সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১২ / একাদশ বর্ষ : দ্বিতীয় সংখ্যা    

                         

সম্প্রতি ‘অভিষেক’ সাহিত্য পত্রিকার আমন্ত্রণে গেছিলাম মালদা শহরে। উপলক্ষ্য ছিল বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি প্রশান্ত গুহ মজুমদারের দুটি কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এবং তারই প্রাসঙ্গিকতায় সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার ধারা সম্পর্কিত আলোচনা ও পরিশেষে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। ‘অভিষেক’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মালদার বিশিষ্ট কবি ও গদ্যকাররা সমবেত হয়েছিলেন। যেমন আমার পরিচিতির মধ্যে ছিলেন তৃপ্তি সান্ত্রা, শুভ্র মৈত্র, পলাশ গঙ্গোপাধ্যায়, অনুরাধা কুন্ডা, শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, শক্তিপদ পাত্র; তেমনি আরও অনেকের সঙ্গেও পরিচিতি ঘটল। এছাড়া কলকাতা থেকেও আমন্ত্রিত হয়ে গেছিলেন কয়েকজন, ‘দূর্বা প্রকাশনী’র প্রকাশক এবং প্রাবন্ধিক পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র, ‘আলোপৃথিবী প্রকাশনী’র প্রকাশক ও কবি শুভদীপ সেনশর্মা ও মৌমিতা পাল, কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ও কবি অলোক বিশ্বাস। সামগ্রীক অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার গুণে এবং আলোচনার গভীরতায় এক স্বতন্ত্র উচ্চতায় পৌঁছে গেছিল। ‘অভিষেক’ পত্রিকার সম্পাদক তানিয়া গুহ মজুমদার অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখেন। তারই সূত্র ধরে প্রশান্ত গুহ মজুমদারের দুটি কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয় – ‘দূর্বা প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ‘কবিতা সমগ্র ১’ এবং ‘আলোপৃথিবী প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ‘পেয়ালা’। অত্যন্ত মনোরম প্রচ্ছদ ও সুদৃশ্য বাঁধাই, বই দুটির আকর্ষণ নিঃসন্দেহে বাড়িয়েছিল। এবং বলা বাহুল্য, প্রকাশিত বই দুটি সম্পর্কে উপস্থিত গুণীজনদের আলোচনাও সমান আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। 

তা মালদায় গেছিলাম, অথচ মালদার আম ও আমের বাগানের কথা আলোচনা করব না, এটা তো হতে পারে না! মালদা মানেই তো আম এবং আমের বাগান! কথাটা শত প্রতিশত ঠিক কথা। মোট প্রায় তিনদিন ছিলাম মালদায়, প্রথম দিনে সম্ভব না হলেও পরবর্তী দুটো দিন কিছুটা ঘোরাঘুরি করেছিলাম। আর বলা বাহুল্য, আমাদের চারপাশ ঘিরে ছিল শুধু আমের বাগান। চারিদিকে এত এত আমগাছ আর আমগাছের বাগান, বিস্ময়ে শুধু দেখেই যেতে হয়। তবে একটা দুঃখ আমাদের থেকেই গেল, আমের সাম্রাজ্যে পদার্পণ করেও মিষ্টি পাকা আমের স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব হলো না, কেননা, সময়টা চৈত্র মাস, গাছভরা আম, কিন্তু সব আমের রঙই সবুজ, গেরুয়া বা লাল রঙের ছোপ এখনও লাগেনি তাদের কচি শরীরে। লাগবে আরও কিছুদিন পরেই, রূপসী হয়ে উঠবে তারা, বুকে টসটস করবে মিষ্টি রস, কিন্তু তখন আমরা সেখানে থাকব না, স্থানীয় বাজার থেকে মালদার আম কিনে খাব, মালদায় বসে মালদার আমের স্বাদ আস্বাদন করার আনন্দ অধরাই থেকে যাবে।

প্রসঙ্গত আম সম্পর্কিত সামান্য কিছু পড়াশোনা করে অবগত হলাম, ভারত ও বাংলাদেশে যে প্রজাতির আমচাষ হয়, তার বৈজ্ঞানিক নাম Mangifera indica। এই প্রজাতি Anacardiaceae পরিবারের সদস্য। তবে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির আমের চাষ হয়, অর্থাৎ আমেরও বিভিন্ন প্রজাতি আছে, যেমন ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসা, অরুণা, আম্রপালি, মল্লিকা, সুবর্ণরেখা, মিশ্রিদানা, নীলাম্বরী, কালীভোগ, কাঁচামিঠা,  আলফানসো, বারোমাসি, তোতাপূরী, কারাবাউ, কেঊই সাউই, গোপাল খাস, কেন্ট, সূর্যপূরী, পাহুতান, ত্রিফলা, হাড়িভাঙ্গা, ছাতাপরা, গুঠলি, হিমসাগর ইত্যাদি। এছাড়াও আছে আরও অনেক আমের প্রজাতি। বাংলাদেশে আমগাছকে জাতীয় গাছের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

আমাদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা ফজলি আমের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও এখানে আরো অনেক ধরনের আম চাষ হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক হাজার আগে থেকেই আম চাষের প্রচলন হয়েছে। কথিত  আছে, পূর্ব এশিয়াতে খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দী থেকেই আমের প্রচলন এবং চাষের শুরু হয় খৃষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে। মূলত উষ্ণপ্রধান অঞ্চল আমচাষের পক্ষে উপযোগী। পূর্ব এশিয়া ছাড়া ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মেক্সিকো, মরোক্কো ইত্যাদি দেশেও আমচাষ হয়ে থাকে। তবে তুলনামূলক বিচারে সব থেকে বেশি আম উৎপাদিত হয় ভারতেই। এর পাশাপাশি উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য-আফ্রিকা ইত্যাদি অঞ্চলেও আমের যথেষ্ট উৎপাদন হয়ে থাকে।

মালদা অবশ্য শুধুমাত্র আমের জন্য সুখ্যাত এবং বিখ্যাত নয়, বরং এই অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ও বাঙালির অতীত ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। একসময় এই মালদা সংলগ্ন গৌড়বঙ্গ ছিল বাংলার রাজধানী। সেই গৌড়বঙ্গের রাজা তথা সুলতানদের শাসনকাল ছিল গৌরবজনক। বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের এক সুবর্ণ সময়কাল। তবে সেই আলোচনা এখানে নয়। পরে কখনও বিশদভাবে করা যেতে পারে।

শুরু হলো আবার একটি নতুন বছর। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই সবাইকে। প্রতিটি দিন সবাই সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন, আনন্দে থাকুন – এই আন্তরিক কামনা করি।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৯




আজ ডেনমার্ক ও নরওয়ের ছবি নিয়ে কাটাছেঁড়ার দিন। শুরুতেই আপনাদের জানানোর জন্য দু-এক কথা, আমি জন্মসূত্রে ও ভোটার হিসেবে হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের বাসিন্দা। আর এই শ্রীরামপুর, শ্রীরামপুর হয়ে ওঠার বহু আগে ছিল ড্যানিশদের ঘাঁটি। ১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫। তখন এই শহরের নাম ছিল ফ্রেডারিক নগর। হুগলী নদীর দু’পাড়ে বিভিন্ন  শহরে যেমন ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগীজরা কোন এককালে জমিয়ে বসেছিল, তেমনি সেই সময় এই শহরে ড্যানিশরা জাঁকিয়ে ব্যবসা করত। এমনকি ১৮১৮ সালে উইলিয়াম কেরি যখন শ্রীরামপুর কলেজ তৈরি করেন, তখন কোথায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়? সেই সময় শ্রীরামপুর কলেজ ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে নিজেরাই ডিগ্রি দিত, ফলে এটা ছিল বকলমে বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজরা ১৮৪৫ সালে ড্যানিশদের থেকে শ্রীরামপুর কিনে নেওয়ার পর আস্তে আস্তে বিভিন্ন নিয়ম বদল হয়। আর এই কারণেই দেখবেন, হুগলী নদীর দু’পাড়ের  পুরনো বাসিন্দারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কথা উঠলেই নিজেদের শহর ও সেইসব দেশের ঔপনিবেশিকতা নিয়ে খুব ইতিহাসপ্রবণ ও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন, একটু-আধটু লেকচার ঝাড়তে চান, সে আমার মত পাঁড় নন-ইতিহাসবিদ লোকেরাও। ওগুলো হুগলী জেলার মুদ্রাদোষ, ভাল না লাগলে শুনবেন না, দু’কানের মধ্যে একটা চ্যানেল তৈরি করে এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবেন।

যাইহোক, আজ আমরা শুরু করব ডেনমার্কের বিখ্যাত পরিচালক কার্ল থিয়োডোর ড্রেয়ার-কে (১৮৮৯-১৯৬৮) নিয়ে। কার্ল ড্রেয়ার ছিলেন একদম শুরুর দিকের ড্যানিশ সিনেমার পথিকৃত। ওনার সিনেমায় যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে, সেগুলো শুরু হয় মনস্তত্ব দিয়ে। সেখান থেকে সামাজিক অবক্ষয় হয়ে ভয়, মৃত্যু ও অশুভের ছায়া অব্ধি। কিন্তু পুরোটাই স্লো মোশনে। ক্যামেরা কখনোই দ্রুত নয়। মাঝে মাঝে লঘুচ্ছলে মনে হয়, জীবনানন্দ নিশ্চয়ই ওনার সিনেমা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সারা জীবনে মাত্র ১৪টা ছবি বানিয়েছেন। এছাড়াও কিছু শর্ট ফিল্ম এবং ডকুমেন্টরী। ওনার সিনেমার ভেতর উল্লেখযোগ্য - দ্য পার্সনস উইন্ডো (১৯২০), লিভস আউট দ্য বুক অব স্যাটান (১৯২১), মাইকেল (১৯২৪), মাস্টার অব দ্য হাউজ (১৯২৫), দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক (১৯২৮), ভ্যাম্পায়ার (১৯৩২), ডে অব র‍্যাথ (১৯৪৩), টু পিপ্ল (১৯৪৫), অর্ডেট (১৯৫৫),গারট্রুড (১৯৬৪) ইত্যাদি। এর ভেতর আজ ড্রেয়ারের মাত্র দুটো সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো ১১ নং পর্বে উল্লেখ করেছিলাম - দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক এবং অর্ডেট।

চোদ্দ শতকের মাঝামাঝি থেকে পনেরো শতকের মাঝামাঝি অব্ধি একশ বছরের বেশি সময় ধরে ইংরেজ ও ফ্রেঞ্চদের যুদ্ধ চলেছিল। ফ্রান্সের সেই মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে জোয়ান অব আর্ক নামক এক বীরকন্যা ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে অনেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৪৩১ সালে তাকে ইংরেজরা ধরে ফেলে এবং পুড়িয়ে মেরে ফেলে। ফ্রান্সে আজো কেউ কেউ তাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা হিসেবে দেখেন। ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক জোয়ানের ধরা পড়ার পর এবং পুড়িয়ে মারার আগে তার যে বিচার চলেছিল, সেই নিয়ে এক নির্বাক চলচ্চিত্র। এই ছবি বানানোর জন্য কার্ল ড্রেয়ারকে ফ্রান্সে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ছবির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত অপেরা অভিনেত্রী রেনি জিন ফ্যালকোনেটি। এবং এটা সত্যি যে ফ্যালকোনেটির অভিনয়ের জন্য এই সিনেমা আরো অনবদ্য হয়ে উঠেছে।

নির্বাক চলচ্চিত্রের জমানায় যে কটা সিনেমা একদম প্রথম সারিতে থাকবে, ‘দ্য প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক তাদের মধ্যে অন্যতম। এই সিনেমার জন্য ড্রেয়ার অনেক রকম কলাকুশলীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। একদিকে আধ্যাত্মিক  বিশ্বাস, অন্যদিকে বিচারের নামে প্রহসন, এই দুয়ের দোলাচলে এই সিনেমা। জার্মান এক্সপ্রেসনিজম নিয়ে আমি আগেই বলেছিলাম, এই ছবিতে এক্সপ্রেসনিস্ট লাইটিং ব্যবহার করা হয়েছে। স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স আগেও বিশ্লেষণ করেছি, এখানে সেই টেকনিক। অদ্ভুত এক অ্যাঙ্গল থেকে শুরু করে। নিঃশ্বাসের খুব কাছাকাছি যখন ফ্যালকোনেটিকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এক সেটের সঙ্গে আরেক সেটের যোগসূত্র, যখন ক্যামেরা এক সেট থেকে আরেক সেটে মসৃণ চলে  যাচ্ছে। আর ক্লোজ-আপে ফ্যালকোনেটির মুখের ওপর যখন ক্যামেরা, তার মুখে যখন একসঙ্গে যন্ত্রণা আর স্বাধীনতার  আনন্দ। অনবদ্য মাস্টারমিস। হ্যাঁ, আপনি বলতেই পারেন ছবি মন্থর, ক্যামেরার কাজ ধীরে। কিন্তু নির্বাক জমানায় সেটাও এক মস্ত সাফল্য, যা এই ছবিকে পুরোপুরি বুঝতে সাহায্য করে। সমালোচক রজার এবার্ট এই ছবি প্রসঙ্গে অসাধারন এক কথা বলেছিলেন। সেটা দিয়েই শেষ করি – ‘you cannot know the history of silent film unless you know the face of Renee Maria Falconetti. In a medium without words, where the filmmakers believed that the camera captured the essence of characters through their faces, to see Falconetti in Dreyer’s “The Passion of Joan of Arc” is to look into eyes that will never leave you’।    

জোয়ান অব আর্ক যদি বিশ্বাসের ছবি হয়, তাহলে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলের ছবির নাম ‘অর্ডেট’। গ্রাম্য ডেনমার্কের এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবার, বাবা বিপত্নীক, তার তিন ছেলের বড় মিকেল ভগবানে বিশ্বাস করে না। মিকেলের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। মেজোছেলে জোহানেস নিজেকে যীশুখৃষ্ট বলে ভাবে। ছোটছেলে অ্যান্ডার্স স্থানীয় এক নেতার মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখানে শুধু যে এই পরিবারের নিজেদের ভেতরের ধর্মীয় সংঘাত দেখানো হয়েছে, তা নয়, এই পরিবারের সঙ্গে গ্রামের অন্যান্যদেরও কিছু কিছু ঝামেলার জায়গা রয়েছে। যাহোক, সিনেমার শেষদিক একটু গতানুগতিক যে কারণে এই ছবির ফিনিশিং আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু এই ছবি ড্রেয়ারের কেরিয়ারের এক মাইলস্টোন।

অর্ডেট মানে শব্দ, the word। সিনেমার থিম এক নাটকের স্টেজ শো থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কি সেই শব্দ? ড্রেয়ার যা অনুচ্চারিত রেখেছেন? আমার মতে, বিশ্বাস। এক শব্দ যা দিয়ে অনেক কিছুর সংজ্ঞা দেওয়া যায়। অনেক কিছু মেনে নেওয়া যায়। আবার উল্টোদিকে যুক্তি তর্ক উঠে আসে। আসলে এই সিনেমা ড্রেয়ার এক প্রিজম হিসেবে ব্যবহার করেছেন যেখানে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা দিয়ে মানুষের অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন। এবং যেটা না বললেই নয়, তা হল এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি। প্রথম কথা, ছবির সেট বেশ সহজ। আউটডোর শটগুলো প্রাণবন্ত। দূর থেকে দিগন্তে পায়চারি যেন এক মুঠো সবুজ বাতাস। প্রার্থনার সময়ে সামনে পেছনে দুলন্ত মানুষগুলো যেন হিপনোটিক। সাদা কালো আলো মনে ছড়িয়ে পড়ে, আস্তে আস্তে। সিনেমা শুরুর সময় ভুরু কুঁচকে উঠলেও পরবর্তীকালে ড্রেয়ার আমাদের এক ম্যাজিকের ভেতর নিয়ে চলে যান, যা ছবি শেষ হবার পরেও চোখে লেগে থাকে। এই ছবি দেখলে, আমি নিশ্চিত, আপনাদের মনে জাপানের পরিচালক ওজুর কথা মনে পড়বেই।    

ড্রেয়ারের ছবি ছেড়ে দিলে ডেনমার্কে অন্যান্য যেসব পরিচালকদের কথা উঠে আসে, তারা ড্রেয়ারের পরবর্তী প্রজন্মের। এদের ভেতর আমি চারজন পরিচালকের চারটে ছবি পাঠকদের দেখার জন্য সুপারিশ করব - গ্যাব্রিয়েল অ্যাক্সেলের ‘ব্যাবেটেজ ফিস্ট’ (১৯৮৭), বিলি অগস্টের ‘পেলে দ্য কনকয়ারার’ (১৯৮৮), সুজেন বিয়া-র ‘ইন আ বেটার ওয়ার্’ (২০১০) এবং থমাস ভিন্টারবার্গের ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ (২০২০)।

২১ নম্বর পর্বে ডেনমার্কের অভিনেতা ম্যাজ মিকেলসেন-কে নিয়ে আলোচনা করার সময় ‘অ্যানাদার রাউন্ড’ নিয়ে কয়েক লাইন লিখেছিলাম। মিকেলসেনের অভিনয় যেখানে প্রধান উপজীব্য। তাই এখানে কাটাছেঁড়া করব ১৯৮৭-র ছবি ‘ব্যাবেটেজ ফিস্ট আর ২০১০-এর ছবি ‘ইন আ বেটার ওয়ার্ল্ড’ নিয়ে।

উনিশ শতকের শেষদিকে ডেনমার্কের এক ধর্মীয় পরিবারে ফ্রান্স থেকে আসা একটি উদ্বাস্তু মেয়ে আশ্রয় নেয়। সেই পরিবারের দুই মেয়ে তাদের বাবার কথা ও ধর্মীয় অনুশাসনের কথা ভেবে বিয়ে করেনি। তাদের বাবা অনেকদিন হল মারা গেছেন। এবার তাদের পরিবারে ব্যাবেটে নামক এই উদ্বাস্তু মেয়েটি আসার পর সে একজন পরিচারিকা হিসেবে পরিবারের লোকেদের খেয়াল রাখতে শুরু করে। তারপর একদিন সে অনেক টাকার লটারী পায়। চলে যাবার আগে সে এই পরিবারের লোকেদের ও তাদের আত্মীয়দের একদিন ফ্রান্সের খাবার রেঁধে খাওয়াতে চায়। তার প্রতি এই পরিবার সহানুভূতি দেখানোর জন্য। সেই ডিনার সেটের অভিজ্ঞতা নিয়েই ছবি ‘ব্যাবেটেজ ফিস্ট’।   

বন্ধুত্ব, কৃতজ্ঞতা, ধর্মীয় অনুশাসন, আচার অনুষ্ঠান, খাবার লোভ – অনেক কিছু নিয়ে ১০২ মিনিটের এই ছবি। ব্যাবেটে খুব কম উপাদান নিয়েও একজন শিল্পীর মত রান্না করতে ভালবাসে। তার মতে, ‘the long cry from the heart of the artist is “give me a chance to do my very best” । খাবার পর সবার মনে এক অদ্ভুত আনন্দ আসে। আমারও মনে পড়ে যায়, লকডাউনের সময় আমরা কিভাবে বাড়ির ভেতর মাত্র কিছু জিনিষ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছি। খাবারের মূল্য বুঝতে শিখেছি। সময়ের সঙ্গে খাবারের গুরুত্ব কিভাবে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে, সেটাও বুঝেছি। এই ছবি, একটু অন্যভাবে দেখলে, সেই সময়ের দলিল। এই ছবি বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়েছে যার মধ্যে অস্কার একটা।

সুজেন বিয়া পরিচালিত ‘ইন আ বেটার ওয়ার্ল্ড’ প্রায় দু’ঘন্টার ছবি। ছবির মূল চরিত্র দুই স্কুলপড়ুয়া ছাত্র। এক ডাক্তার,  যার বাড়ি ডেনমার্ক কিন্তু কর্মস্থল আফ্রিকার এক রিফিউজি ক্যাম্প, বাড়ি আর কর্মস্থলে ঘনঘন যাতায়াত করেন। তার ঘরোয়া জীবন বেশ জটিল। স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ চলছে এবং ছেলে স্কুলে অন্যান্য ছেলেদের কাছে র‍্যাগিং-এর শিকার। এইসময় আরেকটি ছেলে সেই স্কুলে ভর্তি হয় এবং ডাক্তারের ছেলে ইলিয়াস-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়। যে ছেলেরা ডাক্তারের ছেলেকে বিরক্ত করত, তাদের পাল্টা মার দেয়। প্রতিশোধ নেবার জন্য ইলিয়াসকে একটা ছুরি দেয়। একদিন ইলিয়াস যখন আরেকটা ছেলের সঙ্গে মারামারি করছে, ডাক্তার এসে দুজনকে ছাড়াতে যায়। কিন্তু অন্য ছেলেটির বাবা, এক মেকানিক, ডাক্তারকে সপাটে এক চড় মারে অন্য ছেলেটিকে ছোঁওয়ার জন্য। নিজের ছেলের কাছে ডাক্তার ছোট না হবার জন্য সেই মেকানিকের গ্যারাজে ইলিয়াস ও তার বন্ধুকে নিয়ে কথা বলতে যায়। বোঝাতে যায়। কিন্তু সেই মেকানিক এবারেও ডাক্তারকে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় মারে। গালাগাল দেয়। বাবার এই অপমান দেখে ইলিয়াস ও তার বন্ধু প্ল্যান করে মেকানিকের সেই গ্যারাজ বোম মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই বোমের আঘাতে ইলিয়াস নিজে জখম হয়। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, ইলিয়াস ও তার বাবার বন্ধুত্ব আবার জমে উঠেছে। ডাক্তারের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্কও আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। 

ড্যানিশ ভাষায় এই ছবির মূল টাইটেল ছিল ‘Haevnen’ যার অর্থ প্রতিশোধ। সেটাকে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে নরম করে তোলার জন্য মূলভাষার এই পরিবর্তন। সেই নিয়ে এই মেলোড্রামা ছবি। বলে রাখা ভাল, বিয়া ইমোশন ড্রামা নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। এই ছবির স্ট্রাকচার এবং এক সিনের সঙ্গে আরেক সিনের সাদৃশ্য মোটামুটি বোঝা যায়। দর্শক অনুমান করতে পারেন। পাহাড়ের মাথায় বা শেষ দৃশ্য, কি হতে চলেছে এগুলো বলে দেওয়া যায়। আফ্রিকার সিনগুলোর ইন্টারকাট এই ছবিকে আরেকটু আকর্ষণীয় বানিয়েছে। তবে ছবির মূল বিষয়বস্তু আরেকটু জটিল, আরেকটু  অবজেক্টিভ হলে ভাল হত। এখানে যেন মনে হচ্ছে এই ছবি উচ্চবিত্তের এক বিশেষ শ্রেণীকে মাথায় রেখেই করা  হয়েছে। আরেকটু ছড়িয়ে পড়লে, আরেক মাত্রা বাড়াতে পারলে, এই ছবিকে আমি ফুল মার্কস দিতাম। আপাতত দিতে পারছি না।    

নরওয়ে থেকে আজ অব্ধি মাত্র ৬টা সিনেমা অস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছিল – নাইন লাইভস (১৯৫৭), দ্য পাথফাইন্ডার (১৯৮৭), দ্য আদার সাইড অব সানডে (১৯৯৬), এলিং (২০০১), কোন-টিকি (২০১২) এবং দ্য ওয়র্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (২০২১)। যদিও এর কোনোটাই অস্কার পায় নি। এর মধ্যে আমার সবকটাই দেখা। এবং ‘কোন-টিকি’ এখনো অব্ধি ও দেশের সর্বোচ্চ টাকা তোলা ছবি বলে মনে করা হয়। যাইহোক, নরওয়ের সিনেমা নিয়ে আমার সীমিত জ্ঞান এবং স্পেসের অভাবে আজ একটা ছবি নিয়েই আলোচনা করব। বেশি নয়।

আজ আমরা দেখব জোয়াকিম ট্রায়ারের ‘দ্য ওয়র্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। এই ছবির জন্য মুখ্য চরিত্র রেনাতে রাইন্সভে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবং সিনেমা বলতে যদি বহমান জীবন বোঝায়, যদি ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ বোঝায়, তাহলে একেও সেই ব্র্যাকেটে রাখতে হবে। আমরা সত্যজিৎ বা  মৃণালের কলকাতা ট্রিলজি দেখেছি। এই ছবি জোয়াকিমের ‘অসলো’ ট্রিলজির শেষ সিনেমা। রোমান্টিক ড্রামা।

নামের ভেতর একটা প্যারোডি আছে। অসলোর এক স্বাধীনচেতা তরুণী জুলি, ডাক্তারির ছাত্রী। নিজেকে নিয়ে সিদ্ধান্ত  নিতে পারে না। কেরিয়ার নিয়েও পারে না। ডাক্তারি ছেড়ে সে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনো শুরু করে। তারপর ফটোগ্রাফি নিয়ে। তার প্রেমিক এক্সেল তার থেকে ১৫ বছরের বড় একজন কমিক আর্টিস্ট। এক্সেলের খামারবড়িতে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে গিয়ে এক্সেল তাকে বিয়ে করার প্রোপোজাল দেয়, কিন্তু জুলি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফেরত আসার পথে এক বিয়েবাড়িতে সে ইভিন্ড নামক অন্য এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যদিও জুলি আর ইভিন্ড দুজনেরই ফিঁয়াসে আছে। জুলি তার ৩০তম জন্মদিন তার মায়ের কাছে পালন করে। হঠাৎ একদিন জুলি এক্সেলকে ছেড়ে দিয়ে ইভিন্ডের সঙ্গে লিভ ইন থাকতে শুরু করে। কিছুদিন পর সে বুঝতে পারে সে গর্ভবতী। কিন্তু এই আগত সন্তানের বাবা কে? একদিন জুলি জানতে পারে এক্সেল ক্যানসারে ভুগছে। সে এক্সেলকে বলে সে প্রেগন্যান্ট। আবার ফিরে এসে ইভিন্ডকেও বলে দেয় সে প্রেগন্যান্ট। সন্ধেবেলা সে জানতে পারে এক্সেল মারা গেছে। ইভিন্ড তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এবং বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে তার গর্ভপাত হয়ে যায়।

অনেকদিন পর, জুলি যখন কোন এক সিনেমার ফটোগ্রাফি শুটিং করছে, সে দেখতে পায় সিনেমার অভিনেত্রীর জন্য বাইরে ইভিন্ড ও তাদের বাচ্চা অপেক্ষা করছে। জুলি বাড়ি ফিরে এসে সারাদিন ধরে তার তোলা ফটোগুলো এডিট করতে শুরু করে।

অনবদ্য সিনেমা। শুধু থিমের জন্য। এইরকম বোহেমিয়ান ভালবাসার প্লট, বহমান জীবনের প্লট খুব কম ছবিতেই দেখা যায়। আমি ঐসব exquisite, wistful, instant classic এসব বলব না। শুধু বলব অনবদ্য পরিচালনা এবং রাইন্সভে-র ‘messy young woman’ অভিনয় ততোধিক উপভোগ্য। এবং আমি যেটা উপলব্ধি করেছি, তা হল ঘরোয়া জীবন ও আর্টিস্টিক জীবনের সংঘাত কখনো সখনো অনিবার্য। সেই সংঘাত এরকম সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দিতেই পারে। এই সিনেমায় আরো দেখুন নরওয়ের রাজধানী অসলো-র সৌন্দর্য। অসলো-র নাগরিক জীবন।

তাহলে নর্ডিক দেশের ছবির আলোচনা এই অব্ধিই। 

 

(ক্রমশ)

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল’ : ৩য় কিস্তি

 

শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা

 

ইন্দিরা

প্রথম যে বাংলা ছবি দেখার কথা মনে আছে, সেটি হ’লো ছবি বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ ও সুলতা চৌধুরী অভিনীত ‘শেষ পর্যন্ত’। প্রথম দেখা ভবানীপুরের ইন্দিরায়, তারিখ ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৬০, এবং সেটি আমার ও পরিবারের সকলের এত ভালো লেগেছিল যে জীবনে সেই প্রথম কোন ছবি দু’বার দেখি।  দ্বিতীয়বার গড়িয়াহাট থেকে বালিগঞ্জের দিকে বাঁক নিলে আলেয়া বলে যে হলটি পড়ে, সেখানে। তাছাড়া, বিশ্বজিতের ভক্ত হয়ে পড়ি, আর সর্বক্ষণ ‘এই মেঘলা দিনে একলা’ গুনগুন করার পুরস্কার হিসেবে ৭৮ আর পি এমের রেকর্ডটিও আমাকে কিনে দেওয়া হয়, দম দেওয়া গ্রামোফোনে বাজিয়ে শোনবার জন্যে৩১শে জানুয়ারী ১৯৬১ তারিখে মা লিখছেন যে রাত্রে “পানু আমি’ বলে বিশ্বজিতের অভিনীত চরিত্রটির নকল করছি , গানও গাইছি, মাথার চুল হাত দিয়ে সরিয়ে, ঠিক যেভাবে বিশ্বজিৎ করেছিলেন! আমার বয়েস তখন ৩ থকে ৪-এর মধ্যে। সুরকার ও গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! ছবির আরেকটি গান ঐ রেকর্ডের উল্টোদিকে ছিল, যার দৃশ্যায়ন এখনো মনে আছে – সাঁতারের পোশাক পরে একদল তরুণ সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে হাত তালি দিচ্ছেন আর গাইছেন ‘আমরা বাঁধন ছেঁড়ার জয়গানে’। শিল্পী ছিলেন হেমন্তর ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্যরা।

১৯৬৫ সালে বাবা সৈন্যদল থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পর আমরা সৈনিকদের আবাসন ছেড়ে মে মাসে উঠে আসি গোল পার্কের কাছে পূর্ণদাস রোডে ভাড়াবাড়িতে। এখান থেকেই গিয়েছিলাম ১৯৬৫- র মে মাসে ইন্দিরায়  আমার জীবনে প্রথম সত্যজিৎ রায় পরিচালিত দুটি ছবি দেখতেঃ কাপুরুষ ও মহাপুরুষপরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ পড়া ছিলো, তাই বিরতির পর ‘মহাপুরুষ’ মন্দ লাগেনি। কিন্তু একজন ৮ বছরের ছেলের পক্ষে ইন্টারভালের আগে ‘কাপুরুষ’ ছিল ক্লান্তিকর ও অস্বস্তিজনক।

১৯৬৭-তে যতদূর মনে পড়ে মুক্তির দিনই (২রা জুন) রাতের শো’তে ইন্দিরায় গিয়ে দেখি হলের  সামনে প্রচুর ভীড়। সম্ভবত বর-বৌ পার্থ ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বিবাহিত দম্পতির সাজেই এসেছিলেন! ‘বালিকা বধূ’ নিয়ে আগে তরুণ মজুমদারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যা লিখেছিলাম, তা এখানে আবার দিলামঃ ছবিটি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন আমার মাসীমা, বিষয়বস্তু শোনার পর। তাই সদলবলে যাওয়া।

ছবির প্রথমেই আছে দু’টি হাত, একখানি অ্যালবামের পাতা উল্টে-উল্টে কাহিনীর চরিত্রদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরে জেনেছি সেই হাত আর সংলাপের কন্ঠ অন্তত কিছুটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের! তারপর পূর্ণভাবে উপভোগ্য একটি সুন্দর ছবি! গানে গানে মুখর! প্রথমে বিয়ের গাড়িতে করে যেতে যেতে অমল (পার্থ)-এর জামাইবাবু অনুপকুমার গাইছেন দ্বিজেন্দ্রগীতি, ‘আজি  এসেছি, এসেছি বধূ হে’, যন্ত্রানুসঙ্গ গাড়ির হর্ন! বাসরঘরে সেই জামাইবাবুই গেয়ে ওঠেন ‘মলয়  আসিয়া কয়ে গেছে কানে’। গান শেষ করবেন, ‘এইবার তুমি...’, এমন সময় দেখেন যে নববধূ রজনী (মৌসুমী) দিব্যি একজনের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন! মুখ বেঁকিয়ে জামাইবাবু হারমোনিয়াম  বন্ধ করে শেষ শব্দটি উচ্চারণ করেন, ‘আসিবে!’ নেপথ্য কন্ঠে রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে এই জামাইবাবুর মুখেই আমরা শুনব রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’, সেখানেও রবীনবাবুর গলা। (আচ্ছা তরুণবাবু, তপন সিংহ মশায় কিন্তু একরকম জোর করেই হেমন্তবাবুকে তাঁর ছবিতে দ্বিজেন্দ্রগীতি (‘আরোহী’) আর অতুলপ্রসাদের গান (‘ক্ষণিকের অতিথি’) গাইয়েছিলেন। আপনি সেই জোর করলেন না কেন? পরে তো ‘খেলার পুতুল’-এ আপনিই হেমন্তবাবুকে দিয়ে ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’ গাইয়েছেন!)

এরপর ভোরবেলায় অমল আর রজনী গিয়ে বসবে বাড়ির বাইরে মাঠে। দূর থেকে ভেসে আসবে  হেমন্তবাবুর উদাত্ত কন্ঠে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’। আর অমল গেয়ে উঠবে ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনের ঘ্রাণে পাগল করে’, সেও সেই একজনেরই ঐশ্বরিক স্বরে! রজনী বাপের বাড়ি গেলে বিরহী অমল স্কুলের বাংলা ক্লাসে ভাব সম্প্রসারণ (‘নাহি কিরে সুখ, শুধু কিরে দুখ,  এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?’) লিখতে গিয়ে খাতা ভরে ফেলবে ‘রজনী’র নামে, ফলে জুটবে মাস্টারমশায়ের প্রহার! বিরহী শ্যালককে নিয়ে জামাইবাবু যাবেন যাত্রা দেখাতে। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেখানেও এক বিরহী রাজার কন্ঠে, ‘সখী রে, প্রাণপাখী রে’, কিন্তু রাজার বিরহমোচনে মঞ্চে ছুটে আসবেন রাণী, ‘আমি এসেছি, এসেছি গো সখা, ফেলো না কো আঁখিজল!’ (রাণীর ভূমিকায় যে সময় দেখানো হচ্ছে, তার রীতি মেনে পুরুষ – গোঁফ-কামানো জহর রায়!)। বিরক্ত অমল উঠে চলে যায়। এরপর গৃহশিক্ষকের স্বদেশী করার অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া, পুলিশের সঙ্গে তাঁর চলে যাবার সময় নেপথ্যে হেমন্তকণ্ঠে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। জামাইবাবুর বোন/দিদিকে লেখা চিঠি হাতে এসে পড়ায়, তার নকলে অমলের চিঠি লেখে রজনীকে, তাকে সম্বোধন করা, ‘প্রিয়তমা রজনী’! উত্তর আসে, “তোমার চিঠি [বড়রা] সবাই পড়েছে; বলেছে, ‘বাঁদর ছেলে’! আর কখনো আমাকে এরকম করে লিখবে না!” ক্ষিপ্ত অমল স্ত্রীর উত্তর ছুঁড়ে ফেলে দেয় পুকুরে।

রজনী ফিরে এলে সে মেলায় গিয়ে শোনে চারণকবি মুকুন্দদাসের গান (ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত) ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী’, সব মেয়েরা মঞ্চে ছুঁড়ে দিচ্ছেন তাঁদের হাতের চুড়ি, রজনী চট করে তার চুড়ি ভর্তি হাত লুকোবে আঁচলের তলায়। পরে বাক্সভর্তি চুড়ি সে দিয়ে যাবে সম্ভবত ননদের হাতে (জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়) গঙ্গায় ফেলে দেবার জন্যে।

অনেক, অনেক স্মৃতি ‘বালিকা বধূ’কে ঘিরে। প্রথমবার দেখার পর দাদার মাথায় আসে ঠাকুমাকে নিয়ে আসার। মাসীমার মতো তিনিও তো এককালে বালিকা বধূই ছিলেন! ঠাকুমার অবশ্য ছবিটি ভালো লাগেনি। অনেক বছর পরে কিন্তু এই ঠাকুমাই আমার কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে শুনবেন তরুণবাবুর ‘মেঘমুক্তি’ ছবির গল্প! এরপর ‘বালিকা বধূ’ তৃতীয়বারও দেখা হয়।

১৯৭২-এর আগে এটিই আমার সবচেয়ে বেশীবার দেখা বাংলা ছবি। এর আগে ‘শেষ পর্যন্ত’ দু’বার দেখেছি, আর তারপর কোন এক সময় ইন্দিরায় এবং অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে (কোনটিতে আগে মনে নেই) ১৯৫১ সালের বিখ্যাত কৌতুক চিত্র ‘বরযাত্রী’।

২১শে আগস্ট, ১৯৭০-এ লাইটহাউস, রূপবাণী, অরুণা, ভারতীতে মুক্তি পাওয়া তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’ দেখবো প্রায় এক যুগ পরে, বিদেশ থেকে ফিরে, ইন্দিরা সিনেমায়, দুপুরের শোয়ে।

১৯৭৪-এ দেখেছিলাম ইন্দিরায় ‘সাধু-যুধিষ্ঠিরের কড়চা’। রবি ঘোষ, চিন্ময় রায় ও জয়া ভাদুড়ীর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল, ছবিটিও বাণিজ্যিকভাবে এতটাই সফল হয়েছিল যে পরে হেমন্তপুত্র জয়ন্ত/রীতেশ এর একটি হিন্দি রূপান্তর প্রযোজনা করেন আসরানি, অমোল পালেকর ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে! সেটি অবশ্য চলেনি। মূল ছবিটি দু-এক জায়গা ছাড়া আমার অতিদীর্ঘ ও ক্লান্তিকর লেগেছিল।

১৯৭৭-এ প্রথম দেখলাম ইন্দিরায় রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরক্ষা’হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালক, যদিও বেশীর ভাগ গানই ছিল মধুমিতা রায়ের গলায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের মুখে। শেষ গান, ‘যার অদৃষ্টে যেমনি জোটে’তে হেমন্তর সঙ্গে গলা দিয়েছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এবং ধীরেন বসু। এছাড়া হল কর্তৃপক্ষ শো আরম্ভ হবার আগে ও বিরতির সময় নেপথ্যে বাজিয়েছিলেন হেমন্তকণ্ঠে একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড।

আর সত্তরের দশকে প্রাক-উত্তম যুগের একগুচ্ছ ছবি দেখেছি প্রধানত মা’র উৎসাহে। যে ছবিগুলি দেখেছি, সেগুলি বেশীর ভাগই মুক্তি পেত দু’টি নতুন বাংলা ছবির মাঝখানে, এক সপ্তাহের জন্যে। এর মধ্যে ইন্দিরায় দেখেছিলাম নিউ থিয়েটার্সের ‘জীবন-মরণ’ (১৯৩৯ সালের ছবি)। সম্ভবত শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে সমাজে যক্ষ্মারোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে এই ছবির কুশীলব ছিলেন দুই অবাঙালি কুন্দনলাল সায়গল ও লীলা দেশাই।

১৯৮২ সালে ভবানীপুরের শ্যামাপ্রসাদ (সান্ধ্য) কলেজে আমি অধ্যাপনায় নিযুক্ত হই। তখন কলেজের একদিকে বিজলী, ইন্দিরা, ভারতী (আর নেই), পূর্ণ (আর নেই), অপর পাশে বসুশ্রী আর ঊজ্জ্বলা (আর নেই)কলেজের সময় সোম থেকে শুক্র বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৯টা, শনিবার যতদূর মনে পড়ে ৩টে ৩০ থেকে ৬টা ৩০। অর্থাৎ দুপুরের শো দেখে, বা দেরীর দিকে ক্লাস থাকলে ম্যাটিনী শো দেখেও অনায়াসে কলেজে ঢোকা যায়! জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, বাংলার অধ্যাপক অরূপ ভট্টাচার্যের ভাষায়, তখন আমি (বাংলা সিনেমার) ‘কোর্স কমপ্লিট’ করতে বদ্ধ পরিকর! সল্ট লেকে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও হাতিবাগানের চেয়ে ভবানীপুরই তখন ছবি দেখার পক্ষে সুবিধেজনক।

ইন্দিরায় দেখলাম ১৯৬০ সালের ‘কুহক’, এক সাইকোপ্যাথ খুনে চোরের ভূমিকায় মহানায়ক। তার সঙ্গে হেমন্ত-সুরারোপিত এবং গীত ছ’খানি ভিন্ন-ভিন্ন ধরনের গান! ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো’ এগুলির মধ্যে  সবচেয়ে বিখ্যাত, পরবর্তী-কালে এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে গানটি নিয়ে হেমন্তর সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার  জন্য। কিন্তু আমার মন কেড়েছিল ‘সারাটা দিন ধ’রে, চেয়ে আছিস ওরে / তোর মনের কথা তবু তো কেউ জানলো না।’

সাম্প্রতিককালে ছবিটির উৎস-উপন্যাস পড়ে এবং তাঁর থেকে হওয়া ইংরেজী ছবি ‘The Night of the Hunter’ দেখে বুঝেছি যুগপৎ পরিচালক অগ্রদূত এবং সেই ষাটের দশকে উত্তমকুমারের আদ্যোপান্ত ‘রোম্যান্টিক’ ভাবমূর্তির জাঁতাকলে পড়ে চিত্র্যনাট্যকার সমরেশ বসু কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন! মূল চরিত্র এক মানসিক বিকারগ্রস্ত দানবিক হত্যাকারী যে বিধবাদের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে তারপর তাদের হত্যা ক’রে তাদের সর্বস্ব হাতিয়ে আরেক শিকার খুঁজতে বেরোয়। তুচ্ছ অপরাধে সাময়িক জেল খাটার সময় সে আরেক বন্দীর কাছ থেকে জানতে পারে যে সেই বন্দী অভাবের তাড়নায় (কাহিনির প্রেক্ষাপট আমেরিকায় বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের ‘ডিপ্রেসন’-এর সময়) টাকা চুরি করে, তার জন্য মানুষ খুন করে, এখন প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত। মুক্তি পেয়ে আমাদের খলনায়ক এই বন্দীর বিধবা ও দুই সন্তানকে খুঁজে বার ক’রে চুরির লুকোনো টাকা উদ্ধারের চেষ্টায় মাতে। ধর্মপ্রচারক সেজে সে অসহায় বিধবাকে বিয়ে, এবং তারপর হত্যা করে। এবার তার লক্ষ্য দুই অনাথ সন্তানের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড় ছেলেটি, কারণ সে নিশ্চয়ই জানে তাঁর বাবা কোথায় টাকা লুকিয়েছিল।

ষাটের দশকে উত্তমকুমারকে খলনায়ক সাজাবার সাহস কারুরই ছিল না। মহানায়ক তাঁর অভিনয়জীবনের শেষের দিকে এসে তবেই ভবেশের মতো পূর্ণ খল চরিত্র ‘বাঘবন্দী খেলা’-তে (১৯৭৫) করবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭৭-এর ‘রাজবংশ’ ছবিতেও পিতা উত্তম অত্যাচারী লম্পট এবং তাঁর অবৈধ পুত্র উত্তম প্রতিহিংসাকামী। এর আগে ‘শেষ অঙ্ক’ (১৯৬৩) ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্রের অপরাধ খানিকটা স্খালন করার চেষ্টা হয়েছেঃ চরিত্রের বাবা, যৌতুকের লোভে এক মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন। ১৯৭০-এর ‘দুটি মন’-এ জমজ উত্তমঃ একজন ভালো, একজন খারাপ। ১৯৭৩-এর ‘কায়াহীনের কাহিনী’-তেও এক উত্তম চরিত্রহীন লম্পট, আরেকজন অপাপবিদ্ধ।


‘কুহক’ ছবির সুনন্দ উৎস-কাহিনির হ্যারি পাওয়েলের মতো সম্পূর্ণ দানবিক নয়, তাঁর চরিত্রে দ্বৈত আনা হয়েছে, টাকা-চোর গণেশের (তরুণকুমার) বোন (বিধবা স্ত্রী নয়) স্বর্ণলতার প্রতি সুনন্দর নিখাদ প্রেম আর অপরদিকে গণেশের চুরি করে লুকিয়ে রাখা টাকার প্রতি সুনন্দর প্রচণ্ড লোভের মধ্যে। মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে হত বিধবার বড় ছেলের দৃষ্টিকোণ থেকে, যে মানুষ-পিশাচ হ্যারির হাত থেকে নিজেকে ও তার ছোট বোনকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। ‘কুহক’-এর কাহিনি পুরোপুরি সুনন্দর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে, কারণ সুনন্দ যে আদতে উত্তমকুমারই! ফলে উৎস-কাহিনির রুদ্ধশ্বাস ‘সাসপেন্স’ অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে, আর সুনন্দর মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুটি সত্তার মধ্যে শেষ অবধি সামঞ্জস্যও আসেনি।



প্রাচী

প্রাচীতে প্রথম গেছি খুব ছোটবেলায়, দাদার সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত ‘The Gold Rush’ দেখতে। যতদূর মনে পড়ে, এটি ১৯২৫ সালের নির্বাক সংস্করণ ছিল না। দেখানো হয়েছিল ১৯৪২ সালের সবাক রূপ। মনে আছে এখনও ছবির প্রথমেই চার্লির পেছন পেছন বরফের মাঝে ঘুরছে একটি ভাল্লুক। আর চার্লির জুতো খাওয়ার দৃশ্য তো চোখে এখনও ভাসে – জুতোর পেরেকগুলি চার্লি হাড়/ কাঁটার মতো চুষছিলেন!

এর প্রায় ৫০ বছর পর, বর্তমান শতাব্দীতে আবার প্রাচীতে ঢুকি নীতীশ রায় পরিচালিত ‘জলে জঙ্গলে’ (২০১৮) দেখতে। তখন ফেসবুকে যা লিখেছিলাম, এখানে তুলে দিলামঃ

আহা, 'আমাজন অভিযানে'র জন্যে কোণঠাসা এই ১০০ ফুট (প্রথমে বিজ্ঞাপনে ছিল ৩০০ ফুট!)  কুমীরের ছবিটি! আজ প্রাচীতে দেখলাম। জীবনে দ্বিতীয় বার উক্ত প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ। অনেক, অনেকদিন আগে দাদার হাত ধ'রে এখানে এসেছিলাম চ্যাপলিনের Gold Rush দেখতে। সেটা ষাটের দশক। প্রায় ৫০ বছর পরে আবার এখানে! মূল আকর্ষণ কুমীর, আর একটি চরিত্রে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের অভিনয়।

পেশাদার অভিনেতাদের গুণে পার্শ্বচরিত্রগুলো বেশ প্রাণবন্তঃ মিঠুন চক্রবর্তী পাগল বৈজ্ঞানিক, আশিস বিদ্যার্থী ভিলেন শিকারী, ইত্যাদি, ইত্যাদি! জ্যাকি শ্রফ তো নিজেই নিজেকে বর্ণনা করেছেন 'আলু' ব'লে, যে রান্নাতেই তাঁকে ফেলা হোক, ভালো লাগবে!

কুমীরটির নাম মিঠুন রেখেছেন 'হ্যাপি'। খুব লক্ষ্মী কুমীর, মিঠুন যে সুর ক'রে তাকে ডাকেন, এক বেড়াতে আসা কলেজ ছাত্রীর বাঁশীতে সেই সুর শুনে সে ওই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে 'খেলতে' আসে! এসে ঢুঁ মেরে তাদের লঞ্চটি উড়িয়ে দেয়! আবার যে দুষ্টু লোকেরা তাকে ধ'রে নিয়ে যেতে এসছে, তাদের নৌকোগুলো ডুবিয়ে দেয়।

কিন্তু বিরতির প'রে আমার সেই ছাত্রটি কোথায় গেলো পরিচালক জানালেন না!

শ্রী

অধুনালুপ্ত শ্রী’তে দেখেছি, প্রথমে ১৯৫৯-র ‘দীপ জ্বেলে যাই’। ১৯৭০-এ ধর্মতলার এলিট সিনেমায় দাদার সঙ্গে দেখেছিলাম হিন্দি ছবি ‘খামোশী’ওয়াহিদা রহমানের অভিনয় খুব ভালো লেগেছিল, আর ছোটবেলার চেনা গান ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’র হিন্দি রূপান্তর শুনে মজা পেয়েছিলাম। ১৯৭৬-এর পর শ্যামবাজারে শ্রী প্রেক্ষাগৃহে বসে বুঝলাম যে তখন খুবই ভালো, সুস্বাদু ঘোল খেয়েছিলাম বটে, কিন্তু আসল দুধ ঝরে পড়েছিল সেই ১৯৫৯ সালে! আজও বলি, মহানায়িকা যদি আর একটি ছবিও না করতেন, তা’হ’লেও ‘দীপ জ্বেলে যাই’- এর নার্স রাধা মিত্র তাঁর স্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের মধ্যে নিশ্চিত করে দিয়েছিল তখনই! এমনকি ‘উত্তর ফাল্গুনী’র দেবযানী বা ‘সাত পাকে বাঁধা’র আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয়কেও আমি রাধা মিত্রের পরে রাখব! ও, বলতে তো হবেইঃ কি বাংলা  কি হিন্দি, দুই জায়গাতেই গানের সুরে পাগল করেছেন আমার সেই জীবনদেবতা! হিন্দি রূপান্তরটি তো আবার তাঁরই প্রযোজনা! একবার ‘খামোশী’তে আসল রাধা মিত্রকে রাখার কথা হেমন্ত ভাবতে পারতেন, তবে হিন্দি ছবির প্রযোজক হিসেবে বাণিজ্যিক চাপ ছিল, তাও বুঝি!

সম্ভবত ১৯৭৮-এ, শ্রী’তে দেখি আমার অভিজ্ঞতায় প্রথম বাংলা horror ছবি, নরেশ মিত্র পরিচালিত  ১৯৫০ সালের ‘কঙ্কাল’! গল্প বেশ ভালো, ধীরাজ ভট্টাচার্যের অভিনয়গুণে মূল খলনায়ক অভয় বেশ ভয়ঙ্কর। হতভাগিনী নায়িকা তরলার (মলয়া সরকার) প্রতি অভয়ের অদম্য লালসা দেখে গা শিউরে উঠেছিল। অভয়ের হাতে আকস্মিকভাবে তরলার অপঘাত মৃত্যু এবং তারপর প্রতি রাত ন’টায় আলমারীর দরজা আপনা থেকে খুলে গিয়ে তরলার চোখ-কপালে তোলা মৃতদেহের আবির্ভাব ছবির সবচেয়ে ভয়ের দৃশ্য! তবে এই দৃশ্যের সঙ্গে সেই ২১ বছর বয়েসের একটি সুখস্মৃতিও জড়িয়ে আছে! ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম আমার কলেজের এক সহপাঠিনীর সঙ্গে। তরলার ভৌতিক মৃতদেহ পর্দায় ফুটে উঠতেই তাঁর হাত চেপে ধরেছিলাম এবং তিনিও প্রতিদানে আমার হাত চেপে ধরেছিলেন! এর পর অভয় তরলার দেহ ভরবে একটা কাঠের সিন্দুকে, কিন্তু ভয়ার্ত হয়ে দেখবে, ডালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে তরলার একগাছি চুল! এসবের তুলনায় ছবির নামভূমিকায় কঙ্কালটি কিন্তু বেশ হাস্যকর, এবং ভাবাবরোহের উদ্রেককারী!

এর পরের পর্বে রূপবাণী-অরুণা-ভারতী।

 

 

 

 


ক্রিশ্চিয়ান হার্টশর্ন

 

দ্য হোয়াইট বেলুন: নৈর্ব্যক্তিক, প্রাপ্ত-বয়ষ্কদের পৃথিবীতে শৈশব


(অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী)



শৈশব ও বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা প্রাপ্তবয়ষ্ক শিল্পীদের সুযোগ করে দেয় পিছন ফিরে দেখার - একইসাথে শৈশবের অপাপবিদ্ধতা অথচ বড় হবার পথে প্রতিদিনের জীবনে স্বাধীনতা বা স্ব-শাসন ক্ষমতার অভাব কখনো কখনো তাই হয়ে ওঠে শিল্পের বিষয়বস্তÍ।

ইরাণী চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহির প্রথম কাহিনী চিত্র ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ (বাদকোনাকে সেফিড- ফার্সি)-এ পানাহি একটি ছোট্ট বালিকার গল্প চিত্রায়িত করেন যে ইরাণের রাজধানী তেহরান শহরে  একটি গোল্ডফিশ কেনার আশায় ঘুরছে এবং গোল্ডফিশ কেনার এই সংগ্রামে রাজধানীর পথে পথে বহু প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের সাথে তার দেখা হচ্ছে যারা হয় এই বাচ্চা মেয়েটিকে উপেক্ষা করছে অথবা তাকে সাহায্য করতে রাজি হচ্ছে না। পানাহির সিনেমায় এই ছোট্ট মেয়েটির একক দৃষ্টিকোণই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে একটি গোল্ডফিশ কেনার আশায় পার্থিব নানা ক্লেশে জড়িয়ে পড়ছে যেহেতু একটি শিশু ও তার চারপাশের ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরকার অসঙ্গতি এই ছবিটিতে বারবার পুনরুতপাদিত হয়।

ছবিটির প্রথম কয়েক মিনিটের ভেতরেই পানাহি তাঁর দর্শককে পারসিক বা ইরাণী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ‘নওরোজ‘ বা নববর্ষের আগের তেহরানের প্রাণশক্তি ভরপুর রাস্তার আবহের ভেতর সফলভাবে স্থাপণ করেন। সিনেমার শুরুতে তাই পক্ষকাল ব্যপী এই পারসিক নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানের আগে ঘর-দোর সাজাতে ব্যস্ত ইরাণী জনতাকে দেখা যায় শহরের বাজার এলাকায় এলোমেলো ভাবে ঘুরতে, বিক্রেতারা চেঁচিয়ে কথা বলছে এবং নববর্ষ বরণের আবেগে উদ্দীপ্ত মানুষেরা শহরের পথে আবহ সঙ্গীতের সাথে সাথে হেঁটে চলেছে যতক্ষণ না আর পানাহির ক্যামেরা একজন তরুণী মা (এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরেশতেহ সাদরে ওরাফেই) এবং তাঁর শিশুকন্যা রাজিয়েহ (এই চরিত্রে অভিনয় করেছে আইদা মোহাম্মদখানি)। রাজিয়েহ পাশের একটি দোকানে সাজানো একটি বড়সর আকারের গোল্ডফিশ মুগ্ধ হয়ে দেখে সেটি কিনতে চায়। আর তখনি এই সিনেমার কাহিনীতে মূল দ্বন্দ শুরু হয়। ছোট্ট রাজিয়েহ সুন্দর ও বড় আকারের গোল্ডফিশ কিনতে চাইলেও তার মা রাজি নন। যেহেতু সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারটির আর্থিক ক্ষমতা সীমিত এবং রাজিয়েহর মা মনে করেন যে ইতোমধ্যেই তাঁদের বাসায় যে ছোট্ট গোল্ডফিশটি রয়েছে, সেটাই যথেষ্ট। এই গোল্ডফিশ কেনা নিয়ে মা ও ছোট মেয়ের দ্বন্দ থেকেই পানাহি বয়ষ্কদের পৃথিবীতে শিশু ও বয়সীদের ভেতরকার ক্ষমতা-দ্বন্দ ফুটিয়ে তোলেন। বাচ্চাদের কাছে টাকা থাকে না এবং বাবা-মা‘র অনুমতি ছাড়া কোন কিছু কেনার স্বাধীণতাটুকুও তাদের থাকে না বলে ছোট মেয়েটি গোল্ডফিশ কেনার শখটুকু পূরণ করতে পারছে না। এছাড়াও পরিবারটিতে টাকা বিষয়টি বেশ মহার্ঘ বোঝাই যাচ্ছে, যা বয়ষ্কদের অন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হবে; নতুন গোল্ডফিশ কেনার জন্য রাজিয়েহ অনেক আব্দার করলেও শিশুটির এই সাধারণ আকাঙ্খাটুকু ছাপিয়ে বড়দের ভাবনা-চিন্তাই প্রবল হয়ে ওঠে।

চলচ্চিত্রে জাফর পানাহির হাতে-কলমে শিক্ষক আব্বাস কিয়ারোস্তমী যিনি আগে শিশুদের কেন্দ্র করে ‘হোয়্যার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হাউস-১৯৮৭’ অথবা Ôহোমওয়ার্ক-১৯৮৯‘-এর মত ছবি নির্মাণ করেছেন, সেই কিয়ারোস্তমীই কিন্তÍ জাফর পানাহির এই ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সিনেমাটি যতই অগ্রসর হয়, ততই কাহিনীর এক পর্যায়ে রাজিয়েহর হাত থেকে তার টাকা বাচ্চা মেয়েটির অনুমতি ছাড়াই এক সাপুড়ের নিয়ে নেওয়া, অথবা যখন সে গোল্ডফিশের ন্যায্য দাম কত হওয়া উচিত এটা নিয়ে দোকানীর সাথে দামাদামি করে অথবা টাকাটি যখন আবার তার হাত থেকে একটি বন্ধ দোকানের শাটারের নিচে পড়ে গিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন শিশু হিসেবে রাজিয়েহর অসহায়তা তার ছোট্ট শরীরটির চারপাশ ঘিরে দীর্ঘতর বয়ষ্কদের শরীরের মাধ্যমে পরিচালক আরো মূর্ত করে তোলেন যদিও বয়সী শরীরগুলোও ফ্রেমে পুরোপুরি দেখানো হয়না। রাজিয়েহর অসহায়ত্ব নিয়ে তখন দর্শকের ভেতর এক ধরণের খারাপ লাগার বোধ তৈরি হওয়া শুরু হয়। এমন সব সময়ে ছোট্ট রাজিয়েহ কান্না শুরু করলে তাকে ঘিরে থাকা বয়ষ্কদের নিরুত্তাপ মুখভাব যেন রাজিয়েহকে উল্টো তার মন খারাপের জন্য পরোক্ষভাবে খানিকটা শাস্তিই দেয়। এভাবে পানাহি একটি অসহায় শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে চারপাশের প্রাপ্তবয়ষ্কদের দেখান। পানাহির সিনেমার মূল শক্তি বরং প্রতিদিনকার পার্থিব নানা দ্বন্দ্ব উপস্থানের মাধ্যমে মূর্ত হয়। এই সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজিয়েহ এবং তার গোল্ডফিশ কেনার আকাঙ্খায় প্রাথমিক ভাবে বাধা দানকারী মেয়েটির বাবা-মা’র ভেতর তীব্র লড়াই এখানে দেখানো হয়নি। সিনেমায় প্রাপ্তবয়ষ্করা (রাজিয়েহর বাবা-মা) যখন নতুন গোল্ডফিশ কেনার জন্য রাজিয়েহর আকাঙ্ক্ষা গুরুত্বকে প্রশ্ন করে (সিনেমাটি দেখার সময় এর দর্শকরাও এমন প্রশ্ন মনে মনে করতেই পারেন), তখন পানাহি (চলচ্চিত্রটির নির্মাতা) এবং কিয়ারোস্তমী (ছবিটির চিত্রনাট্য রচয়িতা) বরং শিশুটির এই চাওয়াকে বৈধ প্রমাণ করতে চান যেহেতু বহু শিশুই তাদের শৈশবের অপূরিত নানা আকাঙ্খা নিয়ে পরবর্তী জীবনেও অনুতাপ বোধ করে। Ôসোশ্যাল-রিয়েলিস্ট’ বা সামাজিক-বাস্তববাদী এই সিনেমাটির পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিচিত বা নামী অভিনেতা-অভিনেত্রীর বদলে সাধারণ, অপেশাদারদের নেওয়া এবং কোন শ্যুটিং লোকেশন ব্যবহারের বদলে তেহরানের সড়ক বা বাজারের মত বাস্তব সব জায়গায় সিনেমাটি চিত্রায়িত করে পানাহি-কিয়ারোাস্তমী দেখান যে আধুনিক স্বল্প-বাজেট, স্বাধীণ চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশলগুলো ব্যবহার করেও কিভাবে চলচ্চিত্রের নাটকীয়তাকে সফল ভাবে ব্যবহার করা যায়।

পানাহির জন্য ‘দ্য হোয়াইট বেলুন- ১৯৯৫’ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা যেহেতু পরবর্তী জীবনে সমাজে কম গুরুত্বহ সব চরিত্রদের নিয়ে তিনি আরো সিনেমা বানাবেন। এসব চরিত্রদের ভেতর রয়েছে ‘অফসাইড-২০০৬’ বা থ্রি ফেসেস-২০১৮। প্রাপ্তবয়ষ্ক এবং পুরুষ নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীকে ছোট্ট মেয়ে রাজিয়েহর দৃষ্টিকোণ থেকে বলার গল্পের মাধ্যমে পানাহির মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী আমরা বুঝতে পারি। এ সিনেমায় শিশুদের ছোট ছোট চাওয়া যে বড়দের চাওয়া-পাওয়ার মতই গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই পানাহি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যদিও বাস্তব জীবনে শিশুরা তাদের চাওয়া বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব খুব কম ক্ষেত্রেই পায়। গোটা সিনেমায় চারপাশের সব বড়রাই যেমন ছোট্ট রাজিয়েহর নানা সাহায্যের আব্দার বারবারই তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেয়, পানাহি কিন্তÍ এই শিশু কন্যাটির জন্য দর্শক হৃদয়ে সহানুভূতি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। রাজিয়েহর চেয়ে বয়সে সামান্য বড় তার ভাই আলী (এই চরিত্রে অভিনয় করেছে মোহসেন কাফিলি) বাড়ির বড়দের কাছে রাজিয়েহর চেয়ে আদৌ বেশি পাত্তা পায় না। সিনেমার শুরুতে তার বাবা তাকে ধমকায় শ্যাম্পুর বদলে ভুলে সাবান কিনে আনায় এবং বাবা বেচারা আলীর দিকে সাবানটা ছুঁড়েই মারেন। পরে রাজিয়েহ যখন গোল্ডফিশ কিনতে বাজারে ছুটছে, সেখানে ভাই আলীর সাথে তার দেখা হলে আলীর মুখে একটি আঘাতের চিহ্ন থেকে রাজিয়ে কিকরে এমন জখম হলো জাতীয় প্রশ্ন করলেও আলী এর কারণ তার বোনকে বলে না। কিন্তÍ এই একটি দৃশ্যর মাধ্যমে আলী হয় বাড়িতে বড়দের হাতে বা রাস্তায় অন্য কোন প্রাপ্তবয়সীর হাতে পিটুনি খেয়েছে এবং বড়দের পৃথিবীতে শিশুদের অসহায়তা পুনরায় তুলে ধরেন। পুরো কাজটি করা হয় আলীর গালের জখম চিহ্নটি কয়েকটি মিডিয়াম ও ক্লোজ শটের মাধ্যমে- বোনকে আলীর আর কিছুই ব্যখ্যা করে বলতে হয় না।

বাবা-মা‘কে অনেক অনুরোধ করে শেষমেশ দুই ভাই-বোন রাজিয়েহ ও আলীর একটি নতুন গোল্ডফিশ কিনে আনার ‘তোমান’  বা মুদ্রাটি যখন বাজারে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি দোকানের ভূ-গর্ভস্থ কুঠুরিতে পড়ে যায়, তখন বারবার আশপাশের বড়দের কাছে সাহায্যের আবেদন করেও তারা ব্যর্থ হয়।

গোল্ডফিশ কেনায় ব্যগ্র ছোট বোন রাজিয়েহর হাত থেকে তোমানটা অমন দূরূহ একটি জায়গায় পড়ে যাবার পর সেটা তোলা বা ছোট বোনকে সাহায্য করায় উন্মুখ বড় ভাই আলী যখন আশপাশে ছুটে যায়, এত তরুণ ইরানী সৈন্যকে দেখা যায় রাজিয়েহর পাশে বসে খোশ-গল্প শুরু করতে, যদিও রাজিয়েহ কথা বলতে অনিচ্ছুক ছিল। এই সিকোয়েন্সটি দীর্ঘ সব টেকের মাধ্যমে পানাহি ফুটিয়ে তোলেন যাতে দর্শক এই পারষ্পরিক সংলাপ ভাল ভাবে বুঝতে পারে এবং সৈন্যটির সাথে রাজিয়েহর জন্মশহর সহ আরো নানা ব্যবধান একটি সহজাত, কথোপকথনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে। এছাড়াও এই কথােপকথনের সময় ক্যামেরা খানিকটা দূর থেকে সৈনিকের পরণের উর্দির কাঠখোট্টা রং এবং সৈনিকটির দীর্ঘদেহের পাশে রাজিয়েহর ছোট্ট শরীর ও তার পরণের ঝলমলেতর পোশাকের বৈপরীত্যও স্পষ্ট করেন। একটি ছোট্ট বালিকা এবং তার চারপাশের প্রাপ্তবয়ষ্কদের এই বৈপরীত্য দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট-২০১৭  বা এইটথ গ্রেড-২০১৮-এর মত আরো কিছু সিনেমায় দেখা যায় যেখানে ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’-এর মতই নিচু স্বরের নাটকীয়তা ভরা ছবিতে বয়ষ্কদের ভুবনে ছোট মেয়েদের নিজ কর্তৃত্ব লড়াইয়ের প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

ছবিটার শেষ হয় যখন একটি কিশোর বেলুন বিক্রেতা তার বেলুন বইবার কাঠির শেষ প্রান্তে চ্যুইংগাম লাগিয়ে রাজিয়েহকে বদ্ধ দোকানের শাটারের নিচে ভূ-গর্ভ থেকে তার হারিয়ে যাওয়া ‘তোমান’ বা মুদ্রাটি তুলে দেয়। রাজিয়েহ এবং আলী তখন গোল্ডফিশ কিনতে পারে এবং নতুন বছর উদযাপনের জন্য বাড়ি ফেরে। ছবিটির শেষটি একটি আবেগপূর্ণ ইঙ্গিতের মাধ্যমে শেষ হয় যে শিশুদের ভেতর রয়েছে পারষ্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ যা বয়স্কদের নৈর্ব্যক্তিকতার পৃথিবীতে তাদের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। দুই ভাই-বোন ও বেলুন বিক্রেতা কিশোরের ঐ হারিয়ে যাওয়া তোমান উদ্ধারের জন্য একসাথে কাজ করার দৃশ্যের মাধ্যমে খানিকটা দূরবর্র্তী প্রাপ্তবয়ষ্কদের সাথে শিশু-কিশোরদের পার্থক্যটি ভাল ভাবেই বুঝিয়েছেন পরিচালক। এছাড়াও সিনেমাটির শুরুতে বাড়ির বড় ও ছোটদের ভেতর দ্বন্দ খানিকটা কোমলভাবেই শেষ হয় যখন আলী ও রাজিয়েহ ভালয় ভালয় বাড়ি ফেরে এবং এতক্ষণ ধরে তারা দু’জন যা করেছে সেটা সিনেমায় প্রদর্শিত ভুবনে গুরুত্বপূর্ণ কি নয় সে বিষয়ে কোন সোচ্চার বক্তব্যও রাখা হয়নি। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে পানাহির এই সিনেমায় এটাই দেখানো হয়েছে যে প্রাপ্ত-বয়ষ্কদের পৃথিবীতে কোণঠাসা শিশুরা মূলত: ভাল স্বভাবের এবং ছবিটির দর্শকেরাও শিশু-কেন্দ্রিক নানা নতুন শিল্পের আধেয় ও আধার প্রত্যক্ষ করতে পারে যেখানে নববর্ষ আয়োজনের চিরাচরিত প্রাপ্ত-বয়ষ্কদের হাতে শাসিত পরিবেশেও শিশুরা ঠিকই তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণে সক্ষম হয়।

পুনশ্চ:

১৯৯৫ সালে কানে ‘Prix de la Camera d'Or’ পুরস্কার-জয়ী এই সিনেমাটি ইরাণ সরকার পুরষ্কৃত হবার আগেই সিনেমাটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যামে জমা পড়া সিনেমার তালিকা থেকে প্রত্যাহার করতে চাইছিলেন। তবে ফেস্টিভ্যাল কমিটি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন ও পরে ছবিটি পুরষ্কৃত হয়। গোটা ছবিটি ইরানের আদি অগ্নি-উপাসক সম্প্রদায় প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জী অনুসারে উদযাপিত নববর্ষকে ঘিরে আজো ইরানীদের গভীর আবেগ  পক্ষকাল ব্যপী এই নববর্ষ উদযাপনে তাদের জড়িয়ে থাকার বিষয়টি পারসিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রবল সমর্থক পানাহির সিনেমায় এতটা উঠে আসায় সেদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বিব্রত করেছিল। পানাহির সাথে এরপরেও নানা সময়ে সেদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের মতাদর্শিক লড়াই হয়েছে এবং গতবছর ইরাণের নারী আন্দোলনের সময় পানাহি আন্দোলনকারীদের সমর্থন দেবার জন্যও কর্তৃপক্ষের হাতে অযথা হয়রানির স্বীকার হন। ইরাণে পক্ষকাল ব্যপী ‘নওরোজ’ উদযাপনের প্রথম দিনে প্রতিটি ইরাণী পরিবারের টেবিলে আজো ‘হপ্ত সীন‘ বা ‘সাত ধরণের খাবার’ সাজানো থাকে। ছোট্ট রাজিয়েহ এই ‘হপ্ত সীন’ সাজানো টেবিলেই একটি সুন্দর ও নতুন গোল্ডফিশও বাড়তি চেয়েছিল। প্রকৃতির বার্ষিক পুনরুজ্জীবনের এই পনেরো দিন ব্যপী উদযাপনে ইরানের রাস্তায় রাস্তায় মুখে কালো রং মাখা ও লাল পোশাকের ‘হাজী পিরুজ’ যেন পশ্চিমা দুনিয়ার সান্টা ক্লাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ইরাণী বা পারসিক পুরাণের বিনা দোষে নিহত, নিষ্পাপ রাজপুত্র তথা উদ্ভিদ দেবতা সীয়াউস মৃত্যুর পরের কালো পৃথিবীতে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে সেই কালো রংয়ে মুখ কালো করতে হয় ‘হাজী পিরুজ’ সাজিয়েদের। ‘হাজী‘ শব্দটি বর্তমানে ভারত উপমহাদেশে বিশেষত: হজ বা তীর্থযাত্রা করে আসা ব্যক্তি বোঝালেও ইরাণে ‘হাজী‘ শব্দটির অর্থ বৃদ্ধ বা বয়সে বড়, প্রাজ্ঞ ও প্রবীণ ব্যক্তি। ‘পিরুজ’ শব্দটির অর্থ ‘বিজয়ী’ যদিও আরবরা ইরাণ দখল করার পর ‘পিরুজ’ শব্দটি খানিকটা বদলে গেছে। ‘ঈদ- ই নওরোজ’ বা ইরাণী নববর্ষ উদযাপনের সময় এই ‘হাজী পিরুজে’র ভূমিকায় অভিনয়কারীরা তাম্বুরিন হাতে রাস্তায় রাস্তায় নাচ-গান ও সবার সাথে হাস্য-পরিহাস করে। 

 

 


শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী ১৯৪৫



       

(৫)

১৯৭০ ও মুক্তিযুদ্ধে নেতাজির অবদান: 

১৯৪৫ সাল তথা নেতাজির তথাকথিত মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে আমরা বিগত ধারাবাহিকে সময়কাল অনুযায়ী আলোচনা করেছি এবং এই আলোচনা থেকে মোটামুটি একটি বিষয়ে পাঠক মহোদয় নিশ্চিত হয়েছেন তাঁর কার্য পটভূমির বিস্তারতা নিয়ে। শুধু ভারতবর্ষ নয় বরং সমগ্র এশিয়া ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাঁর কার্যকলাপ আমরা ইতিমধ্যে তথ্য অনুযায়ী অনুসন্ধান করার প্রচেষ্টা করেছি। ৭০ এর দশকে কিছু ঘটনা নেতাজির অস্তিত্ব তথা উপ মহাদেশীয় রাজনীতিতে তাঁর সরাসরি প্রভাবকে আরও সুদৃঢ় করে। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা দেখতে পাই  ৭০এর দশক, মুক্তির দশক শ্লোগান - ভারতবর্ষে নকশাল আন্দোলন, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সব মিলিয়ে উপমহাদেশের সরগরম পরিস্থিতি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে নেতাজির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি যেহেতু এই যুদ্ধ ৬০এর দশক থেকে প্রবল আকার ধারণ করেছিল তাই বিগত ধারাবাহিকে আমরা মূলত এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছি। এই ধারাবাহিকে আমরা ৭০ এবং তার পরবর্তী ভিয়েতনাম যোগ নিয়ে তথ্য সমুহ আলোচনা করবো। বলরাজ ট্রিখা দাবী করেছিলেন ১৯৭১ সালে সাইগণ এয়ারপোর্টে তিনি নেতাজীকে দেখেন মিলিটারির ড্রেসে। এই দাবি তাঁর হয়ে সিঙ্গাপুরে ভারত সরকারের হাই কমিশনার প্রেম ভাটিয়া খোসলা কমিশনকে জানিয়েছিল, কিন্তু বলাই বাহুল্য খোসলা বাকিদের মত এই রিপোর্টকে ও নস্যাৎ করে ফেলেন। তার পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনামের সঙ্গে নেতাজির সরাসরি অর্থাৎ শারীরিক উপস্থিতির প্রমাণ না পাওয়া গেলেও (আমার সংক্ষিপ্ত গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়নি তবে প্রমাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ) বিভিন্ন মাধ্যমে ভিয়েতনামের যুদ্ধ পরিস্থিতির তদারকির কিছু প্রমাণ বিদ্যমান।

৭০এর দশকে সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্য বিষয় এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতাজির সরাসরি যোগাযোগ। কিছু বছর আগে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাজির ভবানীপুরের বাড়িতে এসে প্রেস কনফারেন্সে বলেন,  নেতাজি না থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেতোনা এবং তাঁর এই বক্তব্য নেতাজি অনুগামীদের মধ্যে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং পুরনো কিছু বিষয়ও অনুসন্ধানে উঠে আসে। চমকপ্রদ ভাবে দেখা যায় শেখ মুজিবর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিরাট এক জনসমাবেশে বলেন "বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে এটা প্রমাণ করে যে নেতাজি বেচে আছেন", কিন্তু পরবর্তী কালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলেননি। সাংবাদিকরা পরে তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে নেতাজির আদর্শ বেচে আছে এই কথা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় যেমন তাদের গেরিলা অনুশীলন অথবা অস্ত্র সরবরাহ অথবা পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষন সংক্রান্ত নথি যেখানে নেতাজি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যেত বলে গবেষকরা মনে করেন। একটি ঘটনা উল্লেখ করলে ব্যাপারটা বুঝতে আরও সুবিধা হবে যে নেতাজি কিভাবে প্রত্যক্ষ ভাবে সর্বত সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের কাহিনী বা ভারতীয় ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সরাসরি যোগদানের কথা আমরা অনেকেই জানি বা এগুলো ইতিহাস ঘাটলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু যেটা জানিনা বা আজও সেইভাবে উদঘাটন করা যায়নি তা হলো চট্টগাম এর পার্বত্য অঞ্চলে আসা কিছু তিব্বতীয় যুবকের বীরগাঁথা। ঘন জঙ্গল ও পর্বতে ঘেরা চট্টগাম অঞ্চলে পাকিস্তানি এস এস জি ব্যাটিলিয়নের কাছে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধা দের, একদিকে তারা সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করেছে অপর দিকে বিশাল অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত এই ব্যাটিলিয়ন সর্বদা স্নাইপার তাক করে বসে আছে, একটা পাতা পড়ার শব্দ পেলেও অতর্কিতে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। এমন অবস্থায় হঠাৎ করে উদয় হলো একদল তিব্বতীয় যুবক একে ৪৭ হাতে এবং তারা কোথা থেকে আসলো কিভাবে আসলো তা মুক্তিযোদ্ধাদের অজানা। হঠাৎ শীতের রাতে বুলগেরিয়ান একে ৪৭ এবং ছোরা হাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো এই গেরিলা বাহিনী, তারা কিছু বোঝার আগেই নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো পাকিস্তানি ভয়ানক ব্যটিলিয়নরা এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের কবলে চলে এলো। ঠিক যেভাবে এই গেরিলা বাহিনী এসছিল ঠিক তেমনই কেউ কিছু বোঝার আগেই উধাও হয়ে গেলো তারা। পরবর্তী কালে তাদের ফ্যান্টম অফ ৭১ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু এবার বিষয় হলো এরা কিভাবে এলো বা কেই বা পাঠালো এদের। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, ১৯৬০ সালে তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন খুব খারাপ তখন তাদের প্রধান ধর্মগুরু দলাই লামা ভারতে চলে আসেন, এ কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি কিভাবে নেতাজির সাহায্য নিয়ে দলাই লামা ভারতে আসেন। দলাই লামার সঙ্গে বেশ কিছু তিব্বতীয় যুবক ও পরবর্তী কালে নেতাজির ব্যাবস্থাপনায় ভারতে আসেন এবং বলাইবাহুল্য জেনারেল শিবা ওরফে আমাদের নেতাজির প্রশিক্ষনে তারা প্রত্যেকেই গেরিলা বিশারদ ছিলেন। শোনা যায় গোপনে নেতাজি বিজু পট্টনায়ককে নির্দেশ দেন এদের গেরিলা অনুশীলনে ভারতের সৈনিকদের সাহায্য করতে এবং পরবর্তী কালে ভোলানাথ মল্লিকের তত্ত্বাবধানে এই যুবকরা গেরিলা ফোর্সের কান্ডারী হয়ে ওঠেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন মুক্তিযুদ্ধে নেতাজির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এবং কেনো বঙ্গবন্ধু বিশাল সমাবেশে সে কথা স্বীকার করেছিলেন। এটা শুধু একটা ঘটনার উল্লেখ করলাম যার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে এছাড়াও বহু ঘটনা মিসিং লিংক হিসেবে ছড়িয়ে আছে এবং বেশিরভাগই বাংলাদেশ ও ভারত সরকার যৌথ ভাবে নষ্ট করে দিয়েছে কারণ বিষয়টা হলো নেতাজি, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সবথেকে রহস্যাবৃত ঘটনা।

আর একটি চমকপ্রদ তথ্য সামনে আসে এবং প্রিন্ট মিডিয়া তে তা প্রকাশিত ও হয়, নেতাজীকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশে দক্ষিণ চীন সাগরে দেখা যায় একটি যুদ্ধ জাহাজে। এটি প্রকাশিত হয় তৎকালীন যুগবানী পত্রিকায়। চন্দ্রচূড় ঘোষ কোনানড্রামে উল্লেখ করেছেন তার কাছে প্রমাণ আছে যে নেতাজির অনুগামীদের দ্বারাই মুজিবর রহমান দীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তি পান। সুতরাং বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে আমরা এটুকু অবগত হয়েছি শেখ হাসিনা বা তার পিতার করা মন্তব্য কতটা সত্যি এবং নেতাজি কিভাবে বাংলাদেশ সহ প্যান এশিয়ার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন আজীবন, শুধু কিছু সিংহাসন লোভী রাজনীতিবিদদের জন্য এই মহান দেশপ্রানকে আমরা হারিয়েছি ভারতের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে, হয়তো তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে আজ আমাদের আর্থ সামাজিক চিত্র সম্পূর্ণ অন্যরকম  হতো।

(ক্রমশ)