রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(২৩)

 

সাঁঝ বলছিল, আমার মনে পড়ছে ও আমাকে নিজের মতো করে একদিন ব্যাপারটা বুঝিয়েওছিল। গোটা দেশে হাসপাতাল শ্মশান জেলখানা কাক শকুন আর কুকুরের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তার সৌন্দর্যবোধ। ফুলের সৌন্দর্য আছে, সুগন্ধও আছে। ফুলের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। এভাবেই গড়ে তুলতে হবে একটা বিকল্প সংস্কৃতি। আর তা করার জন্য ও নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে।

দিশারী বলেছিল, ওর আরও একটা সুবিধা ছিল। ও কখনও নিজেকে হৃদয়ের প্রতিপক্ষ ভাবেনি। কখনও হৃদয়ের প্রতি ঈর্ষাবোধ করে নি। ও শুধু একজন বন্ধুই হতে চেয়েছিল। আর বন্ধুহিসাবেই নিজের যা কিছু করার তা সবকিছুই করতে চেয়েছিল। ও হৃদয়ের প্রতিটি কথায় বিশ্বাস করত। বিশ্বাস করত বন্ধুত্ব মানে আসলে একটা খোলা বই। সেখানে কোনও লুকোচুরি চলে না। কোনও গোপনীয়তার জায়গা নেই সেখানে। সেখানে সবাই সবার জন্য ভাববে, সবাই সবাইকে অনুভব করবে, নিজেদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনা, পড়া লেখা ছবি গান বই সিনেমা, অর্থাৎ সমস্ত স্মৃতি স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। সবাই মিলে একসঙ্গে পরস্পরকে ভালোবাসবে, একে অপরের জন্য ত্যাগ করবে, দরকার হলে স্বার্থ ও প্রয়োজন বিসর্জন দিয়ে নিজেদের উজাড় করে দেবে। একজন বন্ধু তার রোজকার জীবনের এমনকী সবচেয়ে তুচ্ছ ঘটনাটিও বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে। সৎ উদার ও মুক্তমনের অধিকারী হবে প্রত্যেকেই। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করবে। কোনও অবিচারকে মেনে নেবে না। কখনও কোনও আপোশ করবে না। ফুল শুধু ফুল নয়, হৃদয়ের কাছে ফুল ছিল সেই মুক্ত শাশ্বত মহৎ আত্মার প্রতীক। ফুল তাই সে এতো ভালোবাসত। ওঃ! কী একটা ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল হৃদয়! তাও এই যুগে। দেশের এই অবস্থায়। একটা কল্পনার রাজ্যের বাসিন্দা ছিল সে। কী প্রচণ্ড আবেগ! কী বিস্ফোরক প্রাণশক্তি! মানুষকে ভালোবাসার কী বিপুল ক্ষমতা! কেউ তাকে বিশ্বাস করেনি। শুধু কিছুদিনের জন্য একটু ঘোর লেগেছিল মাত্র। ঘোর কেটে গেলেই যে যার মতো করে নিজেদের লুকোতে শুরু করেছিল। নিজেদের আসল স্বভাব, ছোটো ছোটো মন প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। অথচ কেউ নিজেকে প্রকাশ করতে চায়নি। সবারই হৃদয়ের চোখে ছোটো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কেউ নিজেকে ছোটো করতে চায়নি। শুধু যে যার মতো কেটে পড়ার রাস্তা খুঁজছিল। অবশ্য যথাসম্ভব ফুলের বাগানটিকে ব্যবহার করার পর। তখন ওরা বুঝতেও পারেনি ঘোর লাগা এই সামান্য কয়েকটা বছরই কীভাবে ওদের সবার জীবনই বদলে দেবে। ওদের সবার জীবনই বদলে গেছিল, আর সেই বদলকে ঠেকানোর কোনও উপায়ও ওদের জানা ছিল না। ফুলের বাগানটা তছনছ, লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। একমাত্র বিশ্রুত ছাড়া। ওর কখনও ঘোর কাটেনি। একমাত্র ও-ই এবং শ্রবণ হৃদয়কে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিল। আর ভাবত, হৃদয়ের কথামতো সত্যিই বুঝি সবকিছু হওয়া সম্ভব। যদিও হৃদয়ের থেকে বিশ্রুতর বাস্তববোধ অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সেই বাস্তববোধের সঙ্গে হৃদয়ের দেখানো স্বপ্নের একটা সামঞ্জস্য বজায় রেখে ও চলতে জানত। হ্যাঁ, নিজের বাস্তববোধকে ও যেমন কখনও বিসর্জন দেয়নি, তেমনই হৃদয়ের স্বপ্নকে সফল করারও আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে, তার কোনওভাবে ক্ষতি করার বা তাকে দুর্বল করে দেওয়ারও চেষ্টা করেনি। জীবনের যা কিছু সুন্দর ও মহৎ, তা নিয়ে ওর মধ্যেও নেশা ধরে গেছিল। যদিও সেই নেশা ওকে আত্মহননের পথে নিয়ে যায় নি।

সাঁঝ একটু হেসে বলেছিল, আসলে ওর মন ছিল সাদা পৃষ্ঠার মতো, সেখানে সব কিছুই সহজে দাগ কেটে যেত। এই ব্যাপারটাই ছিল শ্রমণ আর প্রথমদিকে সমিধার মধ্যে। যে কারণে সমধাকে নিয়ে বহুদিন বিভ্রান্ত ছিল হৃদয়। আসলে ফুলের বাগানের এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল বিশ্রুত আর তার জন্য ওকে পরে দামও দিতে হয়েছিল অনেক, ভালোমানুষির দাম...

ইতিমধ্যে বিশ্রুতর জীবনে এসেছে দিশারী। ডান্স কলেজে দুজনে একসঙ্গে নাচ করত। সাত বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েছিল দিশারী। তার বাবা ছিলেন খুব স্নেহপ্রবণ। বিশ্রুতর মধ্যে সেই স্নেহপ্রবণ পুরুষটিকেই আবিষ্কার করেছিল দিশারী। অন্যদিকে বিশ্রুত জীবনে নারীর কোমলতার কথা শুনেছে মাত্র। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে কড়া শাসন ছাড়া কিছু পায়নি। তার মা মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তেন ঠিকই, কিন্তু তারপরই নিজেকে শক্ত করে তুলতেন। তখন তাঁর শাসন দ্বিগুণ বেড়ে যেত। নারী কত কোমল হতে পারে, দিশারীকে দেখেই তা প্রথম জেনেছিল বিশ্রুত। দিশারী ছিল চাপা স্বভাবের। কিন্তু যখন সে কথা বলত গভীরভাবে বিশ্রুতর দিকে তাকাত অথবা অনেক কথার মধ্যে চুপ করে থাকত, তখনই বোঝা যেত সে আসলে কতটা সংবেদনশীল। শব্দকে চেপে দিলেও আবেগকে সে চেপে রাখতে পারত না। একই অবস্থা হত বিশ্রুতর। আবেগে দুজনেই কেমন থরথপ্র করে কাঁপত। আর ইয়খনই বোঝা যেত কত গভীরভাবে তারা একে অপরকে ভালোবাসে।

ফুলের বাগানের সঙ্গে দিশারীও একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ছিল। বিশ্রুতই ওকে জড়াচ্ছিল। দিশারীও নিজেকে জড়িয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছিল। একটি আড্ডায় একদিন দিশারীকে নিয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে অনেকটা দূর হেঁটে গিয়েছিল বিশ্রুত। সেদিনই দিশারীকে ও মন খুলে নিজের ভালোবাসার কথা জানায়। দিশারীর হাত নিজের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরেছিল বিশ্রুত। দিশারী সে হাত ছাড়িয়ে নেয়নি। মুখে কিছু না বললেও বিশ্রুত যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল।

দিশারীর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটত বিশ্রুতর। কিন্তু তাই বলে ফুলের বাগানের কাজে কোনও অবহেলা করত না সে। আগের মতো নিয়মত ফোনে খোঁজখবর নিত। যেদিন আসার কথা সবার আগে পৌঁছে যেত। সঙ্গে করে নিয়ে আসত দিশারীকে। দিশারী নিজেও খুব ফুল ভালোবাসে। বিশ্রুতকে জন্মদিনে সে প্রথম যে উপহারটি দিয়েছিল তা ছিল একটি ফুলের গুচ্ছ। কিন্তু ওরা না চাইলেও সময় নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এটা হৃদয় বুঝেছিল। প্রেমের সেই প্রথম দিনগুলোয় কে-ই বা ভীড়ভাট্টা চায়! সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতে ওদের দুজনেরও মন চাইত। আর সেই সময়টা একটু একটু করে বেড়েও যাচ্ছিল, ওদের অজান্তেই হয়ত বা।

কিন্তু সে সময়েই আবার একটা সঙ্কট দেখা দিল। দিশারী ক্রমেই আরও বেশী করে বিশ্রুতকে জানতে পারছিল। এই জানার মধ্যে ওর পরিবারও ছিল। আর সেখানেই জোর ধাক্কাটা খেল সে। ওর মতো সূক্ষ্ম মার্জিত রুচির মেয়ের পক্ষে অমার্জিত ওই পরিবারে গিয়ে মানিয়ে নেওয়া অসম্ভব বলেই মনে হল। বিশ্রুতকে সে বলল, এখানে আমি থাকব কী করে?

বিশ্রুত গম্ভীর হয়ে গেল। সমস্যাটা সে বুঝেছে।

হৃদয়েওও এই একই সমস্যা হয়েছে ওর পরিবার নিয়ে। দিশারী ও হৃদয় অনেকটা একরকম। সংবেদনশীল আবেগপ্রবণ মার্জিত রুচির। কিন্তু হৃদয় উচ্ছ্বাসপ্রবণ। দিশারী সেখানে সংযত, চাপা। এই ঘটনা হৃদয় ও দিশারীকে একে অপরের প্রতি সহমর্মী করে তুলল। বিশ্রুতর পরিবার নিয়ে হৃদয় নিজেও যথেষ্ট ভুগেছে। কিন্তু সে তো আর ওই বাড়িতে গিয়ে থাকবে না, কিন্তু দিশারী ওই স্থূল রুচির মানুষগুলির মধ্যে গিয়ে থাকবে কী করে? হাঁপিয়ে উঠবে না? শ্রমণের সান্নিধ্যে, মাসিদের সাহচর্যে, এক খোলামেলা, ঝলমলে পরিবেশে সে মানুষ হয়েছে।

তবু বিশ্রুত জানতে চেয়েছিল, চেষ্টা করে দেখবি না একবার?

হ্যাঁ, অবশ্যই করব। দিশারী বলেছিল।

দিশারীকে নিয়ে মাঝেমধ্যে সমধার বাড়িতেও যেত বিশ্রুত। সমিধা ছিল খুব একা। দূরের একটা দ্বীপে সে থাকত। সব সময়ে হৃদয়পুর দ্বীপে আসতে পারত না। তার কাছেই যেত অনেকে। শুধু সমিধাকে সঙ্গ দেওয়া নয়, উপরি হিসাবে ছিল ভালো খাদ্য, প্রচুর খাতির এবং প্রাসাদের মতো একটি বাড়িতে সময় কাটানোর সুযোগ। বিশেষ করে মেহুলোকে নিয়ে আগ্নেয় আর উপমাকে নিয়ে বিহান তো প্রায়ই যেত। নিজেদের বাড়িতে যে অভাব দারিদ্র আর অন্ধকার দেখতে ওরা অভ্যস্ত ছিল, সমধার বাড়ির আলোবাতাসে তা থেকে ওরা মুক্তি পেতে চাইত। বিশ্রুত আর দিশারী কিন্তু যেত শুধু সঙ্গ দিতেই। কখনও কখনও ওদের সঙ্গে যেত সাঁঝ।        

 

 (ক্রমশঃ) 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন