বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

তমাল রায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৮


এ পরবাস


'একা'র আজকাল কিছুই ঠিক ইচ্ছে করে না। মানে ধর, খাওয়া বা ঘুমনো। অথবা হাগা, মোতা। মানে হাগা মোতা  তো অনিবার্যতা, ইচ্ছে না থাকলেও করতেই হয়। কিন্তু নিয়ম-করে কিছুই আর করতে ইচ্ছে করে না 'একা'র। সে  ভেবে দেখেছে এতগুলো বছর সবকিছু নিয়মমাফিক করার পরেও তার কিছুই ঠিকঠাক হয়ে ওঠেনি। যা সে করতে চেয়েছে আর যা করতে চায়নি কখনও, এগুলো কখন না জানি গুলিয়ে গ-ঘ-ঙ!

যেমন গল্প লিখতে ইচ্ছে হলে সে রান্না করত। গান গাইতে ইচ্ছে হলে, কোমোড পরিষ্কার! যেভাবে অনিচ্ছেরা জায়গা  করে নেয় আমাদের বসত ভিটার ঘুলঘুলিতে। পরে সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে খড়কুটো ঘরময়। তখন কুটোগুলোই ঘর, আর ঘর ঘুলঘুলি, এভাবেই জীবনটা কেটে গেল! মানে, যাচ্ছে এই সাম্প্রতিকে। এই-যেমন এখন তার গলায় সুর আর খেলছেই না, তাই নিদেনপক্ষে গায়ত্রী মন্ত্রোচ্চারণ। মুখ লাল, কাশি হচ্ছে প্রবল... থামছেই না... বলে নিই, আসলে ফাঁক-ফোকরেই বলে নেওয়া ভালো, এত সিমেন্টেড সময়... অথচ স্পেসফুল সম্পর্কগুলোর মাঝে বলে নেওয়াই যায়, অনিচ্ছের মাঠে বৃষ্টির চুম্বন ছিটকে পড়লে মাঠ হত সবুজ আর একটা লম্বা মই। সেটা দিয়েই সে চাঁদ আর জ্যোৎস্নার রাজ্যে ঘুরে আসতো পারত কখনও। শতরঞ্চিপাতা এই সব সকাতর অবসরে কেউ উল বুনছিলো, কেউ গাল-গল্প, সে পাশ কাটিয়ে মন্দাকিনীর জলে পূর্ণ অবগাহনের চেষ্টায়... আর তারপর যা হয়, গাল বেয়ে এখনও জল নামছে তার।

তার নাম 'একা'। একলা তালগাছ, একলা আকাশ, সে অবশ্য একলা বাঁড়ুজ্জে বা রক্ষিত নয়, পদবীহীন একা।  বিলকুল একা, যেমন ভুলু কুকুর, যেমন পাগল মানদা পিসি অথবা রাষ্ট্রপতি।

মাঘের শীতে একলার শরীরে বড় আসক্তিতে হাত বোলায় সে, আবার খর জষ্টিতে তীব্র বিরক্তি... মুখ তেঁতো নিজের শরীরটাই এত ক্লান্তিকর। বমি পায়! পুরনো আচারের বোতলের মত ছাতাপড়া জীবন, হারানো স্বামী। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যাওয়া...

পাইন, ম্যাপল, ফার্ন ঘেরা পাকদণ্ডি বেয়ে কুয়াশা নেমে আসছে... আর সেই পাহাড়ি বেঞ্চ... কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে, আর করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা থেকে ভেসে আসছে...এ পরবাসে রবে কে, হায়!

মরতে 'একা'র খুব ইচ্ছে। কিন্তু ওই যে  বালিশের গায়ে লেখা গল্পস্বল্প। চাদরের গায়ে লেগেথাকা মলিন দাগ দেখে বড় মায়া জাগে!

পঞ্চাশ নম্বর লজঝরে বাসটা তখন  নকশালবাড়ি থেকে চলতে শুরু করেছে, গন্তব্য রাজভবন। যার মাথায় আর ছাদ নেই, গায়ে গুল্মজাতীয়রা, সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছে...

ফিতেবাঁধা জুতো, মাথায় নীল রিবনবাঁধা স্কুল বাড়ি পেরিয়ে, ওই যে যেখানে বাবা-মা-কাকু-পিসেদের ছায়াঘেরা পথ পেরিয়ে বাস এখন রাজপথে, ঘন্টা বাজছে, র‍্যাপিড রিডিং। কে যেন পড়ছে, কারা শুনছে সে সব আর খুব স্পষ্ট নয়। মিডল বেঞ্চের গল্পগুলো খানিকটা চেতিয়ে গিয়ে কার্নিক-মারার আগে অতিচেতনার আর কুয়াশার গল্পগুলো আরও করুণ, করুণা, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠোঁট মেলাচ্ছেন... এ পরবাসে রবে কে, হায়! কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে...

'একা'র রঙ্গমঞ্চ এবার কুয়াশায় ঢাকল, এই শেষবার। যেমন হয়, না-হতেও পারত!  

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন