সমকালীন ছোটগল্প |
চেনা অচেনা
(১)
-তুমি যাবে না?
-নাহ।
-কেন?
-এমনি।
-আজকের দিনে কেউ এভাবে ঘরে বসে
থাকে?
-তুমি ঘুরে এসো।
-একা যাব?
-তা কেন? বন্ধু বান্ধব… তাদের সঙ্গে
যাও।
-আর তুমি?
-আমি তো রইলাম। বাড়িতে।
তিতাসকে রঞ্জন আজও বুঝতে পারে না। এত চুপচাপ, শান্ত একটা মেয়ে ওর মতো দামাল ছেলের কপালে যে কীভাবে…
বিয়ে করার কোনও ইচ্ছেই রঞ্জনের ছিল না, বেশ একা একা মর্জি মতো কাটছিল, বাড়িতে সকলে বারবার জোর করেছে,
-কিরে, কেউ কি আছে? বলে দে, আমরা
তো আর আপত্তি করব না রে বাবা।
একে একে বন্ধু বান্ধবদের বিয়েতে
কব্জি ডুবিয়ে খেতে খেতে মনে মনে নিজের ছন্নছাড়া জীবনটা নিয়ে বেজায় গর্ব হতো তার!
নাহ বাবা, কারুর অঙ্গুলি হেলনে তার জীবন তরী সে বাইবে, এমন সহজ মানুষ সে নয়!
তবু পঁয়ত্রিশ পেরোতেই তার মাথায়
টোপর চাপল, নিমরাজি হতেই বাড়ির তৎপরতায় অনেকটা পাঁচন গেলার মতো করে, গোলাপ ঠাসা দুধ
সাদা ইনোভায়, দুধে আলতা শাড়িতে, তিতাস এল তাদের বাড়িতে। চাঁপা ফুলের মতো রঙের পা
দুখান দুধ আর আলতা মেশানো থালায় রাখতেই, সেদিকে
নজর পড়ল রঞ্জনের। সম্প্রদানের সময় হাতটা বড় নরম মনে হয়েছিল, এ মেয়ে কেমন পুতুল
পুতুল! রঞ্জনকে এ কীভাবে সহ্য করবে কে জানে! বিয়েটা ক দিন টিকবে? নিজের মনে এ প্রশ্ন
বার কয়েক এসেছিল ওর।
(২)
ফিরতে বেশ রাত হলো। সারা শহরটা আলোয় ভেসে যাচ্ছে। লোকের সমুদ্র ঠেলতে ঠেলতে কটা ঠাকুর দেখা হলো, তারপর পছন্দের জায়গাটায় বসে থাকা, এভাবে কতটা সময় যে পেরোলো! সময়ের হিসেবে সে বরাবরই কাঁচা, যদিও অংকে চিরকালই তুখোড় ছিল, ক্লাসের সেরা ছাত্রদের মধ্যে একজন হয়েও কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল সবটা! ওই যে, বেহিসেবীপনা তার ঘুচল না। চাইলেই বিদেশে চাকরী নিয়ে সেটেল্ড হতে পারত, সুযোগ ছিল, সে নেয়নি। এ শহর ছাড়া তার হবে না। বলা ভালো এ শহর তাকে ছাড়বে না। এর অলিতে গলিতে ওর শৈশব, ওর কৈশোর ওর যৌবন সব মাখামাখি। সুমনের গানের মতো, এ শহর জানে ওর প্রথম সবকিছু!
(৩)
একসময় অলোকেন্দুর বাড়িতে বিজয়ার পরের মিট টার জন্য রঞ্জনরা সবাই মুখিয়ে থাকত। কাকিমার হাতের জাফরানী পোলাও আর রোগান জোশ… আহা, অমৃত কাকে বলে!
গল্পে মিশে যেত ফুটবল, রাজনীতি,
বব ডিলান, জীবনানন্দ, শেষ পাতে মিষ্টিমুখের মতো থাকত পূর্বরাগ কিংবা ছ্যাঁকা খাওয়ার
অল্প কাহিনী।
টেবিলে চাপড়, গিটারে সুর, সুমনের
গান, নেশার গন্ধ,আর ওরা ছয়; চিলেকোঠার ঘরটা
পাল্টে নিমেশে হয়ে যেত চেনা কলেজ ক্যাম্পাস।
এবারের আড্ডার গতি যদিও অন্য পথ
ধরল, ওদের বন্ধুদের গল্পে মাঝে মাঝেই বিবাহিত জীবনের প্রসঙ্গ উঠে এল। সন্ধ্যে গড়িয়ে
একটু রাত হতেই দু চারজনের ফোনে মেসেজ, ‘কখন ফিরবে… ‘ গোছের খোঁজে খোঁচায়, বন্ধুদের
মুখে বিরক্তির তেতোভাবটা একটু বাড়তেই আলোচনায় পুজোর শপিং নিয়ে বিরক্তি… শ্বশুরবাড়ির
ঝক্কি, এমন ছোটখাটো অভিযোগ যোগ হলো, পানীয় র গ্লাসের সংখ্যা যত বাড়তে লাগল সে সুর
ততই তীব্র ও করুণ হয়ে চলল!
শুধু রঞ্জনের এ নিয়ে বলার মত কিছুই
ছিল না। মনে মনে একটু অস্বস্তিই হলো বরং মলয় যখন বলে বসল, রঞ্জু টা কিন্তু ভাগ্যবান
ভাই, তিতাসের নো কল, নো মেসেজ… তুই বস এখনও যেন ফ্রী বার্ড। কী করে হ্যান্ডেল করিস
বস? সিক্রেটটা কী?
ট্যাক্সির সিটে গা এলিয়ে চোখটা
বুঁজতেই একটা মুখ ভেসে উঠল। কী নরম, কী শান্ত কী অপূর্ব সে মুখ! অথচ ভাবলেসহীন, নিশ্চুপ!
রঞ্জন জানে, সে জেগে, গেটের হালকা আওয়াজেই সে জানলায় এসে দাঁড়াবে, তারপর রঞ্জনকে
এক ঝলক দেখেই দরজা খুলে দেবে। কোনও প্রশ্ন করবে না, জানতে চাইবে না এতটা রাত সে কোথায়
ছিল! ঘরের প্রতিটা কোনায় তিতাসের ছোঁয়া। এত পরিপাটি, এত গোছানো ওদের ঘর, কোথাও এতটুকু
ফাঁক নেই, তবু কী একটা নেই.., কোথায় যেন ফাঁকি!
-এখন আর কিছু খাবে?
-নাহ, খেয়ে এসেছি।
খুব ইচ্ছে করল তিতাসকে জিজ্ঞেস
করতে, তুমি খেয়েছ তিতাস? গলার কাছে এসেও কথাগুলো পথ হারিয়ে ফেলল।
রাতে বিছানায় শুয়ে হঠাৎ খুব ইচ্ছে
করল তিতাসকে আদর করতে। রঞ্জন জানে, তার কোনও ইচ্ছেয় সে বাধা দেয় না। আজও তার ব্যতিক্রম
হলো না।
জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছে
ওদের ঘরটায়। বিছানায় একটুকরো জ্যোৎস্না শুয়ে আছে তার পাশে!
(৪)
‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ, তেমনি করে গাও গো’
গান গাইতে গাইতে তিতাসের চোখ বন্ধ
হয়ে আসছে, খালি গলায় অমন সুন্দর গান… পিচ কালারের একরঙা শাড়ি, কালো ব্লাউজ, হাত
খোঁপায় ওকে আরও সুন্দর লাগছে আজ।
গান শেষ হতেই রোহিনী বলল,
-রঞ্জু, তিতাস কিন্তু গানে তোকে
বলে বলে গোল দেবে। তুই ও গান গাস বটে, তবে তিতাসের মতো নয় বস।
রঞ্জনের যে কেন এত খারাপ লাগছে, ও নিজেও বুঝতে পারছে না। এতে তো খারাপ লাগার মত কিছুই নেই। তাছাড়া, রোহিনী তো ওরই বন্ধু। হঠাৎ দেখা হতেই ও এমন জোর করল যে ইনভাইট না করে উপায় ছিল না। রোহিনীরা ইউ এস-এ সেটেল্ড, তিনবছর পর দেশে ফিরেছে। রঞ্জনের বিয়েতে তাই ওর আসা হয়নি। তবে, রঞ্জনের বউ দেখার প্রবল ইচ্ছেটা কি আর চাপা যায়! যে ছেলে বিয়ের নামেই ক্ষেপে যেত, সেও যে ছাদনাতলায় গেল, কাকে সঙ্গিনী করে আনল তা তো জানতেই হবে।
-এফ বি তে তো তিতাসের কোনও ছবি
পোস্টাসনি। ইন্সটাতেও কিচ্ছু নেই। এখন দেখা।
-কী দেখাব?
-ছবি। তোর বউয়ের ছবি।
-অদ্ভুত তো, আমি কি ছবি পকেটে করে
নিয়ে ঘুরছি?
-ওমা, ফোনেও নেই? তুই সেই একই রয়ে
গেলি।
অতএব খানিকটা জোর করেই নিমন্ত্রণটি
আদায় করে বর সমেত রবিবারের সন্ধ্যেতে রঞ্জনের বাড়িতে হাজির। দরজা খুলতেই তিতাসকে
দেখে দীপ্তর রিঅ্যাকশনটা, রঞ্জন জাস্ট ভুলতে পারছে না। তিতাসও দীপ্তকে দেখে নিমেশেই
কেমন পাল্টে গেল। ওকে এমন হাসিখুশি রঞ্জন আগে দেখেনি। দীপ্ত তিতাসদের কলেজে পড়ত, তিতাসের
থেকে দু বছরের সিনিয়র। হঠাৎ এত বছর পর ওদের যে এভাবে দেখা হয়ে যাবে দুজনেরই কল্পনার
অতীত। তারপর যা হয়, ওদের কলেজ জীবনের গল্প, বারবার ফ্ল্যাশব্যাকে ফেরা, দীপ্তর মুখেই
জানা গেল তিতাসের গান গাওয়ার কথা।
আচ্ছা, আর কী কী জানে মেয়েটা? রঞ্জন যা জানতে পারেনি, দীপ্ত কীভাবে মাত্র একটা বছর এক কলেজে পড়ে এতসব জেনে গেল! অবশ্য তিতাসের রূপ আছে, তাই কলেজে, ছেলেদের যে নজরে ছিল সেটা অনুমান করাই যায়। আচ্ছা, ওর প্রেমিক ছিল? কোনো অ্যাফেয়ার?
ধুর কী সব ছাইপাঁশ ভাবছে সে। ও তো এমন মানুষ নয়। অ্যাফেয়ার থাকলেই বা কি? ও জেনে কী করবে? এসব তো খুব সাধারণ ঘটনা। ভেরী ন্যাচারাল। এমন কি, বিয়ের আগে মেয়েদের ভার্জিনিটি নিয়ে লোকজনেদের অহেতুক কৌতুহলে, রঞ্জন তো চিরকাল বিরক্তই হতো। ইনফ্যাক্ট মোনোগ্যামী ব্যাপারটাতেই ওর হাসি পায়, যত্তসব বস্তা পচা চিন্তা ভাবনা।
সেই রঞ্জন কিনা…
কী বলে একে? ও কি জেলাস? মেল ইগো?
দীপ্ত তিতাসের দিকে যেভাবে তাকাচ্ছে, ওর চোখে মুখে যে মুগ্ধতা, সেসব রঞ্জনের কেন ভালো
লাগছে না? তিতাসের হাসির শব্দ, গানের সুর… আগে তো এই বাড়িতে শোনা যায়নি কখনও। ও যে
এত কথা বলতে পারে, সেটাই কি রঞ্জনের জানা ছিল?
-তুমি গান জানো আমাকে বলোনি তো?
-বলার কি আছে?
-কেন? আমার জানা বারণ?
-নাহ, তা নয়। কখনও প্রসঙ্গই ওঠেনি।
তাই হয়ত বলা হয়নি।
(৫)
-চারটে দিন ছুটি নেবে?
-কেন?
-পারবে কিনা বলো আগে।
-নিতেই পারি, তবে কারণ না জেনে…
-বেড়াতে যাব।
-আমরা? হঠাৎ?
-যাবার ইচ্ছে নেই? নাকি, আমার সঙ্গে
যেতে অসুবিধা? কোনটা?
-কী মনে হয়?
এই প্রথম তিতাসের চোখে দুষ্টুমির হাসি। রঞ্জন হাঁ করে ওকে দেখছে। আজ ওকে আরও সুন্দর লাগছে। শাড়িটার রঙ যেন ওর শরীরের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। অনেকটা খাটাখাটনি হয়েছে ওর। একগাদা রান্নাবান্না। রঞ্জন যদিও বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিতে চেয়েছিল, ওই রাজি হয়নি। রোহিনী, রঞ্জনদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ছিল বলে যা ঘ্যাম ছিল, আজ তিতাসকে দেখে একটু হলেও…
নাহ, কোথায় রোহিনী আর কোথায় তিতাস।
যাক, রঞ্জনের আজ একটু গর্ব হচ্ছে কি? যতই হোক, তিতাস তার… মানে, তার বউ, এটা তো সত্যি।
রাতে গা ধুয়ে তবে ও বিছানায় আসে। কী একটা মাখে কে জানে! কী অপূর্ব গন্ধ! ঘাড়ের কাছে ক ফোঁটা জলের বিন্দু… এই মেয়েটা কীভাবে যে রঞ্জনের জীবনে এল! অবাক লাগে, আট মাস আগেও তিতাসকে সে চিনত না। আর আজ, তিতাস ওর গোটা বাড়ির সবটা জুড়ে রয়েছে। বারান্দার জুঁই গাছটা, সে তো তিতাস আছে বলেই… নইলে ওখানটায় মাকড়শার দল জাল বুনত নিশ্চিন্তে, আর এই যে, খাবার টেবিলে রোজ রঞ্জনের পছন্দের গরম খাবার রাখা থাকে…
হঠাৎ রঞ্জনের মনে খটকা লাগল, তিতাস
কীভাবে জানল পোস্তর তরকারীতে ওর পিঁয়াজ চাই,
মৌরলা ভাজা আর মুসুরির ডাল ওর ফেবারিট, মটন হলেই তাতে গোটা রসুন দিতে হবে, চালের নয়,
সিমাইয়ের পায়েস, এমন কত কত যে খুঁটিনাটি বিষয় তিতাস জানে। কে বলল? রঞ্জন তো কিচ্ছু
বলেনি কখনও। রঞ্জন কি জানে তিতাসের পছন্দ অপছন্দ… ?
নাহ, অনেক ভেবেও কিছুই মনে করতে
পারল না। না না, জানে, সে জানে তিতাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো লাগে! নিশ্চয়ই লাগে, নইলে
গান গাইতে গিয়ে আজ ওই গান গাইবে কেন? তিতাসের জুঁইফুল ভালো লাগে, সেও তো রঞ্জনের জানা।
জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে, নীল শাড়ি পরতে, হাতখোঁপা, কালো টিপ, মাঝারি সাইজের… এই
তো, এমন কত কী।
হয়ত এভাবেই একটু একটু করে জেনে
যাবে, একদিন রঞ্জনও পারবে, ওকে চিনতে, জানতে, ওকে পড়তে….
ল্যাপটপটা নিয়ে টিকিট বুক করতে
গিয়ে সে একবার থামল।
-তিতাস, এদিকে একটু আসবে?
-কিছু বলবে?
-তোমার জঙ্গল ভালো লাগে?
-কখনও যায়নি তো, তাই কীভাবে জানব,
হয়ত ভালোই লাগবে। তুমি কি জঙ্গলে বেড়ানোর প্ল্যান করছ?
-সেরকমই খানিকটা। টিকিট কেটে বলছি।
তুমি স্কুলে ছুটি অ্যাপ্লাই করে দিও। কী? কী দেখছ? যাবে তো?
-হ্যাঁ, যাব।
(৬)
সন্ধ্যে হয়ে আসছে, জঙ্গল এই সময় বড় রহস্যময় লাগে রঞ্জনের। বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে চারপাশটা দেখতে বেশ লাগে। কেমন যেন নেশা, সবুজের রঙ ক্রমশঃ গাঢ় হতে থাকে। তারপর একসময় সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়! আর সেই আঁধারের মধ্যে ভেসে আসে কত ডাক, কোনোটা চেনা, কোনোটা অচেনা।
একটু কফি হলে বেশ হয়। রুমে এসেই
রঞ্জন তিতাসকে দেখতে পেল না। রুমেই তো ছিল, কোথায় গেল? কোথায় যে গেল! রঞ্জন যখন একা
ছিল বারান্দায়, রুমে সে তিতাসকে তো দেখেছিল…
নাহ, করিডোরেও নেই তো!
-ম্যাম কো বাহার যাতে হুয়ে দেখা
থা?
-নেহি তো। কিঁউ, কঁহি গয়ি হ্যায়
কেয়া?
রঞ্জন ফোনে আবার ট্রাই করতে গেল…
নেটওয়র্ক নেই। উফ কী যে করে মেয়েটা! কোথায় গেল? একবার বলে তো যাবে!
অদ্ভুত তো!
নাহ, এভাবে টেনশন করে লাভ নেই,
বরং নিজেই একটু বাইরে গিয়ে…
-কোথায় গিয়েছিলে?
-কাছেই।
-বলে যাবে তো? অন্ধকার হয়ে আসছে।
এসব জায়গায় এভাবে…
তিতাস রুমে ঢুকতেই রঞ্জন বেশ ঝাঁঝিয়ে
উঠল। তিতাস চুপ করে ওর দিকে একবার তাকিয়ে, তারপর জানলার ধারটায় গিয়ে বসল।
-কফি খাবে?
-দাঁড়াও, বানাচ্ছি।
-না না, তুমি বসো, ব্ল্যাক কফিটা
আমি বানাতে পারি।
তিতাস চুপ করে রইল। রঞ্জন কফির
জল টা গরম করতে করতে ওকে দেখছে। এভাবে ওর সঙ্গে কথা বলাটা ঠিক হলো না। তিতাসের কি খারাপ
লাগল? ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনের মধ্যে কী চলছে… এমন শান্ত, নিরুত্তর, চুপ থাকাটাই
ওকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে।
রঞ্জনের নিজের কথাগুলোই নিজের কানে
বড্ড লাগল। সত্যিই তো, সে কখন কী করে, কোথায় যায়, কখন ফিরবে, এসব কথা তো সে তিতাসকে
জানায় না, জানানোর প্রয়োজনই মনে করেনি কখনও। তিতাসেরও কি এমন অস্থির লাগে? কে জানে!
কিছু তো বলে না কখনও।
-সরি
-কিসের জন্য?
-আমি ওভাবে বললাম যে…
-টেনশন হচ্ছিল, তাই রিঅ্যাক্ট করেছ।
ইটস নরম্যাল। আমি কিছু মনে করিনি।
-কোথায় গিয়েছিলে?
-কাছেই, এমনি ঘুরছিলাম।
-জঙ্গল কেমন লাগছে?
-মন্দ নয়।
তিতাসের মুখে এই হাসিটুকু দেখেই
রঞ্জনের বড় শান্তি হলো।
(৭)
বেশ রাত হয়ে গেল। লাস্ট ট্রেনটা হাতছাড়া হলে আজ বেশ ঝামেলায় পড়তে হতো। কামরাটা প্রায় পুরোটাই খালি। শ্রীরামপুর থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক উঠলেন। রঞ্জনের পিছনের সিট থেকে একজনকে বলতে শোনা গেল,
-আরে বিকাশ দা, তুমি?
ভদ্রলোক গিয়ে বসলেন রঞ্জনের পিছনের
সিটে। আনমনে জানলায় চোখ রাখলেও পিছনের গল্প রঞ্জনের কানে পৌঁছতে লাগল।
-এত রাতে, কোথায় গিয়েছিলে? তারপর
বাড়ির সব খবর বলো।
-বাড়ি? হ্যাঁ সব ঠিকই আছে।
-বৌদি কেমন আছে? তোমার ছেলেরা?
-রমা নেই রে। গত সাত বছর ও নেই।
-কী হয়েছিল? আমি জানতাম না।
-অসুখ, ক্যানসার।
রঞ্জনের মনে হলো ভদ্রলোকের গলায়
কী একটা যেন মিশে আছে। রমা নিশ্চয়ই ওঁর স্ত্রীর নাম। বাকি পথটা ওদের কথোপকথন শুনতে
শুনতে, হঠাৎ অজান্তেই ফোনে হাত পড়ল। তিতাসের
নম্বরটায় সে কল করল।
একটা রিং হতেই তিতাস ফোনটা ধরল।
-আটকে গিয়েছিলাম। লাস্ট ট্রেনে
ফিরছি। আর মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
-আচ্ছা।
ট্যাক্সিতে বসে বারবার ওই কটা কথা কানের কাছে বাজতে লাগল যেন।
এখন কেউ অপেক্ষায় বসে থাকে না ভাই। আমার বাড়ি আর কি আমার আছে? কেউ চিন্তা করে না, খোঁজ নেয় না কোথায় আছি, কখন ফিরব। জানতে চায় না আজ কী খাব? অসুখের দিনে কেউ রাত জাগে না রে। রমা ওর সঙ্গে সবটা নিয়ে গেছে। আমার সব ভালো থাকা, সব হম্বি তম্বি, রাগ অভিমান, আবদার… সব। এখন ফিরি বটে, তবে বাড়ি ফিরি কি? বুঝতে পারি না।
গেটের হাল্কা আওয়াজে জানলার পর্দা
অল্প সরতেই তিতাসের মুখ। রঞ্জনকে দেখে দরজা খুলে দাঁড়াল সে। তিতাস, যে রাত জেগে রঞ্জনের
অপেক্ষায় থাকে! কিছু বলে না বটে, রঞ্জন জানে, এই পৃথিবীতে, এই মুহূর্তে, রঞ্জনের জন্য,
রঞ্জনের প্রতীক্ষায় জেগে থাকা মানুষটি আর কেউ নয়, সে তিতাস।
-কিছু খাবে?
-নাহ, খেয়ে এসেছি।
তিতাস পিছন ফিরতেই রঞ্জন বলে বসল,
-তুমি খেয়েছ তিতাস?
তিতাস ওর দিকে তাকাল একবার। তারপর
অল্প হেসে বলল - খেয়ে নেব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন