বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

ময়ূরী মিত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


রসময় আর রসবতী

আজ ভোরে গাছগুলোর সাথে জোর মহব্বত জমেছিল আমার। হাওয়ার  ঘাড়ধাক্কা খেয়ে গন্ধরাজের ডালটা বিছানায় ঢুকে গলায় গলায় হয়ে গেল আমার  সঙ্গে। বাড়িটা গাছপালায় ছয়লাপ। রোদ জল পেয়ে গাছগুলো সারাক্ষণ এমন টগবগ করে, মনে হয় বাড়িটাই ক্ষেতখামার হয়ে যাবে কোনো একদিন!

একেকটা গাছের এক একটা গল্প। ঠিক বাঁ কোণায় একটি নিমগাছ। আমার কিশোরকালে নিমের ডালে নিয়মিত আসত এক কাঠঠোকরা। ডালে ডালে চলত তার অল্প অল্প ওড়া। নিজের খেয়ালে নিমকাঠে দাঁত ঘষটাত। আর নিঝুম দুপুরে সে ঠোকরানির শব্দে চক্ষু মুদে ভাবতাম, এই বুঝি কোনো সুন্দরপানা যুবক বাড়ির প্রধান দরজাটি ধাক্কাচ্ছে, যে পথে প্রবেশ করে নবাগ্ত। চোখ খুলে দেখতাম পাড়ার সবচেয়ে কুচ্ছিত হাড়বজ্জাত ছেলেটা গুঁড়িতে বসে দুলে দুলে  হাসছে।  নিমগাছ ও কাঠঠোকরা দুটোকেই এন্তার মুখখারাপ করতাম।

গাছদের এক জায়গা থেকে তুলে অন্য জায়গায় ফের পুঁতে দেয়ার এক অদ্ভুত  বাতিক ছিল আমার ঠাকুর্দার। যে গাছটা ধরুন বাড়ছে না বা অকালে শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাচ্ছে, তার ঘেঁটি ধরে অন্য জমিতে বসিয়ে দিতেন অবলীলায়। এতে করে গাছটার আলো হাওয়া পাবার সুযোগ হয়ত বাড়ত, কিন্তু গাছের ক্রমাগত   ঠাঁইনাড়া হওয়া মানতে পারত না মালী।

-করছেন কী! করছেন কী! বারবার জমি বদলালে গাছ মরে যাবে যে!  

আর ঠাকুরদার কথা ছিল, গাছ কচি শিশুর মতো। শিশু যেমন সারাক্ষণ বাড়িতে আটকা থাকতে পারে না, মাঝে মাঝে আলো হাওয়ায় খেলিয়ে আনতে হয়, গাছেরও ঠিক তাই। গাছও না হয় খোকাখুকু হয়ে একটু বেড়িয়ে এল!

এই গাছগুলোকে আমি ডাকতাম বেদুইন গাছ। জমি, গাছ ও গাছের ফল নিয়ে অদ্ভুত এক নৈর্ব্যক্তিক বোধ ছিল দার্শনিক ঠাকুদার। বলতেন, গাছের আবার  নির্দিষ্ট জমি কী! সারা পৃথিবীটাই গাছের। ফলেরও একা একজন ভক্ষক নয়।  যত বেশি সংখ্যক ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেবার সুযোগ পাবে গাছ, দেবার উল্লাসে ততই ফুলে ফেঁপে উঠবে সে।

সুতরাং সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেল আমাদের গাছের ফলফুলুরি। সবাই আমাদের বাড়ির ফুল যাতে নির্দ্বিধায় নিতে পারে, ভোর ভোর  দরজা খুলে দিতেন ঠাকুরদা। দেখতাম, বাড়ির প্রধান দরজা খুলে একগাল হাসছেন ফুলপ্রার্থী মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে। সব্বাইকে দেবার হাসি। ভাবুন একবার, আমাদের বাড়ির পুজোর ফুল আসছে কিন্তু বাজার থেকে!

একবার ছাদের ঠিক পিছনের বাড়িতে কাজ করতে এল বাংলাদেশের মেয়ে।  চিৎকার করে কেবল খাবার চাইত জানলা দিয়ে। বাড়ি ফেরার পথও চেনে না,  তার ব্যবসাদার বড়লোক মালিকও তাকে পেটভরা খাবারও দেয় না। পাছে পালায়, তালা আটকে বাড়িতে রেখে যেত। খাবারের জন্য কী আকুল হয়ে যেত সেই মেয়ে! ঠাকুরদা এসময় এক দারুণ ছেলেমানুষি করলেন! লোক লাগিয়ে  বাড়ির হিমসাগর গাছের সবচেয়ে বেশিসংখক ফলভরা ডালটি এগিয়ে দিলেন মেয়েটার জানলায়। প্রথম প্রথম খেত না, কেঁদেই যেত। এক বিকেলে সারাদিন  অভুক্ত থাকার পর আম চুষতে চুষতে ডালেই মুখ ডলতে শুরু করেছিল  মুক্তিকামী মেয়ে। দেখলাম, ঘন  কামনায় সে আমপাতাতেই ডলছে জিভ।  পাতাগুলোও জড়িয়ে ধরেছে তার লালামাখা মুখ। ফল পাতারও হয়ত সেদিন মানুষ পাবার ঝোঁক বেড়েছিল। খিদে গাছকে গতিবান করেছিল। জিভের চটকানিতে আম বেরোলে দেখা গেল, গোধূলির রঙের সাথে রসের তফাৎ করা যাচ্ছে না।

খিদে! খিদে! খাদ্য! একটু খাদ্য! শুকনা জিভে একটুখানি সরস! থাক তুই মানুষে। মজে। মজিয়ে।

এ গোধূলিসুখ!

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন