বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

রূটম্যান




 

(১৩)  

 

লোকটি এতক্ষণ পরে ওর পকেট থেকে বিড়ি বের করে একটা আমাকে দিতে গেলে আমি মাথা নাড়ায় সে নিজেই বিড়ি ধরায়। প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে আবার বলে- সে সময় আমাদের এদিকে রোজই বিভিন্নজনের লাশ পড়ে থাকত। শুধু আমাদের গ্রামের লোকেরই নয়। অন্য গ্রামের অচেনা লোকের লাশও থাকত। আর এসবের পেছনে ছিল কাঁচা পয়সার খেলা। বলতে পারেন আমার বাবা কিছুটা ডাকাবুকো ছিলেন। আপনাকে তো আগেই বলেছি গ্রামের অনেকের মতোই বাবাও এই পাচার কোম্পানীর সাথে জড়িত ছিলেন। এটা আমি অনেক পরে লোকের মুখে শুনেছি। মা নিশ্চয়ই জানত। আর তাই বাবা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত কেমন যেন  ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে চুপ করে দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকত। দশবার ডাকলে হয়তো একবার সারা দিত। এসব এখন বুঝি। কিন্তু আমাদের কাছে কোনদিনই কিছু বলেনি। হয়তো আমরা ভয় পেতে পারি তাই কিছু বলেনি। সেই সময় গভীর রাতেও অবলাদের পারাপার চলত। একসাথে অনেক অবলাকে ছেড়ে দেওয়া হত জলে। কোকদের নিয়ে কোন অসুবিধাই হত না। কিন্তু যারা পেপসি তারা ভয়ে ডাকতে শুরু করত। অনেক সময় তারা তাদের মা বা সঙ্গিদের খুঁজতো।

আমি তাড়াতাড়ি লোকটিকে থামিয়ে বলি- আরে দাঁড়ান দাঁড়ান! আপনি তো মেলগাড়ি ছোটাচ্ছেন। এই যে কোক আর পেপসি কী যেন বললেন সেটা আবার কোন বস্তু? হচ্ছিল অবলাদের গল্প, তার মধ্যে এই ঠান্ডা পানীয় ঢুকলো কীভাবে! আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

লোকটি বার কয়েক মাথাটা নেড়ে বলল- সত্যি আমারই ভুল হয়ে গেছে। আমার বোঝা উচিত ছিল যে এই শব্দগুলো আপনার চেনা হলেও এই গল্পে কীভাবে ঢুকে গেল তা আপনার জানার কথা নয়। আসলে এই সীমান্তবর্তী গ্রামের লোকেরা বিশেষ করে যারা অবলা পাচারের সাথে জড়িত তারা ‘কোক’ বলে বড় অবলাদের। আর ‘পেপসি’ বলে একেবারে ছোটদের। আর  মুশকিল হচ্ছে এই ছোটদের নিয়েই। বড় অবলারা দিব্বি জলে নেমে সাঁতার কাটতে শুরু করে। কিন্তু ছোটরা হয়তো জীবনে এই প্রথম জলে নামল। তাই ভীষণ ভয় পায়। চিল চিৎকার দিতে শুরু করে। আর ওদের মুখ বন্ধ করার জন্য এক ধরনের দড়ির জাল দিয়ে ওদের মুখ বেঁধে  দেওয়া হয়। ওরা তখন অগত্যা জলে নেমে সামনের বড়দের মতো সাঁতরাতে থাকে। এই এক দঙ্গল অবলাদের দু’দিকে দুটি নৌকায় লোক থাকে। তারা লক্ষ্য রাখে যাতে অবলারা জলের  স্রোতে অন্যদিকে ভেসে না যায়। ঠিক অনুরূপভাবে ওপারের সীমানাতেও নৌকা নিয়ে ওরা তৈরি হয়ে থাকে। আর এভাবেই অন্ধকার রাতে পারাপার করা হয় অবলাদের।

-কিন্তু বিএসএফের জওয়ানরা তো জল পাহারা দেয় শুনেছি। তারা তো যে কোন সময় চলে আসতে পারে। তখন কী হয়? আমি চুপ করে থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে ফেলি ।

লোকটি হাসতে হাসতে বলে-আরে দাঁড়ান, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। বিএসএফের ভয় তো অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু তার থেকেও বড় বিপদ হল এতগুলো অবলাকে ওপারের লাইনম্যানেরা চিনবে কেমন করে! রামের কেনা মাল তো রহিমের ঘরে চলে যেতেই পারে। ফলে কেউ কম টাকায় ভালো অবলা পেয়ে যাবে আর কেউ বেশি টাকা দিয়েও হয়তো একটা বুড়ো অবলা পেল। এসব ক্ষেত্রে আবার ওপার থেকে ফোন এলে এপারের দালালেরা তাদের খাতা দেখে বলে আর ওরা তা মিলিয়ে নেয়। কিন্তু এতেও সমস্যা হত কথা স্পষ্ট শোনা যেত না বলে। তখন আমার বাবাই একটা পথ বাতলে দিল। আর সেটা হল অবলাদের শিঙে শিঙে প্ল্যাস্টিকে জড়িয়ে বেঁধে দেওয়া হল মোবাইল। আর ওদের নম্বর বলে দেওয়া হত। ওরা নিজেদের মাল খুঁজে নিত রিং করে। যে অবলার শিঙে বাঁধা মোবাইলে আলো জ্বলে উঠত বোঝা যেত সেটাই তার। একটু বেশি পয়সা খরচ হল বটে কিন্তু সমস্যাটা সহজেই সমাধান হয়ে গেল। আর আপনি যে বলছিলেন বিএসএফের জলের সীমানা পাহারা দেওয়ার কথায়। সে তো ঠিকই। ওরা ওদের মতো এক চক্কর ঘুরে যেত। সবাই জানে এরপর পুরো একটি ঘন্টা ওরা আর এ মুখো হবে না। তাই এই এক ঘন্টার মধ্যে দিব্বি ভারতের অবলারা পেরিয়ে যেত গঙ্গা। তাছাড়া মনে রাখবেন এই সীমান্তের প্রতিটি থানা, বিএসএফ, অঞ্চলের নেতা এবং সর্বোপরি রাজ্যের কোন কোন নেতাদের মুখও টাকা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হত। তবু মাঝে মাঝে জওয়ানদের যুদ্ধের মহড়া দিতেই হয়। পাচারকারীও যেমন মারা যায়, তেমনি বিএসএফের জওয়ানও মারা যায়। কারণ পাচারকারীদের হাতেও আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকে বলেই জানি।

-কিন্তু আপনার বাবার মৃত্যুটার ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন। উনিও কি তাহলে-। আমি বলি।

-হ্যাঁ, বাবা তখন এ অঞ্চলের রুটম্যান হিসেবে বেশ নাম করেছে। বাবার খবর আর বুদ্ধির উপর পাচারকারীদের বেশ ভরসা। কিন্তু একদিন বাবা একটু বেশি বীরত্ব দেখাতে গিয়েছিলেন। তার কাছে খবর ছিল জওয়ানরা সেদিন আর সীমান্তের শেষ প্রান্তে টহল দেবে না। সাধারণত একবার ঘুরে যাওয়ার পর ওরা একই জায়গায় আসে না। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো জনা কয়েক জওয়ান সেখানে পোস্টিং থাকে। আর সেদিন বাবা একটা জমি কিনতে গিয়ে দেখে তার কাছে প্রায় হাজার দশেক টাকা কম পড়ছে। জমিটা ছিল তিনফসলি জমি। তাই বাবা ঠিক করলেন যে আজ সে নিজেই অবলাকে একেবারে পগার পার করে দেবেন। আর তাহলেই পুরো দশ হাজার টাকা হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আমি পরে মায়ের কাছে শুনেছিলাম যে বাবা একবার ঘরে এসে জামা খুলে রেখে শুধু গামছাটা নিয়েই দ্রুত চলে গিয়েছিলেন। মায়ের সাথে ওটাই বাবার শেষ দেখা।

লোকটি তার বাবার কথা বলতে গিয়ে একেবারে ঝরঝর করে না কাঁদলেও আমি বুঝতে পারলাম যে তার মনটা এখন শ্রাবণের বারিধারায় স্নাত। আমি যেন উঁকি দিয়ে ওর মনটাকে দেখতে পাচ্ছিল। যে কোন গল্পকার গল্প করতে করতে যদি অপলক চোখে তার দৃষ্টিকে দূরগামী করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকে তাহলে বোঝাই যায় যে, সে তার গল্পের গভীরে হারিয়ে গিয়ে কাউকে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে চলেছে। এই মুহূর্তে লোকটির অবস্থাও ঠিক তাই। তার দৃষ্টি ঢেউয়ের মাথায় মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু যা খুঁজতে চাইছে তা খুঁজে পাচ্ছে না!

একটু পরে আমার দিকে বারেক সময় শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে বলল- জানেন তো শুধু একজনই আমার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে সাক্ষী ছিল। সে তখন পড়ন্ত রোদে মাথায় ঘাসের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। দু’জন মাত্র বিএসএফ জওয়ান নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল  সীমান্তের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন দূরে গঙ্গার বাঁকে একটা কিছু দেখতে পেয়ে চিৎকার কর বলে- “হল্ট, রুক যাও। নহি তো গোলি চালা দুঙ্গা”। সাথে সাথে সেই প্রত্যক্ষদর্শী লোকটিও দূরে তাকিয়ে দেখে যে একজন লোক সাথে দুটো অবলাকে নিয়ে নদীর মধ্যে সাঁতরে চলেছে। সে হয়তো জওয়ানের সতর্ক বার্তা শুনতেও পাচ্ছে না। হয়তো সবটাই কয়েক মুহূর্তের ঘটনা ছিল। নদীর গভীর জলে দুটো অবলার মাঝখানে লোকটি শুধু তার মাথাটুকু জলের উপর ভাসিয়ে সাঁতরে চলেছে। অর্থাৎ তখন জলে পর পর তিনটি মাথাই দেখা যাচ্ছিল! তারপর মাত্র দুটো গুলি খরচ হল। অদ্ভুত নিশানা ছিল সেই জওয়ানটির। ঠিক মাঝখানের কালো মাথাটিই হঠাৎ টুপ করে জলে ডুবে গেল! আর সাথে সাথে অবলাদুটি পরিত্রাহী চিৎকার করতে করতে যে যেদিকে পারল ভেসে গেল! অথচ সেই লোকটি আর কোনদিনই গঙ্গার জল থেকে ভেসে উঠল না। এমনকি তার পচা-গলা শরীরটিকেও নাকি বাংলাদেশের কোন নদী বা বিলে ভেসে উঠতে দেখা যায়নি। এভাবেই সে হারিয়ে গিয়েছিল। একদিন সকলের মন থেকে হারিয়ে গেলেও আমার মায়ের মন থেকে নিজের স্বামী কোনদিনই হারায়নি। আজো মা কাঁদতে কাঁদতে বলে- ‘তোর বাজান পাটের টক খুব ভালোবাসতরে বাপ। সেদিন তাই করা হয়েছিল। অথচ তা খেয়ে যেতে পারল না। অবশ্য তারপর থেকে আমাদের বাড়িতে আর পাটের টক হয় না।

-বড় প্যাথেটিক আপনার বাবার মৃত্যু। আমি তো ভাবতেই পারছি না!

-আমাদের কাছে এখন সবটাই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো রীতিমত যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যায়। একদিকে পাচারকারীরা অন্য দিকে জওয়ানরা। এই তো কিছুদিন আগেই একজন পাশের গ্রামের জওয়ান তখন ছুটিতে বাড়ি এসেছে। আর ভর দুপুরে পাচারকারীরা রোজকার মতোই অন্যের জমির উপর দিয়ে তাদের অবলাদের নিয়ে নদীর চরে যাচ্ছিল। সারাদিন ঘাস খাইয়ে রাতে পগার পার করে দেবে। এতে সেই জমিতে সদ্য গজিয়ে ওঠা শস্যের চারা যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদ করার কেউ নেই। গ্রামের সবাই পাচারকারীদের ভয় পায়। কিন্তু সেদিন ঐ জওয়ান যুবকটি এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করে বলেছিল তারা যেন এই গরিব চাষিকে এই ক্ষতির দামটা দিয়ে দেয়। সেই পাচারকারীরা সাথে সাথে তাদের লুঙ্গি উঁচু করে তার নীচ থেকে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র বের করে জওয়ানটির বুকে সুট করে নির্বিকার মুখে অবলাদের নিয়ে চলে যায়। আর সেই ছেলেটি সাথে সাথে আছড়ে পড়ে থাকে পাটক্ষেতের পাশে একেবারে দিনের আলোয়। তাই আজ গ্রামের নিরীহ মানুষেরা এমন ঘটনা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওরা জানে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে ছুটে গিয়েও কোন লাভ  নেই। সে এই ঘটনা শুনে নিজের মুখের ভাবটা এমন করবে যেন সে এই প্রথম এমন ঘটনা শুনলো। আর মনে মনে ভাববে এই খুনের জন্য সে মূল পান্ডার কাছ থেকে বেশ মোটা টাকা আদায় করতে পারবে। সে তখন হয়তো মনে মনে হাসতে হাসতে ভাবে- ‘কারোর পৌষ মাস, তো কারোর সর্বনাশ’। সমাজে দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই তো চলে আসছে। লুঠ কর, কিন্তু সবটা কোরো না । কিছুটা অবশিষ্ট থাক। অসময়ে কাজে দেবে।

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন