ধর্ষণ, প্রতিহিংসা ও মৌলবাদী হত্যাসমূহ
এই যে নারী মাত্রেই
ভোগের বস্তু – এই
জ্ঞান আমেরিকার ওই টিন এজার ধর্ষকরা পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারে। বস্তুত এ জগতে এমন পুরুষমানুষ বোধহয় খুব কমই আছে যারা এই ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিতে
দ্বিধা করেন। সঙ্গমের ইউফোরিয়ার চাইতে এই পৃথিবীর কাছে আর সব কিছুই
বড় তুচ্ছ। যদি এটাই সত্যি হয়, তাহলে এই প্রকৃতির একটা জীব হিসেবে নারীর পক্ষেও
তো এটা সত্যি হওয়ার কথা এবং স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী এটা হয়ও। তবে নারীর যে সঙ্গমের তুলনায় সংযমের মাত্রা জ্ঞানটা ও বিচক্ষণতাটাও পুরুষের তুলনায় অনেক
বেশিই যে থাকে তাও সেটা ওই কন্টেক্সচুয়াল কারণের জন্যই। আবার সব সময় যে সেটুকুও থাকে তেমনটাও ভাববার কোন কারণ নেই।
কিন্তু না, সঙ্গমের ইউফোরিয়া নয়, অনেক দীর্ঘ, দীর্ঘ সময় ধরে আদিম শ্রমবিভাজনের রীতি ও
নীতি মেনে চলতে চলতে নারী ও পুরুষের মধ্যে যেমন দৈহিক পরিবর্তন প্রকট হয়েছে,
ঠিক সেই রকম ভাবেই তাদের মানস জগতেও অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিবর্তন ও জেনেটিক মিউটেশনের কারণে আদিম পুরুষ ও নারী এবং আজকের পুরুষ ও নারীর
মধ্যে যেমন বিস্তর ফারাক রয়েছে,
ঠিক সেই রকমই আজকের পুরুষ ও নারীর মধ্যেও অন্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে
সঙ্গে স্বভাবগত এবং মনস্তাত্বিক তফাৎ অনেকটাই হয়েছে যেটা কিনা আদিম নারী পুরুষদের মধ্যে
ততটা ছিল না। আর এই কারণেই আজকের পুরুষরা অনেকটা ক্ষমতা ও আধিপত্যবাদী
হয়ে উঠেছে যেটা আধুনিক নারীদের তুলনায় বিপরীত। ঠিক এই কারণেই এখনকার
সমাজে, মানব সভ্যতায় ধর্ষণ
একটা বিরাট আকার ধারণ করেছে। বস্তুত গোটা পৃথিবী জুড়েই ঘটে যাওয়া
প্রায় সমস্ত ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোই আসে এক বিচিত্র মানসিকতা থেকে। সেটা হল, পুরুষতন্ত্রেরও
যা আসলে ভিত্তিভূমি – পুরুষরা নারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ –
এই বোধ ও ভাবনা থেকে।
এই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম
যে কথা, সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্বগ্রাসী
মৌলবাদ হল পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র যেখানে পুরুষ হয়ে জন্মাবার পরে পরেই প্রতিটি শিশুই পুরুষ গোষ্ঠীর
অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় আর সেটাকে খুব দায়িত্ব নিয়ে পরিবার ও সমাজের অন্য মানুষরা যারা
পিতৃতন্ত্রের বাহক, তারা শিশুটিকে শেখাতে থাকে যে মেয়েদের চেয়ে
ছেলেরা সব কিছুতেই বড় ও অগ্রগামী। তাই একটা পুরুষ শিশুর মধ্যেও দেখা যায়
এই মনোভাব যে সে যে কোন মেয়ের থেকেই সব ব্যাপারে বড় বা শ্রেষ্ঠ। এই যে শ্রেষ্ঠত্বের ধারনা যেটা আসলে স্রেফ একটা অন্ধবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটা শত সহস্র শতাব্দী ধরে একইরকম থেকে
গেছে। প্রায় একটুও পালটায় নি জ্ঞান বিজ্ঞান ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
অজস্র অভূতপূর্ব সব প্রমাণ চোখের সামনে থাকা স্বত্বেও। এই যে চোখ কান বন্ধ
করে একটা অযৌক্তিক বিশ্বাসকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে নিয়ে যাওয়া – এটাই তো মৌলবাদের আসল লক্ষণ। ঠিক সেই কারণেই পিতৃতন্ত্র আসলে একটা মৌলবাদ। যে কোন মৌলবাদই সভ্যতা
ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিপ্রতীপে অবস্থান করে এবং বলা বাহুল্য মানব সভ্যতার স্থিতি ও অগ্রগতির
পক্ষে এক চরম, ভয়ঙ্কর
ও বিপদজনক জগদ্দল পাথরের মত।
যে কথা বলছিলাম, পিতৃতন্ত্র সর্বগ্রাসী। কতটা সর্বগ্রাসী ? আংশিক না পুরোদস্তুর ? আমি চাই সেকথাটা পাঠকরাই বিচার করবেন। আমি শুধু আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের কিছু গুঢ কথা বা পরিস্থিতি সবার সামনে পেশ করতে চাই। আমাদের বেঁচে থাকার প্রাথমিক পরিধি হল পরিবার। এইখানে শিশুর জন্ম হয় আর সে বেড়ে ওঠে। একটা পরিবার তৈরী হয় এক বা একাধিক পুরুষ ও নারীর অন্তর্ভূক্তিতে সেটা একক হোক বা যৌথ হোক। বিবাহ হচ্ছে এর প্রধান পদ্ধতি যার সাহায্যে পরিবারের একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক তৈরী হয় আর শিশুর জন্ম হয়। অথচ এখানেই নারীরা সবচেয়ে অপমানজনক অবস্থায় থাকতে বাধ্য হয়। এখানে নারীর জন্যও একরকম নিয়ম আর পুরুষের জন্য অন্য আর এক রকম। নারীর সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে এখানে এমনভাবে যাতে সে কোন ভাবেই সম্মান নিয়ে নিজের শক্তিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। নিয়ম, অনুশাসন সবটাই নারীকে দমিয়ে রাখার জন্য। পুরুষদের যথেচ্ছ স্বাধীনতা দেওয়া হয়ে থাকে। ভারতের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে নারী সবচেয়ে বেশি শোষিত ও অত্যাচারিত যে হয় সেটাও পরিবারের মধ্যে থেকেই, একথা এখনকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য থেকেই প্রমা ণিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের পুরুষদের কাছে পরিবারের নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সমীক্ষা থেকে এটাও দেখা যায়, ভারতের বেশিরভাগ ধর্ষণই পরিবার ও নিকট আত্মীয় স্বজনদের থেকেই ঘটে থাকে। পরিস্থিতিটা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে পরিবার সমস্ত বয়সের মেয়েদেরকে আদৌ সুরক্ষা দিতে পারছে বা পারবে কিনা সে প্রসঙ্গটাই এখন একটা বড় সড় প্রশ্নচিন্থের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা আধুনিক প্রায় সমস্ত নারীরাই প্রত্যেকে কিছু না কিছু ব্যাবসা অথবা চাকরি করে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার কর্মসূত্রে সারাদিন বাইরে থাকা ছাড়াও অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়, এমনও আছে। তাই পরিবারের সেই সনাতন ধান্দা – নারীকে দিয়েই সন্তান জন্ম দিইয়ে আবার তাকে দিয়েই সন্তানদের আগাপাশতলা মানুষ করিয়ে নেবার তথাকথিত কর্তব্যটা এবং পুরুয়রা শুধু চাকরি করেই বাড়ি ফিরে হাত পা ছেড়ে আয়েস করবে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার চিরকেলে অভ্যেসটা এখন আর নারীদের বেশির ভাগের পক্ষেই মেনে নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। কেননা তাদের খানিকটা অংশ এই প্রশ্নও তুলতে শুরু করেছে যে সন্তান জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে বাকী সব কাজই যদি তাদেরকেই করতে হয়, স্বামী যদি কিছুই না করে, তাহলে স্বামী থেকে লাভ টা কী। ঠিক এইখানে এসেই চিরাচরিত পরিবারের গড়ন টা এবং তার অস্তিত্বটা বেশ বড় সড় একটা ধাক্কা খাচ্ছে। তার মানে যেটা দাঁড়াচ্ছে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটাই একটা বড় সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শুধু তাইই নয় ,খুব শীঘ্রই পরিবারের ধারনা বা সংজ্ঞাটা বদলাতে চলেছে যেটা বলা বাহুল্য একেবারে অমোঘ। পরিবারের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে সেটা একটা পুরোপুরি আলাদা আলোচনার দাবী রাখে বলে আমার মনে হয়। তাই সে বিষয় নিয়ে এখানে আমি কোনও আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু বলতে চাই, এই যে একটা পরিবর্তনের মুখে এসে পড়েছে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি, এটা কিন্তু একেবারে অমোঘ, যদি না পুরুষরা এর দায়িত্ব ঠিকঠাক মত কাঁধে তুলে নিতে রাজী হন।
তাই প্রতিষ্ঠান-আশ্রয়ী মানবসমাজ ও সভ্যতার এই সুপ্রাচীন মৌলবাদও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তৃতি সঙ্গে সঙ্গে, গোটা কাঠামোটারই একটা অপ্রতিরোদ্ধ পরিবর্তনের পাশাপাশি শুধু ওই নারীদের নির্যাতন আর ধর্ষণের ভয় দেখিয়ে পিতৃতান্ত্রিক মৌলবাদ আর বেশি দিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে কিছুতেই পারবে না। সভ্যতা একথা ইতিমধ্যেই বারবার করে প্রমান করেছে যে মানুষের শক্তি আসলে তার বাহুতে থাকে না, এমন কি অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও থাকে না। থাকে মস্তিস্কে। আর এই মস্তিস্কই তো আসল হাতিয়ার ধর্ষণ বা ধর্ষণের শেষ সম্ভাবনাগুলোকে অবলুপ্ত করার ক্ষেত্রে। নয় কি?
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন