তকাই, তাতাবাবু ও ‘অনর্থে’র
ভুবন – ২
(১)
ঔপনিবেশিক চিন্তায় লালিত বাঙালির একটা অভ্যেস আছে। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে কোনও বাঙালির সার্থকতা বা সফলতাকে বিদেশি নাম দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা তার প্রিয় ব্যসন। যেমন বাংলার মিল্টন মধু, বাংলার স্কট বঙ্কিম, বাংলার শেলী রবি, বাংলার এলিয়ট জীবনানন্দ এবং বাংলার লীয়র বা ক্যারল সুকুমার। এত স্বতস্ফূর্ত ও স্বীকৃত প্রয়াসে এই সব খেতাব দেওয়া হয়ে থাকে, যে তেমন তৎপর পাঠক না হলে এইসব ছাঁচ নীরবে ও নিশ্চিতভাবে মনের মধ্যে গৃহীত হয়ে যায়। এই আলোচনায় অন্যদের কথা বাদ দিচ্ছি। সুকুমারের ক্ষেত্রে এই ধরনের 'নামাঙ্কন' নিতান্ত বাতুলতা। আমরা সাহেবশাসনে না থাকলে এক্ষেত্রে সুকুমারই দৃষ্টান্ত হতেন। অন্যের নামে তাঁকে চিহ্নিত করতে হতো না।
এই 'অনর্থশিল্প' সম্বন্ধে কবি এর আগে বেশ মনোযোগ দিয়েছিলেন। একবার অবনীন্দ্রনাথের একটি লেখা পড়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, যে এই ধরনের 'বিশুদ্ধ পাগলামির কারুশিল্প' অবন ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। 'দুয়ে দুয়ে চার' এই যুক্তিধারার বাইরে 'যুক্তিহীন রসবোধের' সমান্তরাল ধারা পৃথিবীর প্রায় সাহিত্যেই দেখা যায়। পণ্ডিতদের মতে 'স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত’ যুক্তি পরম্পরার বাইরে মতপ্রকাশ করা 'পাগলামি'র প্রথম লক্ষণ। কিন্তু ইতিহাস বলছে, তথাকথিত মানসিকভাবে 'স্বাভাবিক' মানুষদেরও মধ্যেও সতত এইসব 'অস্বাভাবিক' রসানুভূতি ও রসগ্রাহিতা সর্বকালেই দেখা যায়। আমাদের শাস্ত্রে একেই 'উদ্ভট রস' এবং পশ্চিমে একে 'ননসেন্স' বলা হয়ে থাকে। আপাতভাবে এ ইধরনের লেখায় মনে হতে পারে বল্গাহীন কল্পনার ঘোড়া বাস্তবের সব বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। কিন্তু এই 'ছিন্নভিন্ন' করার যে 'কারুশিল্প' তার মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রভাবশীল সৃজনশীল সিস্টেম কাজ করে চলেছে। তার নির্দিষ্ট বিন্যাস আছে, নিশ্চিত ছক আছে, আর আছে সূক্ষ্ম শিল্পবোধ। রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেই এর নাম দিয়েছিলেন 'বিশুদ্ধ পাগলামির কারুশিল্প'।(২)
এর আগে আমি উল্লেখ করেছি অভিধ্যেয় শিল্পের পরিসর সনাতন ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের বিচারে তেমন আদৃত ছিলো না। কিন্তু তা বলে এ নিয়ে যে চর্চা হয়নি, তা নয়। কারণ ব্রাহ্মণ্য সেরিব্রাল চর্চার সমান্তরাল স্রোত আমাদের দেশে চিরকালই আছে। সংস্কৃত রসশাস্ত্রে 'উদ্ভট' নামে একটি রসের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমাদের দেশে উদ্ভট রসের যে চর্চা ছিলো তার কিছু নিদর্শন কবিরত্ন পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন, উদ্ভটসাগরের সঙ্কলিত 'উদ্ভট শ্লোকমালা' নামের ১৯০৪ সালে প্রকাশিত বইটিতে পাওয়া যায়। হরিচরণের অভিধানে 'উদ্ভট' শব্দের অর্থ আছে, মহাশয়, মহাত্মা, উদার, দুর্মদ, দুর্ধর্ষ, শ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্ট, অদ্ভুত, অসম্ভব, বিস্ময়কর, উৎকট, অতিপ্রবল। শব্দসূত্র হচ্ছে উদ্ভূত- উদ্ভট। অর্থাৎ 'ঊর্ধ্বে ধৃত'। তবে আমার মনে হয় 'গ্রন্থবহির্ভূত লোকপ্রসিদ্ধ অজ্ঞাত কবিকর্তৃক শ্লোক’, পরিভাষাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রন্থবহির্ভূত ও অজ্ঞাত কবি যখন লোকপ্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন, তখন তার পিছনে ইতরযানী সাহিত্যচর্চার একটি সূত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সব কবিরা ডকুমেন্টেড ও এলিট সমাজের গ্রন্থিত সাহিত্যচর্চার বাইরের লোক, কিন্তু নিজগুণে ‘লোকপ্রসিদ্ধ’ হয়ে উঠতে পেরেছেন। স্থান করে নিতে পেরেছেন ব্রাহ্মণ্য রীতি নিয়ন্ত্রিত শব্দসাধনার মূলস্রোতে। তাঁদের চিন্তায় বা প্রকাশভঙ্গিতে পাথুরে 'যুক্তিবোধ'এর (যা সচরাচর এলিট নিয়ন্ত্রিত) উপরে গিয়ে নির্বাধ কল্পনার আধারে নিজস্ব বোধ বা অভিজ্ঞতাকে নথিবদ্ধ করার যে প্রয়াস, তাকেই অর্থ সম্প্রসারিত করে 'উদ্ভট' শব্দের মধ্যে ধরা হয়েছে। আমাদের লোকসাহিত্যে এর ভূরিভূরি প্রমাণ আমরা পাই।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য, আমি সুকুমারের রচনার নির্মাণ প্রণালীর প্রতি অনেকের যে ধারণা, তা নেহাৎ শিশু বা কিশোরপাঠ্য, তার নিরসন করতে চাইছি। 'বড়ো'দের জন্য লেখা মানে সেখানে পাথরপ্রতিম যুক্তিবন্ধন করতে হবে, মেঘ ও হাওয়ার নির্বাধ গতায়াত শুধু অবোধ বালকদের মনোরঞ্জনের জন্যই প্রযোজ্য, এই যুক্তি আমাদের দেশীয় মৃত্তিকাজাত সাহিত্যসাধনার সঙ্গে অনেক সময়ই মেলে না। এই বোধ সুকুমারের হয়েছিলো এবং এই কথাই বুদ্ধদেব বসু বলতে চেয়েছেন সুকুমারের মননশক্তির সার্থকতা প্রসঙ্গে।
(৩)
বাঙালি শিশুর বই দেখে কবিতার সঙ্গে পরিচয় সম্ভবত সুকুমার থেকেই শুরু হয়। অন্তত আমাদের সময় তাই হতো। সেই সময় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা নামে একটি ব্যাপার ছিলো। যেখানে নানা বয়সের বাঙালি শিশু-বালক-কিশোরেরা বাংলা কবিতা মুখস্থ করে প্রায়শ প্রথম স্টেজ ও মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে শিখতো। ‘পড়ার বই’য়ের বাইরে, যেখানে "পাখি সব করে রব" বা "নাই কিরে সুখ" অথবা খুব বেশি হলে "আমাদের ছোটো নদী" জাতীয় কবিতাই পড়ানো হতো, স্বাধীনভাবে বাংলা কবিতার প্রথম স্বাদ সুকুমারের লেখা থেকেই পাওয়া যেত। আমার মনে আছে প্রথম স্টেজে চড়া, প্রথম মাইক্রোফোনের সামনে, চার-সাড়ে চার বছর বয়সে শুরু হয়েছিলো, 'নমস্কার, কবি সুকুমার রায়ের ‘সৎপাত্র’...' এই উচ্চারণ থেকে। রবিকবি ব্যতীত অপর কবি হিসেবে শিশু বালকদের কাছে সুকুমারই ছিলেন একমাত্র বিকল্প। আমার মতো হয়তো কোটি বাঙালি আছেন, যাঁরা শুরু করেছিলেন, 'শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে...'। আমার পিতৃদেব আবোলতাবোল শেখানোর জন্য একটি অভিনব ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ওখান থেকে কোন একটা লাইন, যেমন, হয়তো বলে উঠলেন, 'টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে' বা ' গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা' অথবা 'কিন্তু সবার চাইতে ভালো' কোন কবিতায় আছে। বলতে পারলে 'দশ নয়া'। ওফফ... সাত রাজার ধন যেন... সাত আট বছরের বয়সের মধ্যে পুরো আবোলতাবোল কণ্ঠস্থ। আমার মনে হয় মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে বহুকাল থেকেই সঞ্চয়িতা না থাকলেও এক কপি আবোলতাবোল থাকতো, মনে হয় এখনও থাকে (তবে পরবর্তী কালে ঐ আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় জজিয়তি করতে গিয়ে দেখেছি কবিতাগুলি বাবা-মায়েরা বহুক্ষেত্রেই রোমান হরফে লিখে দেন)। সুকুমারের কবিতা প্রতিষ্ঠান হতে শুরু করেছে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে থেকেই।
(৪)
তাঁর নাটকগুলির তথ্যপ্রসঙ্গ সমকালীন হলেও তার সৃজনশীলতার বিস্তৃতি ছিলো চিরকালীন। আমাদের ভুয়ো গুরুবাদী চিন্তার অসারতা নিয়ে 'শব্দকল্পদ্রুম', যেখানে হয়তো তাঁকে প্রাণিত করেছিলেন তাঁর 'গুরু' 'হাস্যকৌতুকে'র শারাড জাতীয় রচনাগুলির মাধ্যমে। আবার সেই সময়ের সামন্তবাদী ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে 'ঝালাপালা'। বিদেশি শাসকের অবিচারের বিরুদ্ধে নির্বিষ নির্দন্ত রাজনৈতিক প্রতিবাদ আয়োজনের ছায়া দেখতে পাই 'লক্ষ্মণের শক্তিশেল' নাটকে। ব্রাহ্মসমাজের এক অংশের বদ্ধ রক্ষণশীল চিন্তার প্রতিবাদে 'চলচ্চিত্তচঞ্চরী'। আবার মধ্যবিত্তের সাজিয়ে তোলা চিন্তার জগতে নিছক কমন সেন্সের অভাব নিয়ে 'অবাক জলপান'। গল্প লিখতে গিয়ে তিনি যে মডেলটি অনুসরণ করেছিলেন, তাঁর আগে সেরকম কিছু বাংলা গল্পে আমরা পাইনি। 'পাগলা দাশু', 'হযবরল' বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ পর্যায়। সুকুমারের পরে অসংখ্য সিদ্ধহস্ত বাংলা কবি-লেখকেরা এই ধরনের লেখায় মেধানিয়োগ করেছেন। কিন্তু কেউই তাঁর স্তরটির কাছাকাছি যেতে পারেননি। তাঁর এইসব রচনা শতবার পড়া, দেখা, কিন্তু এখনও একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়ে যেতে হয়। মূলত হিউমারিস্ট হলেও ধারালো উইটের যোগান তাঁর রচনার মধ্যে বারবার চোখে পড়ে।
যখন তিনি সৃষ্টিশীলতার চড়াই ক্রমশ অতিক্রম করছিলেন, সেই সময়ই যতিচিহ্ন আঁকা হয়ে যায়। অল্প বয়স থেকেই আলোকচিত্রশিল্পে তাঁর দক্ষতা ছিলো। সতেরো বছর বয়সে ইংল্যান্ডের Boys Own Paper পত্রিকার ফোটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তাঁর তোলা ছবি পুরস্কৃত হয়েছিলো। ঊনিশ বছর বয়সে তোলা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি সারাদেশে বিশেষ সমাদৃত হয়েছিলো। ফোটোগ্রাফি নিয়ে বাংলায় সম্ভবত প্রথম প্রবন্ধ তাঁরই লেখা ১৯১১ সালে প্রবাসী পত্রিকায়। পরে তো এই বিদ্যাটিকে পেশাদারি স্তরে উন্নীত করেছিলেন। ইলাস্ট্রেটর হিসেবে তিনি সেই সময় দেশের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী ছিলেন। নিজের রচনা তো বটেই, সন্দেশের নানা লেখার সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবিগুলি পত্রিকার সম্পদ ছিলো। আবোলতাবোলের নজিরবিহীন অলঙ্করণ তাঁর রোগশয্যায় করা।
(৫)
কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ উপলক্ষ্যে কবি এসেছিলেন নবপরিণীতা বধূকে আশীর্বাদ জানাতে। তারপর সেখান থেকেই সীতাদেবীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, “...'মুক্তধারা' নাটকটি বাবাকে দিয়া গেলেন 'প্রবাসী'তে ছাপিবার জন্য... সুকুমারবাবু তখন অত্যন্ত পীড়িত, খানিক পরে কবি তাঁহাকে দেখিতে চলিয়া গেলেন”। “তারপর বড়দা অসুখে পড়লেন। শুনলাম রোগটার নাম কালাজ্বর, তার তখন কোনো ভালো চিকিৎসা ছিলো না। চোখের সামনে একটু একটু করে বড়দার শরীর ভাঙ্গতে লাগলো। অমন দশাসই চেহারার আর কিছুই রইলো না। তার আগের বছরেই বিবাহের নয় বছর পরে, বড়ো বৌঠানের সুন্দর একটা ছেলে হয়েছিলো, ঘটা করে তার নামকরণ হয়েছিলো, আত্মীয়স্বজন খুব ভোজ খেয়েছিলো। ছেলের নাম সত্যজিৎ, ডাকনাম মানিক।…
…অনেকদিন ভুগলেন বড়দা। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স, কতো ইচ্ছা, কতো আশা। বড়দার প্রথম বই আবোল-তাবোল প্রেসের জন্য তৈরি হচ্ছে। তার ছবি আঁকা হচ্ছে বিছানায় শুয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে। ছোটো মানিক তার মধ্যে হামা দিতে শিখলো, হাঁটা শিখলো। তার এক বছর বয়স হলো, জন্মদিনে ছোটোখাটো উৎসব হলো।... কিন্তু সবাই জানতো ও বাড়ির সূর্য অস্ত যাচ্ছে”। (লীলা মজুমদার)।
১৯২৩ সালে তিনি শয্যাগত হয়ে পড়েন। তবে তার মধ্যে আবোলতাবোলের মলাট আঁকছেন, ডামি সাজাচ্ছেন, লিখছেন 'ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর'। ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী এসে ভক্তিগীতি শুনিয়ে যেতেন তাঁকে। ২৯শে অগস্ট তাঁর গুরু তাঁকে দেখতে যান ১০০, গড়পার রোডের বাড়িতে। তাঁর শিষ্য, ভক্ত, বন্ধু সুকুমারকে, রবীন্দ্রনাথ শোনালেন নয়খানি গান। ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩ সাল, প্রদীপটি নিভে গেলো।
“২৩ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বড়দা তাঁর সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। মনে পড়ে মা আমাদের স্কুল থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। গড়পার রোডের সেই চেনা বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। বড়দার ঘরে কোনো শব্দ নেই। বড়দা চোখ বুজে খাটে শুয়ে আছেন, আর বড়ো বৌঠান দু হাত জোড় করে চোখ বুজে পাশে বসে আছেন, বোজা চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে স্রোতের মতো জল পড়ছে। বড়দার মা, আমার বিধবা জ্যাঠাইমা, যিনি আমার মাকে মানুষ করে ছিলেন, বড়দার খাটের অন্যপাশে মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছেন। জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিগত শোকের আঘাত বুঝলাম। এর আগ অবধি মৃত্যুও ছিলো শোনা কথা, ছবি দেখার মতো, তার যে কতো ব্যথা এবার বুঝতে পারলাম”।
(আর
কোনোখানেঃ লীলা মজুমদার)
‘আদিম
রাতের চাঁদিম হিম
তোড়ায়
বাঁধা ঘোড়ার ডিম
ঘনিয়ে
এলো ঘুমের ঘোর
গানের
পালা সাঙ্গ মোর...’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন