বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

অভিজিৎ মিত্র

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৮


কিউবিজম্‌


হু হু করে দুটো শালগাছ চোখের সামনে দিয়ে ছিটকে পেছনে চলে গেল। সবুজ টোটো ছুটছে। রা আর ফকির। রাত জমছে। রা একদৃষ্টে ফকিরের গভীর চোখের দিকে চেয়ে। ফকিরের মনে হল মুহূর্তটা বাঁধিয়ে রাখে।

- শোনো...

- বলো... 

আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গেল। খোলা চুলে অগোছালো ক্লিপে কৃষ্ণচূড়া এই সন্ধেবেলাও আগুন ধরাচ্ছে। ফকির কৃষ্ণচূড়ার একটা বৃন্ত খুলে নিচেটা একটু ঘষে উল্টো করে রা-এর তর্জনীর নখে লাগিয়ে দিল।

- ওমা, কী সুন্দর! সবুজ নখের মত লাগছে!

- আমরা ছেলেবেলায় এভাবে কৃষ্ণচূড়া ফুলের বোঁটাগুলো নিয়ে নখ বানাতাম। কার কত বড় নখ।

এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় রা ফকিরের মুখের দিকে আবার।

টোটো ছুটছে। সবুজ টোটো। আশেপাশে হাইওয়ে দিয়ে গাছেরা পেছনে পালাচ্ছে। রানির মুখে হাওয়ার দুষ্টুমি। কানে ঝোলা দুটো টুং। ফকির রানির মুখ ঠোঁট কপাল থেকে একটু একটু করে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। উড়িয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে রানির রাতে জমে থেকে ক্লান্তিগুলো। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে গুনগুন।

- কেন ২০০৫-এ আমার জীবনে আসো নি? আজ আমাদের এভাবে ঘুরতে হত না। আমাদের ভালবাসার দুটো সন্তান থাকত। জীবন কানায় কানায় ভর্তি হয়ে থাকত।

রানির অনুযোগে ফকির হেসে ফেলে।

- ধরো একটা কিউব। এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে যেতে গেলে সমান দূরত্ব। এবার এটা যদি ভেঙেচুরে দাও! এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্ট যেতে সময় হয়ত থামছেই না, আবার কখনো এক পয়েন্টের পাশেই আরেক। এই যে ডিকনস্ট্রাকশন, একে বলে কিউবিজম্‌। জানো, পাবলো পিকাসো কিউবিজমের জন্য ফেমাস। ওনার আঁকা এক বিখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ছবির নাম গের্নিকে। বিশাল বড় ছবি। লম্বায় প্রায় পঁচিশ ফুট, উচ্চতায় এগারো ফুট। আমাদের  সবার জীবন কিউবিজমে ঢেকে আছে। কখনো সোজা। কখনো তোবড়ানো। কখনো ভাল কখনো মন্দ। কখনো থামে, কখনো রাত শেষ হয় না। ২০০৫-এ পাশে ছিলাম না, ১৮-থেকে তো আছি... থাকব। এত ভাবো কেন?

রাজরানি অগাধ ভরসায় ফকিরের কাঁধে মাথা রাখে। কৃষ্ণচূড়া তখনো চুলে রোদ মাখাচ্ছে। রাত প্রায় ন’টা। সবুজ টোটো, সবুজ ড্রেসে মধুবনী ওড়নায় রাজরানি, হাইওয়ে ধরে পালিয়ে যাওয়া সবুজ গাছেরা, রাস্তার দুধারে নাম-না-জানা সবুজ কাঁটাঝোপ। ফকিরের হঠাৎ মনে হল, ও যদি ২০০০ সালে স্ট্যানফোর্ডে ডক্টরেট করতে চলে যেত,  তাহলে কোথায় রাজরানি, কোথায় আজকের এই ভালবাসার মুহূ র্ত? গীতায় ঠিকই বলে। যা হয়েছে, ভালর জন্যই...। ফকির নিজের মনেই ফিক করে হেসে ফেলল, রাজরানির ডানহাত নিজের বুকে শক্ত করে চেপে। হাত কিসি কি পাকড়িয়ে না, পাকড়িয়ে তো ফির...

- এই, হাসছ কেন? বলো!        

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন