কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৮ |
নৌকো ও বিবাদীপক্ষ
দু’টাকার
খুচরোর মতো আমাকে সরিয়ে দিয়ে জানালে, "বউ পাশে বসে আছে, কল কোরো না"।
দরজা
বন্ধ হলো। মোবাইলটা অনাবশ্যক একটা ভারি লাশ মনে হচ্ছে। আমি স্বচক্ষে দেখলাম দুজনে বসে।
শীত করছে। সকলেই উল্টোনো নৌকায় বসে। মোবাইল মগ্ন সভ্যতা উপচে পড়েছে আশেপাশে।
এই
অবস্থায় যতটা হীন লাগার কথা ততটাই লাগল। তাকালাম বাইরে। সব কিছুই ঠিকঠাক। আংশিক মেঘলা
আর কিছুটা থমথমে ভাব। এই অবস্থায় আমি ভাবতে লাগলাম, আমি ঠিক কোথায়? কতটা দূরে? এভাবে
কি তবে বাড়তি হয়ে আছি? অনিবার্য অভিমানে মনে হলো, যদি জলের মতো মিলিয়ে যেতাম! আমি
কে?
নিজের
দিকে ফিরে দেখি ঝরে পড়ছে চুন সুরকি। ধ্বংসস্তুপ। সামনে অসাড় একটা সূর্য আমার মতোই
বিড়ম্বিত হয়ে আছে। অনধিকারের মতো জ্যোৎস্না হয়ে ঢুকে আছি তোমার রং চটা দাম্পত্যের
মাঝে।
নামা আর ওঠা। কিছু মানুষ ভিড় করে আছে উত্তমকুমারের জন্য, পেছনে নেতাজী, সূর্য সেন অপেক্ষায়।
জানলায়
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির ছাঁট, মেট্রোর শীতল হাওয়ায় ভাবছি, আমি নেমে গেলে ট্রেনটা কি স্বস্তি
পাবে আরও? জানলায় বৃষ্টির ছাঁট। আর তখনই মনে হলো তোমার কথা। প্রায় বৃদ্ধ তুমি। চোখের
নীচে ক্লান্তি আর গলার ভাঁজে অবসন্ন বলিরেখা।
একটা
মানুষ, ঘরে আর বাইরে ব্যবহৃত হতে হতে হাত বাড়িয়ে চাইছে একটু ঠাণ্ডা ছায়া। একটা নিরাপত্তা,
যেখানে নাকের বদলে নরুণ সিস্টেম নেই...
দেখছি,
তুমি ছুটে আসছ অসুখ শরীর নিয়ে। মহামারী আর সমস্ত পৃথিবীর তুলে ধরা আঙুল অগ্রাহ্য করে।
শত অপমানে ক্রুদ্ধ আমি ফেলে দিচ্ছি পাঁকে, তবুও, অসহায় একটি মুখ, তবুও দীর্ঘ পথ পার
হয়ে ছুটে আসছ আমার এই ভগ্ন উঠোনে। সেকি শুধু দুটি স্তন আর আমার বিবর চেয়ে?
জলে
ডোবা মানুষের মতো মুখ তুলে বলছ, "শুধু ভালোবাসি, এই কি অপরাধ হয়েছে?" এই
প্রশ্ন তোমার আগে আরো কতজনের! তাদের কথা লেখা আছে পৃথিবীর ইতিহাসে। শুধু ভালোবাসার
জন্য এই নির্বাসন আমার, আর তোমার।
এসে যাচ্ছে প্রান্তিক স্টেশন, আমি নেমে যাব। তাকিয়ে দেখলাম বহু আমি আর বহু তুমি এই পৃথিবীর বুকে। একটি খণ্ড তুমি দূরে আনমনে উদাস বসে আছো। বারান্দায় অন্য একটি নারীর পাশে তোমার অবয়বটুকু, অনেক দূরে তুমি হেঁটে যাচ্ছ, রাজনীতি আর কবিতা সভা থেকে দূরে, কর্ম আর শব্দ থেকে দূরে, সংসার আর সহানুভূতি থেকে দূরে
নির্জন
একাকী কবি এক, ভালোবেসে আক্রান্ত কবি এক। আমার চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে ভিজে হাওয়ায়।
সব ভিড় ফিরছে যেখান থেকে ওরা শুরু করেছিল সকালে।
কোটি
কোটি অণু পরমাণু ঘুরপাক, কোন এক অমোঘ টানে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে সূর্যের দিকে। স্পর্শে
খুলে যাচ্ছে দ্বার।
বৃষ্টি
নেই। মোবাইলটা বাজছে চেনা রিং-টোনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন