বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি (থিয়েটার কাব্যনাট্যচর্চা)




 

প্রতি

একুশ শতকের একটি গ্রুপ থিয়েটার মানে নাট্যের দল প্রযোজনা করতে উদ্যোগী হয়েছে কাব্যনাট্য। দলের নাম কথাকৃতি। নির্দেশক সঞ্জীব রায়ের তত্ত্বাবধানে এমনতর এক প্রয়োগ হতে চলেছে জেনে খুশি হলাম।  নাটক 'প্রথম পার্থ'। যিনি কাব্যনাট্য রচয়িতা তিনি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু। বা বলা চলে, যার কলমপ্রসূত এই সৃজনশীলতা – তা রবীন্দ্র-সময়ের অনতিকাল দূরের। যখন রবীন্দ্রনাথ নেই ও রয়েছেন। এ হল কাব্যের এক দিক। আর থিয়েটারের জন্যে নাট্য। দুই জুড়ে কাব্যনাট্য। থিয়েটারের বা সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চার এক বিষয়-রূপ হল কাব্যনাট্য।

বাংলাভাষার জন্ম থেকেই ঋণ সংস্কৃত ভাষার কবি ও নাট্যকারদের কাছে। এক তরফে দেখলে বিষয় সাহিত্যের রূপ বর্ধিত করতে নাট্যকারদের এক প্রজন্ম তৈরি হওয়ার প্রাককাল। বাংলা নাট্যকে রবীন্দ্র-নাট্য ব্যতীত চর্চা ক্ষেত্রে কাব্য ও নাট্য উভয় গুণে সমৃদ্ধ করে তোলা – কতিপয় রচনাকাদের দ্বারাই সম্ভবপর হয়। কবি মানেই কাব্যনাট্য লিখেছেন – তা হয়নি। আবার নাটক- রচয়িতা মানেই যে তিনি কাব্যময়তার আস্বাদিত করবেন –তাও নয়। বিশেষত এক এমন সময় যখন বুদ্ধদেব বসু সফল কবি, গল্পকার তথা সাহিত্যের পূর্ণগ্রহ। এবং তিনি তাঁর সৃজনশীলতার শেষদিকে এসে কাব্যনাট্য লিখছেন। এবং 'প্রথম পার্থ' রচিত হয়। তারও কিছুকাল আগে অর্থাৎ আরও ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে মিলবে এমন এক তথ্য যেখানে --  বিশ্বখ্যাত কবি, কবিগুরু সাগ্রহে   লেখেন তাঁকে নিয়ে। তারিখ ১৩৩৮ বাংলাসনের কার্তিক মাস।  'বিচিত্রা'। অগ্রজ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনুজ কবি বুদ্ধদেব বসু। যিনি তখন সবেমাত্র তৈরি হচ্ছেন। অগ্রজ কবি খুবই আশাবাদী ছিলেন উল্লেখ অনুজ কবির বিকাশ নিয়ে। এই সময়ের নিরিখে কবিতা পাঠ থেকে অনুমান করার কারণ ছিল। যা রবীন্দ্র-লিখনে " ...  ছন্দ , ভাষা, ভাবগ্রন্থনের " পরিচয়, যা এক কবির আত্মপ্রকাশের সূত্রকথা। যা কবিকে 'খুসি' করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'খুসি' এই বানানে। এবং তিনি এই খুসির কারণ কবিতার জন্যে, তায় ব্যক্ত করেছেন। এখানেই কাব্যময় এক স্মৃতিপথ – যেখানে বর্তমানের সঙ্গে আদিকালের যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায়। এবং কবে থেকে শুরু হয়ে আসা কাব্যাশ্রয়ী নাটকের পথ, তাও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুব প্রাচীন কিছু না। লেখক বুদ্ধদেব বসু-র শাব্দিক কাব্যাঞ্জলির একদিকে ' মায়া-মালঞ্চ' (১৯৪৪), 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী' (১৯৬৬),'কলকাতার ইলেক্ট্রা ও সত্যসন্ধ' (১৯৬৮)। এবং শেষতম রচনাটি  'অনামী অঙ্গনা ও  প্রথম পার্থ' (১৯৭০) --- পর্যন্ত রচনাসমূহ সাহিত্যের সেই বাতায়ন বহন করে, যার শুরু রবীন্দ্রনাথ দ্বারা। কাব্যতা এক ধরণ যেখানে নাটক লেখার পর – তা নাট্য হতে পারে কিনা, সেই আলোচনা চলে। নাট্য এহেতু ব্যবহারিক এক শিল্পচর্চা, যা সাহিত্যে সংলগ্ন হলেও, মঞ্চায়ন ব্যতীত নাটক শুধুই পাঠের, পাঠকের। এবং নাট্যে তা পৌঁছতে গেলে, লাগে মঞ্চাভিনয়, যেখানে পারফরমেন্স হল শেষ কথা। কাব্যনাটকের রবীন্দ্র-আলোচনার আরেকটি সার্থক কবিসত্তা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু – নাটক লিখেছিলেন। যেখানে প্রাক – আধুনিক সময়েই কাব্যানুপাতিক নাটক ও নাট্যের চর্চা ছিল অধিক। সেই আলোচনার সুতো ধরেই চলে আসা একুশ শতকের সাহিত্য – সংস্কৃতির বৃত্তে। যেখানে দীর্ঘ সংলাপ বর্জনীয় করে ভাষা এগিয়ে চলেছে নাট্য ঘরানাকে নিয়ে। যেখানে নাট্য রয়েছে কিন্তু কাব্যধারা অন্তর্হিতপ্রায়। এমনি এক মুহূর্তে একটি থিয়েটার দল কেন বেছে নেয় কাব্যনাট্য। যা আয়ত্তে আনা কঠিন। সঙ্গে অভিনয়ের স্বাতন্ত্র। চরিত্রের জন্যে হয়ে ওঠা। বা নাট্যের সঙ্গে নাট্য অভিনয়ে মেতে ওঠা। প্রাণ যেখানে অতি সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর রূপে ভাষার রূপ খুঁজছে। অণু কবিতা ও অণুগল্পের জাঁক। ভাগ্যিস কাগজে আর লেখা হয় না অধিক। এখন মেশিনে এক-দুই-চার-চারশো পাতার লেখার রকমফের হয় না পৃষ্ঠার খরচে। যে লেখার শুরুতে এমনই ছিল। পাতা খরচ বুঝে লেখো, পাতা বাচাও ইত্যাদি। কিন্তু যখন সেই সাদা আয়তনের চেনা খসখস পৃষ্ঠা রইল না, তখন বেশি লিখলে খরচ নেই তেমন --- তবুও রচনা, সৃজনের শব্দগুচ্ছ কেমন যেন অণু হতে পরমাণুতে। সেখানে কাব্যনাটক চর্চা। মানে, প্রথমে পড়া, শোনা, বোঝা এবং তারপর অভিনয় করা। একুশ শতকে কলাকুশলীদের জন্যে এও বড় কথা। অভিনয়, যা আসলে নয়, তা আয়ত্তে আনতে আনতে যেখানে অভিনেতাদের একত্রে রিহার্সালের সময় মিলেও মেলে না, সেখানে এমন কাব্যনাট্য অভিনেয় হচ্ছে কেন। তাইতে নির্দেশক সঞ্জীব রায়কে জিজ্ঞেস করা গেল,

 প্রশ্ন  -  'প্রথম পার্থ' কেন?

উত্তর – 'প্রথম পার্থ'- থেকে অংশবিশেষ নিয়ে এই স্ক্রিপ্ট তৈরি করা হল। নাম রাখা হয় ' প্রচ্ছন্ন জননী'।

প্রশ্ন  -  কেন?

উত্তর -  কেন নয়? কাব্যনাট্য তো অভিনেতা প্রস্তুতির এক বিশেষ ধাপ। দলের অভিনেতাদের অনেকেরই নাটক ভালবেসে নাটক করতে এগিয়ে আসা। অথচ, তাঁদের শিক্ষা বিবিধ বিষয়ের। যেমন, বিজ্ঞান, কলা, মনস্তত্ব, বাণিজ্য এবং পেশায় চিকিৎসক পর্যন্ত। কারণ, তাঁরা নাটক করতেই চান। বুঝতেই পারছেন, তাঁদের সবাই সাহিত্যের পড়ুয়া – পাঠক নন। ফলে, নাটক করতে গিয়ে কাব্যনাট্য পড়া হয়, বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে জানা হয়। অনেকেরই পড়া – জানার পর, স্মৃতির ব্যায়ামের জন্যেও বেছে নেওয়া হয়। দলের সদস্যরা একবাক্যে স্বীকার করেন যে, কাব্যনাট্য অভিনয় করতে হবে। জানি এই কাজ সহজ নয়। কিন্তু না করে বসে থাকলে তো হয় না। কাজেই করার উদ্যোগ নেওয়া। সবাই জানেন,  কাব্যপ্রধান নাট্য একটা ব্যায়াম হয়। যা কলাকুশলীদের স্বর, উচ্চারণ, শব্দাঘাত সঠিক করতে পারে। থিয়েটারের গ্রামার মেনে নিলে, কাব্যনাট্য প্রযোজনা হওয়া উচিৎ। আরেকটা কারণ হল, টেক্সট-টা। যেটা মহাকাব্যকেন্দ্রিক পুনঃ-নির্মাণের ভাবনা। যা নাটক পাঠের সময় একরকমের অভিনয় হয়। আবার নাটক আত্মস্থ করে যখন শারীরিকভাবে অভিনয় করা হয়, তখন আরেকভাবে উচ্চারিত হয় বা প্রকাশিত হয়।

প্রশ্ন  -  মানে, বলা যায় তাহলে এসবই প্র্যাকটিস অফ পারফরমেন্স ?

উত্তর  -  নির্দেশক সঞ্জীব রায় একটু চুপ করে বললেন, প্রথমে আমাদের রিহার্সাল দেখতে আসুন। তারপর শো তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমি, কলকাতা-য়।

অসমাপ্ত কথার সূচনার জন্যে কথাকৃতি দলের রিহার্সাল দেখতে হয় উল্লিখিত নাটকটির।

নির্দেশকের ভাবনায় নাট্যকে ধরা হয়েছে – কর্ণ সূর্যস্তব শেষ করে। দেখতে পায় এক নারীকে। যিনি কুন্তী। অজ্ঞাত ব্যাক্তিকে কর্ণের দান করার কথা সর্বজনজ্ঞাত। এক্ষেত্রে অজ্ঞাত ব্যাক্তি এক নারী, অর্থাৎ কুন্তী, যে নারী আত্মপরিচয় দানে ইচ্ছুক হয়। মহাভারতেরকাহিনি। যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। এবং দুই চরিত্রকে ধরে লিখছেন তৎ-পরবর্তীতে বুদ্ধদেব বসু। উক্ত কাব্যনাট্যটির অংশ বেছে নেওয়া হয়েছে। যেখানে কর্ণ চিনতে পারছে কুন্তীকে। পরিচয় হয়  এবং একটি ক্লাইম্যাক্স তৈরি হয় – যেখানে কর্ণ 'ভাসিয়ে দিয়েছিলে' উচ্চারণে, দর্শক-উপলব্ধ দুঃখে প্লাবিত হতে ইচ্ছে করার। কুন্তী বলতে চায় ...'কাল প্রবাহ'। পূর্ব –নির্ধারিত নিয়তি, যেখানে মানুষের কিছুই করার থাকে না। থিয়েটার প্র্যাকটিশনারদের ক্ষেত্রে এইরকম চরিত্র অভিনয়ে আশ্চর্যের কিছুই নেই। এও গ্রীক নাটকের পুনরাবৃত্তি, যেখানে নিয়তির নির্ধারণে চরিত্রের দুঃখ বা ট্র্যাজেডি। সেই তো ফিরে দেখার একুশ শতকের সংস্কৃতির পাঠশালায়। দিন দুই নাট্য-নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখা হল। কুন্তী-চরিত্রের উচ্চারণ যথাযথ। জিজ্ঞাসা করলাম, বাচিক শিল্পী? জানলাম, নিয়মিত শ্রুতি-মাধ্যম্যে অভিনয় করে থাকেন। রেডিওতে তিনি নিয়মিত শিল্পী।  কুন্তী চরিত্রাভিনেত্রীর নাম মিতালি। তাঁকে শুধু আয়ত্ত করতে হবে দেহজ অভিনয়টুকু সংলাপ বলার সঙ্গে সঙ্গে, একই পারদে একই আবেগে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কর্ণ-চরিত্রাভিনেতা যথেষ্ট পরিণত। দক্ষ মঞ্চের অভিনয়ে। নাম দীপঙ্কর। তিনি চেষ্টা করছেন কিভাবে সাযুজ্যে কর্ণ হয়ে ওঠা যায়। তাঁর উচ্চতা, দৃষ্টি, নাসা-স্বর প্রভৃতি দিয়ে না-দেখা কর্ণের রোপণে ত্রুটি নেই। আপাতদৃষ্টিতে কর্ণ বীর, তা এক বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতার পক্ষে হয়ে ওঠা – যা এমনিতেই বীরের মতন লড়াইয়ের সামিল। কারণ, দীপঙ্কর এবং আরও অভিনয়-শিল্পীদের থিয়েটারে অভিনয়টাই পেশা। যা একুশ শতকের মূল্যতুল্য জীব ও জীবিকার ক্ষেত্রে কতটা যুদ্ধের, তা থিয়েটারে পূর্ণ-নিমজ্জিতরাই জানেন। ফলে লড়াই করতে থাকা কলাশিল্পীদের এই নাট্যে নিমজ্জনের জন্যে অপেক্ষা করা। এই নাট্যের নির্মাণ দেখতে দেখতে কাব্যনাট্য এবং রবীন্দ্রনাথ, কাব্যনাট্য এবং বুদ্ধদেব বসু। এবং টি এস এলিয়টের দুই-একটি বিষয়ভিত্তিক কথা মাথায় উঁকি দিল। এলিয়ট বলেছেন, কাব্যনাট্য নাট্যের এক শিল্পসম্মত রূপ, যা কাব্য এবং নাটকের যোগফল নয়। যেখানে নাটকের গুণ আর কবিতার গুচ্ছ নয় শুধু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোঝাতে চেয়েছেন যে, কাব্যনাট্য হল 'অভিজ্ঞতার তিন স্তরের সমগ্রতা'। যেখানে কাহিনি বা ঘটনা প্রত্যক্ষ ও প্রথম স্তর, দ্বিতীয় স্তর হল কবিতার – যা 'উৎস থেকে উত্তরণ ঘটবে প্রজ্ঞায়'। এবং এই দুইয়ের সমন্বয় হলে হবে, তৃতীয় স্তর, যেখানে কাব্যনাটক থেকে নাট্য হতে পারে। এই তৃতীয় ধাপে তিনিই জৈবিক সমন্বয়ের কথাটি উল্লেখ করেছেন। যেখানে এলিয়ট বিস্তৃত ব্যাখ্যায় দুই যুগব্যাপী দীর্ঘচর্চার পর বলেছেন যে, কাব্যনাট্য অধরা বা ব্যাখ্যারও অতীত এক শিল্পগোত্র। যেখানে আমাদের দেশের দুই কবি লিখেছেন। এক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুই, বুদ্ধদেব বসু। যে নাটক অভিনয় হচ্ছে, তা-ই নাট্য। ফলে, কাব্যময় সেই সংলাপ অভিনয় হতে গেলে অভিনেয় কলাকুশলীদেরও ওই তৃতীয় স্তরে পৌঁছুতে হবে।     

যদিও মঞ্চে অভিনয় আগে। পরে তা জনিত ব্যাকরণ সৃষ্টি হবে।

সেই যে প্রশ্ন ছেড়ে এসেছিলাম ... নাট্য দেখতে যাওয়ায়, সেখানেই ফের যেতে হবে। কাব্যময় আরও কত অনুষঙ্গ ততক্ষণে আউরে নিয়ে নাট্যের কলাকুশলীরা যেমন তৈরি হবেন। তেমনই দেখতে যাওয়ার জন্যে দর্শকও তৈরি হবেন। 

এই পরম্পরায় লিখিত কিস্তি কাব্যনাট্য চর্চা ও একুশ শতকীয় উপস্থাপনা। রীতি পরে আর অভিনীত হতে থাক আগে। কালিমাটি পত্রিকার মাননীয় সম্পদক লেখক কাজল সেন-এর সুবাদে নাট্য-সংস্কৃতি আলোচনা ও উপস্থাপনার এই ধাপ। যেখানে তিনি বিশাল অন্তরীক্ষে আন্তর্জাল পত্রিকার ধারায় চালিয়ে দিচ্ছেন আমাদের। উপমহাদেশীয় ভাষা-সমুদ্রে তিনি দেশীয় নাবিকের মতন। যার পত্রিকা সম্পাদনায় একুশ শতকীয় সংস্কৃতির ধারা ঋদ্ধ। ততদিনে চলুক #থিয়েটার #কাব্যনাট্যচর্চা।  

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী …

 

(প্রচ্ছদ-অঙ্কনশিল্পী : অর্ঘ্য চক্রবর্তী)


1 টি মন্তব্য: