ধারাবাহিক উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(১৩)
এদিকে সেই বছরের মাঝামঝি নাগাদ মানময়ীর কাছ থেকেই
শ্যামাঙ্গী জানতে পারে, আগমনীকে নিয়ে পুপু বেজায় সমস্যায় পড়েছে আর শকুন্তলার
ছোটছেলে অগ্নিভ হাতে পায়ে বেশ বেড়ে উঠেছে। সে এখন আপাতত মানময়ী ও অলঙ্কৃতার তত্বাবধানে
নিহিতপাতালপুরীতে বড় হচ্ছে আর বেশ খানিকটা দুরন্তও হয়েছে। কিন্তু সবার সব সমস্যাকে
ছাপিয়ে যায় শকুন্তলা একাই নিজে। দিগন্তসেনা সামলাবার পাশাপাশি মূল ভূখন্ডে নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব
দলটিরও একজন কর্ণধার হয়ে উঠেছে শকুন্তলা। নানা কাজে কখনও এখানে কখনও সেখানে আবার
কখনও বিদেশে যেতে হয় তাকে। কিন্তু রাতে না শুলে তার ঘুম হয় না। ফলে ও যখন যেখানে
থাকে তখন সেখানেই কাউকে পটিয়ে পাটিয়ে ঠিক নিজের ব্যাবস্থাটা পাকা করে রাখে। প্রথমে
ব্যাপারটা কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি। সকলেই ভেবে নিয়েছিল ওর একটা পরিবর্তন হয়েছে এবং
সেটা ভালোর দিকেই। স্বামী রেঁনোয়া বত্তিচেল্লীও কিছুই বুঝতে পারেনি। কেননা ও যখন
যখন দিগন্তসেনায় থাকে তখন প্রতিদিনই ওরা সহবাস করে। তার মধ্যে কোথাও কোন খুঁত থাকত
না যে রেঁনোয়ার মনের চোখে সেটা ধরা পড়বে। কেননা সেই সমস্ত দিনগুলোতেও শকুন্তলার
আচার ব্যবহার শোওয়া বসায় এত বছরের পুরনো শকুন্তলাকেই অনুভব করা যেত রীতিমত ভালো
ভাবেই। এতটাই স্বতস্ফুর্ততা থেকে যেত সেই সব রাতগুলোতে রেঁনোয়ার প্রতি ওর বিশেষ
স্বভাব বৈশিষ্টগুলোতে। তাই সন্দেহ হবার মত কোন কারণই থাকত না রেঁনোয়ার পক্ষ থেকে।
আসলে যেটা হয়েছিল শকুন্তলা একেবারে একদম একই ছিল। ওর মানসিক জগতের কোথাও পরিবর্তন
তো হয়ইনি। তাই তার ছাপ তার আচার ব্যাবহারের ওপরে পড়বার প্রশ্নই ওঠে না। ও ঠিক যেমন
যতটা রেঁনোয়াকে প্রথম থেকে ভালোবাসত শেষ্পর্যন্তও ঠিক তেমন আর ততটাই ভালোবেসে যাবে।
কোথাও কোন পার্থক্য কোনওদিনও এতটুকু ঘটবে না। কেননা এই বিষয়টাকে নিয়ে ওর মনের
মধ্যে একটা পাকা ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল আর করেছিল ও নিজেই। রেঁনোয়াকে ও যে তুমুল আর
গভী্র ভালোবাসত সেটা ছিল খুব শক্তপোক্ত আর মজবুত। কোন কিছুতেই সেটা ভেঙে পড়বার
সম্ভাবনা ছিল না, এমন কি যদি সেটা ঘটতও তাহলে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত ও নিজেই। কাজের সুত্রে
বা নানা কারণে ও যখন আলাদা থাকত, তখন ও শুধু ওর প্রবৃত্তির দাসত্বকেই গুরুত্ব
দিতেই বেশি পছন্দ করত। কেননা ও খুব গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছিল ওর নিজের স্বত্ত্বাকে
আর তার ফলেই ও আবিস্কার করেছিল যে প্রতিদিন রাত্তিরের ওইসব শোওয়াগুলো ওর শরীর
ও মগজটাকে খুব সাংঘাতিক ভাবে তরতাজা আর
অসীম ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। তারই ফলে ও নিজে এই
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে ভালোবাসার সঙ্গে যৌনতাকে কোন ভাবেই জড়ানো উচিত নয়। তাতে
ভালোবাসার আয়ু কমে যায় আর সেটা শেষমেষ নিছকই একটা অভ্যেসে পরিণত হয়। যৌনতা শরীরের আর পাঁচটা প্রবৃত্তির মত নিছকই একটা প্রবৃত্তি
মাত্র। ভালোবাসার সঙ্গে তার কোন মেলবন্ধন হওয়া উচিত নয়। ফলে ও সবসময়ই ওর নিজের কাছে পরিষ্কার ছিল। তাই ওর স্বতস্ফূর্ততার কোন অভাব কোনদিনই হয়নি। ব্যাপারটা জানাজানি হয়
তখনই, যখন মহামতি নদী সম্পর্কিত সমস্যার কারণে
ও প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে এদেশ ওদেশ করে বেড়াচ্ছে আর মূল ভূখণ্ডের সরকারের
সঙ্গে দিগন্তসেনার চিরকেলে বৈরী মনভাব থাকা স্বত্বেও নতুন একটা সম্পর্কের
টানাপোড়েন শুরু হয় আর সেই কারণেই শকুন্তলার মাথাটাও বেশির ভাগ সময়েই গরম হয়ে থাকতে
শুরু করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মহামতি জল সরবরাহ চুক্তি দুপক্ষের সমস্যার সমাধান করে
আর রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী আবিষ্কার করে শকুন্তলার
শরীর যেন একটু অন্যভাবে নিজেকে ব্যক্ত করতে শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে রেঁনোয়া নিজে
থেকে কিছুই বলে না শকুন্তলার গর্ভধারণ পর্বটা চলাকালীন। বেচারা এতই অবাক হয়ে যায়
যে তার কান্ডজ্ঞান পর্যন্ত সে সবই খুইয়ে বসে। তারপর যখন বাইরে থেকে বোঝা যায় যে শকুন্তলার মধ্যপ্রদেশ অস্বাভাবিক হারে স্ফীত হতে
শুরু করেছে এবং সকলেই বুঝে ফেলতে শুরু করেছে যে আবার ও মা হতে যাচ্ছে, ঠিক সেই
সময়টা শ্যামাঙ্গী ওকে সরাসরিই একটু হাল্কা চালে বলে ফেলে যে মা হওয়াটা যখন সকলের
কাছে খুব যন্ত্রণাদায়ক একটা বিষয়, তখন শকুন্তলা বুঝি এ ব্যাপারে বিশ্বরেকর্ড করার
গুরু দায়িত্ব নিজেই কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। শকুন্তলা ফ্যালফ্যাল করে শ্যামাঙ্গীর দিকে
তাকায়, কেননা ও তখন দেশের সমস্যা নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার মধ্যে ডুবে ছিল বলে শ্যামাঙ্গীর কথাটা ওর মাথার ওপর দিয়েই
চলে যায়। এ অবস্থায় শ্যামাঙ্গীও বেশ একটা ধাঁধায় পড়ে যায়। তার মনে পড়ে ছোটবেলায়
শোনা অনঙ্গর সেই মেয়েদের চোদ্দ হাত কাপড়ে কাছা আঁটার কথাটা আর এতদিনে ও কথাটার মানে উদ্ধার করে, তাও অন্যের সাহায্য নিয়ে। তখন ওর মনে হয় গর্ভপাত করলেই তো প্রবচনটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে যায়। ঠিক তখনই ওর মাথায় আসে শকুন্তলাও তো ওই পথেও যেতে পারত, কিন্তু কেন গেল না ভাবতে ভাবতেই কিছু
দরকারি কাজের ছুতোয় সে রেঁনোয়াকে ডেকে পাঠায়। সে এলে দেখা যায় বেচারার মুখটা শুকিয়ে
এইটুকু হয়ে গেছে। শ্যামাঙ্গী ওকে বলে, ‘আমি কি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারি?’
রেঁনোয়া ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দেয় যে, না। তারপর চলে যায় সে। শ্যামাঙ্গী আঁচ করতে পারে সবটা আর শকুন্তলাকে ডেকে কথা বলে। কোনরকম লুকোছাপা না করেই সে তার নিজস্ব
বক্তব্যটা শ্যামাঙ্গীকে বুঝিয়ে বলে যার সবটা বিশ্বাস ও হজম করতে শ্যামাঙ্গীর গোটা জীবনকালটাও যথেষ্ট কম বলে মনে হলেও সে শকুন্তলাকে
রেঁনোয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলে। রেঁনোয়ার কাছে যেতেই আর একটু জোড়াজুড়ি
করতেই শকুন্তলা অবাক হয়ে আবিস্কার করে ওর মুখের দিকে সত্যিসত্যিই তাকানো যাচ্ছে না। কিন্তু ও একটুও গুটিয়ে না গিয়ে ওর গোটা মনটাকে রেঁনোয়ার সামনে খুলে মেলে ধরে। সবশেষে রেঁনোয়া জিজ্ঞেস করে,
‘সত্যি’? শকুন্তলা বলে, ‘সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি। নাও। হয়েছে তো’? রেঁনোয়া ঘাড় নেড়ে বোঝায় হয়েছে। বোঝাবুঝির পালাটা চুকে
গেলে যখন ডাক্তারের কাছে যায় ওরা দুজনেই, সব পরীক্ষা করে ডাক্তার জানায় একটাও নয়, দুটোও নয়, মোট
পাঁচ পাঁচটা সন্তান আছে শকুন্তলার গর্ভে আর সেটা শুনে শকুন্তলার অন্যবার একটা করে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় যে পরিমাণ
আনন্দ হয়েছিল এবার তার পাঁচ পাঁচ গুণ বেশি আনন্দে যেই লাফিয়ে ওঠার উপক্রম করে, অমনি রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী খপ করে তার
হাতটা ধরে ফেলে আর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেখেছেন ডাক্তারবাবু, ওর কোনদিনও আর কান্ডজ্ঞান
হবে না! ওকে নিয়ে আমি কি যে করি।‘
ডাক্তার হাসেন। তারপর যেদিন সময় এল, শকুন্তলার
পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা বিয়োনোর সময় আত্মীয়স্বজন আর পরিচিতরা উদ্বিগ্ন হয়ে এমন লম্বা
লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে হাসপাতালের বাইরে যে দিগন্তসেনার রাস্তাঘাটে গাড়ি
চলাচল বন্ধ হবার উপক্রম হয়। ওদিকে লোকজন মন দিয়ে কানে রেডিও
নিয়ে দিন পাড় করে দেয় ঠিকঠাক শেষ পর্যন্ত বাচ্চাগুলো এল কিনা আর তাদের মায়ের শরীর
স্বাস্থ্য, মরণবাঁচন পর্বটার ধারাবিবরণী শোনার জন্য। যখন জানা যায় সব কিছুই ভালোয়
ভালোয় মিটে গেছে, তখন বড় সড় একটা মিষ্টির কোম্পানি সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর উদ্যোগ
নেয় আর সেটার সমাধানও করে ফেলে। মানময়ী, অলঙ্কৃতা, অনঙ্গ আর সুদাম, উপমা আর
লগ্নলতা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর শ্যামাঙ্গী বলে, ‘আসলে
ব্যাপারটা হল, ও এবং একমাত্র ও-ই ঐতিহ্যগত জ্ঞানের শৃঙ্খল থেকে বেরাতে পেরেছে,
যেটা পারা খুব সহজ কাজ নয়, এমন কি আমিও তা অতিক্রম করতে পারিনি’।
সত্যি সত্যিই শ্যামাঙ্গীর মনের মধ্যে শকুন্তলার জন্য একটা সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধার বোধ কাজ করতে শুরু করে দেয়। শকুন্তলা কিন্তু এইখানে এসেও থেমে যায় না। কেননা আরও সাত সাতবার গর্ভধারণ করে এবং উন্নত বৈজ্ঞনিক কৌশলের সাহায্যে এইভাবে মোট চল্লিশজন শিশুর জন্ম দেয় যাদের মধ্যে পঁচিশজন মেয়ে আর পনেরো জন ছেলে আর মোট চুয়াল্লিশটা শিশুর জন্ম দিয়ে তাদের সার্থকভাবে মানুষ করে দিগন্তসেনা আর মূল ভূখন্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় যা কি না ভবিষ্যতে গোটা দেশটার জনজাতিকে সম্ভ্রমের সঙ্গে সুশৃঙ্খল ভাবে বেঁচে থাকার দিক নির্দেশ করার ব্যাপারেই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। তাদের প্রত্যেকেরই নাম হবে কোনও না কোনও স্বরবর্ণ দিয়ে এবং শেষ হবে কুন্তল দিয়ে। তাই প্রথম পাঁচ জনের নামকরণ করা হল অলকা, অনুভব, অন্তরা, অনিন্দিতা ও অনুরাগ এবং পদবী হিসেবে পেছনে জুড়ে দেওয়া হল ‘কুন্তল’। পরবর্তী সম্ভাব্য পাঁচজনের নাম ঠিক করে রাখা হল অতসী, অনন্যা, অজয়, অতনু, অদিতি আর তাদেরও পদবী হবে কুন্তল। তার পরবর্তী তৃতীয় সম্ভাব্য পাঁচ জনের নাম হল আহুতি, আনোয়ার, আনত, আবৃতা ও আগমনী এবং পরবর্তী চতুর্থ সম্ভাব্য পাঁচ জনের নাম হল ইচ্ছে, ইছামতী, ইলোরা, ইমন ও ঈপ্সিতা আর এদেরও সকলের পদবী হবে তাদেরই মায়ের নামের এক খন্ডাংশ – কুন্তল দিয়ে। এইভাবে পরর্বর্তী সম্ভাব্য পাঁচজনের নাম হবে উন্নতি, উপত্যকা, উন্নয়ন, উজ্জয়িনী ও উড়ান এবং পরবর্তী সম্ভাব্য পাঁচ জনের নাম হবে ঋতু, ঋতবান, ঋতিকা, ঋষভ ও ঋজু আর নামগুলোর পদবী হবে ‘কুন্তল’। আর একই নিয়ম মেনে সপ্তম সম্ভাব্য পাঁচ জনের নাম হবে এষা, এলা, এষণা, এক্ষণ, এনা এবং অষ্টম সম্ভাব্য পাঁচজনের নাম হবে ঐন্দ্রিলা, ঐতরেয়, ওদুত, ঈশান, ইতু। এদের সবার পদবীও হবে তাদের মায়ের নামের খন্ডাংশে – কুন্তল। শকুন্তলার যখন এদিকে কুন্তল বংশ পত্তনের কাজ ও কারবার চলেছে অত্যন্ত দম ও দ্রুততার সঙ্গে, তখন ওদিকে লগ্নলতা মেয়ে মেয়ে করে হেদিয়ে মরে। কিন্তু তবুও তার একটা মেয়ে হয় না। একদিন সময় সুযোগ দেখে সে এসে খপাৎ করে শকুন্তলার হাতটা ধরে আর তারপর চুপিচুপি, গোপনে, একেবারে ফিসফিসিয়ে সে শকুন্তলার কাছে জানতে চায়, ‘এই, ব্যাপারটা কি রে!’ তখন শকুন্তলা বলে, ‘কোন ব্যাপার?’ লগ্নলতা বলে, ‘এই যে এক চান্সে এত এতগুলো করে ছেলেমেয়ে পেয়ে যাচ্ছিস!’ তখন শকুন্তলা পুরো ব্যাপারটা ভালো করে খোলসা করে ওকে বলে কোনও রাখঢাক একেবারে কিছুই না করে। সবটা শুনে লগ্নলতা বোঝে যে তার এত দম নেই আর তার আর মেয়ে পাওয়াও হবে না। ঠিক সেই মুহুর্ত থেকেই সে তার বাকি জীবনের মত মেয়ে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে মাঝপথে রণে ভঙ্গ দেয়। আর ঠিক তখনই শ্যামাঙ্গীর কথাটা একবার সত্য প্রমাণ হয়ে যায় যে একমাত্র শকুন্তলারই ঐতিহ্যগত জ্ঞানের শৃংখল ভেঙে বেরাবার দম আছে। আর কারুরই তা নেই এই কারণে সেই কাজটা খুব কঠিন আর তেমন কর্মীও খুবই বিরল, শুধু আজ নয়, গোটা সভ্যতার ইতিহাসে চিরকালই। এর মধ্যে শকুন্তলা কাজের ফাঁকে আরও দুবার গর্ভধারন করে আরও দশটা সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায় শুধু নয়, সাঁতরে যেন দুনিয়াটা এপার ওপার করতে থাকে অবিরাম। ওর অতর্কিত হানায় মূল ভূখন্ডের গোটা অংশটাই এমনকি সরকার থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও বেশ কিছুটা যেন তঠস্থ হয়ে থাকতে শুরু করেছে। মন্ত্রীদের ভাতাও কমে গেছে আর এক একজনের পেছনে সাত আট জন করে সান্ত্রী পোষার ব্যারামটাও উড়ে গিয়ে পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেছে। নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব-এর মধ্যে এইরকম একটা অধ্যাদেশ জারি করে দেয় সে যে যারা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ব্যাপারে যত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবে দলের পক্ষ থেকে তাদের সমর্থন করা হবে এবং তাদের সেইসব কাজে সাহায্য করা হবে। এইভাবে মূল ভূখন্ডের রাজনৈতিক দলের কাজকর্মের সার্বিক পর্যালোচনা করে বার বার সেটা সর্বসমক্ষে সে জানাতে শুরু করল। দলের কর্মীদের মধ্যেও সেই বোধ সঞ্চারিত করল আর তারা আবার বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে সেইসব ব্যাপারগুলোকে চারদিকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করল। এইভাবে একধরনের জনজাগরণ তৈরী হল। যখন দলেরই একজন মহিলা কর্মীর ওপরে একদিন নির্যাতন আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটল, তখন প্রতিবাদের যে ভয়ঙ্কর চেহারা দেখা গেল তাতে দলীয় সমর্থক সংখ্যা এক ধাক্কায় কয়েকগুণ বেড়ে গেল। মেয়েটির নাম পৃথা। সে যখন দলের কাজ করে রাতে বাড়ি ফিরছিল, তখন ওপর তার চড়াও হয়ে কয়েকজন অত্যাচার ও ধর্ষণ করে। সে এসে সোজা শ্যামাঙ্গীকে জানায়। শ্যামাঙ্গীর থেকেই শকুন্তলা জানতে পারে আর সে সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী দুদিনের মধ্যে দলের সবাইকে জানিয়ে দেয় যে তৃতীয় দিন সোমবার তারা সকাল দশটা থেকে দশটা কুড়ি মিনিট অব্দি প্রতিবাদ হিসেবে কর্মবিরতি পালন করবে। সেটা সব জায়গায় প্রচার করা হল দিগন্তসেনার বেতার, দুরদর্শন মারফত। আর সেইদিন সকালে অন্য দিনের মতই সমস্ত মানুষ তাদের জীবনপ্রবাহ শুরু করল। ঠিক দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দলের প্রত্যেকে এবং দলীয় সমর্থকরা যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল সে সেই অবস্থায় স্থির হয়ে গিয়ে তার নিজের কাজটুকু মাত্র কুড়ি মিনিটের জন্য বন্ধ করে দিল। গোটা একটা ভূখন্ড, তার সমস্ত জনপদ, তার নিত্যনৈমিত্তিক জীবন প্রবাহকে মাত্র কুড়ি মিনিটের জন্য হলেও যে সেদিন স্তব্ধ করে দেওয়া গেল সেটা অবশ্যই একটা সাফল্য আর তাতে কেউ কেউ উজ্জিবীত। বেতার দূরদর্শনে প্রচারের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে বলা হল যে ওরা আজ সমস্ত জীবনপ্রবাহকে অতি সামান্য সময়ের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল শুধু এটা দেখাতেই যে এই অল্প মুহুর্তেই তার চেহারাটা কি সাংঘাতিক পরিস্থতি তৈরী করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং এর ভবিষ্যৎটা কত ভয়ানক, ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে যদি ওদের দাবী মাফিক অত্যাচার, ধর্ষণ মেয়েদের ওপর থেকে তুলে নেওয়ার কোন একটা পাকাপাকি ব্যাবস্থা না করা হয়। শুধু এই একটা কারণকে কেন্দ্র করেই দলের সদস্য সংখ্যা অবিশ্বাস্য ভাবে বাড়তে শুরু করল। ড্রাইভার, কনডাক্টর, মুদি দোকানী, চাল ও সবজি বিক্রেতা, ফুলের মাসিরা, গৃহবধূ, কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রীরা, ব্যাঙ্কের কেরানীরা থেকে ম্যানেজার, পোষ্টমাস্টার, দুধওয়ালী, বাজারবিক্রেতা, আনাজপাতি নিয়ে বসা মাসিরা সবাই এসে লাইন দিল সদস্যপদের জন্য। পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রনের জন্য আর ব্যাপারটা যাতে স্রেফ হুজুগে পরিণত না হয় তার জন্য দলীয় কর্মীরা জানায় আগামী সপ্তাহের সোমবার থেকে সদস্য পদের জন্য আবেদন পত্র দেওয়া হবে ও এক সপ্তাহের মধ্যে জমা দিতে হবে সেটা পূরণ করে সঙ্গে দশ টাকা করে দিয়ে এবং তার পরের মাসের দশ তারিখ থেকে সদস্যপত্র হিসেবে কার্ড দেওয়া হবে। তাতে ছবি লাগিয়ে আবার এখানে এসে এখান থেকে তার ওপর দলের স্টাম্প লাগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আড়ালের সত্যটা আসলে এই নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব-এ এর আগে আদৌ এইসব ব্যাবস্থা ছিল না। লোকজনের সদস্যপদের জন্য ভিড় দেখে চৈতির মাথায় হঠাত বুদ্ধিটা খেলে যায় আর অমনি সে এক সদস্যকে শিখিয়ে দেয় ওই কথা গুলো আর সে গিয়ে কথাটা গম্ভীর ভাবে বলে দেয়। আনুষ্ঠানিক সদস্যপদের ব্যাবস্থাটা এভাবেই চালু হয়ে যায় দলে যেটা কিনা আগে পারস্পরিক চেনাজানার ভিত্তিতেই চলে আসছিল। শ্যামাঙ্গী তার দলের সদস্যদের হাতের তালুর রেখার মতই চিনত, খুব বেশি সংখ্যক সদস্যদের সবার পক্ষেই ওই ভাবে চেনা সম্ভব হত না। খবরটা শুনে শ্যামাঙ্গীর খুব ভালো লাগল যে পরবর্তী প্রজন্ম কি সুন্দর একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। কেননা শ্যামাঙ্গী তো জানে এ লড়াই এক দিনে, এক বছরে বা এক জীবনে শেষ হবার নয়। ও যতদিন পারবে, যতটা পারবে এটা চালিয়ে যাবে। তারপরও তো কাউকে হাল ধরতে হবে। উত্তরসুরী চাই। উত্তরসুরী না হলে কোন প্রবাহই চলতে পারে না। মাঝ পথে সে থেমে যাবে। তখন প্রথম লড়াইটাও মূল্যহীন হয়ে যাবে।
আগমনীকে নাকি পুপু আর সামলাতে পারছে না। এমনিতেই ওকে গানের জন্য নানা জায়গায় এদেশে ওদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। মেয়েটা বেশির ভাগ সময়ই মায়ের চাইতে বাবাকে বেশি কাছে পায়। কিন্তু রবার্টেরও তো কাজ ও ব্যাস্ততা থাকে। তাই ওর জন্য গবরনেস রাখা হয়েছে। কিন্তু ওর উদ্ভট উদ্ভট চিন্তা আর কাজকর্মে গবরনেসেরও পাগল হবার দশা। আগমনী তার বাবার কাছ থেকে আঁকা আর মায়ের কাছ থেকে গান দুটোই শিখেছে। গত ক’বছর ধরে স্কুলে যাওয়া থেকেই ও ঠিক করেছে যে ও ইতিহাসবিদ হবে। কেননা একদিন শ্রাবণ সোফিয়া আর সাসাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। আগমনীর জোড়াজুড়িতেই ওরা কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে বাধ্য হয় আর তখনই সোফিয়ার সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে যায়। সোফিয়ার কাছ থেকে নানা মানুষের নানা গল্প শোনে। আর তখনই সে তার ইতিহাস প্রেমটাকে সমাজতত্ববিদের মত করেই ইতিহাসবিদ হওয়া অব্দি টেনে নিয়ে যায় শুধু নয়, ও নাকি ওদের কাছে জানতে চেয়েছে সেটা হয় কিনা। ওরা ওকে বলেছে হয়। আর তারপর থেকেই সে একটু একটু করে ইতিহাসবিদ হয়ে উঠতে শুরু করে। রাজ্যের যত সব বড় বড় মোটা মোটা বই জোগাড় করে সেই বই খুলে বসে থাকে। অথচ ওগুলোর একটি অক্ষরও ওর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ও খালি গবরনেসকে বলে বই এনে দিতে আর বইয়ের নাম খুঁজতে ইন্টারনেট থেকে। এইভাবে বই জোগাড় করতে করতে বাড়িটাকে একটা আস্ত বইয়ের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে। সারাক্ষণ সাংঘাতিক একটা বিজ্ঞের মত হাবভাব করে গোটা বাড়ি পায়চারি করে বেড়ায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে। একদিন স্কুলের একজন বাড়িতে এসে ওর খোঁজ করে। ও তার সামনে গিয়ে গম্ভীরভাবে নিজের পরিচয় দেয় যে সে-ই ঐতিহাসিক আগমনী জয়েস। তারপর তার কাছে জানতে চায় যে সে রোমান আর ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সম্পর্কে কী জানে আর কোনটাকে শ্রেষ্ঠ বলে ভাবে। যখন ও জানতে পারে যে তার বিষয় অঙ্ক, তখন আগমনী তাকে অঙ্ক শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে কতটা কী জানে জিজ্ঞেস করে। সে বেচারা অঙ্ক জানে, কিন্তু তার ইতিহাস জানা নেই। তখন সে রীতিমত বড় সড় কিছু লেকচার দেয়, মানুষ কীভাবে প্রথম অঙ্ক শুরু করে এবং কেন করে। গ্রেকোরোমান সভ্যতায় সেই শিক্ষা কীভাবে অন্যান্য জিনিসের জানার ব্যাপারে কাজে লেগেছে। আরবরা অঙ্কশাত্র সম্পর্কে কতটা কী জানত? আর নতুন কী কী তাতে যোগ করেছিল। শেষে বলে তাকে যে পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার নাম – হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা, গ্রীক ও রোমান সভ্যতা, আর লাতিন আমেরিকার তিনটি সভ্যতা – মায়া, আজতেক ও ইনকা সভ্যতার মানুষরা কতটা অঙ্ক জানত সেইসব। যে শিক্ষক বাড়িতে এসেছিল, সে ওর সব কথা শুনে আর বাড়ি ভর্তি বইয়ের স্তুপ দেখে ও সেগুলোর নাম লিখে নিয়ে তড়িঘড়ি স্কুলে গিয়ে ব্যাপারটা জানায়। এরপর একদিন পাঁচজন শিক্ষক আসে যাদের একজন ইতিহাসের, একজন গণিতের, একজন দর্শনের যদিও স্কুলে ইতিহাসটাই পড়ান, একজন ভাষাশিক্ষার আর একজন হেড মিস্ট্রেস। তারা তাকে বলে ইতিহাস, অঙ্ক, বিজ্ঞান এসব বিষয়ে ওর কাছে কিছু শুনতে চায়। আগমনী অবলীলাক্রমে এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট ধরে সব কিছু নিয়ে একটা পাঁচমেশালী ঘ্যাট তাদের শ্রুতিগোচর করালে তারা চলে যায়। আগমনীর নামে বক্তৃতার আসর বসায় স্কুলে। তারপর তাকে বক্তৃতা দিতে ডাকে। সে যায় ও চরম আত্মবিশ্বাসের নজির গড়ে এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিটের একটা বড় সড় বক্তৃতা দেয় আর শিক্ষকরা সেটা সংরক্ষণ করে গান সংরক্ষণের মত করে। এরপর নানা জায়গা থেকে ওর বক্তৃতার ডাক আসতে থাকে আর ও সেসব জায়গায় গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে আসে। পরিচিত একজন ইতিহাসের শিক্ষক তো ওকে নিয়ে রীতিমত পাগল। কেননা তিনি ওকে মনে করেন স্কুলের এবং দেশ ও দশের সম্পদ এক শিশু দেবদূত। কিন্তু যেগুলো ওর জানার কথা নয় সেগুলো ও ওই বয়েসে জানল কী করে – এখন এটাই হচ্ছে পুপু ও রবার্টের একমাত্র প্রশ্ন। আর ও যে ধরনের জীবনযাপন করছে তাতে ওর স্বাভাবিক জীবনযাপন ও বেড়ে ওঠা ভীষণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে যেটা ওর ক্ষতি ডেকে আনতে পারে ভবিষ্যতে। তাছাড়া ও বক্তৃতায় যেগুলো বলছে সেটা কতটা সত্যি আর কতটা মন গড়া এসবও পুপু বা রবার্ট কেউই বুঝতে পারছে না কিছু। আপাতত সাতদিনের ছুটিতে ওরা দিগন্তসেনায় বেড়াতে আসছে। ওরা এলে একদিন বাড়িতেই ছোট কজনের আড্ডা আর খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা করে শ্যামাঙ্গী। আবাসিক বিদ্যালয়ের কজন ইতিহাস আর মনবিদকেও ডাকা হল। আসল উদ্দেশ্য আগমনীর ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করা। সবাই এলে সবার সামনে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর সবাই ওকে যেগুলো জিজ্ঞাসা করল সেগুলো বলল। তারপর সকলে খাওয়াদাওয়া করে যে যার মত চলে গেল। দুদিন পরে পারস্পরিক যোগাযোগের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস শিক্ষকরা ডাক্তাররা মিলে সমস্যাটা সমাধান করে ফেলল। যে কথাগুলো আগমনী বলেছে সেগুলোর তথ্যগত সত্যতা প্রমানিত। তবে ওগুলো ও কোথাও পড়েছে বা শুনেছে। আর তার সঙ্গে মিলে মিশে আছে ওর গভীর ও প্রখর কল্পনাবোধ। সেই জন্যেই এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলে। তাছাড়া এটা ওর কাছে একটা খুব আকর্ষনীয় খেলা। তাই এইখানে আঘাত করাটা কখনই উচিত হবে না। ওকে বোঝাতে হবে যে তুমি এগুলো করছ কর। কিন্তু তার পাশাপাশি তোমাকে অন্য বাচ্চারা যেগুলো করে সেগুলোও করে যেতে হবে। একমাত্র তাহলেই তোমার এই জিনিসটা ভালোভাবে ভবিষ্যতে আরও বেশি করে করার সুযোগটা তুমি পাবে। সব কিছু শুনে আর বুঝে সপ্তাহান্তে পুপু আর রবার্ট তাদের একমাত্র সন্তান আগমনীকে নিয়ে ফিরে গেল যদিও আসার সময় ওরা ভেবেছিল যে আগমনীকে ওরা এখানেই রেখে যাবে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন