ধারাবাহিক উপন্যাস
রূটম্যান
(১০)
বিএসএফ
ক্যাম্পের কাছেই একটা ঝাঁকড়ালো বটগাছ বছর পনের হল গজিয়ে উঠেছে। নীচটা গ্রীষ্মকালে বেশ
ঠান্ডা। গ্রামের অনেক গবাদি পশুরা মাঝে মাঝে মাঠের খাবার ফেলেও এর নীচে এসে একটু জিরিয়ে
নেয়। আর গাছের মাথায় সব সময় পাখপাখালির কলরব লেগেই থাকে। খলিলের এই জায়গাটা বেশ পছন্দ
হয়। সে তার আগের আস্তানা পালটে ইদানীং এখানে এসে চট পেতেছে। আর এতে জওয়ানদের বেশ সুবিধাই
হয়েছে। তাদের আর হাতে করে জুতো নিয়ে অতদূরে যেতে হচ্ছে না। কারণ জুতোটা পালিশ রাখা
পোশাকের মতোই বাধ্যতামূলক। বলা যায় না যে কোন সময় ওপরওয়ালা চলে আসতেই পারেন। তাদের
আবার অন্য দিকের থেকে এই দিকেই বেশি নজর। চোখের অলক্ষ্যে হাতি গলে গেলেও তাদের ভ্রুক্ষেপ
নেই। কিন্তু সামনে দিয়ে যেন সূঁচ না গলে যায়! এ ব্যাপারে তাঁরা ভীষণ কড়া।
প্রথম
দিনে খলিলের কাছে মাত্র তিনজোড়া বুট এসেছিল। তার পরের দিন এসেছিল পাঁচজোড়া। আর তারপর
থেকেই হু হু করে বুটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা জওয়ানদের মধ্যে বেশ জানাজানি
হয়ে গেছে। ফলে এখন সে মাথা তুলতেই পারে না। ওদের বলে দিয়েছে যে আপনারা জুতো রেখে আমাকে
কম করে আধঘন্টা সময় দেবেন। তারপর সব জুতো একবারেই দিয়ে দেব। আর খলিল চেষ্টা করে তার
ভাঙা ভাঙা হিন্দি দিয়ে ওদের সাথে ভাব জমাতে।
ওরা
হাসিমুখে চলে যেতেই খলিল ওর পুরনো মোবাইলটা অন করে ফিসফিস করে বলে- তুমহাদের কামটা
আর কতদূর?
-তুই
একনা টাইম চাহে লে খলিল। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে একজন বলে।
-আরে
এমনিতেই হামি আধাঘন্টা টাইম চাহে লিয়েছি। উয়াদের আর কত আটকাব কহ।
-আরে
উপারের কামখান শেষের পথে। হামরা যদি আধাঘন্টা টাইম পাই তাহলেই শ’দুয়েক পার করে দিব।
হামরা তো তৈরিই আছি। শুধু একখান ফোন আলেই হল।
-ঠিক
আছে। যা করার জলদি জলদি কর। পরে কিন্তু হামাকে মিছাই গাল পারতে পারবা না। এটা হামি
আগেই তুমাদের কহে দিলাম। খলিল এ ব্যাপারে নিজে পরিষ্কার থাকতে চায়। শেষে ওরা নিজেদের
দেরির জন্য যদি ধরাও পড়ে তাহলে সে যেন দায়ি না হয়। ওর যা কাজ তা সে করে দিয়েছে।
আসলে
খলিল আর সলেমানের দলের লোকেরা জানে যে সবটা ওদের হাতে নেই। ওপারের লোকেরা যত তাড়াতাড়ি
তাদের সুড়ঙ্গের কাজ শেষ করতে পারবে ততই মঙ্গল। তা না হলে যদি জওয়ানরা টহলে বের হয়ে
এদিকেই আসে তাহলে তো সব কিছু বানচাল হয়ে যাবে। অনেকে ধরাও পড়ে যেতে পারে।
ঠিক
এমন সময় সোলেমানদের কাছে একটা ফোন এল ওপার থেকে। ওরা যে তৈরি তা জানিয়ে দিল। ব্যস!
সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল এপারের ব্যস্ততা। প্রথমে পাট গাছের আড়ালে যে সব অবলাদের রাখা
হয়েছিল তাদের নিয়ে সুড়ঙ্গের সামনে আনা হল। উপরে তারকাঁটার সীমানা। আর নীচে বেশ লম্বা
সুড়ঙ্গের মাথাটা রয়েছে বাংলাদেশে আর শেষটা রয়েছে এপারে। একবার এপার থেকে সুড়ঙ্গে ঠেলে
দিতে পারলেই কাজ শেষ। আর চিন্তা করতে হবে না।
প্রায়
দশ-পনের জন লোক একটা করে অবলাকে সুড়ঙ্গের মুখের কাছে এনে চার পা মুড়ে বসিয়ে দিয়ে ঠেলে
দিচ্ছে সুড়ঙ্গের সংকীর্ণ পথে। আর ওপারে যারা রয়েছে তারা অবলাদের কান বা শিঙ ধরে টেনে
সুড়ঙ্গের থেকে বের করে নিচ্ছে। এপার থেকে যারা এই পদ্ধতিতে অবলাদের ঠেলে দিচ্ছে আর
যারা ওপারে টেনে নিচ্ছে তাদের কাজে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা রয়েছে। একেবারে নিঃশব্দে যন্ত্রের
মতো কাজ এগিয়ে চলেছে। সত্যিই মাত্র আধঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রায় শ’দুয়েক ভারতীয় অবলা বিনা বাধায় বাংলাদেশী হয়ে গেল। এ যেন জাদু সম্রাট
সরকার মশাইয়ের হাত সাফাইকেও হার মানায়। তবে খলিলের কথা মতো সেদিন যারা এই সীমান্তের
রাস্তায় টহল দিতে এল তারা চারদিকে তাকিয়েও কিছুই বুঝতে পারল না যে কী কর্মকান্ডটাই
না এখানে কিছুক্ষণ আগেই ঘটে গেছে! এখন চারদিক একেবারে শুনশান!
এ
এক অদ্ভুত চতুরতা। বিএসএফ যদি চলে ডালে ডালে তাহলে সোলেমানদের মতো লোকেরা চলে পাতায়
পাতায়। কারণ বিএসএফের কমান্ডান্ট থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং স্থানীয়
পুলিশের সব কটা মাথাই এদের কাছে বিকিয়ে গেছে। অবশ্য না বিকিয়ে গিয়েও বুঝি উপায় নেই।
কারণ এসব সীমান্তে তারাই পোস্টিং পায় যাদের মেরুদণ্ড যথেষ্ট পলকা। সব সময় যেন কেঁচোর
মতো গুঁটিয়ে রেখেছে নিজের মেরুদন্ডটাকে। সামান্য রাজনৈতিক নেতাদের এক ধমকেই প্যান্ট
নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয় এদের। বারবার কোমর থেকে প্যান্ট নীচে নেমে যায়। এসব সকলের জানার
কথা নয়। কারণ সীমান্তের নিকটবর্তী থানায় আসার জন্য অনেক উচ্চস্তরের অফিসারদের বাড়িতে
প্রতি নিয়তই ভেট দিতে হয়। আসলে যে দেবতা যেমন ফুল-ফলে তুষ্ট হন তাঁকে তা না দিলে তিনিই
বা তাকে বর দেবেন কীভাবে! এ যেন স্কুলে করা সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো। নীচ থেকে ধাপে ধাপে
উপরে উঠতে পারলে তবেই না মূল মধু ভাণ্ডের নাগাল
পাওয়া যাবে! এই সহজ হিসেবটা যারা বোঝে না তাদের অন্তত পুলিশে কাজ করা উচিত নয়। আর তাই
যারাই নিজেদের মেরুদন্ডকে সোজা রাখার সামান্যতম চেষ্টাও করেছেন তাঁদের কপালে যে কী
দুর্ভোগ জুটেছে তা বলাই বাহুল্য! তাই নিজের ভালো পাগলকেও বুঝতে হয়। আর তা না হলে মোটা
লোহার শেকল দিয়ে আজীবন খুঁটিতে বাঁধা থাকতে হবে। কোনদিন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস পর্যন্ত
নিতে পারবে না!
খলিল
একবার ভেবেছিল যে সে এই বুট পালিশের কাজটা ছেড়ে দেবে। এতদিন সংসারে বুড়ি মা ছাড়া আর
কেউ ছিল না। আর সেই টানেই দুপুর আর রাতে বাড়িতে ফিরতেই হত। কিন্তু এখন তো তাও নেই।
বাক্সটা কাঁধে করে সেই সকালে বাড়ি ছাড়ার পর থেকে সারা বাড়িটাই সূর্যাস্ত অবধি হা-পিত্যেশ
করে বসে থাকে খলিলের জন্য। অথচ তার কোন টান নেই! এখন তো দিনে আর বাড়ি ফেরা হয় না। রোজই
পান্তা-পেঁয়াজ খেয়ে কাজে বেরিয়ে গিয়ে বটতলায় চট পেতে বসে পড়ে। কেউ জানতে চাইলে হাসতে
হাসতে বলে- মোর অফিস ত চলনু। বটতলার অফিস ঘরে। খলিলের এমন কথায় যারা বোঝার তারাও হাসে।
আর যারা সত্যিই কিছুই বুঝতে পারে না তারা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে।
একটা
পেট তাই দিব্বি চলে যায়। এখন এই ক্যাম্পের জওয়ানদের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে খলিলের।
অনেকে এসে তার কাছে মনের কথাও বলে যায়। যদিও খলিল তা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে
বের করে দেয়। কারণ এ সব ব্যক্তিগত খবর বিক্রী হয় না। এসব শুনতে সোলেমানদের বয়েই গেছে।
তবে মাঝে মাঝেই অনেক জওয়ান অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে গেলে প্রথম কয়েকটা দিন খলিলের একটু
অসুবিধাই হয়। তারপর সবাইকে হাত করে নিতে খলিলের জুরি নেই। সে মাঝে মাঝে স্থানীয় লাল
সুতোর বিড়ি খাওয়ায় জওয়ানদের। সবটাই হাতে রাখার জন্য। ওরাও দিব্বি আমেজে বিড়িতে সুখ
টান দিতে দিতে হরেক রকমের খোস গল্প করে।
খলিল
জানে একটা সঠিক খবরে তার পকেটের ওজন কতটা বাড়ে। কিন্তু তবু যখন শোনে সামান্য একটা বাগাল বা রাখাল গাড়ি থেকে
অবলাদের নামানোর পরে নির্দিষ্ট গ্রামে একটি অবলাকে পৌছে দিতে পারলেই দেড় থেকে দুই হাজার
টাকা পকেটে পুরে নেয় বা কোনমতে জীবন বাজি রেখে যদি জওয়ানদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একজোড়া
অবলাকে সীমান্ত পার করে দিতে পারে, তাহলে সাথে সাথে দশ থেকে বারো হাজার টাকা সে কোমরের
লুঙ্গিতে গুঁজে নিতে পারবে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতটা পারিশ্রমিক পাওয়া যে কোন
শ্রমজীবী মানুষের কাছে কল্পনাতীত! তাই তখন খলিলের বড় লোভ হয়।
খলিলকে
একদিন প্রাইমারি স্কুলের সাত্তার স্যার বলেছিলেন- ‘হ্যাঁরে খলিল, তোক তো জলতরঙ্গে ফাৎনার
মতন লাগেরে’। এই কথার অর্থ সেদিন খলিল বুঝতে না পেরে স্যারের দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে
তাকিয়েছিল। তবে স্যারও আর সে ব্যাপারে কিছু ভেঙে বলেননি। এসব ছোটবেলার কথা হলেও কিছু
কিছু কথা মাথার হার্ড ডিস্কে অদ্ভুতভাবে গেঁথে যায়। সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা অস্পষ্ট
হয়ে গেলেও হঠাৎ করে কিছু দেখলেই তা মনে পড়ে যায়। যেমন এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরার পথে খলিল
দেখল রাস্তার পাশে যে লম্বা নয়নজুলি চলে গিয়েছে, তাতে গ্রামের অনেক কচিকাঁচারা ছিপ
ফেলে বসে রয়েছে। এই নয়নজুলিগুলোর সাথে যে কোন ভাবেই হোক বিলগুলোর একটা যোগাযোগ রয়েছে।
কারণ গঙ্গায় যখন রোজ জোয়ার খেলে তখন বিলের জলও বাড়ে আর সাথে সাথে নয়নজুলির জলও বাড়ে।
আর মাঝে মধ্যেই কিছু বিলের মাছও ভুল করে ঢুকে পড়ে নয়নজুলির জলে। তখন ওরা আর বিলে ফিরে
যেতে পারে না। খলিল রোজকার মতো আজও বারেক দাঁড়িয়ে মাছ মারা দেখে। হঠাৎ দেখতে পায় একটা
ফাৎনা একবার করে জলের উপরে খাড়া হচ্ছে আবার সোজা হয়ে ডুবে যাচ্ছে। এমনটা হতেই পারে।
মাছে যদি বঁড়শিতে গাঁথা টোপটিকে অল্প অল্প করে ঠুকরে খায় তাহলে ফাৎনাটি মাঝে মাঝেই
কাঁপবে। কিন্তু সে যদি অধৈর্য হয়ে সেই খাবারটি নিয়ে পালাতে চায় তাহলে ফাৎনাটি একবার
করে ডুবে যাবে আবার পর মুহূর্তেই জলের উপরে ভেসে উঠবে। এরা হচ্ছে রাক্ষুসে মাছ। অর্থাৎ
শোল বা বোয়াল জাতীয়। আর এমন সময় জোরে ছিপ ধরে হ্যাঁচকা টানলে মাছ অবধারিত উঠবেই। কিন্তু
খলিল ঘটনাটা দেখছিল বটে অথচ ওর মাথার মধ্যে চলছিল স্যারের সেই কথাটির সারমর্ম। বহুদিন
ঐ কথার অর্থ খলিল বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টাই করেনি। কিন্তু একদিন নৌকায় করে সাবিনাকে
নিয়ে বিলে ঘোরার সময় হঠাৎ করেই সাবিনা হেসে ওঠে। অমনভাবে হাসার কোন কারণ ঘটেনি। তাই
অবাক হয়ে খলিল কারণটা জানতে চাইলে সাবিনা বলেছিল- হামার মনে একখান ছবি ভাইসা উঠল বলেই
হাসলাম।
অথচ
এমন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল না যে তা শুনে সাবিনাকে হঠাৎ হাসতে হবে। তাই কিছুটা
অপ্রস্তুত হয়ে খলিল বলে- মিছা মিছা কেউ হাসে নাকি! উটা তো পাগলির লক্ষণ।
-হামি
কেনে মিছা মিছা পাগলি হতে যাব। চোক্ষের সামনে কেন যে ছবিখান দেইখলাম তাই ভাবছি। ও ইবার
মনে পইড়েছে। সাবিনা একটু দূরে আঙুল তুলে দেখায়।
সামনে
বিলের অথৈ জল। জেলেরা জাল ফেলে এখন তা টেনে নিচ্ছে। আর প্রচুর মাছও উঠছে। কিন্তু এতে
হাসির কী থাকতে পারে তা খলিল বুঝতে পারে না। তাই খলিল সাবিনার কাছে হাসার কারণটা আবার জানতে চাইলে
সে জালের সাথে লাগান বড় বড় সোলার ‘ব’গুলোকে দেখিয়ে বলে- ঐ সোলার জিনিসগুলান কেবল পানিত
ডোবে আবার খাড়া হয়। ঠিক তুমার চলার মতন।
জলের
উপর ভাসমান সোলার সাথে নিজের মিলটা কোথায় তা খলিল বুঝতে না পেরে সাবিনার দিকে তাকালে
সাবিনা আবার বলে- হামি জাইনতাম তুমি বুইঝবে না। পানিত যে ওগুলান ডোবে আর ওঠে তোমার
চলাখান দেইখলেই হামার এমুনটাই মনে হয়। ঠিক ফাৎনার মতুন তুমার চলা। সাবিনা নিজের কথাতেই
আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে।
খলিল
মনে মনে বেশ লজ্জা পায়। ওর হাঁটা নিয়ে সাবিনার অমন ব্যাখ্যায় সাত্তার স্যারের কথাটা
আবার মনে পড়ে যায়। হয়তো স্যারও তেমনই বোঝাতে চেয়েছিলেন। খলিল সেদিন তা বুঝতে পারেনি।
কিন্তু এত বছর পরে সাবিনার মুখ থেকে অমন উদাহরণ শুনে খুব দুঃখ পায়। খলিল অনেক্ষণ চুপ
করে থাকায় সাবিনা বুঝতে পারে খলিলের হাঁটা নিয়ে তার হাসাটা ঠিক হয়নি। মানুষ হিসেবে
খলিল গ্রামের অনেকের থেকেই বেশ ভাল মনের মানুষ। সাবিনা মনে মনে অনুতপ্ত হয়। সে হঠাৎ
খলিলের হাত জড়িয়ে ধরে বলে- অজান্তে হামি তুমার মনত আঘাত দিবার চাই নাই। হামারে তুমি
মাপ কইরা দাও।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন