “শাওণ আসিল ফিরে, সে ফিরে এলো না”…সমে এসে ধরতাইয়ে এমন একটা সবহারা মোচড়, গলার কাছটায় যন্ত্রণা এনে দেয়! প্রেম কি যন্ত্রণা!
শ্যামলকান্তি ধরিত্রীপুত্র তাকে বলেছিল, কী দারূণ ব্যাপ্তি আপনার নামের! ছন্দবাণী সুর! ছন্দ, বাণী, সুর…! শুনে আশ্চর্য হয়েছিল ছন্দা! নিজের নাম নিয়ে এভাবে তো ভাবেনি কোনওদিন! লাজুক হেসে বলেছিল বলেছিল, আমার চেয়ে আরও বেশি ব্যাপ্তি তো আপনার নামের! প্রায় পাঁচ অক্ষর বেশী! তার পরেও সারা ধরিত্রীর পুত্র আপনি!
- অক্ষর!
- হ্যাঁ অক্ষর! গুনে দেখুন! ধরিত্রীপুত্র!
তার ওপর ‘শ্যামলকান্তি’! আকাশবাতাস মেঘ অরণ্য ছুঁয়ে যার বসবাস…।
শুনে মুগ্ধ হয়েছিল শ্যামল নামের
বাইশ-তেইশের তরুণ!
বলেছিল, আসলে পুরুষতান্ত্রিক পদবী
আমার ধরে রাখতে ভালো লাগেনি। আচার্য, ভট্টাচার্য, উপাচার্য… কোনটাই আমি নই। আমি ধরিত্রীর পুত্র এটা তো মিথ্যে
নয়! তাই…
এরকম কথায় কথায় অক্ষরগণনা ওদের
দুজনের মধ্যে প্রায়শ:ই…
শ্যামলকান্তি এ্যাথেলিট হিসেবে
সেই বাইশ-তেইশ থেকেই বেশ রাইসিং! ওর হাত ঈশ্বরের হাত না হলেও, খেলার মাঠে ওর কিছু কিছু
সর্ট কবিতা হয়ে যায়। সেখানে উথাল-পাথাল ছন্দ!
কেমন করে ছন্দে ছন্দে মিলন গড়ে ওঠে ভাবতে ভাবতে উধাওপুরের নূপুরের সুরবেয়ে অরণ্য-বনাণী- বাগান-পার্ক উড়ে বেড়ায় ছন্দবাণীও। শ্যামলকান্তির ছন্দময় টাটকা শ্যামলপণা কবিতার চরণ-বা্ণী হয়ে ছন্দবাণীর খাতার পাতায় সুরে বাজতে থাকে। এখানে অবশ্য কোনও অক্ষরগণনা নেই। গণনাতীত অক্ষরের নিসর্গে তার গেয়ে ওঠার চলন বলন! ছন্দবাণী সেখানে সুর বসায় উদার ভৈঁরো রাগে, কখনও ঝম্পকে, কখনও আবার গভীর যন্ত্রণার ‘মালকোষে’।
এভাবেই ওদের প্রেম পায়ে পায়ে তরুণ!
মনে মনে অরণ্য-প্রকৃতি আর খেলার মাঠ একই ভালোলাগার রঙ ধরায় দুজনের অন্তর্মনে। তরুণী
ছন্দা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভালো স্কলারশিপের অফার পেয়ে দিল্লী। মাঠে থেকে যায় শ্যামল।
শ্যামলকান্তি। শ্যামলকান্তি একটা বিশ্ব-মাঠ চেয়েছিল। চাওয়া-পাওয়ার আলেখ্যে দুজনে দুজনের
মতো নিজস্ব ভাষ্য রাখছিল। কিন্তু দুজনে দুজনের
মতো ফুল ফোটাতো একই ময়দানে! তার নাম ভালোবাসার আনন্দ ময়দান। দুজনের দূরত্ব সেখানে মরুভূমি
আনেনি। বরং হোয়াটসএ্যাপের টেক্সটে টেক্সটে
ফুল হয়ে ছড়িয়ে থাকতো।
এই স্বপ্নের কৃষিকাজে মাঠভরা স্বপ্নকুসুম! ফোটাতে ফোটাতে ওরা বুঝতে পারেনি ফোটানোর ভাষ্যে কখন চুরি করে ঢুকেছে সময়। সময় তার লিপি লিখে যাচ্ছিলো গোপনে!
ধরাবাঁধা কৃষিকাজ যখন অভ্যস্থ হয়ে
উঠছে ওদের হাতে, তখন গোপন চিঠি তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল সময়ের ক্যুরিয়ার।
তারপর?
তারপর গুছিয়ে তোলা শব্দকুসুমে চাপানো
রঙের দরকার হয়েছিল। যে ফুল অনায়াসে দীপ্তি ছড়াতো, তাতে ওপর থেকে জরি-মীনাকারির চাপানো
কাজের দরকার হয়ে পড়লো। বাড়তে লাগলো চকমকে ঝকমকে ‘গ্লো অ্যান্ড লাভলি’ মাখানো। যাতে
সময়ের বলিরেখা জবরদস্তি ঢেকে রাখা যায়। যায় কি? ঝকমকে মেটাল্ড ফুলে কবে থেকে যেন মরচে
ধরছিল সময়াভাবে ওরা খেয়াল করেনি কি! ছন্দবাণী মাস্টার্স করে পি.এইচ.ডি’র মাঠে এখন এক
ব্যাস্ত চাষি। সেখানের অক্ষরচাষের চরিত্র অন্যরকম। নিত্য পরিবর্তণশীল! শ্যামলকান্তির
চাষপদ্ধতিতেও নতুন কেতার দাবী আসতে লাগলো। প্রত্যেকবার পায়ের শর্টে নতুন বিন্যাস, নব
নির্মাণ, ডিকন্সট্রাকশন, নতুনতর ময়দান-পরিকল্পনা। দলের ব্যক্তিগত চিন্তা-ধারণাকে সমবেত কৌশলে
দীক্ষিত করা। এইসব উনপঞ্চাশ কোটির নিত্য-পরিবর্তিত রোজনামচার কাছে শ্যামলকান্তি অপহৃত
হতে হতে বুঝতে পারলো, কোনও কিছুর আরোপিত জেল্লা আসলে তার মৃত্যুবার্তার পূর্বক্ষণ!
শ্রাবণ এভাবেই তাকে ফিরিয়ে আনতে অস্বীকার করে। শ্রাবণ ফিরে আসে কালের নিয়মে। সময় যাকে
নিয়েছে, সে ঠিক একইরকম ফিরে আসে না। নিজের পেশার প্রেমে পড়লে জীবনের স্বরচিত প্রেমের
বাগানটি আর তেমন ফুল্ল কুসুমিত থাকে না। এইসব কথা…
একটু শ্বাস ফেলার অবসর পেয়ে মাথা তুলে দুজনে দুজনকে আর তেমন করে চিনতে পারেনি — এরকম খবর ভাইরাল হয়েছিল, আমার কাছেও এসেছিল ভাইরাল হওয়া সেই আশ্চর্য খবর! আর আমার মনের মধ্যে ধ্বক ধ্বক বাজছিলো, “দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর / ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর!”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন