সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

আমার হেমন্ত




 

(১ম পর্বঃ শৈশব ও বাল্যকাল)

প্রধানত মা, এবং তাঁর সঙ্গে বাবা এবং দাদা, একটি লাল বাঁধানো খাতায় আমার জন্ম থেকে সাতবছর পূর্ণ করা অবধি আমার কীর্তিকলাপ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সেটিকেই উৎস হিসেবে ব্যবহার করে বর্তমান স্মৃতিচারণ।

২৮শে এপ্রিল ১৯৫৯, গ্রামোফোন ফেলেছে, রেডিও ফেলতে যাচ্ছিল... মার খেয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল [বাড়ীর পাঁচিলের মধ্যেই বেশ বড় মাঠ ছিল] পরে, দুধ খেতে ডাকছি যখন, তখন পালাচ্ছে আর বলছে, “তকুন আমায় নাই বা তুমি দাকলে’।

এর দু’দিন আগে, ২৬শে এপ্রিল তারিখে, লেখা আছে ‘যখন পড়বে মা নোর’ বলছি,  ‘না মোর’-এর জায়গায়।

সবাই বুঝে গেছেন বিশেষ কোন গানের রেকর্ডের কথা বলা হচ্ছে? পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’

https://www.youtube.com/watch?v=sx1q6AnMTTw


গ্রামোফোন ছিল মা’র। কালো রঙের একটি চতুষ্কোণ বাক্স, ভেতরে যন্ত্রটি। যাতে পিন লাগিয়ে রেকর্ডের ওপর বসানো হতো, সেটির গায়ে লাগানো sound box থেকেই আওয়াজ বেরোত। এখন সিনেমায় যে চোঙ-লাগানো জিনিস দেখা যায়, তার তুলনায় কিছুটা আধুনিক ছিল আমাদেরগানের কল’। অবশ্যই অধিকাংশ রেকর্ডই ছিল ৬/৭ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের প্রতি মিনিটে ৭৮-বার ঘোরা গতির।

কোন-কোন গান মনে পড়ে? ১৯৫৮ সালের ৫ই অক্টোবর তারিখে বাবা ইংরেজীতে লিখছেন যে, আমার যাবতীয় চঞ্চলতা স্থির হয়ে যেত প্রিয় গান বাজালেই।

রেকর্ডগুলো কিন্তু সহজেই ভেঙে যেত! ১৪ই নভেম্বর তারিখে মা লিখছেন যে, ‘শান্ত  নদীটি’ রেকর্ড আমি ভেঙে ফেলেছি। তবে পরে রেকর্ড বাজিয়ে ‘শান্ত নদী’ আর তার উল্টোদিকে ‘জোয়ারের গান’ বার-বার বাজিয়ে শোনার কথা মনে পড়ে। অতএব, রেকর্ডটি আবার কেনা হয়েছিল।

আর পরিষ্কার আমার নিজের মনে আছে নীল রঙের গোল লেবেল লাগানো চল্লিশের  দশকে প্রকাশিত এই গানের রেকর্ডটি, এটিও রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘হে নিরুপমা’। বিশেষ করে ‘ঝর-ঝর ধারায় আজি উতরোল’ লাইনটি মনে আছে, কারণ ওই বয়েসে ‘উতরোল’ শব্দটি স্বাভাবিক ভাবেই জানা ছিল না, ভাবতাম, পুজোর মেলায় কাঠের নাগরদোলায় চড়া হয়ে গেলে যারা দোলাটি ঘোরাতো, তারা বলত, “উতরো, উতরো,” যাতে অন্য বাচ্চারা উঠে বসতে পারে, এটা সেই ‘উতরো’!

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬০, আমাকে ভবানীপুরের ইন্দিরা প্রেক্ষাগৃহে ‘শেষ পর্যন্ত’  দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। মা লিখছেন যে, ধৈর্য ধরে শেষ অবধি বসে দেখেছিলাম,  এবং তারপর গানগুলি মনে রেখেছিলাম। ৩১শে জানুয়ারি ১৯৬১তে লেখা আছে যে,  রাতে “আমি পানু” বলে অভিনেতা বিশ্বজিতের চুলের style এবং ছবির গানগুলি নকল করছি। ১১ই ফেব্রুয়ারি লেখা আছে যে, এই রেকর্ডটি আমায় কিনে দেবার ফলে গানটি আমি ভালই তুলেছিঃ ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’।

গ্রামোফোনে হাত দেওয়া স্বাভাবিক কারণেই বারণ ছিল। বড়রা কেউ বাজিয়ে শোনাতেন। অবশেষে যখন আমাকে দম দিয়ে রেকর্ড বাজানোর যোগ্য মনে করা হল, সেদিন প্রথম যে গানটি আমার হাতে বেজেছিল সেটি হল পঞ্চাশের দশকের হিন্দী ‘শর্ত’ ছবির ‘ন ইয়ে চাঁদ হোগা, ন তারে রহেঙ্গে’, সুরকার-শিল্পী তাঁর  আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’-য় যে গানটিকে তাঁর ‘বেটি’ বলে সম্বোধন করেছেন!

এছাড়া শিশুমহলে এক শিশুশিল্পীর গলায় শুনে খুব ভাল লেগে যায় আরেকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। তার রেকর্ড খুঁজতে যাওয়া হলো রাসবিহারী এভিনিউ-এর ‘মেলডি’তে। ৭৮ গতিতে গানটি পাওয়া গেল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে, কিন্তু মন ভরলো না। এবার ৪৫ গতির একটি extended play ডিস্কে গানটি পূরবী মুখোপাধ্যায়ের গলায় শুনে বেশ লাগলো। কাছেই মাসীমার বাড়িতে আছে সেই  রেডিওগ্রাম, অতএব কিনে ফেলা হল রেকর্ডটি। কিন্তু বিধি বাম! রেডিওগ্রামের ওই ৪৫ গতিটিই অচল! ফেরৎ গেলো সে রেকর্ড! পরে সেটি আবার কেনা হয়েছিল। এবং গানটি অবশেষে সত্তরের দশকে সালে শোনা গেল সেই কণ্ঠেঃ ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’।

https://www.youtube.com/watch?v=HDbuSOI1Vnc


১৯৬৬ সালে এই গানের সূত্র ধরে ঘটেছিল আরেক কাণ্ড। ছবির নাম দেখে ঐ গানটি থাকবে এই আশায় বাবা-মা আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভবানীপুরের বিজলী প্রেক্ষাগৃহে ‘মণিহার’ দেখতে! রবীন্দ্রসঙ্গীতটি তো তাতে ছিল না, কিন্তু ছিলেন আমার প্রিয় অভিনেতা বিশ্বজিৎ, এবং পুরুষ কণ্ঠে তাঁর এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নেপথ্যে সেই তিনি! রাগাশ্রয়ী গানগুলির মর্ম তখন বুঝিনি, সবচেয়ে ভালো লেগেছিল সুরকারের স্বকণ্ঠে ‘এই নিঝুম সন্ধ্যায়’

https://www.youtube.com/watch?v=p24vqLeZYMM

২০শে এপ্রিল ১৯৬৫ সালে আমায় বাবা জন্মদিন উপলক্ষে রফি আহমদ কিদওয়াই রোডে অবস্থিত ‘মেলোডি রুম’ –এ নিয়ে গিয়ে কিনে দেন HMVর তৈরী 4-speed ‘রেকর্ড প্লেয়ার’ Playmateএর আগে ৭৮ গতির ৬/৭/১২ ইঞ্চি রেকর্ড ছাড়া পারিবারিক বন্ধু অনিল ভট্টাচার্য মশায়ের বাড়িতে প্রথম দেখেছিলাম ৩৩.১/৩ গতির  ১২ ইঞ্চি ‘লং প্লে’ রেকর্ড, যাতে এক-এক দিকে একটির পরিবর্তে থাকতো ছ’টি করে গান, দু’দিক মিলিয়ে দু’টির জায়গায় ১২টি গান! নতুন রেকর্ড-প্লেয়ারে নতুন গতি-ব্যবস্থার উদ্বোধন করতে কেনা হলো পরে HMVর ১২ ইঞ্চি লং-প্লে ডিস্ক Gems from Tagoreএকদিকে কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের এবং অপরদিকে সেই তাঁর ছ’টি করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। তাঁর গাওয়া প্রতিটি গানই গলায় উঠে গিয়েছিল। তার মধ্যে দুটি গানের কথা বিশেষ করে বলবঃ ‘মনে পড়ে, কত না দিন রাতি/ আমি ছিলেম তোমার খেলার সাথী’! যে যন্ত্রটিতে গানটি বাজতো, সেও তো নামে ছিল Playmate! আর ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’র আভোগে মনে হতো শুনছিঃ ‘মনে হয় যে পাব খুঁজি, পুলের ভাষা যদি বুঝি রে’! বুঝতেই পারছেন গানটি কীঃ ‘তুই  ফেলে এসেছিস কারে, মন মন রে আমার’।

আর ইস্কুলে, গানের ক্লাসে গাইতে বললেই যে গানটি স্বতস্ফূর্ত ভাবে গেয়ে উঠতাম, সেটিও ছিল তাঁরই রেকর্ড থেকে তোলা ‘অরূপ তোমার বাণী’

https://www.youtube.com/watch?v=KLRKE4MI7_s


হিন্দী গান প্রীতি

আমার দাদা আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়। আমি যখন ওপরে উল্লেখিত রেকর্ডগুলি শুনছি, দাদা তখন বয়েসের ধর্ম মেনে শুনছেন হিন্দী ছবির গান! শোনার জায়গা রেডিওতে ‘রেডিও সিলোন’ আর ‘বিবিধ ভারতী’। বাড়িতে প্রবেশাধিকার পেত  সায়গলের ছবির গান (‘তানসেন’) আর ‘মহল’ বা ‘বৈজু বাওরা’ ছবি থেকে লতা মঙ্গেশকর, মহম্মদ রফির গান। লক্ষ করুন যে এগুলি সব ৪০/৫০ দশকের ছবি, প্রাক-ষাট! দাদা শুনছেন এবং আমাকে শোনাচ্ছেন ‘জংলী’, ‘তাজমহল’, ‘কাশ্মীর কি কলি’র গান!  ফলে, আমি মহম্মদ রফির একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছি।

ছোট পিশেমসাই আমার আবদার শুনে কিনে দিয়েছিলেন মহম্মদ রফির গলায় মজার গানঃ

https://www.youtube.com/watch?v=rJiohcg-gKo

কিন্তু এই ৭৮ গতির উল্টোদিকে কি ছিল?

https://www.youtube.com/watch?v=EhDCAmXKBBs

আবার দাদা কিনে আনলেন হিন্দী ‘কোহরা’ ছবির রেকর্ড। আমি বেশী শুনতে ভালোবাসতাম – এবং ভয় পেতাম – লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘ঝুম ঝুম ঢলতী রাত’।

কিন্তু অপরদিকেই ছিল সেই যুগান্তকারী গান, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির ‘এই রাত তোমার আমার’ থেকে আস্থায়ীর সুরটুকু নিয়ে ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’

https://www.youtube.com/watch?v=2gMhbWeo30o

 

(২য় পর্বঃ তাঁকে চাক্ষুষ করা)

১৯৭২ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী। সেই সঙ্গে, ১৫ই আগস্ট শ্রীঅরবিন্দেরও জন্মবার্ষিকী। ৮, শেক্সপীয়র সরণীতে, যেখানে শ্রীঅরবিন্দের জন্ম হয়েছিল, এখন যাকে আমরা ‘শ্রীঅরবিন্দ ভবন’ নামে চিনি, সেখানে তখন দিনের পর দিন চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঋষির ভাবধারার অনুগামিনী ছিলেন আমার মা। অতএব প্রায় রোজই আমরা সেখানে উপস্থিত। একদিন এখানে সঙ্গীত পরিবেশন করতে এলেন সুচিত্রা মিত্র এবং সেই তিনি। দেখলাম, দীর্ঘদেহী এক সুপুরুষ (ছবি দেখেছি এর আগে) মঞ্চের সামনে দিয়ে হেঁটে এসে উঠলেন, একটু হোঁচট খেয়ে হাসলেন, তারপর একটি কাঠের চেয়ারে বসে, সামনে আরেকটি চেয়ারে রাখলেন হারমোনিয়াম। এর আগে, সুচিত্রা মিত্র পা মুড়ে বসেই গেয়েছিলেন, তাই এই ব্যাপারটা বেশ অভিনব লাগলো! প্রথমেই, তাঁর যে গানটি প্রায়ই ইস্কুলে গাইতাম, সেই ‘অরূপ তোমার বাণী’। তারপর ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে’, ‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার’ (এই গানটি প্রথম শুনলাম), ‘আমার আর হ’বে না দেরি’। আরও দু’খানি রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর (কোনগুলি আর মনে পড়ছে না) গাইলেন দেশাত্মবোধক ‘মাগো, ভাবনা কেন’ (এটি সেভাবে শুনিনি, তবে এক ইস্কুলের সহপাঠী একবার আস্থায়ীটি গুনগুন করেছিল, ৭১-এর বাংলাদেশ-যুদ্ধের সময়), তারপর ‘তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ’ (কখনো এর আগে শুনিনি!)। এর পরেই তিনি ফিরলেন রবীন্দ্রনাথে, যে গানের রেকর্ড বাড়িতে  ছোটবেলা থেকে বেজেছে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠেঃ ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। পাশের শ্রোতা বিরক্তিভরে বলে উঠলেন, ‘দূর! সব একঘেয়ে গান। এর চাইতে দেবব্রত বিশ্বাসের গান শোনা ভাল!” যেহেতু কখনোই এঁদের কারুর অনুষ্ঠান শুনিনি, বিরক্তির কারণ বোধগম্য হলো না! পরে, যখন একাধিক অনুষ্ঠানে তাঁকে শুনেছি, তখন বুঝেছি যে কিছু গান তিনি প্রায় সব সময়েই গাইতেন। একেবারে বাঁধা ছিল ‘দিনের শেষে’, সে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর হোক, কি মেশানো গানের অনুষ্ঠান, কি আধুনিক বা ছায়াছবির গানের! সেদিনের অনুষ্ঠান তিনি শেষ করলেন ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’ দিয়ে। যখন আস্তে-আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছি, দেখলাম মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি অনেককে সই দিচ্ছেন।

(ক্রমশ)

 

 


1 টি মন্তব্য: