বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন (পর্ব – ৩)




 

চেতন অচেতন

কোনো কোনো মানুষের ছোটোবেলা কাটে না। অনেক বড় হলেও থেকে যায় অপরিণত, এলোমেলো, খ্যাপাটে, আবেগসর্বস্ব। আমি দেখেছি এমন মানুষ। ঘনিষ্ঠভাবে। এদের সহজেই তুচ্ছ করে মানুষ, কিন্তু এরা বেহিসেবির মতো ভুল করে জীবনভর। মুহূর্ত না ভেবে দিয়ে দিতে পারে নিজের  প্রাণ। আমি কাছ থেকে দেখি কারণ এর থেকে আমার মুক্তি নেই। আবার অনেক মানুষ দেখেছি ছোট থেকেই বেশ পাকাপোক্ত, ম্যাচ্যুরড্। হিসেব করে কথা বলা, হৃদয় নয় মস্তিষ্ক দ্বারা চালিত মানুষ পৃথিবীতে জয়ী হয়।

ছেলেবেলা তাই শেষ হয় না। ভেবে নিতে হয় জীবনের বাহ্যিক কোনো বাঁক। তবু এক একজন মানুষ চিরন্তন। এক একটা দৃশ্য আলাদা। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। সেদিন বেশি ভিড় হয়নি। বেলুড় মঠে যারা এসেছিলেন অনেকেই চলে গেছেন। আমাকে কোলে নিলেন ছোট্ট তিনি। ভরত মহারাজ। মা সারদেশ্বরী আশ্রমে দীক্ষিত। গৌরীমা, দুর্গাপুরী দেবীর সাক্ষাৎ শিষ্যা ছিলেন দিদিমা।

সেদিনটা আবছা অস্পষ্ট, খুব হাওয়া, বেলুড় মঠে। বসে আছেন মহারাজ স্মিত মুখে। এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। An aura of positive energy. আমি তাঁর কোলে বসে আছি। তিনি মাথায় হাত দিলেন। মাকে কিছু বলেছিলেন আমার ব্যাপারে। মা চোখ মুছলেন। ‘শুদ্ধ’ শব্দটুকু মনে আছে সেসব কথার মধ্যে। আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম অন্য কারণে। এত নরম গলা, এত স্নিগ্ধতা, আমার মতো একেবারে শিশুকেও স্পর্শ করেছিল। লজেন্স দিয়েছিলেন। আরেকবার মাথায় হাত। উঠে আসছি, তিনি চেয়ে আছেন। যেন কত কষ্ট,  আমি চলে যাচ্ছি বলে।

-"আবার এসো কেমন!"

কোল থেকে ওঠার সময় তাঁর শেষ কথাটি ভুলিনি। আর কখনো নয়। কাগজে ছাপা হয়েছিল তাঁর দেহান্তের খবর কালো কালো বড় বড় অক্ষরে। কালো চশমা, সুচিত্রা সেনের ছবি।

ধার্মিক বলতে যা বোঝায় তা আমি কোনোদিন নই। কিন্তু একেকজন মানুষ খুব আকর্ষণ করেন।

এমন দুঃখ পেয়েছি বড়ো হয়ে লোকেশ্বরানন্দজি মহারাজের প্রয়াণে। তাঁর সঙ্গে অবশ্য অনেকটাই কথোপকথন হতো। তিনি গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ সেই সময়ে।

 

***

নকশালবাড়ি আন্দোলন শেষ হয়ে গেল আমার জ্ঞান বুদ্ধি হবার আগেই। কিন্তু অতি গোপনে সমাজের অভ্যন্তরে এর বীজ প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল, তার উৎপাটন সম্ভব হয়নি। মানুষ কখনো ভোলেনি নকশাল আন্দোলনের কথা বরং ক্রমশ তাদের প্রতি এক নীরব সমর্থন মনে সৃষ্টি হয়েছিল দমনের বীভৎস রূপ প্রত্যক্ষ করে। তাই নকশালবাড়ি আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি, মনে হয়েছে, বরং তা অনেকাংশে সফল, রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে।

আমাদের মধ্য কলকাতার বাড়ির অদূরে ময়রা স্ট্রিটে আসতেন উত্তমকুমার, বাবা কাকার মুখে শোনা। প্রতিবেশী ছিলেন কামু বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধ্যা হলে ঠাকুমারা পাটভাঙা শাড়ি পরে চুল বেঁধে ঠোঁট রাঙাতেন পান খেয়ে। কাকিমা জ্যেঠিমাদের আলাদা আড্ডা হতো। হাসির ফোয়ারা উঠত।

কিন্তু সবটাই এমন নিটোল ছবি ছিলো না। ছিলেন প্রেমে ব্যর্থ এক কাকা, খামখেয়ালি একাকী। কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে সারা দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন। ছিলেন এক জ্যাঠা। তিনিও ঠাকুর্দা ও অন্য জ্যাঠার মতো রিজার্ভ ব্যাংকের কর্মী ছিলেন। অপূর্ব গান গাইতেন। চাকরির বাইরে তাঁর নেশা ছিল ফটোগ্রাফি। শুনেছি একবার দু তিন দিনের জন্য ফটো শুট করতে গিয়ে ফিরে তাঁর মধ্যে এক পরিবর্তন দেখা দেয়। একটু বড়ো হয়ে বইপত্তর পড়ে জানতে পারি শুচিবায়ুগ্রস্থ একটি মানসিক রোগ। বাজার থেকে এসে টাকা পয়সা ধুয়ে রোদে শুকোতে দিতেন। অফিস থেকে ফিরে চান করে সেই যে খাটে বসতেন আর কিছু ছুঁতেন না। কারো সেই ঘরে ঢোকাও বারণ ছিল। ক্রমশ এই রোগ এক মর্মান্তিক আকার ধারণ করে এবং জ্যেঠিমাও আক্রান্ত হন এই রোগে। বাকি আত্মীয় পরিজন থেকে নির্বাসিত হয়ে পড়েন।

আরও একটি স্মৃতি আবছা অথচ গভীরে দাগ কেটে গেছিলো শৈশবে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় এক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করছিলেন। এদিক ওদিক এলোমেলো তাকাচ্ছিলেন। একের পর এক বাস চলে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি ওঠেননি। অনেক বেলায় হঠাৎ একটি দোতলা লাল বাসের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রামতুতো আশ্রিতা বোবা কালা নিলি পিসি আমাদের হিঁচড়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন। থ্যাঁতলানো দেহটা দেখিনি বটে কিন্তু রাস্তায় রক্তের দাগ শুকিয়ে ছিল। সেই দাগ মনে গেঁথে আছে। তিন বছর বয়সেই ভাবতাম শেষ মুহূর্তে মানুষটির কী মনে এসেছিল।

আমাদের শৈশবে একটি খেলা ছিলো চুপি চুপি ডিমের খোলে ফড়িং পুরে ছাড়া। ঘরময় ডিম উড়ত। এই কাজে আমাদের সবচেয়ে বড়ো জ্যাঠতুতো দিদি ছিলো সিদ্ধহস্ত।

সেজঠাকুমা পুতুলের জন্য তৈরি করে দিতেন ছোটো ছোটো জামা কাপড় বালিশ বিছানা। গোল হয়ে বসে শুনতাম গল্প। আমাদের সেজঠাকুমা এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তখনকার দিনে মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য ছিলেন। নিয়মিত মাঠে যেতেন খেলা দেখতে। কালো রোদচশমা পরা তাঁর ক্লাবহাউসে বসা ছবি বেরিয়েছিল খবরের কাগজে।

এরপর শুরু হলো নতুন পর্ব। মূল উৎপাটন করে বাসা বদল। শহর থেকে অজ গ্রাম। নিবিড় নিশীথ রাত। বাঁশবন, অন্ধকার, দূরে শেয়ালের ডাক, হ্যারিকেনের আলোয় মায়ের দীর্ঘতর ছায়ার ভেতর বসে একটি

ছিন্নমূল মেয়ের প্রথম পাঠ অধ্যায়।

দুপুরে পেয়ারা আম গাছের ত্রিকোণে চলে যেতাম। শিকার শিকার খেলা। আমার সঙ্গে আমি।

একটা কাঠের লাঠিওলা কালো বড় ছাতা খুলে তাঁবু খাটিয়ে শিকারী হতাম। লক্ষ্য রাখতাম সতর্ক দৃষ্টিতে। কাঠবিড়াল আসত এপাশ ওপাশ দিয়ে, ডাল ধরে ওঠা নামা করত।

সারদেশ্বরী আশ্রমে কখনো কখনো যাওয়া হতো। মা না গেলেও দিদিমার সঙ্গেই। লক্ষ্ণীদিদি বলে একজন সন্ন্যাসিনী ছিলেন। খুব ভালোবাসতেন আমাকে। সেখানে আমার অবারিত দ্বার। নিষেধ নেই। ওপরের ঘরে খুব বুড়ি দিদা ছিলেন। আমার কাছে তাই, তবে তিনি আশ্রমের সকলের মা ছিলেন। বেলুড় মঠ বা সারদেশ্বরী আশ্রমে তেমন কোনো ধর্মের বাড়াবাড়ি ব্যাপার দেখিনি। খুব আনন্দ হতো।

আমাদের গ্রামে সেই সময়, যাত্রাপালা হতো। শীতকালে। আমি গ্রামতুতো মাসি বা কোনো দিদার সঙ্গে দিব্যি সোয়েটার পরে চাদর মুড়ি দিয়ে গেছি দু একবার। মা গেলেও ফিরে যেতেন মাঝে। সবচেয়ে ছোটোবেলায় দেখা যাত্রার নাম মনে নেই কিন্তু একটি লোক রানী সেজেছিল। এইটে খুব অবাক লেগেছিল। খুব ভিড়। গ্রামের পাশের গ্রাম থেকেও আসত। আমি ওই ভিড়ে মাটিতে শতরঞ্জির ওপর বসতাম ঘেঁষাঘেঁষি করে।

একবার পুতুল নাচের আসর হয়েছিল। কার্তিক মাসের শেষে হিমরাতে দেখেছি অদৃশ্য সুতোয় নড়াচড়া পুতুল নাটক।

আমাকে কখনো বই পড়ে শ্রেণীহীন সমাজের রূপকথা পড়তে হয়নি। মানুষে মানুষে বিভেদ বা মানুষ থেকে ভয় কোনোটাই আর সৃষ্টি হয়নি।

কিছুদিন পর মা বাগানে নেমেই ছোট্ট একটি শিবমন্দির তৈরি করেন। পুতুলের ঘরের মতো। সামনে চাতাল। ভেতরে শিবঠাকুরের গলায় রুপোর সাপ। শিরে ত্রিশুল। আমার এসব কোনোকালেই ভালো লাগত না। তবে মাঝে মাঝে মন্দিরের কাজ করতে হতো মায়ের আদেশে। তখন বেলপাতা বাছতে শিখলাম। পাতার গায়ে সাদারেখা, দাগ হলে হবে না। ঠিক তিনটে পাতা হতে হবে। ঘাস নয় দুর্বাঘাস, চন্দন বাটা। তবে পুজোর জায়গায় ফুল ধূপ চন্দন মিলেমিশে একটা মিষ্টি সুবাস হতো।

শিব রাত্রির সময় পড়শিরা আসতেন জল ঢালতে। চার প্রহরের পুজো। আমার খুব ঘুম পেত। শেষ প্রহরে ঢুলে পড়তাম প্রায়। হাত থেকে ঝরে পড়ত ফুল পাতা, ঠাকুরমশাই রাগ করতেন। আট বছরের মেয়ে আমি। মায়ের এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারিনি। উপোস করে গোটা দিন থাকার জন্য নয়। কিন্তু অহেতুক একবার দই একবার মধু একবার ঘি, সঙ্গে জল করার কী দরকার বুঝতাম না। শিবলিঙ্গ ভালো লাগত কারণ কোনোদিনই মূর্তিপুজো বিশ্বাস করতাম না। এ তবু মন্দের ভালো। যে মাকে অন্য ভূমিকায় দেখেছি তাঁকে পাথরের শিব নিয়ে এত কাণ্ড ভালো লাগেনি। তখন তেমন কোনও বইপত্র পড়িনি। ছেলেমানুষি ভাবনা। ছোটোবেলায় মনে হতো খৃষ্টধর্ম খুব ভালো একটা ছিমছাম ব্যাপার।

আসলে সত্যিই বছর দশেক বয়সেই আমার যা কিছু ঐশী উপলব্ধি তা মন্দিরের বাইরে প্রকৃতিতেই নিহিত হয়েছিল।

 

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন