বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

পৃথা কুণ্ডু

 

সমকালীন ছোটগল্প


অশেষ

“আপনার গল্পটি মনোনীত হয়নি।”

মেইলটা দেখে তার খারাপ লাগল না, বরং একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। না, এই পত্রিকাটি অন্তত ভদ্রতা করে জানিয়ে দিয়েছে, অন্য কোথাও গল্পটা দিতে পারবে- সে জন্য নয়। এটা যদি ছাপা হত, দেখে খারাপ লাগতে পারত তনুর। পারত কেন, লাগতই। তাতে যদি ওকে তনু আগুনের ছ্যাঁকা লাগার মত বিশটা কথা শোনাত- নোংরা, চরিত্রহীন, এক্সপ্লয়েটিভ, স্যাডিস্ট, ওর জন্য তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে— এইসব বলত, তাহলে তো কিছু বলার ছিল না। অবশ্য এ কথাগুলো নতুন নয়। প্রায়ই শুনতে হয়, তবে এমনি শোনা এক, আর সত্যি সত্যি লোকের সামনে দুঃখের প্যানপ্যানানি আর ন্যাকামি দেখিয়ে ওকে ‘ম্যালাইন’ করা... তাহলে তো তনু ওর সম্বন্ধে যা  যা ভাবে, সেগুলো সত্যি হয়ে যায়, তাই না? আর কপালটাও তেমন, তনুর জন্য ও জানপ্রাণ দিয়ে, হাজারো সমস্যা  নিজের ঘাড়ে নিয়ে যতই চেষ্টা করুক, শেষপর্যন্ত কাজগুলো সাকসেসফুল হয় না। বা জোড়াতালি দিয়ে হয়। এক এক সময় সে ভাবে, তার যদি অনেক ক্ষমতা থাকত, তনুর জন্য সে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারত। ওর জন্য কিছু করতে পেলে সে নিজে ধন্য হয়ে যেত। কিন্তু অত কপাল করে কি সে জন্মেছে? জন্ম না দিলে কি মা হওয়া যায়? ভালোবাসা দিতে গেলেই যে উল্টোদিকের মানুষটা নেবে, এত বড় দাবি করার হক তো কেউ তাকে দেয়নি। সে তো নেহাত দূর সম্পর্কের মাসি! কেন যে তনুকে তার আত্মজা মনে হয়! কোন অধিকার নেই ওর ওপর, তবুও। নিজে যা পারেনি তা পূরণের স্বপ্ন দেখেছিল ওর মধ্যে। ভালোই হয়েছে, তনু সময় বুঝে ওর কাছ থেকে সরে গেছে, এবার যদি ওর জীবনে ভালো কিছু হয়! দোষটা তারই, তনু যে আসলে ওই “কূলহারা কোন রসের সরোবরে, মূলহারা ফুল ভাসে জলের পরে”-র মত। ওকে হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করতে গেলে ঢেউয়ের ঠেলায় সরিয়ে দেওয়াই হয়। রাগ করিস না রে সোনা, আমি এমন কিছু সত্যি লিখিনি কিন্তু, যে তোর অসম্মান হবে। কেউ কিছুই বুঝতে পারত না। শুধু অনেক কথা বলার ছিল, তুই শুনতে চাসনি বলে একটু হাল্কা হবার জন্য লিখে ফেলেছিলাম, তোকে কোন দোষও দিই নি। সেভাবেই লিখেছিলাম। আর ভালোই হয়েছে, ওরা লেখাটা নেয়ও নি। আচ্ছা, আমাকে কি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবি না? আমি মরে যাওয়ার আগে যদি তোকে সব দিয়ে যাই, নিবি রে সোনা? কিছুটা অনাথ আশ্রমে দেব, নিজের নামে নয় কিন্তু... তা ছাড়া সামান্যই আছে, সেটা দিয়ে তোর যা ইচ্ছে করিস, কিন্তু নিস... তাতে কি খুব দোষ হবে?

নিজের মনেই হাসতে ইচ্ছে করে তার, একটা চরিত্র খাড়া করে নিজের কাছে নিজেরই সাফাই গাওয়া শুনে। লেখাটায় তনুর নাম তো নেই-ই, আর এসব কথাও কিছু নেই। শুধু সামান্য ইঙ্গিত,  কারো বোঝার কথা ছিল না। যাক গে, এবার ওই ফালতু লেখাটা ছিঁড়ে ফেলবে সে। কপি থাকলেই আবার হয়ত কোথাও দিতে ইচ্ছে করবে। সে তো আর সত্যি সত্যি বড় লেখক নয়। টুকটাক লেখে শখে... আর কী হবে এসব করে?

শুধু তনু কেন, সাগ্নিক আর অরিত্রাদিরও খারাপ লাগতে পারত। অবশ্য ওরা হয়ত জানতেও পারত না, জানার আগ্রহও থাকার কথা নয় ওদের। অরিত্রাদির যখন মিসক্যারেজ হল বছর পাঁচেক আগে, ও প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল, সে যতটা  পেরেছে সামাল দিয়েছে। দিনের পর দিন ওর কাজগুলো করে দিয়েছে, নানারকম কথা বলে, আরও কত রকমভাবে চেষ্টা করেছে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর। না হলে ও হয়ত নিজেকে... হে ভগবান, সেটা যে ঘটেনি, সেজন্যই তো তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তারপর এখন যদি অরিত্রাদির মনে হয় তার সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না, সে অধিকার তো তার আছে। কী এমন করেছে সে, যে অরিত্রাদিকে তার কথা মনে রাখতে হবে? নিজের জীবন নিয়ে সে ব্যস্ত, একটা মেসেজেরও উত্তর দেবার সময় যদি তার না হয়, হতেই পারে। সেটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে গল্পে ঢোকাবার তো কোন দরকার ছিল না। ছিঃ, সত্যি তার নিজের মনটা খুব নোংরা।

আর সাগ্নিক, সেই বা কেন অ্যাভয়েড করবে না তাকে? কথা উঠেছিল তাদের সম্পর্ক নিয়ে, সাগ্নিককেও লোকে দুচারটা কথা তো বলছিল! চল্লিশ বছরের এক মহিলা যদি বাইশ বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে আদিখ্যেতা করে, তাকে রাত দশটা পর্যন্ত নিজের বাড়িতে ডেকে পড়ায়, গল্প করে, গান শেখায়, তাকে চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি করে দেবার স্বপ্ন দেখায়, আর তার বিনিময়ে তাকে ‘এক্সপ্লয়েট’ করে— অর্থাৎ নিজে কম্পিউটারে তেমন সড়গড়  নয় বলে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেনটেশনটা একটু বানিয়ে দিতে বলে... তাহলে কথা উঠবে না?  কিন্তু ওকে নিয়ে  দেবদত্তার ভুলভাল কথাগুলো যদি সাগ্নিক বিশ্বাস না করত বিনা বিচারে, তাহলে হয়ত এতটা আঘাত পেত না সে। যাক গে, ভুল বোঝার অধিকারও তো মানুষের আছে। সাগ্নিক তার সঙ্গে আর কথা বলতেই চাইল না। ... কিন্তু সাগ্নিককে একটা কথা দিয়েছিল সে, কথাটা রাখা হয়নি, “চিনিলে না আমারে কি” গানটা ওকে তুলিয়ে দেওয়া হল না, ও ওর ইউনিভার্সিটির একটা প্রোগ্রামে গাইবে বলে তুলতে চেয়েছিল... পরের বছর... সেই পরের বছর আর এল না... সত্যিকারের ‘সামাজিক দূরত্ব’ চলে এল... দূর, ও নিশ্চয় অন্য কারো কাছে তুলে নিয়েছে।

তবে সাগ্নিক আর অরিত্রাদিকে নিয়েও আসল কথাগুলো তো সে লেখেনি।

তাপস, শৌভিক, আনোয়ার, বিদিশামাসি, মধুরাদি, স্বপনমামা, দেবুকাকা... আরও কত, কত মুখ ভেসে ওঠে... এদের সবার জন্য সে কিছু না কিছু করতে চেয়েছিল, তার বিনিময়ে একটু ভালবাসা চেয়েছিল।  বন্ধু তো কত রকমের হয়— ভালবাসাও। আর কিচ্ছু না, একটু মনের কথা খুলে বলার মত মানুষ চেয়েছিল, সেটাও জুটল না। মন? সেটা নিয়ে কি ধুয়ে খাবে? মানিক থাকলে আজ উল্টো করে লিখতে হত তাঁকে, “তোমার মন ছাড়া অন্য কিছুই নাই,...?” আরে তুমি নিজে যদি অ্যাবনর্মাল হও, জগতের কোন দায় নেই তোমার পাগলামিকে প্রশ্রয় দেবার। আর পাঁচজনের মত হতে পারো নি যখন, তাহলে কন্সিডারেশন চাও কোন মুখে? ছোটবেলা থেকেই তো দেখেছ, কেউই তোমায় পছন্দ করে না। আবার অত আহ্লাদ কীসের? চোখের পাতায় এত স্বপ্নের ভিড় কিসের? হিউম্যান রাইটস? আরে ওটা নর্মাল মানুষের জন্য। তোমার মত অপদার্থের জন্য নয়অপদার্থ শেষ পর্যন্ত গান গেয়ে আর সততার জোরে, ভালবাসার জোরে জিতে যাচ্ছে, ওসব সিনেমায় হয়। জীবনটা ‘দাদার কীর্তি’ নয়।

আচ্ছা, যে গল্পটা নিয়ে এত কথা—তাতে ঠিক কী ছিল? ছিঁড়েই তো ফেলেছে, আর মনে করে কী লাভ? আর তার চেয়ে অনেক মানুষ অনেক, অনেক কষ্টে আছে... তাদের চোখের জল শিশিরে শিশিরে ঝরে... কেউ শোনে না, তার কথাই বা এমন কি গুরুত্বপূর্ণ যে সবাইকে শোনাতে হবে?  বরং সে তো অনেক পেয়েছে, অনেকের চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছে, তাও কেন বলতে পারছে না, “ওগো যা পেয়েছি সেইটুকুতেই খুশি আমার মন”?

এরপর গল্পটার কথা আস্তে আস্তে ভুলেই যাবে সে। আরও কয়েক বছর কেটে যাবে, তার শরীরের মধ্যে বাড়তে থাকা রোগটা হয়ত আরও ছড়াবে, তনু ততদিনে নিশ্চয় সেটলড হয়ে যাবে, হে  ভগবান, এইটুকু অন্তত করে দিও, না... শুধু তনু কেন, অরিত্রাদি, সাগ্নিক, আরও সবাই, সব্বাই যেন ভাল থাকে— সে এখন খুব একলা, কাউকে নিজের কথা বলে আর বিব্রত করতে চায় না। কোন এক সন্ধ্যায় খুব যন্ত্রণা হলে সে হয়ত চোখের ওপর হাতটা ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকবে, এত বেসুরো লাগছে কেন সব কিছু? তার একটা গান শুনতে খুব ইচ্ছে করবে... “এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে”... আবার মনে পড়বে সেই গল্পটার কথা... কেন যে ছিঁড়ে ফেলল! আর একবার লেখা যায় না নতুন করে? কিন্তু শেষটা... শেষটা তো এখন অন্যরকম হবে...

তখন সেই হারিয়ে যাওয়া গল্পের একটা চরিত্র যদি এসে বলে,

“লিখে দিই গল্পের শেষটা? আপত্তি আছে?”

সে বলবে, “না, আপত্তি নেইকিন্তু তুমি আমার হয়ে লিখবে কেন? কেন এত কষ্ট করবে আমার জন্য?”

--“তুই কেন করেছিলি?”

--“তোমার জন্য তো আমি কিছু করিনি।”

--“মনে করে দ্যাখ।”

--“মনে পড়ছে না তো। তোমার তো কিছু দরকার ছিল না আমার কাছে। বরং আমার ছিল। যখন খুব কষ্ট হত, তখন কেন জানি না, শুধু তোমাকেই চাইতাম... কেন বল তো? সবাই চলে গেছে, তুমি কেন রইলে?”

--“এতদিন সাথে রইলাম, বুঝতে পারলি না? আমার তোকে দরকার ছিল, তোর কথাগুলোকে সুরে ফেলব বলে।  তুই যখন ‘লহো লহো তুলে লহো’ শুনতে গিয়ে “পরশ দিয়ে সরস করো” কথাগুলো রিওয়াইণ্ড করতে থাকিস, তখন তোর ওপর বর্ষা নামাব বলে। আমার তোকে দরকার ছিল, তোর দুয়ে দুয়ে চারগুলোকে সাতে এনে  দেব বলে...”

--“দুয়ে দুয়ে সাত? হয় নাকি?”

--“অঙ্কে হয় না। সৃষ্টিতে হয়। সা-তে শুরু, সা-তে শেষ, আবার শুরু।”

--“হুমম... এত কথা বলতে পারো জানলে তোমার মুখে আরও অনেক কথা বসিয়ে দিতাম। জানতাম না তো।”

--“এই তো জানলি।”

--“এত দিন বলো নি কেন?” একটু অভিমান দেখায় সে, “আমার গল্পটা যে লেখাই হল না!”

--“আজ বলব বলে।”

মুখ ভার করে থাকতে গিয়েও হেসে ফেলে সে, “সব খুব অদ্ভুত ভাবে হল, না? তোমার সঙ্গে তো আমার চেনাজানার কথাই ছিল না। কেউ চিনিয়ে দেয় নি। তোমার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক, তাও জানি না। তবু কেমন করে তুমি আমার কথাগুলো জানতে পারলে?”

--“আমাকে তো জানতেই হত। নইলে বাজাতাম কি করে?”

--“মানে?”

--“আমার হারমোনিয়ামের রিডগুলোকে আমি না জানলে, কে জানবে?”

--“কী, কী বললে?”

--“বললাম, তোর গল্পের শেষটা লিখে দিয়েছি। দেখে নিস। চললাম।”

--“আমিও... যাব...” সে বলার চেষ্টা করে। মাখঝানের শব্দগুলো কিছুতেই মনে পড়ে না।

কাগজ-কলম যেমনকার তেমনি পড়ে থাকে। পাশে একটা ফুলদানি, তাতে একগোছা রজনীগন্ধা। এ কি, কিছুই তো লেখা হয়নি। আসলে কোন গল্পই ছিল না। কোন লেখকও হয়ত ছিল না সেভাবে। তনু, সাগ্নিক, অরিত্রাদি... এরা কেউ ছিলই না কোথাও। শুধু একটা চরিত্র ছিল, চরিত্র নয়, চরিত্রের আদল... তাছাড়া সবটাই ফাঁকি, বুঝেছেন তো? একটা আষাঢ়ে গল্প লেখার শখ হয়েছিল কালো কলমটার, কিন্তু দাঁড়াল না। আজকাল তো ওদের ডাক পড়ে না তেমন। সবাই কী বোর্ডেই লেখে।

আস্তে মশাই আস্তে, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ও হো, আপনি বুঝি ফিল্মমেকার? একটা ভালো গল্প খুঁজছিলেন শর্ট ফিল্মের জন্য, গেল তো ঘেঁটে? আর আপনি? রিসার্চ করেন, তাই না? ‘উত্তর আধুনিক গল্পের শেষ’—এই আপনার বিষয়? না দিদি, আরও অনেক গল্পকার আছেন, ভালো ভালো গল্প লেখেন... তাঁদের গল্পগুলো পড়ে দেখুন, প্লিজ। এটাকে নিয়ে ভাবতে বসবেন না, এটা  নিতান্ত নিকৃষ্ট মানের লেখা।... আর আপনার কী হল, মাসিমা? একটা পুরনো দিনের ছায়াছবির মত গল্পের আশা করেছিলেন বোধহয়? শুরুটা ওইরকম হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ওই সাদা-কালো, মুছে যাওয়া দিনগুলি যে আমরা পেরিয়ে এসেছি। আর হবে না ওইরকম গল্প। আপনার মনে কষ্ট দিতে খারাপ লাগছে, ক্ষমা করে দেবেন পারলে...

ফাঁকা কাগজগুলো যেন মুচকি হেসে বলতে থাকে, কেমন দিলাম? আরে, মজাও বোঝেন না আপনারা?

ঘরে এসে ঢোকে একজন। কাগজ কলম সব তুলে গুছিয়ে রাখে। সদ্য স্নান করে এসেছে মনে হয়। একবার সে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়। একটা দেশলাই-এর বাক্স বের করে দেরাজ থেকে, আর ধূপের প্যাকেট। টেবিলের একপাশে রাখা ছবির সামনে একটা ধূপ জ্বেলে দেয়। গুনগুন করে গাইতে থাকে, “আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে...”

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন