সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)




(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)


অধ্যায় - ২ / ৩

উৎস (Origin):

একইভাবে দেখা গেছে যে, পরাজিত দলপতিদের মধ্যে কয়েকজন নতুন সমাজে উচ্চ সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিল। বলবুথা (Balbutha) এবং তারুকসা'র (Taruka) মতো দাস দলপতিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহারগুলি যাজকীয় স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ করেছিল এবং নতুন ব্যবস্থায় তাদের পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দাসেরা যে উপহার প্রদান করার মতো অবস্থায় বিদ্যমান ছিল এবং উদার ও দানশীল হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল, তা থেকে তাদের উৎস 'দাস' হওয়ার এবং তাদের 'দাস' বিশেষণটির উৎপত্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। পরবর্তীকালে তাদের আত্মীকরণের প্রক্রিয়া চলেছিল, যাতে ভবিষ্যত সাহিত্যসমূহ এই ঐতিহ্যকে নথিভুক্ত করে যে প্রতার্দনা (Pratardana) দৈবদাসী ঈন্দ্রের জগতে পদার্পণ করেছিল, যে ঈন্দ্র ঐতিহাসিক ভাবে আর্য আক্রমণকারীদের ঔপাধিক শাসক ছিলেন।

পুরাতন ইতিহাস, সাধারণ আর্য জনসাধারণ ও পূর্ববর্তী সমাজের বেঁচে থাকা মানুষদের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার উপর কষ্টসহকারে hardly) কোনো আলোকপাত করেছে। সম্ভবত তাদের বেশিরভাগই পরিনত হয়েছিল, যাকে বলা হয় আর্য সমাজের চতুর্থ বর্ণে। কিন্ত আমরা যদি 'পুরুষাসুক্ত'র (Purusasukta) বাইরে অবস্থান করি, সেক্ষেত্রে ঋগবেদ-এর পর্যায়কালের মধ্যে শূদ্র বর্ণের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। যদিও প্রাক-আর্য যুগে, নারীদাসীদের একটি ক্ষুদ্র ক্রীতদাসসুলভ গোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল। এটি মনেহয় যে, আর্যদের শত্রুদের মধ্যেকার পুরুষ সদস্যেরা যখন মারা পড়েছিল, তখন তাদের স্ত্রীলোকেরা দাসত্বে পর্যবসিত হয়েছিল। এইভাবে, এটি কথিত আছে যে, পুরুকুৎসা'র (Purukutsa's) পুত্র ত্রাসাদস্যু (Trasadssyu), পঞ্চাশটি স্ত্রীলোক-কে উপহার স্বরূপ দান করেছিল। পুনরায়, নারী দাসেদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় অথর্ববেদ-এর শুরুর দিকের অংশগুলিতে। সেখানে নারী ক্রীতদাসেরা প্রদর্শিত হয়েছে সিক্ত হস্তে মুষল ও হামানদিস্তা ব্যবহার করতে এবং গরুর গোবর দিয়ে ঘুঁটে লেপন করতে, যা দর্শায় যে তারা গৃহস্থালীর কাজে ব্যপৃত ছিল। এই সঙ্কলন সুপ্রাচীন কালো-দাসী'র (black dasi) প্রাচীনতম উল্লেখ উপলব্ধ করায়। এইসব উল্লেখসমূহ সেইজন্য সুপারিশ করে যে গোড়ার দিকের বৈদিক সমাজে নারী ক্রীতদাসদের গৃহস্থালীর কাজে নিয়োগ করা হতো। দাসী শব্দটির ব্যবহার এটি সুনিশ্চিত করে যে এই সমস্ত নারীরা ছিল পরাজিত দাসেদের নারীজাতি।

দাস শব্দটির ক্রীতদাস অর্থে ব্যাবহার সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায় ঋগবেদের শেষের দিকের অংশগুলিতে। দুটি উল্লেখের ঘটনা দেখা গেছে প্রথম পুস্তকে, একটি দশম পুস্তকে এবং একটি সন্নিবেশিত হয়েছে অষ্টম পুস্তকের অনুপূরক স্তোত্রগুলির মধ্যে, যেগুলিকে বালখিল্য (valakhilya) বলা হয়। এই ধরনের গোড়ার দিকের একমাত্র উল্লেখটি পাওয়া গেছে অষ্টম পুস্তকে। ঋগবেদে ক্রীতদাস অর্থে আর অন্য কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি, এবং সেইজন্য এটি পরিষ্কার যে, গোড়ার দিকের ঋগবৈদিক পর্যায়ে পুরুষ-ক্রীতদাসের অস্তিত্ব ছিলোনা বললেই চলে।

শেষের দিকের ঋগবৈদিক পর্যায়ে দাসেদের সংখ্যা ও চরিত্র সম্পর্কে উল্লেখসমূহ কেবলমাত্র একটি অস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে। বালখিল্য (valakhilya) একশ'টি ক্রীতদাসের উল্লেখ করেছে, যাদের গাধা-ভেড়ার সরণীতে ধরা হয়েছে। অন্য একটি পরবর্তী উল্লেখে 'দাস-প্রভর্গ (dasa-pravarga) শব্দটি, সম্পদ বা ক্রীতদাসদের সমাবেশ বোঝাতে পারে। এটি সুপারিশ করে যে, ঋগবৈদিক পর্যায়ের শেষের দিকে ক্রীতদাসেরা সংখ্যাগত দিক থেকে বেড়ে চলেছিল, কিন্ত তাদের উৎপাদনের কাজে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। তারা তাদের যাজকীয় অথবা যোদ্ধা প্রভূদের গৃহস্থালী কাজের পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত ছিল বলে প্রতীত হয়। এইসব প্রভূরা সাধারণভাবে যোদ্ধা ছিল ; কেবলমাত্র একটি উল্লেখে ক্রীতদাসদের প্রভূ হিসেবে  যাজক দীর্ঘতামস (Dirghatamas)-এর কথা উদ্ধৃত করেছে। তাদের স্বাধীনভাবে গবাদিপশুর সাথে ছেড়ে দেওয়া যেতো। এটি মনে হয় যে, ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতাই ছিল ঋণখেলাপকারীর দাসত্ববন্ধনের কারণ। কিন্ত বিশেষত দাস নামটি বোঝায় যে, বৈদিক যুগে যুদ্ধ্ই ছিল দাসত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

কারা ছিল দাসেরা? তাদের সাধারণত দস্যুদের সাথে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্ত 'দস্যু-হত্যা'র (dasyu-hatya) বিপরীতে 'দস-হত্যা' (dasa-hatya) শব্দটির অনুপস্থিতি, পার্বত্য- উপজাতীয় যুদ্ধে আর্যদের সহায়ক হিসেবে দাসেদের উপস্থিতি, 'অপ-ব্রত' (apa-vrata), 'অন্য-ব্রত' (anya-vrata) ইত্যাদির বিবরণের অনুপস্থিতি, তিন জায়গায় দাস-ভিসাস (dasa-visas)-এর উল্লেখ এবং সর্বোপরি 'ইরানী দাহায়' (Iranian Dahae) এক সেথিয়ান (Seythian) উপজাতি'র সাথে তাদের একীভবন প্রভৃতি, দাসেদের সাথে দস্যুদের তীক্ষ্ণ পার্থক্য নির্দেশ করে, যাদের আর্যদের সাথে কষ্টকল্পিতভাবেও (hardly) কোনো সাদৃশ্য আছে বলে মনে হয় না। ভারতীয়-ইউরোপীয় ভাষায় দস্যু শব্দটির কোনো সাধারণ শব্দ (common word) নেই। দস্যু শব্দটি পুরাতন পারসিক (Old Parsian) এবং অবেস্তান (Avestan) ভাষাগুলিতে রয়েছে, কিন্ত সেগুলির অর্থ মানুষের বাসস্থান, জেলা, প্রদেশ, দেশ প্রভৃতি ; এগুলি প্রাচীন ভারতীয় দস্যুদে'র সাথে বৈসাদৃশ্যমূলক শব্দ, দস্যু বলতে বোঝায় কোনো মানুষ, কোনো দেশ নয়।অপরদিকে 'দাস' শব্দটি বহুবিধ ভাষাই সাধারণ (Common) অর্থে ব্যবহার করে। এইভাবে, গ্রীক 'দৌলাস' (doulas), সার্ভাস (servus) মাইশেনেয়েন, (Mycenaean) দোয়েরা (doera)-তে প্রত্যায়িত (attested) হওয়া শব্দটি সংশৃষ্ট হয়েছে ইরানীয় 'দাহা'র সাথে এবং সেটি ইঙ্গিত করে ইন্দো-ইউরোপীয় 'দোস' (dos) শব্দের দিকে। এই সমস্ত ভাষতেই শব্দটির অর্থ হয় 'মানুষ' বা 'বীর', যেটি অবশেষে এসে দাঁড়িয়েছে জাতিগত তাৎপর্যে। গ্রীকেরা জানতো, একটি মানুষকে দাই (Daai), দাঐ (Daoi), দোয়াই (Doai) প্রভৃতি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এইচ ডব্লিউ বেইলী (H W Baily) তুলে ধরেছেন যে, দাস শব্দটি ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কষ্টসাধ্য ভাবেও (hardly) একটি যথার্থ শব্দ নয়। কিন্ত ঋগবেদের অসংখ্য উল্লেখসমূহে বলা হয়েছে যে দাসেরা হয় আর্যদের বিরোধী ছিল অথবা সহযোগী। প্রাচীন ভারতে দাসা (dasa) শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে তার ভিত্তি --- দাস থেকে, যার মানে ক্রোধপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হবে (to treat violently)। তারা একটি সমগোত্রীয় জাতিগত বংশ নাও হয়ে থাকতে পারে কিন্ত তারা নিঃসন্দেহে বৈদিক পর্যায়ের একটি জনগোষ্ঠী ছিল। প্রফেসর বেইলী (Proessor Baily) নিজেই এমন কিছু মানুষের অস্তিত্বের বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন যাদের ডাকা হতো তাদের জাতিগত নাম ইরানীয় দাহা (Iranian daha) নামে, পরবর্তীকালে ক্সেরক্সেস (Xerxes) নামক একটি শিলালিপিতে, যাদের নাম উল্লেখিত হয়েছিল সাকা (saka) নামের আগে। এটি যথার্থ ভাবে প্রস্তাবিত করা হয়েছে যে, প্রাচীন ভারতের দাস পদটি পরবর্তীকালের সামাজিক পরিবেশজনিত কারণে মর্যাদাহানিকর হয়ে উঠেছিল।

সম্ভবত দাসেরা ছিল সংযুক্ত ইন্দো-আর্য জনসাধারণের একটি অগ্রবর্তী রক্ষীবাহিনী, যারা ভারতে এসেছিল সেই সময় যখন ক্যাসিটেস-রা (Kassites) খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫০ সালে ব্যাবেলোনিয়া'য় আবির্ভূত হয়েছিল। বিষয়টিকে সংযুক্ত করা যেতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের সাথে, যেটি অনুমান  করেছে যে, উত্তর পার্সিয়া (Northern Persia) থেকে ভারতের দিকে মানুষজনের গতিবিধির, হয় একটি ক্রমিক গতি সক্রিয় ছিল (Continues movement of people) অথবা দুটি বিশাল গতিবিধি সঙ্ঘটিত হয়েছিল এবং প্রথমটির কাল নির্ধারিত করা হয়েছে ২০০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দের ঠিক পরে। যেহেতু দাসেরা ঋক-বৈদিক জনতার সাথে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান ভাগ (share) করে নিয়েছিল, তাই শেষোক্তরা তাদের প্রতি এক মীমাংসাসূচক নীতির অবলম্বন করেছিল এবং সহজেই দেবদাস (Divodas), বলবুথা (Balbutha) ও তারুক্সা (Taruksa) নামক দাস-দলপতিদের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছিল। এটিই কারণ ছিল যে দাসেরা, তাদের উপজাতীয় পারস্পরিক সংঘর্ষগুলির ক্ষেত্রে বারংবার আর্যদের মিত্রশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এইভাবে এটি অধিষ্ঠিত হয় যে, ক্রীতদাস অর্থে 'দাস' নামটি ভারতের অনার্য বসবাসকারীদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হয়নি বরং সেটি হয়েছে ইন্দো-আর্য সংমিশ্রিত বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে। ইরানে যারা উৎকীর্তিত (lauded) হয়েছিল, ভারতে তারা নিন্দিত হয়েছে, সম্ভবত ইন্দো-আর্যদের একটি ভূতপূর্ব জন-তরঙ্গের কারণে, যারা পরবর্তী সেই একই লোকেদের জন-তরঙ্গের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঋগবেদের পরবর্তী পর্যায়ে, দাস শব্দটি হয়ত নির্বিচারে প্রযুক্ত হয়েছে কেবলমাত্র বেঁচে থাকা ইন্দো-ইউরোপিয়ান দাসেদের আচ্ছাদিত করার জন্যই নয় বরং প্রাক-আর্য দস্যু ও রাক্ষস এবং আর্যদের সেই সমস্ত অংশের জন্যও, যারা তাদের নিজ বর্গের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে অধীনতায় হ্রস্বীকৃত (reduced) হয়েছে।

সম্ভবত দাসেরা ছিল সংযুক্ত ইন্দো-আর্য জনসাধারণের একটি অগ্রবর্তী রক্ষীবাহিনী, যারা ভারতে এসেছিল সেই সময় যখন ক্যাসিটেস-রা (Kassites) খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫০ সালে ব্যাবেলোনিয়া'য় আবির্ভূত হয়েছিল। বিষয়টিকে সংযুক্ত করা যেতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের সাথে, যেটি অনুমান  করেছে যে, উত্তর পার্সিয়া (Northern Persia) থেকে ভারতের দিকে মানুষজনের গতিবিধির, হয় একটি ক্রমিক গতি সক্রিয় ছিল (Continues movement of people) অথবা দুটি বিশাল গতিবিধি সঙ্ঘটিত হয়েছিল এবং প্রথমটির কাল নির্ধারিত করা হয়েছে ২০০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দের ঠিক পরে। যেহেতু দাসেরা ঋক-বৈদিক জনতার সাথে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান ভাগ (share) করে নিয়েছিল, তাই শেষোক্তরা তাদের প্রতি এক মীমাংসাসূচক নীতির অবলম্বন করেছিল এবং সহজেই দেবদাস (Divodas), বলবুথা (Balbutha) ও তারুক্সা (Taruksa) নামক দাস-দলপতিদের সাথে সংমিশ্রিত হয়েছিল। এটিই কারণ ছিল যে দাসেরা, তাদের উপজাতীয় পারস্পরিক সংঘর্ষগুলির ক্ষেত্রে বারংবার আর্যদের মিত্রশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এইভাবে এটি অধিষ্ঠিত হয় যে, ক্রীতদাস অর্থে 'দাস' নামটি ভারতের অনার্য বসবাসকারীদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হয়নি বরং সেটি হয়েছে ইন্দো-আর্য সংমিশ্রিত বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে। ইরানে যারা উৎকীর্তিত (lauded) হয়েছিল, ভারতে তারা নিন্দিত হয়েছে, সম্ভবত ইন্দো-আর্যদের একটি ভূতপূর্ব জন-তরঙ্গের কারণে, যারা পরবর্তী সেই একই লোকেদের জন-তরঙ্গের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঋগবেদের পরবর্তী পর্যায়ে, দাস শব্দটি হয়ত নির্বিচারে প্রযুক্ত হয়েছে কেবলমাত্র বেঁচে থাকা ইন্দো-ইউরোপিয়ান দাসেদের আচ্ছাদিত করার জন্যই নয় বরং প্রাক-আর্য দস্যু ও রাক্ষস এবং আর্যদের সেই সমস্ত অংশের জন্যও, যারা তাদের নিজ বর্গের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে অধীনতায় হ্রস্বীকৃত (reduced) হয়েছে।

আর্যরা যদি সংখ্যায় কম হতো, তাহলে তারা বিজয়ী মানুষদের উচ্চতর শ্রেণীর এক নতুন, সংখ্যালঘু শাসক হিসেবে নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে পারতো, যেমনটি করেছিল হিট্টিটাস (Hittites), অ্যানাতোলিয়া (Anatolia) এবং ক্যাসিটেস (Cassites) ও মিটান্নিস-রা (Mitannis), মেসোপোটেমিয়াতে (Mesopotania)। কিন্ত ইরান ও ভারত, উভয় ক্ষেত্রেই ভাষাবিদ্যাগত অবস্থান ইঙ্গিত করে ব্যাপক পরিযানের (Mass migration) দিকে। ঋক-বৈদিক তথ্য-প্রমাণ এই অনুমনের পক্ষে মারাত্মক যে, আর্যরা সংখ্যালঘু অবস্থায় ভারতে নিজেদের আরোপিত করেছিল। বৈদিক রচনাসমূহে আমরা আর্য জাতির অসংখ্য গতিবিধি ও বসতি স্থাপনের ঘটনার সম্মুখীন হই। ১৯৪৭ সাল থেকে সম্পন্ন হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানসমূহ আর্যদের চিহ্নিতকরণ সম্পর্কিত এক ঝাঁক উন্নত তত্ত্বের ফসল উৎপাদিত করেছে। এইসব তথ্যসমূহের বেশ কয়েকটির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করা যায়, যদি আমরা নবাগতদের ধারাবাহিক প্রবাহকে স্বীকার করে নিই, যারা ১৫০০ থেকে ৫০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দ পর্য্যন্ত সম্পুর্ন উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাদের সাংস্কৃতিক উপাদান সমূহের অজস্র ছাপ রেখে গেছে। যদিও গোড়ার দিকের ঋক-বৈদিক সভ্যতার অবশিষ্টাংশের শনাক্তকরণ কষ্টকর, তবুও গান্ধারা কবরগুলি হয়ত ১৮০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দে আর্যদের প্রথম অভ্যাগমন (arrival) ঘোষিত করতে পারে। সে যাই হোক, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং পাকিস্তান সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য উৎকীর্ণ শিলালিপি ও ধূসর মাটির পাত্র সম্বলিত নানান ভগ্নাবশেষ সমূহ সুপারিশ করে যে, ১০০০ থেকে ৫০০ খৃষ্টপৃর্বাব্দের মধ্যে এইসব অঞ্চলে ব্যাপক হারে নবাগতদের জনবসতির পত্তন (settlements) হয়েছিল। সংখ্যাগত দিক থেকে মোট ৩১৫টি পি জি ডব্লিউ সাইটের (PGW Sites) (ভগ্নস্তুপ) উদ্ধার হয়েছে, বেশিরভাগই অবস্থিত উপরি গঙ্গা ও সাতলেজ অববাহিকায় এবং ঘাগ্গর (Ghaggar) উপত্যকায়। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানগুলি হরিয়ানার সরস্বতী (Sarasvati) ও দ্রসদবতী (Drsadvati) নদীর তীরে প্রায় ৩০০টি, পি জি ডব্লিউ সাইট-কে (ভগ্নস্তুপ-কে) প্রচারের আলোয় এনেছে এবং ইতিমধ্যে এই ধরনের সমস্ত ভগ্নস্তুপের সংখ্যা হয়ত ৫০০ অতিক্রম করে গেছে। যে সমস্ত ভগ্নস্তুপের খনন করা হয়েছে, জানা গেছে যে সেগুলি দুই থেকে তিন শতক যাবত জনপদ অধ্যুষিত ছিল।

পুনরায়, ভারতের বৃহত্তর পরিসর জুড়ে আর্য ভাষাগুলির বিন্যাস থেকে, তাদের ভাষাভাষীদের ব্যাপক পরিযানের বিষয়টি পূর্বাহ্নেই স্বীকৃত হয়ে গেছে। সংস্কৃত শব্দের প্রারম্ভে নানান মুন্ডা ও দ্রাবিড়ীয় শব্দের মজুত থাকা সত্ত্বেও, বৈদিক পর্যায় থেকেই উত্তর ভারতের মানুষের প্রাক-আর্য জীবনযাত্রা, নবাগতদের দ্বারা এত বেশি প্লাবিত হয়েছিল যে, তারা নিজেদের ভাষাকেও ধরে রাখতে পারেনি। যেমন পরবর্তীতে দেখানো হবে যে উত্তর ভারতে শূদ্ররা, বৈশ্যদের সহযোগ সহকারে জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ ছিল, কিন্ত সেক্ষেত্রে এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না যার দ্বারা দেখানো যায় যে তারা অনার্য ভাষা বলতো। কিন্ত অপর দিকে বৈদিক পর্যায়ের পরবর্তীতে, উপজাতীয় শূদ্রেরা আর্য-বাক্য বুঝতো, যা পরিস্ফুট হয়েছে বলিদানের সময় ব্যবহৃত তাদের ঠিকানার প্রস্তুত-প্রণালির মধ্য দিয়ে। এই সূত্রে মহাভারতের একটি পরম্পরাগত প্রথা তাৎপর্যপূর্ণ : "বেদ-এ অঙ্গীভূত সরস্বতীসমূহ, ব্রহ্মা দ্বারা ইতিপূর্বে সকল চার বর্ণের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল ; কিন্ত শূদ্রেরা, ধন উপার্জনের তাড়নায় অজ্ঞতার শিকার হয়ে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে তারা তাদের বেদ সম্পর্কিত অধিকার থেকে বিচ্যুত হায়েছিল।" ওয়েবার (Weber) এই অংশটিকে এই অর্থে উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রাচীনকালে শূদ্ররা আর্যদের ভাষায় কথা বলতো। এটি সম্ভব যে কানাডীয় সীমান্তের উপজাতিরা তাদের নিজেদের স্থানীয় ভাষা ভুলে গিয়েছিল আর্য ভাষার স্বপক্ষে, যেমন বর্তমান সময়ে বিহারের কতিপয় পার্বত্য উপজাতি, তাদের নিজেদের ভাষা পরিত্যাগ করেছে এবং কুরমালি (Kurmali), সাদানা (Sadana) প্রভৃতি আর্যদের স্থানীয় ভাষা গ্রহণ করেছে, যদিও তাদের সংখ্যা, যাদের ভাষা তারা গ্রহণ করেছে, তাদের তুলনায় অনেক কম। এমনকি আধুনিক কালে, যখন আর্যভাষী জনসাধারণ, তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার-কে কেন্দ্র করে অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে, তারা কিন্ত অনার্য ভাষাগুলিকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়নি, যে ভাষাগুলির কিছু ক্ষেত্রে, সতেজ বিকাশ ঘটানোর সামর্থ্য আছে।

(ক্রমশ)

  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন