কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৩ |
শুঁয়োপোকার শুঁয়ো
অঙ্গরি
রে জঙ্গরি কাউয়া মারে সুঙার
কার
হাতে গুটি আছে বল তো রাজার কুমার
এই বিকেলটুকুই নিজস্ব। স্বাধীন। কয়েকটা সজনেগাছ আর আমড়াগাছ ঘেরা এইটূকু মাঠ ও পনেরোজন সাথী। তবুও তো মাঠের তিন দিশায় অস্বস্তি। প্রাণ মন দেহ ইঞ্চি ইঞ্চি কমিয়ে দেয়। বিকেল ঢলে এলেও মাঠের ডানদিক দিয়ে একসার মাংসের দোকান থেকে ঝোলানো দেড় মানুষ প্রমাণ ছাল ছাড়ানো মস্তু প্রাণীমাংসের গন্ধ ভেসে আসে।
এই দোকানগুলো হালে বসেছে। পার্টিঅফিস হুকুম দিয়েছে। মাস ছয়েক আগে গোবরির চোখের সামনে মাতৃসম ধবলিকে নিয়ে গেল বুচারেরা। খুব কম দুধ দিচ্ছিল বলে বাপ বুড়ি গাইকে বিকে দিল। এখানে হঠাৎ হঠাৎ মায়ের পচা মাংসের গন্ধ পায় গোবরি।
গোবরির বয়েস বারো। চতুর্থ বালিকা সন্তান। ছেলে না হওয়ায় আশাহত ওর নাম দিয়েছে গোবরি। মাঠের বাঁদিকে গাঁজেড়ি আসর বসে। গাঁজার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। চেনা যায় না কে কেমন। মাঠের পিছন দিকে বিকেল পড়তেই শুরু হয়ে যায় নির্লজ্জ মলত্যাগ। তখন ওদের খেলা শেষ করতেই হয়। কিন্তু ইস্কুলের মিড ডে মিলের শেষে এঁটোপাতা পরিষ্কার করেই সাততাড়াতাড়ি দৌড় মারে গোবরি। মাঠে এসে পালিয়ে বাঁচে।
আজ এখানে এসেই দেখে চোদ্দজন বসে, একটা আসন ফাঁকা। যে দাঁড়িয়ে আছে সে ঢেলকি। বলল, 'গোবরি তুই ওখানে বোস, আমি আজ রাণি।' গোবরির মনে কষ্ট। আজ পনেরো দিন পরে তার পালি ছিল। পনেরো জনের মধ্যে এই ঢেলকিকেই তার ভাল্লাগে না। পাকা। খালি জায়গায় বসতে বসতেই চোখে পড়ল কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আদুড় গা লুঙ্গি পরা নগরু। মুখে মোল্লাকাট দাড়ি। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গোবরির দিকে। গোবরি ফ্রক টেনে পা ঢাকল। নগরু ঢেলকির মামা।
মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঢেলকি চেঁচিয়ে বলল, 'ইষ্টার্ট। চোখ বন্ধ। সবার কোল ছুঁয়ে বোলি বলব। গুটিপাথর কার কোলে, যে তার নাম বলবে সে হবে রাজা। না পারলে আউট, কিন্তু কেউ উঠবে না। চোখ বন্ধ করে বসে থাকবে।'
সবার চোখ বন্ধ। 'অঙ্গরি রে জঙ্গরি...' সবার কোলে ঢেলকির হাত ফিরতে লাগল। কয়েকটা রাউন্ড পর গোবরির অস্বস্তি খুব বাড়তে থাকে। খেলার নিয়ম, চোখ বন্ধ। আজ কেন এমন মর্দানি হাত কোল হাতড়াচ্ছে বারবার? ঢেলকির হাত তো এমন নয়? খেলার নিয়মে হাত সবার পিছনে। গুটি পড়বে কোলে। আবার এক রাউন্ড। অঙ্গরি রে জঙ্গরি...। আঃ। এবার আর্তনাদ করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল গোবরি। সবাই চোখ খুলে দেখল, গোবরি দুহাতে শক্ত করে নগরুর হাত ধরে আছে। ঢেলকি পালিয়েছে।
নগরু পালাবে কি, ধরে ফেলল সবাই। বোঝা গেল সবারই একই অভিজ্ঞতা। টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরল সজনেগাছের গোড়ায়। সজনেগাছে অজস্র শুঁয়োপোকা। নগরু আছাড়িপিছাড়ি খায়। গোবরি তার সারাগায়ে শুঁয়োপোকা লেপতে থাকে আর গান গায়, 'অঙ্গরি রে জঙ্গরি কাউয়া মারে সুঙার'।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন