বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

প্রশান্ত গুহমজুমদার

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৮


মার্কসিট

 

মার্কসিট হাতে নিয়ে ঝুমা একদম চুপচাপ হয়ে গেল। এবারেও! জ্বলজ্বল করছে, র‍্যাঙ্ক

-কে ফার্স্ট হল?

-তৃণা।

আবার! নং জায়গাটা কি কোনদিন মিত্রার হবে না! ক্রমে দুচোখে আগুন

-এ রকম হ'ল কেন? কেন অংকে ৯৬ আর ইভিএস-এ ৮৭? 'টা মাস্টার? কেন তবু এ'রকম?

বাইরে রোদ্দুর ঝিমিয়ে এসেছে মিত্রার স্কুলের রেজাল্ট বেড়োবে বলেই ঝুমা আজ অফিস যায়নি সারাদিনের উৎকণ্ঠার পর আবার সেই একই ঘটনা!

-কেন? উত্তর দাও

ঝুমার চিৎকারে কাঁচের জানালা যেন কেঁপে উঠলো। ওই রোগা মেয়েটা এর কি উত্তর দেবে! ও তো প্রচুর খেটেছিল। ক্লাস সেভ্‌নের থেকেও বেশি। মায়ের চোখ দেখে ও বারবার কেঁপে উঠছিল। ও জানে, এরপর কী হবে। শক্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল। প্রথম চড়টা তাই ও সহ্য করতে পেরেছিল। দ্বিতীয় মারটা আর পারলো না। সারাদিন প্রায় কিছুই মুখে দিতে পারেনি। স্কুল ইউনিফর্মেই আছড়ে পড়লো। টেবিলে মাথা ঠুকে মাটিতে যখন মিত্রা  পড়লো, ওর জ্ঞান নেই।

সময় গড়িয়েছে গত তিনদিন ঝুমা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। বিকাশ চলে যাওয়ার আটবছর হ'ল।  ডাই-ইন-হারনেশের চাকরিটা করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই ও করতে পারেনি। মিত্রার মধ্যেই তাই আকাঙ্ক্ষা  ঢেলে দিয়েছে। নাচ গান পড়া-সব কিছুতেই মিত্রাকে সেরা হতে হবে। তার জন্য যা যা করা দরকার, ঝুমা দাঁতে দাঁত চেপে করে যাচ্ছে। ওর জীবনে এখন পরিষ্কার দুটো ভাগ একদিকে চাকরি, অন্যদিকে মিত্রা। সে যুদ্ধে মিত্রা  কেন হেরে যাবে বারবার! মিত্রা যে এদিকে একটু একটু করে রোগা সাদা একটা রোবট হয়ে যাচ্ছে, ঝুমার সে খেয়াল নেই। বছরের এই দিনটাতে প্রতিবারই ঝুমা হেরে যায়। ঝুমা বুঝতে পারছে, ক্লাসে, শুধু স্কুলে না, নাচের পরীক্ষায়, গানে যতদিন তৃণা থাকবে, ঝুমার স্বপ্ন সফল হবে না। অথচ ওরা খুব ভালো বন্ধু। মিত্রা শরীর খারাপের কারণে স্কুলে যেতে না পারলে তৃণা সোজা বাড়িতে চলে আসে। তারপর ওদের যে কতো গল্প! কী গল্প, ওরাই জানে। কিন্তু ঝুমা যেন আর পারছে না। তৃণার উপস্থিতিই ঝুমার কাছে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠেছে। সংসারের সমস্ত যুদ্ধে হেরে যেতে যেতে ঝুমার পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এই বিয়াল্লিশে এসেই ঝুমা বড়ো ক্লান্ত।

শেষ অবধি এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয় ঝুমা। তৃণাকে মিত্রার আশেপাশে আর দেখতে চায় না ঝুমা এবার মিত্রার জন্মদিন ঝুমা খুব জমকালো করে আয়োজন করে। ক্যাটারারকে অর্ডার দেয় মিত্রার ক্লাসের সব বন্ধুকে বলে। মিত্রা কিছু অবাক হয়। যদিও মায়ের মুখের উপর কিছু বলে না।

সন্ধ্যাবেলা সবাই এসে গেছে খুব হইচই আলোয়-নাচে-গানে গোটা বাড়িটা যেন কাঁপতে থাকে। আনন্দে, নাকি  কোনো এক আশঙ্কায়! সবার হাতে সফট ড্রিংক্সের গ্লাস তুলে দেয় ঝুমা নিজে। তৃণার হাতে গ্লাসটা দেওয়ার সময়ে ঝুমার হাতটা কেমন যেন কাঁপছিলো ওর কেবল মনে হচ্ছিলো, গ্লাসটা ঠিকঠাক দিলাম তো!

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন