কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৮ |
ভানু লেপচা আর একটা উট
ভানুর জন্ম সিকিমের এক পাহাড়ি গ্রামে। ঘোর অভাব-অনটনের মধ্যেও আটক্লাস অবধি পড়েছিল সে। তারপর দালালের ব্যবস্থায় সতেরো বছরের ভানু গাঁ ছেড়ে অনেকদূরের এই সমুদ্রতীরে এসেছে কাজ করতে।
পুরী। চারধামের একধাম। সমুদ্রতীরে সারি দিয়ে সস্তা, দামী সব রকমের হোটেল। তারই একটাতে ভানু কাজে লেগে গেল। লোকেদের বাক্স-প্যাঁটরা তোলা, চানঘরে গরম জলের বালতি রাখা – এইসব খাটাখাটনির কাজ দিনভর। শীত বর্ষা গরম কিছুই না মেনে হাজার হাজার বেড়ানো পাগল লোক পুরীতে আসে প্রতিদিন। ভানুদের হোটেলটা তো রোজই ভর্তি।
জায়গাটা ভানুর বিচ্ছিরি লাগে। গাছপালা তেমন নেই। ভ্যাপসা গরম। তার ওপর পেতলের বোতাম লাগানো মোটা কাপড়ের ড্রেস পরে থাকতে হয়। সামনে ধু-ধু সমুদ্র, ঢেউগুলো দিনরাত ঘড়ঘড় আওয়াজ করে ফেনা কেটে বালিতে আছড়ে পড়ছে। এই একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে এতো লোক আসে! শুনেছে এখানে নাকি একটা বড়সড় মন্দির আছে। সে অবশ্য দেখেনি। এখানেই কি তার জীবন কাটবে? কে জানে!
কাজের ফাঁকে ভানু তাকিয়ে থাকে সমুদ্রতীরের দিকটায়। সেখানে হরেক পসরা। শাঁখ, পাথরের মূর্তি, ঝালমুড়ি, বেলুন, মাছভাজা, চা। আরেকটা জিনিস দেখেছে সে। উট। পাহাড়ে থাকতে হাতী, চিতাবাঘ, হরিণ দেখেছে কিন্তু উট তার অচেনা। এই অদ্ভুত জানোয়ারটিকে দেখলেই বোঝা যায় এ এদেশের নয়। দূরের কোনো দেশ থেকে ধরে এনেছে নিশ্চয়। পিঠের ওপর লাল গদি আর স্টীলের হাতল দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। এতসব জবরজং সাজ-পোষাক নিয়ে সমুদ্রের জোলো গরমে উট হাঁপিয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু করে না। ভয় পায়। যদি ওরা তাকে ছেড়ে দেয়, যদি আর খেতে না দেয়!
একটা মইও তাকে বইতে হয়। লোকেরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মই বেয়ে পিঠে ওঠে। উটের নাকে দড়ি – সেটা ধরে উটওয়ালা সমুদ্রতীর বরাবর এদিক থেকে ওদিক ঘোরায়। সওয়ারিরা মজা পায়। বালুতটে লোকজনের ভীড়, কেনাবেচা আর রকমারি তামাশা ছেড়ে ভানুর চোখ বারবার চলে যায় উটের দিকে।
বুধবার বিকেলটা ছুটি পায় ভানু। বালিতে আনমনা হাঁটছিল – দেখল উট বসে আছে একটু দূরে। দড়িটা খুঁটিতে বেঁধে উটওয়ালা দোকান-টোকানে গেছে বোধহয়। ভানু আস্তে আস্তে উটের কাছে এসে দাঁড়ালো। ভানুকে দেখেই যেন উট তার লম্বা গলাটা নুইয়ে সোজা করে রাখল বালিতে। ভিজে বালির শীতল স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে নিতে চায়। ভানু বসল পাশে। আদর করে উটের গলায় হাত বোলাতে লাগল সস্নেহে। উট কিছু বলল না। চোখ বুঁজে রইল – যেন ভানুকে বলতে চাইছে, “বস বন্ধু কিছুক্ষণ, ভারি ভালো লাগছে তোমাকে…”
দূর থেকে হোটেলের ম্যানেজার দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল। উটওয়ালা ফিরে আসার সময় দেখে বালুতটে দুজন কাছাকাছি বসে আছে, যেন কতদিনের চেনা! সুখদুঃখের কথা বলছে! এরা বন্ধুর মত এত কাছাকাছি বসেছে কেন তা উটওয়ালা বা ম্যানেজার বুঝল কি? ওদের অবশ্য অনেক কাজ। তাছাড়া ওদের ওপরেও মালিক আছে। বুঝলেও এসব নিয়ে ওদের করার কিছু নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন