সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

মধুবন চক্রবর্তী

 

ভানুসিংহ, কবি টমাস চ্যাটারটন ও বৈষ্ণব দর্শন




খুব ছেলেবেলায় ভানু নামটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাংলা ছায়াছবির প্রখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখার পর। 'মাসিমা মালপো খামু...' এই সংলাপ বোধহয় আজও ইউনিভার্সাল। 'সাড়ে চুয়াত্তর' সিনেমাটি বাবা মাকে নিয়ে একসঙ্গে দেখার অভিজ্ঞতা বিরল। সেদিন বাবা বলেছিলেন, 'তোমাকে একজনের অভিনয় দেখাব, মন দিয়ে তাঁর অভিনয় ফলো করবে। তিনি হলেন ভানু বন্দোপাধ্যায়।' যে সময়টায় সুচিত্রা-উত্তমকে দেখার জন্য মানুষ পাগল, তখন বাবা বলেছিলেন, আসল নায়ক এখানে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

আসলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে হঠাৎ করে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা কেন বলছি, সেটা নিয়ে আপনাদের মনে খটকা লাগতে পারে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে দুই প্রজন্মের দুই শিল্পী। দু'জনেই ভানু নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম ভানু না।

১৯২০ সালের ২৬শে আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ মৈসুণ্ডি গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু। মা-বাবার কাছে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন আদরের ভানু। ভানু নামের আড়ালে তাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে যিনি শুধু কৌতুক অভিনেতা হিসেবেই নয়, কিংবদন্তী অভিনেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।

আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভানুসিংহ ছদ্মনামে মাত্র পনেরো বছর বয়সেই লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক গীতি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকে জয়দেব বিদ্যাপতি পদাবলী নান্দনিক চেতনায় মগ্ন ছিলেন। 'গীতগোবিন্দম' তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে বারবার আবৃত্তি করা সত্ত্বেও, তা অণুলিপি করেছিলেন। কবি বলেছেন, 'আমি তখন সংস্কৃতের কিছুই জানিতাম না। বাংলা ভালো জানিতাম বলিয়া অনেকগুলি শব্দের অর্থ বুঝতে পারতাম, সেই গীতগোবিন্দখানা কতবার যে পড়িয়াছি, তাহা বলিতে পারি না, জয়দেব যাহা বলিতে চাহিয়াছেন, তা তো কিছুই বুঝি নাই। কিন্তু ছন্দে ও কথায় মিলিয়া আমার মনের মধ্যে যে জিনিসটি গাঁথা হইতেছিল, তাহা আমার পক্ষে সামান্য নয়।'

রবীন্দ্রনাথ আরও বলছেন, জয়দেব সম্পূর্ণ তো বুঝি নাই, অসম্পূর্ণ বোঝা বললে, যাহা বুঝায় তাহাও নহে, তবে সৌন্দর্যে আমার মন এমন ভরিয়ে উঠিয়াছিল যে, আগাগোড়া সমস্ত গীতগোবিন্দ একখানি খাতায় নকল করিয়া লইয়াছিলাম।

বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি। বৈষ্ণব কাব্যরস তরুণ কবির ভালবাসায় আত্মমুক্তি ঘটেছিল। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জগবন্ধু ভদ্র মহাজন' পদাবলী সংকলন করেন। সেগুলি দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সংগ্রহ করতেন। তার একমাত্র পাঠক ছিলেন বারো বছরের রবীন্দ্রনাথ। পদাবলীর কাব্য ছন্দ ভাব ও রসের প্রভাব পড়েছিল কবি মনের উপরে। সে কথা কবি নিজে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, 'what give me bolness when when I was young was mine early acquaintance with old vaishnava poems of Bengal, full of the freedom of metre and courage of expression. I think I was only twelve when these poems began to be reprinted.  I surreptitiously got hold of copies from the desk of my elders. I must also admit that the greater part of these lyrics was erotic and not quite suited to a boy just about to reach his teens. But my imagination was fully occupied with the beauty of their forms and the music of their words and their breath heavily Laden with voluptuousness, passed over my mind without distracting it...' বৈষ্ণব পদাবলীর দিব্যিয় সুর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কিশোরকালেই স্থায়ীত্ব লাভ করে।

ভানুসিংহর পদাবলী পর্যায়ে অনুকরণ অনুসরণের বৃত্তে ছিল। কিন্তু গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি, পূর্বে রবীন্দ্র সৃষ্টিতে আত্তীকরণের পর্যায় এক শিল্পের নির্মাণ হয়। ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা মাত্র কুড়িটি হলেও সংগীতের ইতিহাসে এবং রবীন্দ্রকাব্যে একটা অন্যতম দিক চিহ্ন, তাই ভানুসিংহের পদাবলী বৈষ্ণব পদাবলী ভাষার থেকে খানিকটা আলাদা হলেও পদাবলী সাহিত্যের মতো উজ্জ্বল। গবেষকরা মনে করেন ভানুসিংহের পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিদের অনুসরণ করেননি বরং যথার্থ অনুসরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য পদাবলী শুধু সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষভাবে সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। স্বামী প্রজ্ঞানন্দের এ বিষয়ে মূল্যায়ন, রসের বিচারে ভানুসিংহের পদাবলীকে বৈষ্ণব কাব্যধারার সমান মূল্য দেওয়া চলে -- ভাবের দিক থেকে যদিও তা একটু হালকা বলতেই হবে। তবুও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, স্বাতন্ত্র্যের দাবি নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথের পদাবলীকাব্য সৃষ্টি পদাবলী সাহিত্যের এক পাশে স্থান করে নেবে।

বাল্যকাল থেকেই কবির মনে বৈষ্ণব চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল। ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে আমরা দেখি গায়ক শ্রীকণ্ঠ সিংহের একনিষ্ঠ শিষ্য বালক রবীন্দ্রনাথকে একাধিকবার বহুজনকে গান গেয়ে শোনাতে হচ্ছে "ম্যায় ছোরকি ব্রাজকি বাঁশরী"। এই সঙ্গীত শুধুমাত্র নিছক কিশোর কবি কন্ঠের মহিমাই ছিল না, এর পশ্চাতে কাজ করতো কবি মনের এক দিব্যিয় ভাব। শ্রীকণ্ঠ সিংহ সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন বলেছেন,  "এই ভক্ত নিখুঁত মানুষটি রবীন্দ্রনাথের চিত্তে যতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন ততখানি আর কেউ করেননি, এমনকি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও নয়...'

অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে তিনি জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক জনৈক বালক কবির কথা। যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। আর এই জায়গাতেই ভানুসিংহের সঙ্গে কবি চ্যাটরটনের অসম্ভব মিল। কে এই টমাস চ্যাটারটন? কিশোর প্রতিভাবান এই কবি খুব কম বয়সে মধ্যযুগের শিল্প-সাহিত্য সৌন্দর্যতত্ত্ব চিত্র গির্জার নানারকম ক্যালিগ্রাফি দ্বারা আকৃষ্ট হন। শিল্পকলার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য নান্দনিকতা তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। সে মধ্যযুগের শিল্প স্বপ্নে বিভোর হয়ে গির্জার স্বল্পালোকিত কক্ষগুলোতে বিচরণ করতেন। এতটাই আত্মমগ্ন হয়ে যেতেন যে প্রভাবিত হয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন। মধ্যযুগীয় প্রীতি এবং ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কবিতাগুলো তিনি কোনও মধ্যযুগীয় কবির নামে প্রকাশ করবেন। তাই 'রাউলে' ছদ্মনামে তিনি কবিতাগুলি লেখা শুরু করেন। পরে জানা যায়, রাউলে নামের কোনও কবি আসলে ছিলই না।

কাল্পনিক কবির ছদ্মনামে চ্যাটারটন বিশ্ববন্দিত কবি হয়ে উঠেছিলেন। মধ্যযুগীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর হস্তাক্ষর ভাষা ছন্দ ও পরিবেশ এবং সে সময়ে আবহকে এমন নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর কবিতায়, যা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল এবং বিস্মিত করেছিল।

ভাষার অপরিচয় দুরূহতা, তার কবিত্বকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ভাষার গঠনশৈলী তাঁর কবিতাকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করত, যদিও মাত্র আঠেরো বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন এই কবি।

আত্মহত্যার ঘটনা বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই জায়গাতেই মিল কবি চ্যাটারটনের। দু'জনেই মধ্যযুগীয় কবিদের সৃষ্টি দ্বারা আকৃষ্ট। নিজেও মাত্র পনেরো বছর বয়সে ভানুসিংহ ছদ্মনামে গীতিকবিতাগুলি রচনা করেছিলেন বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। সেই সঙ্গে কবি চ্যাটারটন তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে।

পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন উদ্ধব দাসের 'আষাঢ় গত পুণ্য মাহ শাভান সুখদ যমুনাক তীর...' এবং গোবিন্দ দাসের 'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে...'

কবি জয়দেবের 'নাম সমেত কৃত সংকেত বাদয়তে মৃদু বেনুনম' ভানুসিংহের পদাবলী 'সতিমির রজনী সচকিত সজনী, শুনি নিকুঞ্জ অরণ্য।' কলয়তি মলয়ে, সুবিজন নিলয়, বালা বিরহ বিষণ্ণ...'

গোবিন্দদাস যেখানে উচ্ছ্বসিত 'শারদ চন্দ পবন মন্দ, বিপিনে ভরলো কুসুম গন্ধ, ফুল মল্লিকা মালতী যূথী মধুকর ভোরনি...'

বিশ্বকবি এখানে বাণীরূপ দিলেন, 'গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে মৃদুল মধুর বংশী বাজে সাজে বিসরি ত্রাস লোকলাজে সজনি আও আও লো। 'ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং  সংগীতের অন্যতম দিগচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে রস নির্মাণেও এক নতুন দিক। যেখানে বৈষ্ণবীর রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের।

‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে পদাবলী সৃষ্টির পেছনে কবিগুরু তাঁর মানসিক প্রেরণার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি  বলছেন, 'গাছের বীজের মধ্যে যে অঙ্কুর প্রচ্ছন্ন ও মাটির নিচে যে রহস্য অনাবিষ্কৃত, তাহার প্রতি যেমন একটি কৌতূহলবোধ করিতাম, প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা সম্বন্ধেও আমার ঠিক সেই ভাবটাও ছিল, আবেদন করিতে করিতে একটি অপরিচিত ভাণ্ডার হইতে একটি আধটি কাব্যরত্ন চোখে পড়িতে থাকিবে। এই আশাতেই আমাকে উৎসাহিত করিয়া তুলিয়াছিল। এই রহস্যের মধ্যে তলার দুর্গ অন্ধকার হইতে তুলিয়া আনিবার চেষ্টায় যখন আছি তখন নিজেকে একবার এই রহস্য আবরণে আবৃত করিয়া প্রকাশ করিবার একটা ইচ্ছে আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল...'

ভানুসিংহ একজন প্রকৃত পক্ষে গীতিকবি তাই ভানুসিংহের পদাবলী গীতিকবিতায় ভাস্বর যেখানে শুধুমাত্র কীর্তনের সুর প্রাধান্য পায় না। ভানুসিংহের পদাবলীকে তথাকথিত রাধা-কৃষ্ণ লীলার মাধুর্য ধরা পড়ে না। এখানে ভক্তিরস ভাগবত প্রেম ছাপিয়ে লৌকিক প্রেমে ধরা দেয়। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে। ভানুসিংহ পদাবলীকে তাই বলা যেতেই পারে আন্তর্জাতিক মানের বৈষ্ণব সাহিত্য।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন