কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৫ |
চড়াই
দুপুর ঘন হয়ে এসেছে। ছেলেটা একমনে হাতের কাঠিটা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। কেন! কেন ওকে
পিঁপড়েগুলো কামড়ালো? ও তো কিছু করেনি! এক মনে আমগাছের আম
গুনছিলো। আজ স্কুল নেই। অন্তু পিঁপড়েগুলোকে গর্তে ঢোকাচ্ছে। সব পিঁপড়ে ও আজ মেরে
ফেলবে। বাগানের ৫২টা সুপুরিগাছ আর একটা বূড়ি কাঁঠালগাছ মুখ নিচু করে ওকে দেখছিল
এতক্ষণ। দুটো গোলাপগাছ আর তিনটি জবা এগিয়ে এসেছিল খানিক। সবাই উদ্বিগ্ন। আর পাঁচটা চড়াই। লাফাচ্ছে, ঝগড়া করছে
কিন্তু নজর অন্তুর দিকেই।
-অন্তু, অন্তু!
মায়ের গলা। হতাশ অন্তু উঠে পড়লো। আজ হ'ল না। কাল হবে।
কাঁঠালগাছ কিছু
শুকনো পাতা গর্তের উপর ঝরিয়ে দিল। সুপুরিগাছ সোজা আবার। জবা, গোলাপ
গুটিগুটি নিজেদের জায়গায়।
এই অবধি ছবিটা খুব স্পষ্ট। যেন গতদিনের। তারপর
কত দ্রুত বদলে গেল সব। বাবা মা চলে
গেলেন। ছোট্ট বাগানটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। আর অন্তু বড়ো হয়ে গেল। ক্রমে একজন জলবিশারদ। কত রাজ্যে যে ঘোরাঘুরি! জলের
গুরুত্ব, জলের সংরক্ষণ, আগামীতে
জলের সংকট - এসব নিয়ে কাজ, সেমিনার, গ্রামগঞ্জে নানান শহরে কেটে গেল দীর্ঘ ৩৭ বছর। বিয়ে করেছিলেন কেরালায়। একমাত্র কন্যা রিয়া। বিয়ে দিয়েছেন। জামাই ফিজিসিয়ান। পুনেতে
থাকে। তাদের একমাত্র সন্তান
সবুজ। স্ত্রী
বিয়োগের পর গত সাত বছর তিনি একা। শহর থেকে সামান্য দূরে বাংলো প্যাটার্নের একটা
ছোট বাড়ি বানিয়েছেন। নাম দিয়েছেন 'কাজললতা'। দক্ষিণের টেরেসে বসেই আজকাল দিনের অর্ধেক কেটে যায়। পড়াশোনা, লেখা, শীতের দুপুরে ছোট্ট একটা ন্যাপ- সব
এখানেই।
ছ’বছরের সবুজকে
নিয়ে মেয়ে দুদিন হ'ল এসেছে। ওকে নিয়ে আজ বাজারে গিয়েছিলেন। মেয়ে চিংড়িমাছ ভালবাসে। সবুজ
কেবল মিষ্টি। তবু ওর জন্য প্যাস্টেল একবাক্স, ড্রয়িংখাতা।
ফিরতে ফিরতে একটু দেরি হ’ল।
রিয়ার উদ্বিগ্ন বকুনি।
টুপিটা সোফার উপর ছুঁড়ে দিয়েই- মা, মিষ্টি দাও। দাদান অনেক এনেছে। রিয়া হেসে ফ্যালে। অতীন্দ্রবাবুও হাসেন।
- দে একটু। চাইছে যখন।
দুপুরে খাওয়া বেশ হ'ল। রিয়ার রান্নার হাত একেবারে ওর মায়ের মতো
হয়েছে। ইজিচেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলেন অতীন্দ্র। আজ আর কিছু পড়তে লিখতে ভালো লাগছে না। চারপাশটা কতো পালটে গেল দ্রুত! কতো মানুষ! চারপাশে কেবল বহুতল। কত্ত
রকমের মানুষ। সবুজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। গুটিকয়েক এন জি ও জল, সবুজায়ন- এসব নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে মানুষকে সচেতন করার। এদের একটার
সঙ্গে তিনিও খানিক জড়িত।
-দাদান, ও দাদান, দ্যাখো না, এই
চড়াইদুটো এঁকেছি। কেমন হয়েছে?
ইজিচেয়ার থেকে মাথা তুললেন অতীন। চোখটা একটু
লেগে এসেছিলো। তিনি একটা কিশোর আর ছোট্ট একটা বাগানের দুপুর দেখছিলেন। সবুজ সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে ড্রয়িংখাতা।
লাল-কালো পাখির মতো কিছু এঁকেছে। নিচে লিখেছে 'sparrow'। আশ্চর্য! চড়াই ও দেখলো কোথায়! অতীন্দ্র সবুজের দিকে চোখ তুললেন।
-খুব সুন্দর
হয়েছে। কিন্তু আর তিনটে কোথায় গেল!
-আরো তিনটে ছিল!
-ছিল তো দাদু।
-ও। তাহলে এক্ষুনি এঁকে আনছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন