সমকালীন ছোটগল্প |
সুশীলের বউ, পালালেন, ফিরে
এলেন, আবার পালালেন
সুশীল ছিল আমার সহকর্মী। আমি বিয়ে করে শিমলায় তুষারপাতের মাঝে হনিমুন করতে যাচ্ছি শুনে শুশীল বলল, তুই পাঞ্জাবের রোপড় জেলায় আমার গ্রামে চল, ওখান থেকে চণ্ডীগড় হয়ে বাসে করে চলে যাস। গেলুম ওদের গ্রামের বাড়িতে। সুশীল ওর বউ আর দুটো বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে চলল। ওদের গ্রামের বাড়িতে পায়খানা ছিল না; আখের বা সর্ষে খেতে গিয়ে হাগতে হতো। আমার স্ত্রী সলিলা, নতুন বউ, যেহেতু হকি খেলোয়াড় ছিল, নানা জায়গায় খেলতে যেত, ওর মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। সুশীলের বাবা আমাদের খাঁটি দুধ, ঘিয়ের পরোটা আর চিকেন মাখানি খাইয়ে আদর-যত্ন করলেন।
সমস্য দেখা দিল চণ্ডীগড় হয়ে শিমলা যাবার পরিকল্পনায়। সুশীলের বউ আবদার করে বসল যে, ওরাও আমাদের সঙ্গে যাবে, কেননা সুশীল ওকে হনিমুনে শুধু শোবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা চণ্ডীগড়ে সুশীলের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলুম। সেখানে একজন যুবতী এসে হাজির; উনি হাংরি আন্দোলনের কবির সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছেন, জানালেন। সলিলা বলল, কেমন ফ্যান তোমার, এরকম গায়ে-পড়া। সেখানেও পান-ভোজন হলো। হকি খেলোয়াড়দের শীতের সময়ে খেলার আগে এক পেগ রাম খাইয়ে দেবার চল ছিল বলে সলিলার অসুবিধা হল না। তবে সুশীলের স্ত্রী অবাক হল; পরে আমি বউটির পালটি-খাওয়া দেখে অবাক হয়েছিলুম — বস্তুত কারণ খুঁজে পাইনি।
চণ্ডীগড় থেকে শিমলা যাবার বাসে সুশীল, ওর বউ আর দুই বাচ্চা আমাদের সঙ্গী হল। শিমলায় বাস থেকে নামলুম মাঝরাতে; নামতে গিয়ে তুষারে আমাদের পা হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে গেল। বাসের ছাদে রাখা সুটকেসের ওপরেও তুষারের পরত। বাসস্ট্যাণ্ডে হোটেল-ম্যানেজারদের তাদের হোটেলে ওঠার জন্য পীড়াপীড়ি করায় একটা হোটেলে উঠলুম। আমরা যে হোটেলে উঠলুম ওরাও সেই হোটেলে উঠল। ওদের নিচের তলায়। আমাদের ওপর তলার ঘর থেকে সরাসরি মলের রাস্তায় বেরিয়ে পড়া যেত। দুজনে মিলে এক বোতল ওল্ড মঙ্ক শেষ করলুম মুর্গির মাংস দিয়ে।
বেড়াতে বেরোবার সময় সুশীল আর ওর বউ-বাচ্চা সঙ্গ নিল। হানিমুন মাটি। ছিঁচকাঁদুনে বাচ্চাগুলোকে আমরাই সামলালুম। সলিলা বলল, বউটার পেটে বাচ্চা আছে, বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না। ওদের সঙ্গে যতটা পারা যায় ঘোরাঘুরি করলুম। রাত হলেই দুজনে বেরিয়ে পড়তুম চুপচাপ, তুষারপাতের আহ্লাদ নেবার জন্য, আর ফিরে এক বোতল ওল্ড মঙ্ক। যতদিন থাকার পরিকল্পনা করেছিলুম তা আর হল না। কুলু-মানালি যাবার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল। পরে অবশ্য গেছি জায়গাগুলোয়। এখন তো বন্যায় ভেসে যাচ্ছে হোটেল আর মোটরগাড়ি।
চণ্ডীগড় থেকে সরাসরি ফিরে এলুম বাড়ি, পাটনায়। বছর পাঁচেক পরে প্রলয় রায়চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি দিয়ে গেল পিয়ন, সুশীলের বাবার লেখা, জানতে চেয়েছেন সুশীলরা কেমন আছে। বুঝতে পারলুম না কাকে লেখা, তাই সুশীলকে দিয়ে দিলুম। অমন তিন চারটে চিঠি পাবার পর আমি সলিলাকে সঙ্গে নিয়ে, সুশীলকে আগে থেকে না জানিয়ে, ঢুঁ মারলুম ওর ফ্ল্যাটে। সুশীল হাসিমুখেই আপ্যায়ন করল। সলিলা সুশীলকে বলল, যাই তোমার বউয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। সুশীল বলল, ও তো নেই, বেরিয়েছে, বড়ো মেয়েটা আছে রান্নাঘরে। রান্না করতে গিয়ে মেয়েটার হাত পুড়ে গেছে, বাড়ি ফেরার সময়ে সলিলা বলল। অফিসের কাজে গোলমাল হতো সুশীলের; একবার পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্কের জন্য আসা সতেরো কোটি টাকা ক্রেডিট করে ফেলেছিল পাঞ্জাব অ্যাণ্ড সিন্দ ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে। অফিস ওকে অন্য বিভাগে পাঠিয়ে দিল। সাতশো কর্মীর দপ্তরে আমাদের যোগাযোগ কম হয়ে গে্ল।
গুজব শুনলুম সুশীলের বউ নতুন বাচ্চাটাকে নিয়ে, মেয়ে আর এক ছেলেকে সুশীলের কাছে রেখে, একজন শিখ সরদারের সঙ্গে কোথাও চলে গেছে। পাঞ্জাবিরা তখনও পর্যন্ত নিজের বড়ো ছেলেকে শিখ করতে চাইছিল বলে সেই শিখ সরাদারের ওদের সংসারে প্রবেশ। সুশীলের বাবা এই খবরগুলোই জানতে চাইছিলেন প্রলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকে। সুশীল ওর বাবাকে কিচ্ছু জানায়নি। কাউকে জানায়নি।
কয়েক বছর পরে, মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্হা করেছিলেন সুশীলের বাবা। শিখ হয়ে যাওয়া বড়ো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন রোপড়ে নিজেদের বাড়িতে।
সুশীলের প্রোমোশান হল, চণ্ডীগড় অফিসে চলে গেল। আমি অফিসের কাজে চণ্ডীগড়ে গিয়েছিলুম, কিন্তু ওর বাড়ি যাইনি। জিগ্যেস করেছিলুম, ডিভোর্স দিসনি? সুশীল বুঝতে পারলো আমি সব জানি। বলল, না দিইনি, কীই বা হবে দিয়ে!
আরও বছর দশেক পরে, এক সহকর্মী অফিসার, যে পাটনায় আমার সঙ্গে কাজ করতো, বলল, রায়চৌধুরী, চল সুশীলের ফ্ল্যাটে, ওর বউ নাকি ফিরে এসেছে, সুশীল আপত্তি করেনি। ছোটো ছেলেটা সেই শিখ সরদারের সঙ্গে আম্বালায় থাকে। গেলুম সুশীলের ফ্ল্যাটে। যদিও আমি নাবার্ডে আর সুশীল ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। ওর স্ত্রীকে দেখলুম, বুড়ি হয়ে গেছে। একাই এসেছে।
সুশীল বলল, অফিসে গিয়ে চেক করে এসেছে আমি মরলে পেনশানটা ও পাবে কিনা; সেই জন্যেই এসেছে। ডিভোর্স তো দিইনি, পেনশান ওই পাবে; জেনে গেছে যে লিভার ক্যানসারে ওর আগেই মরব। সুশীলের লিভার ক্যানসারের কথা জানতুম না, অথচ ওর বউ ঠিক খবর রেখেছিল।
সুশীল দিল্লি অফিস থেকে রিটায়ার করল। অফিস ওকে ফ্ল্যাট দিয়েছিল। ওর গাড়ির ড্রাইভার ওর দেখাশোনা, রান্না, বাজার, ওষুধ ইত্যাদি সব কাজ করত। সুশীল একদিন ফোনে জানালো যে, ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করাচ্ছে, পনেরো লাখ টাকায়।
তার কয়েকদিন পরে ওর শিখ ছেলের ফোন পেলুম, “বাবা মারা গেছে, ট্রান্সপ্ল্যাণ্ট সফল হয়নি।”
“আর মা?” আমি জিগ্যেস করলুম।
“পাটনা ছাড়ার পর আমার সঙ্গে দেখা
হয়নি কখনও। শুনলুম, বাবার ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে হেড অফিসে গেছে পেনশন ক্লেম করার জন্য।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন