কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৭ |
শীতের পাখি
অসংখ্য গল্পের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সুতপা। হালকা বাতাস, তাদের যাওয়া, ধরতে পারছিল না একটাকেও, অথচ টের পাচ্ছিল সে। শীত শেষ হয়ে এলো, এবার পাখিরা ক্রমে উত্তরে যাবে। বসন্ত এবার কি কোথাও নিয়ে যাবে ওকে! কোথায়? ২৭টা তো পেরিয়ে এলো। সঙ্গে ঐ পোলিও আক্রান্ত বছর ২০র বোন আর চিররুগ্না মা। সেদিন মা পড়ে গিয়ে হিপ জয়েন্ট ভাঙলো, দুই বোনে পারলো না, শেষ অবধি পাড়ার ছেলেদের সাহায্যে নিয়ে গেল হাসপাতালে। অপারেশন করাতে নাকি অনেক টাকা। সুতপা কোথায় পাবে অত টাকা! স্বাস্থ্য সাথী কার্ডও নেই। পৌরসভার চেয়ারম্যান অনুগ্রহ না করলে কিছুই করতে পারতো না সুতপা।
ব্যাগের
মধ্যে ফোন বাজছে। এ সময়ে কে! ও তো ডাক্তারদাদাকে বলেই বেড়িয়েছে। রাস্তার একপাশে
দাঁড়িয়ে ফোনটা বের করলো। বোন।
-কি
হ'ল?
-কখন
আসবি? আমরা বসে আছি!
-কেন! যেমন আসি। এখনো মাকে খেতে দিস নি! রাস্তায় আছি।
বিরক্ত হয়ে
ফোনটা সাবধানে ব্যাগে
ঢোকালো। এগোতে গিয়েই পায়ের কাছে একটা ঘুড়ি গোত্তা খেয়ে পড়ল। কি সুন্দর দেখতে! এটাই
কি সেই সুমন-এর 'পেটকাটা
চাঁদিয়াল'! আকাশের দিকে মুখ তুললো। অনেক ঘুড়ি।
কতোই না ওড়ার কায়দা। একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়েছে। আর গুটিকয়েক ১০-১২ গাড়িবাইকের
তোয়াক্কা না করেই দৌড়চ্ছে। ছোটবেলা
বোধহয় এমনই
বেপরোয়া। ওরটা যে কবে হারিয়ে গিয়েছে! আবার
একটা গল্প ভেসে গেল ওর শরীর ছুঁয়ে।
মায়ের শরীরটা
বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ। কোমড়ের
সমস্যাটা আছেই, তারপর গত
দুদিন ধরে ক্রমাগত বমি। যা খাচ্ছে, তাই বেড়িয়ে আসছে। ডাক্তারদাদাকে ব’লে ওষুধ এনে
খাইয়েছে, লাভ বিশেষ কিছু তো হয় নি। আর কাকেই বা দেখাবে! দুপুরে হাসপাতালেই নিয়ে
যেতেই হবে। ইচ্ছে করে না, তবুও। ও আর সত্যিই পারছে না। আর মা-ও যতো দিন যাচ্ছে,
সুতপাকে আঁকড়ে ধরছে।
হাসপাতাল কয়েকটা টেস্ট করিয়েছে। কাল রিপোর্ট পাওয়া যাবে। ঘরে বোনটা যেন ক্রমশ
চুপ।
সারাদিনে কতটুকুই বা কথা বলে। লেখাপড়াটাও বন্ধ হয়ে গেল। ও কি কোনো সঙ্কেত পাচ্ছে!
রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। ডাক্তার চিত্তরঞ্জনে নিয়ে যেতে বলেছেন। সুতপার মাথায়
আকাশ ভেঙে পড়লো। কি করবে এখন ও! মাস গেলে এই তো সামান্য ক’টা টাকা! কি দিয়ে কি
করবে!
সামনের শিরিষ গাছে প্যাঁচার ডাক শুনে রাত কেটেছে। অন্ধকার ক্রমে প্যাঁচার দু
ডানায় গুটিয়ে গেল। তবু ডিউটিতে যেতে হবে। বাথরুমে ঢুকে এক মগ জল মাথায় ঢালতেই এ
কদিনের চাপা কান্না সমস্ত শরীর ভেঙে যেন বেড়িয়ে এলো। কি করবে এখন ও! কি করবে?
বাথরুম থেকে বেড়িয়েই দেখলো, একটা বড়ো সাদা পাখি পড়ে আছে। ছটপট করছে। আকাশের
দিকে মুখ তুললো। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে
রসিকবিল থেকে। এই একা পাখি কি আর ফিরতে পারবে? গলায় চিনে মাঞ্জার সুতো
জড়িয়ে গিয়েছে। রক্ত পড়ছে। সুতোটা কি ছাড়িয়ে দেওয়া যাবে! সুতপা ভেজা কাপড়েই হাতদুটো
বাড়িয়ে দিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন