সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী
১৯৪৫
(৫)
১৯৭০ ও মুক্তিযুদ্ধে নেতাজির অবদান:
১৯৪৫ সাল তথা নেতাজির তথাকথিত মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে আমরা বিগত ধারাবাহিকে সময়কাল অনুযায়ী আলোচনা করেছি এবং এই আলোচনা থেকে মোটামুটি একটি বিষয়ে পাঠক মহোদয় নিশ্চিত হয়েছেন তাঁর কার্য পটভূমির বিস্তারতা নিয়ে। শুধু ভারতবর্ষ নয় বরং সমগ্র এশিয়া ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাঁর কার্যকলাপ আমরা ইতিমধ্যে তথ্য অনুযায়ী অনুসন্ধান করার প্রচেষ্টা করেছি। ৭০ এর দশকে কিছু ঘটনা নেতাজির অস্তিত্ব তথা উপ মহাদেশীয় রাজনীতিতে তাঁর সরাসরি প্রভাবকে আরও সুদৃঢ় করে। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা দেখতে পাই ৭০এর দশক, মুক্তির দশক শ্লোগান - ভারতবর্ষে নকশাল আন্দোলন, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সব মিলিয়ে উপমহাদেশের সরগরম পরিস্থিতি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে নেতাজির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি যেহেতু এই যুদ্ধ ৬০এর দশক থেকে প্রবল আকার ধারণ করেছিল তাই বিগত ধারাবাহিকে আমরা মূলত এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছি। এই ধারাবাহিকে আমরা ৭০ এবং তার পরবর্তী ভিয়েতনাম যোগ নিয়ে তথ্য সমুহ আলোচনা করবো। বলরাজ ট্রিখা দাবী করেছিলেন ১৯৭১ সালে সাইগণ এয়ারপোর্টে তিনি নেতাজীকে দেখেন মিলিটারির ড্রেসে। এই দাবি তাঁর হয়ে সিঙ্গাপুরে ভারত সরকারের হাই কমিশনার প্রেম ভাটিয়া খোসলা কমিশনকে জানিয়েছিল, কিন্তু বলাই বাহুল্য খোসলা বাকিদের মত এই রিপোর্টকে ও নস্যাৎ করে ফেলেন। তার পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনামের সঙ্গে নেতাজির সরাসরি অর্থাৎ শারীরিক উপস্থিতির প্রমাণ না পাওয়া গেলেও (আমার সংক্ষিপ্ত গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়নি তবে প্রমাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ) বিভিন্ন মাধ্যমে ভিয়েতনামের যুদ্ধ পরিস্থিতির তদারকির কিছু প্রমাণ বিদ্যমান।
৭০এর দশকে সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্য বিষয় এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতাজির সরাসরি যোগাযোগ। কিছু বছর আগে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাজির ভবানীপুরের বাড়িতে এসে প্রেস কনফারেন্সে বলেন, নেতাজি না থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেতোনা এবং তাঁর এই বক্তব্য নেতাজি অনুগামীদের মধ্যে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং পুরনো কিছু বিষয়ও অনুসন্ধানে উঠে আসে। চমকপ্রদ ভাবে দেখা যায় শেখ মুজিবর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিরাট এক জনসমাবেশে বলেন "বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে এটা প্রমাণ করে যে নেতাজি বেচে আছেন", কিন্তু পরবর্তী কালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলেননি। সাংবাদিকরা পরে তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে নেতাজির আদর্শ বেচে আছে এই কথা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় যেমন তাদের গেরিলা অনুশীলন অথবা অস্ত্র সরবরাহ অথবা পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষন সংক্রান্ত নথি যেখানে নেতাজি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যেত বলে গবেষকরা মনে করেন। একটি ঘটনা উল্লেখ করলে ব্যাপারটা বুঝতে আরও সুবিধা হবে যে নেতাজি কিভাবে প্রত্যক্ষ ভাবে সর্বত সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের কাহিনী বা ভারতীয় ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সরাসরি যোগদানের কথা আমরা অনেকেই জানি বা এগুলো ইতিহাস ঘাটলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু যেটা জানিনা বা আজও সেইভাবে উদঘাটন করা যায়নি তা হলো চট্টগাম এর পার্বত্য অঞ্চলে আসা কিছু তিব্বতীয় যুবকের বীরগাঁথা। ঘন জঙ্গল ও পর্বতে ঘেরা চট্টগাম অঞ্চলে পাকিস্তানি এস এস জি ব্যাটিলিয়নের কাছে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধা দের, একদিকে তারা সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করেছে অপর দিকে বিশাল অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত এই ব্যাটিলিয়ন সর্বদা স্নাইপার তাক করে বসে আছে, একটা পাতা পড়ার শব্দ পেলেও অতর্কিতে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। এমন অবস্থায় হঠাৎ করে উদয় হলো একদল তিব্বতীয় যুবক একে ৪৭ হাতে এবং তারা কোথা থেকে আসলো কিভাবে আসলো তা মুক্তিযোদ্ধাদের অজানা। হঠাৎ শীতের রাতে বুলগেরিয়ান একে ৪৭ এবং ছোরা হাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো এই গেরিলা বাহিনী, তারা কিছু বোঝার আগেই নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো পাকিস্তানি ভয়ানক ব্যটিলিয়নরা এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের কবলে চলে এলো। ঠিক যেভাবে এই গেরিলা বাহিনী এসছিল ঠিক তেমনই কেউ কিছু বোঝার আগেই উধাও হয়ে গেলো তারা। পরবর্তী কালে তাদের ফ্যান্টম অফ ৭১ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু এবার বিষয় হলো এরা কিভাবে এলো বা কেই বা পাঠালো এদের। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, ১৯৬০ সালে তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন খুব খারাপ তখন তাদের প্রধান ধর্মগুরু দলাই লামা ভারতে চলে আসেন, এ কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি কিভাবে নেতাজির সাহায্য নিয়ে দলাই লামা ভারতে আসেন। দলাই লামার সঙ্গে বেশ কিছু তিব্বতীয় যুবক ও পরবর্তী কালে নেতাজির ব্যাবস্থাপনায় ভারতে আসেন এবং বলাইবাহুল্য জেনারেল শিবা ওরফে আমাদের নেতাজির প্রশিক্ষনে তারা প্রত্যেকেই গেরিলা বিশারদ ছিলেন। শোনা যায় গোপনে নেতাজি বিজু পট্টনায়ককে নির্দেশ দেন এদের গেরিলা অনুশীলনে ভারতের সৈনিকদের সাহায্য করতে এবং পরবর্তী কালে ভোলানাথ মল্লিকের তত্ত্বাবধানে এই যুবকরা গেরিলা ফোর্সের কান্ডারী হয়ে ওঠেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন মুক্তিযুদ্ধে নেতাজির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এবং কেনো বঙ্গবন্ধু বিশাল সমাবেশে সে কথা স্বীকার করেছিলেন। এটা শুধু একটা ঘটনার উল্লেখ করলাম যার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে এছাড়াও বহু ঘটনা মিসিং লিংক হিসেবে ছড়িয়ে আছে এবং বেশিরভাগই বাংলাদেশ ও ভারত সরকার যৌথ ভাবে নষ্ট করে দিয়েছে কারণ বিষয়টা হলো নেতাজি, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সবথেকে রহস্যাবৃত ঘটনা।
আর একটি চমকপ্রদ তথ্য সামনে আসে এবং প্রিন্ট মিডিয়া তে তা প্রকাশিত ও হয়, নেতাজীকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশে দক্ষিণ চীন সাগরে দেখা যায় একটি যুদ্ধ জাহাজে। এটি প্রকাশিত হয় তৎকালীন যুগবানী পত্রিকায়। চন্দ্রচূড় ঘোষ কোনানড্রামে উল্লেখ করেছেন তার কাছে প্রমাণ আছে যে নেতাজির অনুগামীদের দ্বারাই মুজিবর রহমান দীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তি পান। সুতরাং বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে আমরা এটুকু অবগত হয়েছি শেখ হাসিনা বা তার পিতার করা মন্তব্য কতটা সত্যি এবং নেতাজি কিভাবে বাংলাদেশ সহ প্যান এশিয়ার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন আজীবন, শুধু কিছু সিংহাসন লোভী রাজনীতিবিদদের জন্য এই মহান দেশপ্রানকে আমরা হারিয়েছি ভারতের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে, হয়তো তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে আজ আমাদের আর্থ সামাজিক চিত্র সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো।(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন