কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৩ |
ছোঁয়াচ
“আপনি
স্লিপের উলটোদিকে আরেকটা সই করুন। বুঝতে পারছেন না নাকি?”
কাউন্টারে
যে যুবক ব্যাংককর্মী বসে আছে সে বেশ জোরের সাথেই কথাটা বলল। কণ্ঠস্বরে বিরক্তি
স্পষ্ট।
সামনের
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হাতের পেন তবুও নড়ল না। তিনি যেন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
“সই?”
“হ্যাঁ,
সই…কতবার বলতে হবে?”
“কিন্তু…আমার
নাম? আমার নামটা যে মনে পড়ছে না…সই করব কী করে?”
“নাম মনে
পড়ছে না মানে? আজব পাবলিক তো! নিজের নাম মনে পড়ছে না?”
“না…মানে”
“আপনি
অন্য কারো চেক নিয়ে আসেননি তো? আপনারই তো এই চেকটা?” ব্যাংককর্মী এবার সাবধানী। কিছু
একটা সন্দেহ হয়েছে তার।
বৃদ্ধ
ভদ্রলোকের দু’জন পরেই রজত লাইনে দাঁড়িয়ে। সে এগিয়ে যায়।
“মেসোমশাই
কী হয়েছে?”
বৃদ্ধ
রজতের দিকে চাইলেন।
“আমার
নিজের নাম মনে পড়ছে না…বাবা! সই করব কী করে? টাকা দেবে না তো এরা তাহলে। কী হবে?”
বৃদ্ধের হাত কাঁপছে। চোখের কোণ ভিজে গেছে। কাঁদছে নাকি?
রজত
দক্ষতার সাথে মধ্যস্থতা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিল। ভদ্রলোকের স্মৃতি যে বড়োসড়ো গোলমাল করছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
কাউন্টারের ছেলেটা ঠিকমতো ব্যবহার করেই ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতে পারত। যাইহোক,
বৃদ্ধকে তাঁর নাম মনে করানো হল পাসবই দেখে, তাঁর করা সই মিলল, তিনি টাকাও পেলেন।
রজতের
কিছু টাকা জমা দেওয়ার ব্যাপার ছিল। সেটা মিটিয়ে পিছু ফিরতেই দেখে বৃদ্ধ তখনও
দাঁড়িয়ে।
“তোমাকে
কী বলে যে ধন্যবাদ দেব, বাবা! অনেক কিছুই মনে থাকে না আজকাল, বুঝলে? কিন্তু নিজের নামটাও যে ভুলে যাব…”
রজত বৃদ্ধের দিকে পূর্ণ চোখে তাকাল। ও বৃদ্ধকে ভালোই চেনে। প্রণব দাশগুপ্ত। রজতদের পুরনো পাড়ার প্রতিবেশী। একেবারে পাশের বাড়ি নয়, কিন্তু একই পাড়ার। উচ্চপদস্থ সরকারী আধিকারিক ছিলেন। অত্যন্ত অহংকারী আর দুর্মুখ। রজত একবার অ্যাটেস্টেড করাতে গিয়েছিল। একেবারে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন যা-তা কথা বলে। সেই লোকের এই অবস্থা! স্মৃতির অবস্থা তো শোচনীয়। অ্যালঝেইমার্স না কি বলে যেন? প্রণব দাশগুপ্তের দুরবস্থা দেখে রজতের কি খারাপ লাগছিল? না বোধহয়। অপমান পুরনো হলেও কি অত সহজে ভোলা যায়? ওই অহংকারী লোকের এই অবস্থা দেখে একটা হালকা ভালোলাগাও ছড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু তা তো আর প্রকাশ করা যায় না!
“আপনাকে
কি পৌঁছে দিয়ে আসব?”
“না না,
রিক্সা নিয়ে এসেছি। এটা ভুলিনি দেখো।” প্রণব দাশগুপ্ত হাসেন। ফোকলা দাঁতের হাসিটাও
কি বিশ্রি লাগে!
প্রণব
দাশগুপ্ত বেরিয়ে যান ধীরে-ধীরে।
কিছু পরে
রজত সিঁড়ি দিয়ে নামে। ঘড়ি দেখে। একটা কুড়ি। আরে, খুব দেরি হয়ে গেছে! তার একটা
জরুরি কাজ আছে যে! সামনেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। রজতকে দ্রুত পা চালিয়ে আসতে দেখে
সামনের ট্যাক্সিওয়ালা জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়।
“কোন্
দিকে, দাদা?”
রজত উত্তর
দিতে গিয়েও থমকে যায়। তাকে কোথায় যেতে হবে তার একদম মনে পড়ে না। সে শুধু জানে তার
একটা জরুরি কাজ আছে। কী কাজ, কোথায়, সব ব্ল্যাংক। ও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন