ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(২৬)
সেদিকে তাকিয়ে মেহুলী বলে উঠল,
কয়েকটা কথা ক-দিন ধরেই মনে হচ্ছিল, তাই বলছি।
বিশ্রুত অপেক্ষা করতে লাগল। তার
হৃদয়ের স্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে সে। পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে
পড়ছে। কী মুগ্ধ চোখেই না সে তাকিয়ে থাকত মেহুলীর দিকে সেই দিনগুলোয়।
মেহুলী বলতে শুরু করেছিল, দিশারী
কি তোকে সুখী করতে পারবে? আমি দেখেছি ও নিজে খুবই স্বাধীনচেতা। কিন্তু পদে পদে অন্যের
স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। নিজের মতো করে তোকে চালাতে চায়। তোর ওপর অধিকারবোধ ফলায়।
ওকে ছাড়াও যে তোর একটা আলাদা, নিজস্ব জীবন আছে, সেটা ও কোনও দিন মেনে নিতে পারবে না।
তাছাড়া ওর মধ্যে রয়েছে অসম্ভব ইগো। ও অল্পবয়সে মা-বাবাকে হারিয়েছে। নিজের একটা সামাজিক
প্রতিষ্ঠার জন্য অসম্ভব লড়াই করেছে। লক্ষ্য স্থির করে বসে আছে। দিশারী জানে ও যেখানে
কমজোরি, সেই সমস্ত জায়গাই শক্তপোক্ত হতে পারে যদি একবার ও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। নাচে
সাফল্য পাওয়াটা তাই ওর কাছে এত জরুরি। নিজের সামাজিক প্রতিষ্ঠাকে তাই এত গুরুত্ব দেয়
ও।
বিশ্রুত দিশারীর পক্ষ নিয়ে বলে
ওঠে। বলে, মনে রাখিস দিশারী শ্রমণের ছোটোবেলার বন্ধু। শ্রমণকে দেখেই নিজেকে ও অনেকটা
গড়ে তুলেছে।
তার ফল কী হয়েছে? লোকে শ্রমণকে
দিয়ে ওকে বিচার করতে যায়। কিন্তু ও হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের এক মানুষ। শ্রমণ
উদার দিলখোলা পরোপকারী সরল। জীবনের যে কোনও সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। দিশারী
আত্মকেন্দ্রিক, সতর্ক, হিসেবি। শ্রমণের ব্যর্থতাগুলো থেকে সবার অজান্তে, চুপচাপ সন্তর্পণে
ও শিক্ষা নিয়েছে। আর নিজেকে তৈরি করেছে সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচে। যাতে শ্রমণের মতো ওকেও
কেউ ব্যবহার না করতে পারে। শ্রমণকে যে ব্যবহার করবে, শ্রমণ ছুটে গিয়ে তার বেশী বেশী
উপকার করে আসবে। তাকে নিজের সমস্ত ভালোমানুষী উজাড় করে দিয়ে আসবে। বেশী বেশী করে তাকে
সম্মান দেখাবে। দিশারী কিন্তু তাকে বুঝিয়ে দেবে কোথায় তাকে থামতে হবে আর তার প্রয়োজনের
চেয়ে বেশী একটি শব্দও ব্যবহার করবে না। দিশারী যত বাধা পেয়েছে তত আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী
হয়ে উঠেছে। শ্রমণ যত বাধা পেয়েছে, তত আরও মানবিক হয়ে উঠেছে।
বিশ্রুত মেহুলীর মুখের দিকে তাকায়।
মুগ্ধতা ওর ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মেহুলী ওর চোখে ক্রমেই আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
মেহুলো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তারপর বলে, দিশারীর ব্যপারটা আমি বুঝি। কিন্তু গোটা ব্যপারটা ওকে মানসিকভাবে অসুস্থ
করে তুলেছে। ও এক মিনিটের জন্য ভুলতে পারে না যে, ও এমন একজন নর্তকী যার নামডাক আছে।
কিছুদিন আগে সমধার মা ওকে একটি কাগজে সই করতে বলেন। বোধহয় কোনও কিছুর সাক্ষী হিসাবে।
ও নামটা সই করে পাশে লেখে নর্তকী। ব্যাপারটা সবারই চোখে পড়েছে। এখন থেকেই এই প্রফেশন্যাল
মনোভাব। এমনকী বন্ধুর মা-র একটা তুচ্ছ অনুরোধ রাখতে গিয়েও। তোর ক্ষেত্রে এ তো ভাবাই
যায় না। ও যেন সবসময় নিজের গায়ে নর্তকীর অদৃশ্য পোশাক চাপিয়ে বসে আছে। যেন দেখলেই ওর
যোগ্যতা লোকে বুঝে যায়। ওর সাফল্যে সবার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ওই পোশাকটাই যেন হয়ে উঠেছে
ওর পরিচয়। শুনেছি নাচের পোশাক পরেই ও নাকি রাতে বিছানায় শোয়। এই পোশাকে ওর কাছে নিজের
জীবন, প্রিয়জন, বন্ধু, আত্মীয় সম্পর্ক সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে গেছে। তোকে এর জন্য সারাজীবন
ভুগতে হবে। এখন ও প্রেমে মজে আছে। ঘোরে আছে। এই ঘোর কেটে গেলে রোজকার জীবনে ও তোকেও
ছাড়বে না। প্রতি মুহূর্তে তোকে বুঝিয়ে দেবে তোর চেয়ে ও কিছু কম যায় না। বন্ধু প্রেমিক
স্বামী অর্থাৎ বাকি সব পরিচয় তুচ্ছ হয়ে যাবে। তুইও তখন ওর চোখে একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই
হয়ে উঠবি। সারা জীবন ধরে ওর এই নর্তকী হওয়ার সাফল্য আর যোগ্যতার দাম দিয়ে যেতে হবে
তোকে।
আর এই দাম খুব কম হবে না।
বিশ্রুত মাথা নীচু করে বসে থাকে।
ব্যাপারগুলো ওকেও ভাবিয়েছে। মেহুলী ওকে যুক্তি দিয়ে ভাবাতে চাইছে। দিশারীর প্রেম ওকে
ভাসিয়ে দিতে চাইছে। সেখানে কোনও যুক্তিই চলে না। ও কোন দিকে যাবে? হয়ত অন্য কেউ এইসব
যুক্তির কথা শোনালে ও গ্রাহ্যই করত না। কিন্তু মেহুলী যখন এইভাবে আলাদা করে ডেকে ওকে
ওকে এসব কথা শোনায় ব্যাপারটা তখন অন্যরকম দাঁড়ায়। যুক্তিগুলো ওকে শুনতেই হয়। আর সেগুলো
উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। যথেহট সারবত্তা আছে সেগুলোয়। কিন্তু মেহুলীই বা ওকে এসব বলছে
কেন? এইভাবে ওকে সম্মমোহিত করতে চাইছেই বা কেন? একটার পর একটা শব্দ কিন্তু শব্দগুলো
যেন মাঝে মাঝেই নিজেদের মানে হারিয়ে ফেলছে। সেগুলো ওর কানের কাছে এসে গুণগুণ করছে,
তারপর মেহুলীর মুখের ছায়ায় গুড়োগুড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছে। ওই মুখ ছাড়া সব কিছুই অস্তিত্বহীন
হয়ে যাচ্ছে তার কাছে।
সমধা সেদিন বলছিল, মেহুলী বলে
চলে, তোর পক্ষে একটা সাধারণ মেয়েই অনেক ভালো ছিল। শান্তিতে থাকতি তুই। ছোটছোট ব্যাপারে
নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা নিয়ে লড়তে হত না। জেতা-হারা নিয়ে ভাবতে হত না। অনেক বেশী ওপন স্পেস
পেতি। ভালোবাসাটা হত অনেক নির্মল। সম্পর্কটা অনেক সহজ। স্বাধীনতাও অনেক বেশী পেতি।
তুই কিন্তু ভুল করছিস...
আমার আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই।
বিশ্রুত আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলে ওঠে।
নেই! সত্যি তুই তাই ভাবিস নাকি?
ঝাঁঝিয়ে ওঠে মেহুলী, সব ব্যাপারেই তুই কেমন হার মেনে যাস। তোর মধ্যে সেই কিলার ইন্সটিংক্টটাই
নেই। আরে, মানুষকে অনেক নিষ্ঠুর হতে হয়, বেপরোয়া হতে হয়, হিসেবী হতে হয়, নিজের ভালোর
জন্য কোনও আপোশ করলে চলে না। ক-দিনের সম্পর্ক তোদের? এরকম সম্পর্ক ভুরি-ভুরি ভেঙে যাচ্ছে।
আমার তো ওই ফুলের বাগানের ব্যাপারটাও মাথায় আসে না। সব কৃতিত্বটাই নিয়ে যাচ্ছে একা
হৃদয়। অথচ তোর অবদান কি কিছু কম না কি? আমার তো মনে হয় হৃদয়ের চেয়ে অনেক বেশী। তোর
মেধা, তোর শ্রম, তোর ত্যাগ এসব ছাড়া কোথায় থাকত এই বাগান এতদিনে? অথচ সবাই শুধু হৃদয়ের
কথা বলে। তোর কথা কেউ বলে না। সেদিন হৃদয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তোদের ফুলের বাগানটা
দেখতে গেছিলাম। ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ দেখাল। খুব খাতির করল আমাকে। তারপর বলে উঠল, ভালোই
বানিয়েছি তাহলে! চমকে উঠলাম আমি। লোকে ওকে এমনভাবে সব কৃতিত্ব দিচ্ছে ও নিজেও ভাবতে
শুরু করেছে যা হয়েছে সব ওর জন্যই হয়েছে। ওর প্রশ্নটাকে আমল না দিয়ে আমি বলে উঠলাম,
ফুলের বাগানের এই ব্যাপারটা তুই দেখিস একজন বিশেষজ্ঞের চোখ দিয়ে, কারিগরের চোখ দিয়ে।
কিন্তু বিশ্রুত দেখে একজন প্রেমিকের চোখ দিয়ে, শিল্পীর চোখ দিয়ে। খুব নরম সেই দেখার
চোখ, কাঠখোট্টা নপয়। আমার মনে হয়, তোদের এই সাফল্যের পিছনে বিশ্রুতর অবদান সবচেয়ে বেশী।
বিশ্রুতই এই ফুলের বাগানে প্রাণসঞ্চার করেছে। তোর স্বপ্ন সফল হয়েছে বিশ্রুতর মতো শিল্পীকে
পাওয়ার জন্যই। প্রেমিকের হৃদয় আর শিল্পীর নান্দনিকতা দিয়ে ও একে গড়ে তুলেছে। এসব শুনেই
হঠাত কেমন গম্ভীর হয়ে গেল হৃদয়, সেভাবে আর কথা বলছিল না আমার সঙ্গে, কেমন যেন এড়িয়ে
এড়িয়ে যাচ্ছিল...।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন