রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস                                                      

 

দিগন্তসেনা

 


 (১০)

 

দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই যেন ও পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবে যেতে যেতে জোর করে দুহাতে ভর দিয়ে তীরভূমিতে উঠে দাঁড়ায় আর ঠিক সেই সময় যেন তূর্যনিনাদ বাজতে শুরু করে দেয়। তাতে কান ঝালাপালা করে উঠিয়ে বসিয়ে দেয় শ্যামাঙ্গীর দরজায় করাঘাত করতে করতে শ্যামাঙ্গীকে তার বাড়ির খাস চাকরানীটি। সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে  দরজার কাছে এসে জানতে পারে যে তার সহকারী অফিসারটি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য। কেননা শত্রু এসে আক্রমণ করেছে দিগন্তসেনা। সমরাঙ্গনে যাবার জন্য রীতিমত আপাদমস্তক প্রস্তুতি নিয়ে আস্তাবল থেকে ঘোড়া বের করে তার ওপর চেপে সহকারীর সামনে এসে দাঁড়ালে সে তাকে জানায় সমুদ্রের দিক থেকে কারা যেন এদিকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শ্যামাঙ্গী ও তার সহকারী তাদের নির্মিত একমাত্র দুর্গটির দিকে এগিয়ে গিয়ে ওপরে উঠে ছাদে পৌঁছে যায়। তারপর সেখান থেকেই দূরবীন দিয়ে দেখতে পায় দূরে সমুদ্রের মাঝ বরাবর মোচার খোলার মত কয়েকটা  জিনিস যেন ভেসে ভেসে এদিকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা গেল সেগুলো মোচার খোলার তুলনায় অনেক বড় আর সেগুলোতে পাঁচ-ছ’জন মাত্র মানুষ আছে। এমনকি তাদের গায়ে বা  আশেপাশে যুদ্ধের পোশাক বা অস্ত্রসস্ত্র সেরকম কিছুই নেই। ওরা ওখান থেকে নেমে এসে তীরভূমির কাছাকাছি গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বড় বড় নৌকাগুলো একসময় পাড়ে লাগল আর তার সওয়ারীরা আপাদমস্তক ধোপদুরস্ত সাদা পোশাকে মোড়া অবস্থায় ধুতির কোঁচাটা পাঞ্জাবির একদিকের পকেটে গুঁজে সৌমদর্শন এক ভদ্রলোক আর পেছনে আরও কজন এদিকেই আসছেন। শ্যামাঙ্গী ঘোড়া থেকে অস্ত্র সহযোগে নেমে একটু এগিয়ে গিয়ে বন্দুকটা তাক করল আর মুখে বলল, ‘পরিচয়?’ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি হাত জোড় করে নমস্কার করে জানালেন তার নাম অবনীমোহন রায়চৌধুরী আর রাজ্যের দক্ষিণে একটি  শহরতলিতে তাঁর বাস। একসময় বাপ-পিতামহ যদিও জমিদার ছিলেন। তবে  এখন আর সেসব নেই। অনেককাল ধরেই দিগন্তসেনার পত্তনের কাহিনী লোকমুখে শুনতে শুনতে তিনি সেটা  নিজে চোখে দেখার লোভটা সংবরণ করতে পারেননি। তাই এই আসা। শ্যামাঙ্গীও হাত জোড় করে প্রতিনমস্কারের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, ‘অচেনা মানুষের এখানে প্রবেশ নিষেধ, মহাশয়ের সে কথাটা  জানা নেই দেখছি’। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গেই মার্জনা চেয়ে ফিরে যাবার উপক্রম করতেই শোনা গেল, ‘দাঁড়ান’। তিনি দাঁড়ালেন এবং পেছনে ফিরলেন। শ্যামাঙ্গী  তার সহকারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার ওপরেই দায়িত্ব দিল সবটা ঘুরিয়ে দেখানো এবং আতিথেয়তার। তারপর বিদায় জানিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করল। কেননা অন্য একজন তার কাছে অন্য কোন একটা সমস্যার খবর নিয়ে এসেছে।

মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা আস্তে আস্তে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। ওদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকছে। এখন উদারপন্থী দলই সরকার চালাচ্ছে যদিও, তবু কোন রাজনৈতিক দলই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ব্যাপারে যথাযথ ব্যাবস্থা নিতে অপারগ। সকলেই রাষ্ট্রীয় খুনকেই ধর্ষণের সমাধান বলে ভেবে সেটাই লোককে বোঝাচ্ছে। প্রথম প্রথম লোকে সেটা খাচ্ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে সকলেই কম বেশি বুঝতে পারছে যে সমস্যার সমাধান সেটা আসলে নয়। অথচ মধ্যমেধা চৌকনা দলটার বক্তব্যগুলো মাঝে মাঝে তার আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করলেও তাতে আসলে যে কিছু কাজ হবে না, তার বাস্তবতা সকলের কাছেই প্রমাণিত। রক্ষণশীল  দলের কাছে কিছু আশা করাই বাতুলতা। কেননা তারা আজও  ঐতিহ্যের পচাগলা রসপায়ী পরজীবি ছোট ছোট পোকা আর উকুনের মত দেশের আর সমাজের গায়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন জনসভায় শ্যামাঙ্গীর ডাক পড়ছে। সকলেই চায় দিগন্তসেনায় বসবাস করতে যেটা আসলে এক অসম্ভব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা তার পরিধিটা ছোট। পারিবারিক গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর জনসাধারণ এই অবস্থায় শ্যামাঙ্গীর সহযোগিতা চায়। এক রক্তাভ ঊষায় ছাদে দাঁড়িয়ে মানময়ী শ্যামাঙ্গীকে বলল নতুন একটা দল তৈরী করতে। নীচে এসে সুদামের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেও ওই একই কথা বলল। অনঙ্গ, অলঙ্কৃতা, উপমাও ওই  একই কথা বলল। প্রতিবেশী যে কজনের সঙ্গে দেখা হল আসাযাওয়ার পথে সে কজনই ওকে দল তৈরীর কথা বলল। সবচেয়ে বড় কথা উন্মাদনাপ্রবালগাথা ও চাঁদের ঢেউ অঞ্চলের বাসিন্দারা একেবারে ওর পেছনে পড়ে গেল যাতে ও একটা দল তৈরী করে সম্মুখ সমরে নামে। কদিনের মধ্যে নিহিতপাতালপুরীর তিনটি ব্লক, গণসংবাদালয়, তীর্থসরোবরের মানুষজন একটা সকলের স্বাক্ষরিত আবেদন পত্র নিয়ে শ্যামাঙ্গীকে হাতে হাতে দিয়ে তাদের বক্তব্য জানিয়ে গেল। কিন্তু তখনও শ্যামাঙ্গীর নিজের কাছে পরিস্কার নয় ব্যাপারটার ভবিষ্যৎ বাস্তবতা শেষপর্যন্ত কী। 

অবনীমোহন ঠিক কোথায় থাকেন সেটা তার জানা হয়ে ওঠেনি স্রেফ তাড়াহুড়োবশত। তবে এটুকু সংবাদ তার কানে পৌছেছে যে সমস্ত অবস্থাতেই তিনি ও তার গ্রামবাসীরা তার পাশে থাকবেন। সচেতনতামূলক প্রয়াস দিয়েই যাত্রা শুরু করা হবে সে কথা জানিয়ে দিল শ্যামাঙ্গী সবাইকে। মনে মনে ঠিক করল, দিগন্তসেনায় তার যে বাহিনী আছে সেটা ছাড়াও  এখানে ও ওর নিজস্ব একটা বাহিনী গড়ে তুলবে। আর সেটা হবে দিগন্তসেনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। শ্যামাঙ্গী তার প্রস্তাবিত দলটার নাম রাখল ‘নবদিগন্ত উন্মোচন হিসেব’। তার জন্য একটা কোর কমিটি ও সেই কোর কমিটির অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটিও নিজেদের কাজ করে যাবে। সেইজন্য একটা নির্দিষ্ট কর্মপন্থাও ঠিক করল। আর তারপরেই আশেপাশের সবাইকে জানিয়ে দিল। এরপর জনগণের উদ্দেশ্যে, মূলত যুবকযুবতীদের উদ্দেশ্যে একটা স্বেচ্ছাবাহিনী গড়ে  তোলার ডাক দিল। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে সভা করে করে মানুষের কানে পৌঁছে দিতে হল সেই ডাক। কেননা  বেতারতরঙ্গ ও দূরদর্শন আসলে সরকারের কয়েক প্রজন্মের পৈতৃক সম্পত্তি। অতএব ওদের জন্য আপাতত সে দরজা বন্ধ। দলে দলে যুবক যুবতীরা এসে নবদিগন্ত উন্মোচন হিসেবের ছাতার তলায় জড় হল। অঞ্চলভিত্তিক তাদের ভাগ করার কাজটা প্রথমে সেরে ফেলে তারপরে প্রত্যেক অঞ্চলের একজন করে নেতা ঠিক করা হল যারা আসলে কোর কমিটির সদস্য। সভাগুলো বসতে থাকল গ্রামে, শহরে, গাছের তলায় অথবা কারুর বাড়ির ছাদে। প্রত্যেক মেয়েদের শাড়ি, শালোয়ার, ওড়না, কামিজ ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরার আবেদন জানানো হল এই যুক্তিতে যে প্রস্তাবিত পোশাকগুলো যথেষ্ট শক্তপোক্তই শুধু নয়, চলাফেরার পক্ষেও যথেষ্ট সুবিধেজনক। মেয়েদের ক্যারাটের প্রশিক্ষণ  দেওয়া হল। তারপর তাদেরই ওপর দায়িত্ব দেওয়া হল তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে নিজেরাই আলাদা আলাদা সভা করে ও দেখভাল করে সর্বনিম্ন  জনস্তর অব্দি যাতে এই ব্যাবস্থা করতে পারে।

সেই বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় সবাই রাস্তায় বেরিয়ে আবিস্কার করল যে চোখের নাগালে যাকেই দেখা যাচ্ছে সকলেই প্যান্ট শার্ট পরে এদিকে ওদিকে নানান কাজকর্ম করছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা যাওয়াও করছে। যারা যারা পড়াতে যাচ্ছে এবং পড়তে যাচ্ছে স্কুল কলেজগুলোতে তারাও প্যান্ট শার্ট পরে যাতায়াত করছে। গুটি কজন যে মেয়ে উকিলরা আছে তারাও কালো প্যান্টের ওপর শাদা শার্ট পরে কোর্টে ঢুকছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই অবস্থা। সবাই যা হোক একটা প্যান্ট পরেছে আর তার ওপরে নানান রকম ঢিলেঢালা শার্ট পরেছে। পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়াল স্কুল কলেজের মেয়েরা নানারকম পোশাক কেনবার জন্য বিভিন্ন দোকানে ঢুকে তাদের জামাকাপড় খোঁজ করতে গিয়ে দেখল যে তাদের জন্য প্যান্ট শার্ট নেই। সেইরকম একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ওরা হাতের কাছে ওদের মাপের সমস্ত যা পেল তাইই  কিনে ফেলতে লাগল এই ভেবে যে পরে যদি আর সেটাও না পাওয়া যায়। বিক্রেতারা ভাবল যে তাদের তো বিক্রি হওয়া নিয়ে কথা। কে কিনল না কিনল তা নিয়ে মাথাব্যথা করে কি লাভ। এদিকে ছেলেরা গিয়ে পোশাক না পেয়ে বাড়িতে ফিরে এল। যেসব বিক্রেতারা মেয়েদের অন্যান্য পোশাক রাখত তাদের মাথায় হাত পড়ল। প্যান্ট আর শার্ট তৈরীর কোম্পানিগুলো পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে আরও আরও প্যান্ট শার্ট বানিয়েও কোন কূল কিনারা পেল না। তারা অবাক হয়ে দেখল যে দিনরাত জেগে খাটাখাটুনি করেও  চাহিদা মত  পোশাক যোগান দিতে পারছে না। বাজারে আরও নতুন নতুন পোশাক তৈরীর কোম্পানি এল যারা সব এমন এমন চমকপ্রদ সব প্যান্ট, শার্ট বানাতে লাগল আর তাদের গায়ে ইউনিসেক্স লেবেল এঁটে দিতে লাগল যাতে মেয়েরা ছেলেরা যে কেউ যে কোন পোশাক পরতে পারে।  প্রৌঢ আর বৃদ্ধরা কেউ কেউ ঘরে বা বাইরে হাত পা নাচিয়ে সুর করে বলতে লাগল ‘কালে কালে কী  যে হল, মেয়ে মানুষের ডানা গজাল’। আবার কেউ কেউ বলল ‘দেশটা রসাতলে গেল’। একদিন এক সভায় বক্তৃতা শেষে মঞ্চ  থেকে নেমে দাঁড়াতেই খুব সুন্দর গলায় ওকে বোঝাতে শুরু করল এক বৃদ্ধ নারীদের কর্তব্য  ও মহিমা, এমন কি সেই সঙ্গে তাদের ঐতিহ্য। তারপর বোঝাল ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে এগুলো করা আসলে স্বেচ্ছাচারিতা। তার উত্তরে শ্যামাঙ্গী হেসে বলল, আপনার কাছে যেটা স্বেচ্ছাচারিতা, আমার কাছে সেটা মুক্তি, স্বাধীনতা। এবার বলুন কোনটার দাম বেশি ? আপনার স্বেচ্ছাচারিতার না আমার স্বাধীনতা বা মুক্তির?  সে থম মেরে চুপ করে গেল। শ্যামাঙ্গী দলের কোর কমিটিতে এবার বলল পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের ক্লাব তৈরী করে সেখানে বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের যোগদানে উৎসাহিত করা আবশ্যক। বিভিন্ন অঞ্চলে সভা সমিতিতেও ওই একই কথা বলল। দলের সকলেই সাধ্য মত সেই চেষ্টা করল। ব্যাপারটা অনেকটা জগদ্দল পাথর সরাবার মত হল। তবু এক একদিন সকালে এক এক জায়গার মানুষ ঘুম থেকে উঠে দেখল সেখানে মেয়েদের জন্য একটা করে ক্লাব মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেখানে ভোরবেলা থেকে রাত্রিবেলা অব্দি নানা বয়সের মেয়েরা কিছু না কিছু একটা খেলায় ব্যাস্ত। প্রত্যেকের জন্য প্রতিটি ক্লাবেই ক’জন  ট্রেনার ক্যারাটে শেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  

উদারপন্থী দল ক্ষমতায় থাকাকালীন খুব বেশি সমস্যা হল না। মানময়ী একদিন শ্যামাঙ্গীকে একটা বিয়ে করে ঘরসংসার করে থিতু হতে বলল। কিন্তু ছেলেদের সঙ্গে প্রেম ব্যাপারটা ওর চিরকালই মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। সবসময়ই মনে হয় প্রেমের সঙ্গে ছেলেদের সম্পর্ক খানিকটা ব্যাস্তানুপাতিক। প্রেমের নামে যেটা চলে তার খানিকটা সুবিধেবাদিতা, ক্ষমতার পরম্পরা। আর বিয়ে ফিয়ে ব্যাপারটা আসলে চিরকালই  মেয়েদের ত্যাগের মহিমা মেপে দেখা। প্রথম পাঁচ সাত বছর যদিও বা কোনরকমে চলে তারপর তো সারা জীবন ধরে চলে সহ্যগুণের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলার এক অপরূপ সংমিশ্রণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে আপনজন বলে পৃথিবীতে কাউকে একটা রাখা যেতেই পারে নিজের রক্তের সম্পর্কের। দিগন্তসেনায় সে ব্যাপারটা চালুও আছে। স্পার্ম ডোনেশন ব্যাঙ্কের সাহায্যে গর্ভধারণ। সেটাই ওর সবচেয়ে উপযুক্ত বলে নিজের জন্য মনে হল, যদিও পরের  বার থেকে সন্তান দত্তক নেওয়াটাকেই ও এ ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে ভেবে রাখল।  মানময়ীকে সঙ্গে নিয়ে আপাতত প্রথম পর্বের কাজটা সেরে  ফেলে ডাক্তারের পরামর্শে আবার কাজের জগতে ফিরে এল। ইতিমধ্যে রক্ষণশীল সমাজদল সরকারে এসেছে। দিনে রাতে এরা মানুষের প্রতিটি ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোটা এদের একচেটিয়া অধিকার ভেবে নিয়ে সেইমতই কাজকর্ম করতে লাগল তাইই নয়, সব কাজকর্ম একেবারে লাটে ওঠার জোগাড় হল। তবু মুখ গুঁজে মাটি কামড়ে পড়ে থাকল দলের সদস্যরা।

 স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেশ কয়েকটা জায়গায় শ্যামাঙ্গীকে বক্তৃতা দিতে হল। ও বলল, ‘স্বাধীনতা দিবস বলতে পরাধীনতার সমস্ত রকম গ্লানি থেকে একটা  দেশ যে দিন স্বাধীনতা পায় সেই দিনটিকে সে দেশের স্বাধীনতা দিবস বলা হয়। কিন্তু একটা রাষ্ট্রের দমন পীড়ন বা অধিকার হরণ চলে এসেছে যেমন পৃথিবীর ইতিহাসে, ঠিক সেই রকমই একদল মানুষের অধীনতা স্বীকার করে অন্যদল মানুষকে দিনের পর দিন বেঁচে থাকতে হয় আর সেইসব মানুষের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের ইচ্ছের দাসত্ব করাটা যে দিন অধীনস্থ মানুষের হয়, তার জীবনের স্বাধীনতা দিবস সেইটা হয়। আজও অব্দি একটি  মেয়ে জন্মায় বিয়ের জন্য বলিপ্রদত্ত হিসেবে। তার নিজের ভিটে তার নয়, বিয়ে হয়ে সে যেখানে গিয়ে থাকবে সেটাই তার নিজের বাড়ি বা ভিটে ভেবে নেওয়াটা তার মহৎ কর্তব্য। আর সেই হিসেবে দেখতে গেলে আমরা মেয়েরা জন্ম উদ্বাস্তু । আমাদের কোন দেশ হয় না , ভিটে বলেও কিছু হয় না। এমনকি এক দেশে জন্মে বিবাহসূত্রে সে অন্য দেশে গেলে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে সেটাই তার নিজের দেশ, যেখানে জন্মেছে সেটা নয়! এটা কত বড় অমানবিকতা, কত বড় রকমের মানবতার অপমান, সেটা ভেবে দেখার সময় এসে গেছে কিন্তু এবার, বলেই আমার মনে হয়। আমি সকলকে বিষয়টা ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। মেয়েদের জীবন এবং যাপনের সবটুকু খুব ভালো করে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা আসলে ক্রীতদাস হিসেবেই ব্যাবহৃত  হয়। অন্যের  সেবা করতে করতে, অন্যের ফাইফরমাস খাটতে খাটতে, তাদের নিজের নামটুকু, পদবীটুকু পর্যন্ত তাদের নিজেদের থাকে না। কেননা অনেক সময়ই আমি দেখেছি পয়সাওলা শ্বশুরবাড়ি বাড়ির নববধূর নব নামকরণ করেছে। তাকে কোন কোন কাজ করতে দেওয়া হবে না হবে, কোন পোশাক, কিরকম সাজগোজ সে করবে তার ফর্দ তৈরী হচ্ছে। কখনও একবার কারুর মনে হয় না, এগুলো অমানবিকতা। কেননা এটাই প্রথা, ঐতিহ্য। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়ে আমরা যেন ভাবি, এই মুহুর্তে পৃথিবীতে থাকা প্রায় প্রত্যেকটি দেশ বা রাষ্ট্র সকলেই ভেবে দেখি সমাজের, সভ্যতার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মানুষকে বাকী অর্ধেক সংখ্যক মানুষকে দমিয়ে, দাবিয়ে রেখেছি স্রেফ নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার  বন্দোবস্ত হিসেবে। মেয়েদের জীবন আসলে দাসত্বের জীবন। সেই দাসত্বের থেকে মুক্তি পাওয়া এবার বড্ড জরুরী হয়ে উঠেছে। আমি দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে ভেবে দেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি’।   

ডাক্তারের পরামর্শে মানময়ী, অলঙ্কৃতা, অনঙ্গ শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে দিগন্তসেনায় গিয়ে থাকতে লাগল। ঠিক হল, যদিও প্রয়োজন পড়বে না, তবু যদি পড়ে, তাহলে সুদাম চলে যাবে। ব্যবস্থাটা কিন্তু শ্যামাঙ্গীর মনঃপুত হল না যে সেটা মানময়ী ধরে ফেলল। শ্যামাঙ্গী মনে মনে চায় পুরো ব্যাপারটা নিজেই পরিচালনা করতে শেষ অব্দি। সেই জন্যেই সে নিজের বাহিনীকে সতর্ক করে রাখল যাতে প্রয়োজনে তারা আসতে পারে ও পরিস্থিতিটা সামলাতে পারে। অবশেষে সেই মোক্ষম সময়টা এল যখন শ্যামাঙ্গী প্রসববেদনা সহ্য করে ফুটফুটে শিশুর জন্ম দিল আর সে জন্মাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারস্বরে এই পৃথিবীতে তার আগমন বার্তাটি ঘোষণা করল। কদিনের মধ্যেই শ্যামাঙ্গী চলাফেরা করতে করতে বাইরে দাঁড়িয়ে তার সহকারীর সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগল দিগন্তসেনার নানা প্রকল্প নিয়ে। শিশুটিকে খাওয়ানোর সময় বাদ দিয়ে বাকী সময়টা  গোটা দিগন্তসেনা ঘোড়ায় চড়ে টহল দিতে দিতে নানা জায়গায় নানা কাজকর্ম দেখাশোনা করতে লাগল। বাচ্চাদের স্কুলটা ভালোই চলছে। তবে খেলাধুলোর মাঠটা আরও একটু বড় হলে ভালো হত বলে ওর মনে হল। ইতিমধ্যে মূল ভূখন্ড থেকে খবর এল রক্ষণশীল সমাজদলের তান্ডবে তার দল নবদিগন্ত উন্মোচন হিসেবের মোটামুটি একেবারে দফা রফা। ব্যাপারটা সহ্য করা ওর পক্ষে খুবই মুস্কিল হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে ও দিগন্তসেনার বেতার তরঙ্গে ঘোষণা করল, রক্ষণশীলসমাজ দল যে বাড়াবাড়িটা করছে সেটা যদি তারা অবিলম্বে বন্ধ না করে তাহলে ও তাদের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ওদের ঠেকাবার জন্য যত দূর যেতে হয়, যাবে আর খুব তাড়াতাড়িই ওরা যেন ওর সঙ্গে সম্মুখ সমরের জন্য প্রস্তুত হয়। ওষুধে কাজ হল অনেকটাই। এ পর্যন্ত ওদের এখানকার  সাতাশটা জুটির একটি করে সন্তান হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের সবার বয়েসও বিভিন্ন। সকলেই খুব ছোট। যেসব মেয়েরা একা আছে, তারা বেশির ভাগই মা হবার ঝক্কিটা নিতে চায় না। কিন্তু সন্তান চায়। ফলে দত্তক নিয়েছে তাদের অনেকেই আর সেই শিশুরা এখন স্কুলে পড়ছে। তবে ছেলেদের মধ্যে দুটি সমকামী দম্পতিও দুটি মেয়ে দত্তক নিয়েছে। শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে ওদের চমৎকার সখ্যতা। আর মা হবার পর ওরা ওর বাচ্চাকে দেখতে এসেছিল আর এসে বাচ্চাকে সামলাবার নানান উপায়ও বাতলে দিয়ে গেছে। একটা জুটি হল ফ্রান্সিস্কো ও ফ্রেডারিখ, আর অন্য জুটিটা হল পিয়েত্রো ও উইনস্টোন। এদের বাচ্চারাও যেহেতু আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়ছে, তাই ওরাও শ্যামাঙ্গীকে জানিয়ে দিয়েছে মূল ভূখন্ডে কোনও সমস্যা হলেই ওরা সবসময়ে যেতে প্রস্তুত। দিগন্তসেনাতে এখনও যে জিনিসটা খোলা হয় নি বা দরকার পড়ে নি সেটা হল বিবাহ রেজিস্ট্রেশন অফিস। যে কজন জুটির সন্তান জন্ম নিয়েছে তাদের নামকরণও তাদের মায়ের নামানুসারেই হয়েছে।  আর সেটা ওই জুটিদের নিজস্ব ইচ্ছেতেই। তবু ভবিষ্যতে দরকার মত এ ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা করা যাবে ভেবে রাখল শ্যামাঙ্গী।

ইতিমধ্যে কিছু দরকারি কাজে পালমা বলে একটি মেয়ে মূল ভুখন্ডে গিয়েছিল আর উঠেছিল একটা হোটেলে। একদিন রাতে বাড়ি ফেরবার পথে ওকে কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের ছেলে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে একটা মাঠে ফেলে ধর্ষণ করে। তারপর বিদ্ধস্ত অবস্থায় সে খুঁজে খুঁজে স্থানীয় থানায় গিয়ে গোটা ঘটনাটা জানায়। তারপর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে ও সোজা দিগন্তসেনা ফিরে আসে। পুলিশ এখনও কাউকে ধরতে পারেনি। এই ঘটনায় শ্যামাঙ্গীর রাগ ও ক্ষোভের পারদ চড়তে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে বেতারতরঙ্গ মারফত ঘটনাটা গোটা পৃথিবীকে জানান হল। শ্যামাঙ্গী মূল ভূখন্ডের  সরকারের কাছে অবিলম্বে ধর্ষকদের ধরে ওর হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায়। এর জন্য আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দেওয়া হয় রক্ষণশীল সমাজ দলের সরকারকে। রক্ষণশীলদলের মন্ত্রীরা এক একজন এক এক মতামত ব্যক্ত করল যার মোদ্দা কথাটা হল এই যে মেয়েরা বাইরের জগতে নানা পোশাকে বেরায় বলেই এগুলো ঘটে। তাছাড়া সামান্য একটা ধর্ষণের ঘটনাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার মত সময় সরকারের নেই, তাদের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এইসব। ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। গোপনে সংবাদ পাঠানো হল সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যে তাদের বিশেষ কয়েকটা জায়গায় সরিয়ে দেওয়ার ব্যপারে। সকলেই সবুজ রঙের ওপর বিভিন্ন রকমের গাছের পাতায় চিত্রিত বিচিত্র সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় প্রস্তুত। সময় একটু একটু করে পেরিয়ে যাচ্ছে, তাতে সরকারের কোন হেলদোল নেই। কোন কোন মন্ত্রী কী করে পাশের দেশের সামান্য খানিকটা জমি দখল করে নেওয়া যায় তাই নিয়ে পরিকল্পনা করতে বসলেন। আবার কেউ কেউ সামনের বছর দেবী আরাধনা উপলক্ষে নাগরিকদের কি কি সুবিধা দেওয়া যায় তাই নিয়ে মিটিং করলেন। অপরাধীদের ধরার কোন চেষ্টাই কারোর দেখা গেল না। শ্যামাঙ্গী তার বাহিনীর কিছুটা দিগন্তসেনায় রেখে বাকীটা নিয়ে মূল ভূখন্ডে গোপনে প্রবেশ করল। যুদ্ধের  প্রথম ঘোষণা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা একটা খালি গাড়িকেই বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হল। হতাহত কেউ তাতে হল না। এরকম ভাবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে সাত জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের বাড়ির সামনে ওদেরই কেউ একটা করে খালি গাড়ি রেখে চালক সহ দূরে চলে গেল আর তারপর সেটাকেই বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হল। তারপরেই শুরু হয়ে গেল দুপক্ষের যুদ্ধ। উত্তরোত্তর সরকারী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হতে লাগল। দিগন্তসেনার সৈন্যদেরও কেউ কেউ আহত হল। তবু যুদ্ধ চলল। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা কঠোর নিরাপত্তা বেস্টনীর মধ্যে নিজেদের মুড়ে রেখে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিল। ফলস্বরূপ  বেশ কিছু সেনা আহত ও নিহত হল। তারপর একজন মন্ত্রীর কনভয়ে বোমা ফেলা হল পরপর পাঁচটা মন্ত্রীসহ গোটা কনভয় স্রেফ আগুন আর অনর্গল কালো ধোঁয়া হয়ে হাওয়ায় মিশে যেতে থাকল। দূরদর্শনে সেই দৃশ্য দেখানোও হতে থাকল। বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এবার নড়েচড়ে  বসতে শুরু করেছে। দেশের আরও কতগুলো জায়গায় সাতটা মন্দির, আটটা  মজজিদ  এবং তিনটে গীর্জা যেগুলো কিনা তালাবন্ধ অবস্থায় এমনিই পড়ে ছিল, সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া হল। দুপক্ষের অজস্র সেনা আহত ও নিহত হল। দিগন্তসেনার বেতার ও দূরদর্শনেই এই সমস্ত খবরের সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল কর্নেল সি শ্যামাঙ্গী গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। চতুর্দিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। উইং কমান্ডার বেঁকে বসার ফলে ওদের তরফ থেকে আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ ব্যাহত হল। বিদেশের বেশিরভাগ রাষ্ট্রপ্রধানই তাদের বিবৃতি দিয়ে রক্ষণশীল সমাজ দলকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দিতে থাকল। দু পক্ষের থেকেই আপাতত যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হল। দিগন্তসেনার তরফ থেকে জানানো হল ধর্ষককে যেখান থেকে পারে খুঁজে নিয়ে এসে অবিলম্বে দিগন্তসেনার হাতে তুলে দেওয়ার দাবী। সব বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানই এ ব্যাপারে সহমত হল। আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দেওয়া হল। সবাইকে পাওয়া না গেলেও যে তিনজনকে পাওয়া গেছে, দশ ঘন্টার মাথায় তাদের দিগন্তসেনার সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হল। প্রস্তাবিত ও ঘোষিত শাস্তি হিসেবে তাদের খোজা করে দেওয়া হল। বারবার করে সেই বক্তব্য ও ওই তিনজনকে বেতার ও দুরদর্শনে শোনানো ও দেখানো হতে থাকল এইজন্যে যে যাতে এই দৃষ্টান্তটা সবসময় সকলের মাথায় থাকে।

 

(ক্রমশ)  

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন