বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

মলয় রায়চৌধুরী

 

সমকালীন ছোটগল্প


আত্মভুক 

ঘোরের ভেতরে পাক কাচ্ছিলেন কার্তিকবাহন : আমি আমার পঁচানব্বই বছরের বুড়ো বয়সে সবচেয়ে বিস্ময়কর, সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ, আর সবচেয়ে স্মরণীয় স্বপ্নগুলো ঘুমোবার সময়ে উপহার পেয়েছি, আর তার দরুন এই মূল্যবান সংক্ষিপ্ত অস্তিত্ব সার্থক হয়েছে, আর, অদ্ভুতভাবে, আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে শুধু চোখ বন্ধ করে জেগে থাকা স্বপ্নগুলো। আমার মনের সেই নিজস্ব মহাবিশ্বের মধ্যে দৃশ্যত কী ঘটছে তা দেখার জন্য, স্কুলবালক শিশু হিসাবে, যখনই শিক্ষকদের অদক্ষতার কারণে অর্থহীনতায় বিরক্ত হতাম, তখনই আমি পেছনের সারিতে বসে চোখ বন্ধ করে অপ্রত্যাশিত ছবি দেখতাম। সেই দিবাস্বপ্ন দেখার জন্য চোখকে তৈরি করে দিয়েছিল আমার মন। বাইরের বোবা পৃথিবী তখন তার অনুমানযোগ্য বাজে কথার মধ্যে হোঁচট খেয়ে বেড়াচ্ছে। আধো-ঘুমে, যখন একজন সেবিকা রাতেরবেলায় তাঁর অর্ধেক-টাক বাবরি চুলে হাত বোলায়, কেবিএস শুনতে পান নারীর এই ক্ষমতা-কীর্তন, মায়ের হাসি-মুখ ভেসে ওঠে তন্দ্রায় :

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু জাতিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু লজ্জারূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু কান্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু দয়ারূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

ইন্দ্রিয়ানামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাং চাখিলেষু ইয়া

ভূতেষু সততং তসৈ ব্যাপ্তৈ দেব্যৈ নমো নমঃ।।

চিতিরূপেণ ইয়া কৃৎস্নমেতদ্‌ ব্যাপ্য স্থিতা জগত।

নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

মুখময়  ঘাম নিয়ে বিছানায় উঠে বসেন কেবিএস। সেবিকা শাশ্বতী গোলদার ওনাকে বিছানায় শুইয়ে বলে, ঘুমের ওষুধ খান আবার মদও খান, তাই আপনার ভালো ঘুম হয় না। এসি আঠারো ডিগ্রি করে, চাদর চাপা দিয়ে দিচ্ছি। আমি জেগেই আছি, চিন্তা করবেন না। আপনি ঘুমোন তো দিকি! কেবিএস বিছানায় শুয়ে শাশ্বতী গোলদারকে বলেন, আরে কংশাল মানে সুপারি কিলার। সুপারি কিলারদের রেট অনেক বেশি, আমার আর আমার বাপের অমন রেট ছিল না । সুপারি কিলারদের রেট শুধু একজনকে উড়িয়ে দেবার। আমরা অনেক বেশি সংখ্যায় উড়িয়ে পুষিয়ে নিতুম। সেই টাকায় বাপ জমি কিনলো আর কারখানা  বসালো। যোধপুরি লেপচাপা দিয়েও ঘুম আসছিল না। কেবিএস বললেন, বুঝলি শাশ্বতী, আমবানি-আদানিরা যদি টাওয়ার হয়, তাহলে আমরা হোমিওপ্যাথির শিশি, কিন্তু উপায়টা এক। আজকাল শুনছি কয়লার এদিক-সেদিক, গোরুপাচার, ইশকুলে টিচার, ক্লার্ক, চাপরাসি ভর্তি করা নিয়ে ভালো কামাচ্ছে লোকে, আমার বাপ বেঁচে থাকলে ওই গ্যাঞ্জামে ঢুকে কিছু আয় করতে পারতো। ছেলে আর নাতিটা কোনো কম্মের নয়। সুশীল মোদি, নীরব মোদি, বিজয়মাল্য, মেহুল চোকশি, ওরাও কত কামিয়ে নিয়েছে, যার যেমন প্যাঁচমারার ক্ষমতা। মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে শাশ্বতী গোলদার জিগ্যেস করল, যদিও আগ্রহহীন, কেমন করে? থেমে-থেমে কেবিএস বললেন, সবদেশেই বড়োলোক হবার একটা প্যাটার্ন আছে। তাঁরা প্রথমে বিভিন্ন অনীতিনিষ্ঠ উপায়ে কিছু টাকাকড়ি কামায়, তারপরে সেই ধন ব্যবহার করে ক্ষমতার কুর্সি গরম করা  রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক নীতিকে কব্জা করে।…

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন