সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল’ : ৩য় কিস্তি

 

শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা

 

ইন্দিরা

প্রথম যে বাংলা ছবি দেখার কথা মনে আছে, সেটি হ’লো ছবি বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ ও সুলতা চৌধুরী অভিনীত ‘শেষ পর্যন্ত’। প্রথম দেখা ভবানীপুরের ইন্দিরায়, তারিখ ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৬০, এবং সেটি আমার ও পরিবারের সকলের এত ভালো লেগেছিল যে জীবনে সেই প্রথম কোন ছবি দু’বার দেখি।  দ্বিতীয়বার গড়িয়াহাট থেকে বালিগঞ্জের দিকে বাঁক নিলে আলেয়া বলে যে হলটি পড়ে, সেখানে। তাছাড়া, বিশ্বজিতের ভক্ত হয়ে পড়ি, আর সর্বক্ষণ ‘এই মেঘলা দিনে একলা’ গুনগুন করার পুরস্কার হিসেবে ৭৮ আর পি এমের রেকর্ডটিও আমাকে কিনে দেওয়া হয়, দম দেওয়া গ্রামোফোনে বাজিয়ে শোনবার জন্যে৩১শে জানুয়ারী ১৯৬১ তারিখে মা লিখছেন যে রাত্রে “পানু আমি’ বলে বিশ্বজিতের অভিনীত চরিত্রটির নকল করছি , গানও গাইছি, মাথার চুল হাত দিয়ে সরিয়ে, ঠিক যেভাবে বিশ্বজিৎ করেছিলেন! আমার বয়েস তখন ৩ থকে ৪-এর মধ্যে। সুরকার ও গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! ছবির আরেকটি গান ঐ রেকর্ডের উল্টোদিকে ছিল, যার দৃশ্যায়ন এখনো মনে আছে – সাঁতারের পোশাক পরে একদল তরুণ সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে হাত তালি দিচ্ছেন আর গাইছেন ‘আমরা বাঁধন ছেঁড়ার জয়গানে’। শিল্পী ছিলেন হেমন্তর ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্যরা।

১৯৬৫ সালে বাবা সৈন্যদল থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পর আমরা সৈনিকদের আবাসন ছেড়ে মে মাসে উঠে আসি গোল পার্কের কাছে পূর্ণদাস রোডে ভাড়াবাড়িতে। এখান থেকেই গিয়েছিলাম ১৯৬৫- র মে মাসে ইন্দিরায়  আমার জীবনে প্রথম সত্যজিৎ রায় পরিচালিত দুটি ছবি দেখতেঃ কাপুরুষ ও মহাপুরুষপরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ পড়া ছিলো, তাই বিরতির পর ‘মহাপুরুষ’ মন্দ লাগেনি। কিন্তু একজন ৮ বছরের ছেলের পক্ষে ইন্টারভালের আগে ‘কাপুরুষ’ ছিল ক্লান্তিকর ও অস্বস্তিজনক।

১৯৬৭-তে যতদূর মনে পড়ে মুক্তির দিনই (২রা জুন) রাতের শো’তে ইন্দিরায় গিয়ে দেখি হলের  সামনে প্রচুর ভীড়। সম্ভবত বর-বৌ পার্থ ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় বিবাহিত দম্পতির সাজেই এসেছিলেন! ‘বালিকা বধূ’ নিয়ে আগে তরুণ মজুমদারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যা লিখেছিলাম, তা এখানে আবার দিলামঃ ছবিটি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন আমার মাসীমা, বিষয়বস্তু শোনার পর। তাই সদলবলে যাওয়া।

ছবির প্রথমেই আছে দু’টি হাত, একখানি অ্যালবামের পাতা উল্টে-উল্টে কাহিনীর চরিত্রদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরে জেনেছি সেই হাত আর সংলাপের কন্ঠ অন্তত কিছুটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের! তারপর পূর্ণভাবে উপভোগ্য একটি সুন্দর ছবি! গানে গানে মুখর! প্রথমে বিয়ের গাড়িতে করে যেতে যেতে অমল (পার্থ)-এর জামাইবাবু অনুপকুমার গাইছেন দ্বিজেন্দ্রগীতি, ‘আজি  এসেছি, এসেছি বধূ হে’, যন্ত্রানুসঙ্গ গাড়ির হর্ন! বাসরঘরে সেই জামাইবাবুই গেয়ে ওঠেন ‘মলয়  আসিয়া কয়ে গেছে কানে’। গান শেষ করবেন, ‘এইবার তুমি...’, এমন সময় দেখেন যে নববধূ রজনী (মৌসুমী) দিব্যি একজনের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন! মুখ বেঁকিয়ে জামাইবাবু হারমোনিয়াম  বন্ধ করে শেষ শব্দটি উচ্চারণ করেন, ‘আসিবে!’ নেপথ্য কন্ঠে রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে এই জামাইবাবুর মুখেই আমরা শুনব রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’, সেখানেও রবীনবাবুর গলা। (আচ্ছা তরুণবাবু, তপন সিংহ মশায় কিন্তু একরকম জোর করেই হেমন্তবাবুকে তাঁর ছবিতে দ্বিজেন্দ্রগীতি (‘আরোহী’) আর অতুলপ্রসাদের গান (‘ক্ষণিকের অতিথি’) গাইয়েছিলেন। আপনি সেই জোর করলেন না কেন? পরে তো ‘খেলার পুতুল’-এ আপনিই হেমন্তবাবুকে দিয়ে ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’ গাইয়েছেন!)

এরপর ভোরবেলায় অমল আর রজনী গিয়ে বসবে বাড়ির বাইরে মাঠে। দূর থেকে ভেসে আসবে  হেমন্তবাবুর উদাত্ত কন্ঠে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’। আর অমল গেয়ে উঠবে ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনের ঘ্রাণে পাগল করে’, সেও সেই একজনেরই ঐশ্বরিক স্বরে! রজনী বাপের বাড়ি গেলে বিরহী অমল স্কুলের বাংলা ক্লাসে ভাব সম্প্রসারণ (‘নাহি কিরে সুখ, শুধু কিরে দুখ,  এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?’) লিখতে গিয়ে খাতা ভরে ফেলবে ‘রজনী’র নামে, ফলে জুটবে মাস্টারমশায়ের প্রহার! বিরহী শ্যালককে নিয়ে জামাইবাবু যাবেন যাত্রা দেখাতে। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেখানেও এক বিরহী রাজার কন্ঠে, ‘সখী রে, প্রাণপাখী রে’, কিন্তু রাজার বিরহমোচনে মঞ্চে ছুটে আসবেন রাণী, ‘আমি এসেছি, এসেছি গো সখা, ফেলো না কো আঁখিজল!’ (রাণীর ভূমিকায় যে সময় দেখানো হচ্ছে, তার রীতি মেনে পুরুষ – গোঁফ-কামানো জহর রায়!)। বিরক্ত অমল উঠে চলে যায়। এরপর গৃহশিক্ষকের স্বদেশী করার অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া, পুলিশের সঙ্গে তাঁর চলে যাবার সময় নেপথ্যে হেমন্তকণ্ঠে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। জামাইবাবুর বোন/দিদিকে লেখা চিঠি হাতে এসে পড়ায়, তার নকলে অমলের চিঠি লেখে রজনীকে, তাকে সম্বোধন করা, ‘প্রিয়তমা রজনী’! উত্তর আসে, “তোমার চিঠি [বড়রা] সবাই পড়েছে; বলেছে, ‘বাঁদর ছেলে’! আর কখনো আমাকে এরকম করে লিখবে না!” ক্ষিপ্ত অমল স্ত্রীর উত্তর ছুঁড়ে ফেলে দেয় পুকুরে।

রজনী ফিরে এলে সে মেলায় গিয়ে শোনে চারণকবি মুকুন্দদাসের গান (ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত) ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী’, সব মেয়েরা মঞ্চে ছুঁড়ে দিচ্ছেন তাঁদের হাতের চুড়ি, রজনী চট করে তার চুড়ি ভর্তি হাত লুকোবে আঁচলের তলায়। পরে বাক্সভর্তি চুড়ি সে দিয়ে যাবে সম্ভবত ননদের হাতে (জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়) গঙ্গায় ফেলে দেবার জন্যে।

অনেক, অনেক স্মৃতি ‘বালিকা বধূ’কে ঘিরে। প্রথমবার দেখার পর দাদার মাথায় আসে ঠাকুমাকে নিয়ে আসার। মাসীমার মতো তিনিও তো এককালে বালিকা বধূই ছিলেন! ঠাকুমার অবশ্য ছবিটি ভালো লাগেনি। অনেক বছর পরে কিন্তু এই ঠাকুমাই আমার কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে শুনবেন তরুণবাবুর ‘মেঘমুক্তি’ ছবির গল্প! এরপর ‘বালিকা বধূ’ তৃতীয়বারও দেখা হয়।

১৯৭২-এর আগে এটিই আমার সবচেয়ে বেশীবার দেখা বাংলা ছবি। এর আগে ‘শেষ পর্যন্ত’ দু’বার দেখেছি, আর তারপর কোন এক সময় ইন্দিরায় এবং অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে (কোনটিতে আগে মনে নেই) ১৯৫১ সালের বিখ্যাত কৌতুক চিত্র ‘বরযাত্রী’।

২১শে আগস্ট, ১৯৭০-এ লাইটহাউস, রূপবাণী, অরুণা, ভারতীতে মুক্তি পাওয়া তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’ দেখবো প্রায় এক যুগ পরে, বিদেশ থেকে ফিরে, ইন্দিরা সিনেমায়, দুপুরের শোয়ে।

১৯৭৪-এ দেখেছিলাম ইন্দিরায় ‘সাধু-যুধিষ্ঠিরের কড়চা’। রবি ঘোষ, চিন্ময় রায় ও জয়া ভাদুড়ীর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল, ছবিটিও বাণিজ্যিকভাবে এতটাই সফল হয়েছিল যে পরে হেমন্তপুত্র জয়ন্ত/রীতেশ এর একটি হিন্দি রূপান্তর প্রযোজনা করেন আসরানি, অমোল পালেকর ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে! সেটি অবশ্য চলেনি। মূল ছবিটি দু-এক জায়গা ছাড়া আমার অতিদীর্ঘ ও ক্লান্তিকর লেগেছিল।

১৯৭৭-এ প্রথম দেখলাম ইন্দিরায় রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরক্ষা’হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালক, যদিও বেশীর ভাগ গানই ছিল মধুমিতা রায়ের গলায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের মুখে। শেষ গান, ‘যার অদৃষ্টে যেমনি জোটে’তে হেমন্তর সঙ্গে গলা দিয়েছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এবং ধীরেন বসু। এছাড়া হল কর্তৃপক্ষ শো আরম্ভ হবার আগে ও বিরতির সময় নেপথ্যে বাজিয়েছিলেন হেমন্তকণ্ঠে একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড।

আর সত্তরের দশকে প্রাক-উত্তম যুগের একগুচ্ছ ছবি দেখেছি প্রধানত মা’র উৎসাহে। যে ছবিগুলি দেখেছি, সেগুলি বেশীর ভাগই মুক্তি পেত দু’টি নতুন বাংলা ছবির মাঝখানে, এক সপ্তাহের জন্যে। এর মধ্যে ইন্দিরায় দেখেছিলাম নিউ থিয়েটার্সের ‘জীবন-মরণ’ (১৯৩৯ সালের ছবি)। সম্ভবত শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে সমাজে যক্ষ্মারোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে এই ছবির কুশীলব ছিলেন দুই অবাঙালি কুন্দনলাল সায়গল ও লীলা দেশাই।

১৯৮২ সালে ভবানীপুরের শ্যামাপ্রসাদ (সান্ধ্য) কলেজে আমি অধ্যাপনায় নিযুক্ত হই। তখন কলেজের একদিকে বিজলী, ইন্দিরা, ভারতী (আর নেই), পূর্ণ (আর নেই), অপর পাশে বসুশ্রী আর ঊজ্জ্বলা (আর নেই)কলেজের সময় সোম থেকে শুক্র বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৯টা, শনিবার যতদূর মনে পড়ে ৩টে ৩০ থেকে ৬টা ৩০। অর্থাৎ দুপুরের শো দেখে, বা দেরীর দিকে ক্লাস থাকলে ম্যাটিনী শো দেখেও অনায়াসে কলেজে ঢোকা যায়! জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, বাংলার অধ্যাপক অরূপ ভট্টাচার্যের ভাষায়, তখন আমি (বাংলা সিনেমার) ‘কোর্স কমপ্লিট’ করতে বদ্ধ পরিকর! সল্ট লেকে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও হাতিবাগানের চেয়ে ভবানীপুরই তখন ছবি দেখার পক্ষে সুবিধেজনক।

ইন্দিরায় দেখলাম ১৯৬০ সালের ‘কুহক’, এক সাইকোপ্যাথ খুনে চোরের ভূমিকায় মহানায়ক। তার সঙ্গে হেমন্ত-সুরারোপিত এবং গীত ছ’খানি ভিন্ন-ভিন্ন ধরনের গান! ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো’ এগুলির মধ্যে  সবচেয়ে বিখ্যাত, পরবর্তী-কালে এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে গানটি নিয়ে হেমন্তর সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার  জন্য। কিন্তু আমার মন কেড়েছিল ‘সারাটা দিন ধ’রে, চেয়ে আছিস ওরে / তোর মনের কথা তবু তো কেউ জানলো না।’

সাম্প্রতিককালে ছবিটির উৎস-উপন্যাস পড়ে এবং তাঁর থেকে হওয়া ইংরেজী ছবি ‘The Night of the Hunter’ দেখে বুঝেছি যুগপৎ পরিচালক অগ্রদূত এবং সেই ষাটের দশকে উত্তমকুমারের আদ্যোপান্ত ‘রোম্যান্টিক’ ভাবমূর্তির জাঁতাকলে পড়ে চিত্র্যনাট্যকার সমরেশ বসু কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন! মূল চরিত্র এক মানসিক বিকারগ্রস্ত দানবিক হত্যাকারী যে বিধবাদের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে তারপর তাদের হত্যা ক’রে তাদের সর্বস্ব হাতিয়ে আরেক শিকার খুঁজতে বেরোয়। তুচ্ছ অপরাধে সাময়িক জেল খাটার সময় সে আরেক বন্দীর কাছ থেকে জানতে পারে যে সেই বন্দী অভাবের তাড়নায় (কাহিনির প্রেক্ষাপট আমেরিকায় বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের ‘ডিপ্রেসন’-এর সময়) টাকা চুরি করে, তার জন্য মানুষ খুন করে, এখন প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত। মুক্তি পেয়ে আমাদের খলনায়ক এই বন্দীর বিধবা ও দুই সন্তানকে খুঁজে বার ক’রে চুরির লুকোনো টাকা উদ্ধারের চেষ্টায় মাতে। ধর্মপ্রচারক সেজে সে অসহায় বিধবাকে বিয়ে, এবং তারপর হত্যা করে। এবার তার লক্ষ্য দুই অনাথ সন্তানের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড় ছেলেটি, কারণ সে নিশ্চয়ই জানে তাঁর বাবা কোথায় টাকা লুকিয়েছিল।

ষাটের দশকে উত্তমকুমারকে খলনায়ক সাজাবার সাহস কারুরই ছিল না। মহানায়ক তাঁর অভিনয়জীবনের শেষের দিকে এসে তবেই ভবেশের মতো পূর্ণ খল চরিত্র ‘বাঘবন্দী খেলা’-তে (১৯৭৫) করবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭৭-এর ‘রাজবংশ’ ছবিতেও পিতা উত্তম অত্যাচারী লম্পট এবং তাঁর অবৈধ পুত্র উত্তম প্রতিহিংসাকামী। এর আগে ‘শেষ অঙ্ক’ (১৯৬৩) ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্রের অপরাধ খানিকটা স্খালন করার চেষ্টা হয়েছেঃ চরিত্রের বাবা, যৌতুকের লোভে এক মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন। ১৯৭০-এর ‘দুটি মন’-এ জমজ উত্তমঃ একজন ভালো, একজন খারাপ। ১৯৭৩-এর ‘কায়াহীনের কাহিনী’-তেও এক উত্তম চরিত্রহীন লম্পট, আরেকজন অপাপবিদ্ধ।


‘কুহক’ ছবির সুনন্দ উৎস-কাহিনির হ্যারি পাওয়েলের মতো সম্পূর্ণ দানবিক নয়, তাঁর চরিত্রে দ্বৈত আনা হয়েছে, টাকা-চোর গণেশের (তরুণকুমার) বোন (বিধবা স্ত্রী নয়) স্বর্ণলতার প্রতি সুনন্দর নিখাদ প্রেম আর অপরদিকে গণেশের চুরি করে লুকিয়ে রাখা টাকার প্রতি সুনন্দর প্রচণ্ড লোভের মধ্যে। মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে হত বিধবার বড় ছেলের দৃষ্টিকোণ থেকে, যে মানুষ-পিশাচ হ্যারির হাত থেকে নিজেকে ও তার ছোট বোনকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। ‘কুহক’-এর কাহিনি পুরোপুরি সুনন্দর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে, কারণ সুনন্দ যে আদতে উত্তমকুমারই! ফলে উৎস-কাহিনির রুদ্ধশ্বাস ‘সাসপেন্স’ অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে, আর সুনন্দর মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুটি সত্তার মধ্যে শেষ অবধি সামঞ্জস্যও আসেনি।



প্রাচী

প্রাচীতে প্রথম গেছি খুব ছোটবেলায়, দাদার সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত ‘The Gold Rush’ দেখতে। যতদূর মনে পড়ে, এটি ১৯২৫ সালের নির্বাক সংস্করণ ছিল না। দেখানো হয়েছিল ১৯৪২ সালের সবাক রূপ। মনে আছে এখনও ছবির প্রথমেই চার্লির পেছন পেছন বরফের মাঝে ঘুরছে একটি ভাল্লুক। আর চার্লির জুতো খাওয়ার দৃশ্য তো চোখে এখনও ভাসে – জুতোর পেরেকগুলি চার্লি হাড়/ কাঁটার মতো চুষছিলেন!

এর প্রায় ৫০ বছর পর, বর্তমান শতাব্দীতে আবার প্রাচীতে ঢুকি নীতীশ রায় পরিচালিত ‘জলে জঙ্গলে’ (২০১৮) দেখতে। তখন ফেসবুকে যা লিখেছিলাম, এখানে তুলে দিলামঃ

আহা, 'আমাজন অভিযানে'র জন্যে কোণঠাসা এই ১০০ ফুট (প্রথমে বিজ্ঞাপনে ছিল ৩০০ ফুট!)  কুমীরের ছবিটি! আজ প্রাচীতে দেখলাম। জীবনে দ্বিতীয় বার উক্ত প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ। অনেক, অনেকদিন আগে দাদার হাত ধ'রে এখানে এসেছিলাম চ্যাপলিনের Gold Rush দেখতে। সেটা ষাটের দশক। প্রায় ৫০ বছর পরে আবার এখানে! মূল আকর্ষণ কুমীর, আর একটি চরিত্রে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের অভিনয়।

পেশাদার অভিনেতাদের গুণে পার্শ্বচরিত্রগুলো বেশ প্রাণবন্তঃ মিঠুন চক্রবর্তী পাগল বৈজ্ঞানিক, আশিস বিদ্যার্থী ভিলেন শিকারী, ইত্যাদি, ইত্যাদি! জ্যাকি শ্রফ তো নিজেই নিজেকে বর্ণনা করেছেন 'আলু' ব'লে, যে রান্নাতেই তাঁকে ফেলা হোক, ভালো লাগবে!

কুমীরটির নাম মিঠুন রেখেছেন 'হ্যাপি'। খুব লক্ষ্মী কুমীর, মিঠুন যে সুর ক'রে তাকে ডাকেন, এক বেড়াতে আসা কলেজ ছাত্রীর বাঁশীতে সেই সুর শুনে সে ওই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে 'খেলতে' আসে! এসে ঢুঁ মেরে তাদের লঞ্চটি উড়িয়ে দেয়! আবার যে দুষ্টু লোকেরা তাকে ধ'রে নিয়ে যেতে এসছে, তাদের নৌকোগুলো ডুবিয়ে দেয়।

কিন্তু বিরতির প'রে আমার সেই ছাত্রটি কোথায় গেলো পরিচালক জানালেন না!

শ্রী

অধুনালুপ্ত শ্রী’তে দেখেছি, প্রথমে ১৯৫৯-র ‘দীপ জ্বেলে যাই’। ১৯৭০-এ ধর্মতলার এলিট সিনেমায় দাদার সঙ্গে দেখেছিলাম হিন্দি ছবি ‘খামোশী’ওয়াহিদা রহমানের অভিনয় খুব ভালো লেগেছিল, আর ছোটবেলার চেনা গান ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’র হিন্দি রূপান্তর শুনে মজা পেয়েছিলাম। ১৯৭৬-এর পর শ্যামবাজারে শ্রী প্রেক্ষাগৃহে বসে বুঝলাম যে তখন খুবই ভালো, সুস্বাদু ঘোল খেয়েছিলাম বটে, কিন্তু আসল দুধ ঝরে পড়েছিল সেই ১৯৫৯ সালে! আজও বলি, মহানায়িকা যদি আর একটি ছবিও না করতেন, তা’হ’লেও ‘দীপ জ্বেলে যাই’- এর নার্স রাধা মিত্র তাঁর স্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের মধ্যে নিশ্চিত করে দিয়েছিল তখনই! এমনকি ‘উত্তর ফাল্গুনী’র দেবযানী বা ‘সাত পাকে বাঁধা’র আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয়কেও আমি রাধা মিত্রের পরে রাখব! ও, বলতে তো হবেইঃ কি বাংলা  কি হিন্দি, দুই জায়গাতেই গানের সুরে পাগল করেছেন আমার সেই জীবনদেবতা! হিন্দি রূপান্তরটি তো আবার তাঁরই প্রযোজনা! একবার ‘খামোশী’তে আসল রাধা মিত্রকে রাখার কথা হেমন্ত ভাবতে পারতেন, তবে হিন্দি ছবির প্রযোজক হিসেবে বাণিজ্যিক চাপ ছিল, তাও বুঝি!

সম্ভবত ১৯৭৮-এ, শ্রী’তে দেখি আমার অভিজ্ঞতায় প্রথম বাংলা horror ছবি, নরেশ মিত্র পরিচালিত  ১৯৫০ সালের ‘কঙ্কাল’! গল্প বেশ ভালো, ধীরাজ ভট্টাচার্যের অভিনয়গুণে মূল খলনায়ক অভয় বেশ ভয়ঙ্কর। হতভাগিনী নায়িকা তরলার (মলয়া সরকার) প্রতি অভয়ের অদম্য লালসা দেখে গা শিউরে উঠেছিল। অভয়ের হাতে আকস্মিকভাবে তরলার অপঘাত মৃত্যু এবং তারপর প্রতি রাত ন’টায় আলমারীর দরজা আপনা থেকে খুলে গিয়ে তরলার চোখ-কপালে তোলা মৃতদেহের আবির্ভাব ছবির সবচেয়ে ভয়ের দৃশ্য! তবে এই দৃশ্যের সঙ্গে সেই ২১ বছর বয়েসের একটি সুখস্মৃতিও জড়িয়ে আছে! ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম আমার কলেজের এক সহপাঠিনীর সঙ্গে। তরলার ভৌতিক মৃতদেহ পর্দায় ফুটে উঠতেই তাঁর হাত চেপে ধরেছিলাম এবং তিনিও প্রতিদানে আমার হাত চেপে ধরেছিলেন! এর পর অভয় তরলার দেহ ভরবে একটা কাঠের সিন্দুকে, কিন্তু ভয়ার্ত হয়ে দেখবে, ডালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে তরলার একগাছি চুল! এসবের তুলনায় ছবির নামভূমিকায় কঙ্কালটি কিন্তু বেশ হাস্যকর, এবং ভাবাবরোহের উদ্রেককারী!

এর পরের পর্বে রূপবাণী-অরুণা-ভারতী।

 

 

 

 


1 টি মন্তব্য:

  1. এই এক সুবিধে সিনেমায়। ফিরে দেখা যায়। আপনার লেখা পড়ে খুব মনে পড়ল। পালিয়ে দেখা প্রথম সিনেমার নাম ...। পালিয়ে দেখার গল্প। সেই হতভাগ্য কৈশোর-বেলায় সিনেমা মানে বখে যাওয়া একটা ব্যাপার ছিল। সিনেমার টান খুব রয়ে গেছে পড়তে পড়তে আপনি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। এমন লেখাকে কুর্ণিশ। হ্যাঁ, পুরনো সিনেমার পোস্টারে দেখা এই নামগুলো আজ পোস্টার ও অতীত সরণির না ভোলা সেই বেলা। আপনি লিখতে থাকুন, আমরা মুগ্ধ পাঠক পড়তে থাকি। @মৌ _ ২০২৩

    উত্তরমুছুন