শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৭


দিকশূন্যপুর

'শালা এ তো হেব্বি খিচাইন হল! আমাদের তো কেউ পোড়াতেও আসবে না, গুরুমা জানতে পারলে না, ক্যালানি জুটবে।' আরো কয়েকটা অপশব্দ ভেসে  আসছে রাস্তাটা থেকে। অমলেশ এগিয়ে যাচ্ছে ওদিকেই। সভা শেষ। বর্ধমান স্টেশনের পাশে রাস্তাটায় রোজই বসে থাকে এদের একটা দল। পানাগড়ে ওদের 'খোল'। মানে বাসা। গাঢ় রঙের লিপস্টিক। চড়া রোদের মত চুল। অনবরত পান খাচ্ছে। ট্রেন থেকে নামলেই অকারণ তালি বাজিয়ে টাকা আদায় করে ওরা।

সকলের চোখে মুখেই আজ অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। একটু কি ভীত?

-'আরে, হয়েছেটা কী?'

অমলেশ জানতে চায়।

ওদের চোখে মুখে অস্বস্তির ছাপটা গাঢ় হয়। অমলেশ হাল ছাড়ে না।

-'বলো কি হয়েছে? কাকে পোড়াবার কথা বলছিলে? কেউ মারা গেছে নাকি?'

একজন উত্তর দেয়-

-'তুই সেই ইস্কুলের বাবু না? সভা-টভা করিস। আমাদের কথা শুনতে এয়েছিস নাকি দয়া দেখিয়ে ‘পারিক’ হতে চাস?'

অমলেশের চোয়াল শক্ত হয়। তবুও উত্তর দেয় ও।

-'আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই।'

একটু বোধহয় নরম হয় ওরা।

-' আমাদের একজন 'কোতি' হতে গিয়ে মরেছে। গুরুমা বলেছিল ওর ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু ও শালী নিজেই হাসপাতালে এসেছিল। গুরুমার অমতে। আর  আমরা ওকে সাহায্য করতে গিয়ে ফেঁসেছি'। আগের জনকে থামিয়ে অন্য একজন উত্তর দেয়। 

স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল, ওষুধের গন্ধ পেরিয়ে অমলেশ ওদের নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছয়। মৃতদেহ পড়ে রয়েছে মেঝেতেই। এক টুকরো কাপড়ে ঢাকা কোনমতে। অমলেশ সব ব্যবস্থা করে বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। ওর ভিতরে মেঘ বইছে। এখানেই শেষবার দেখা হয়েছিল শ্যামার সঙ্গে। শ্যামলাল থেকে শ্যামা হওয়ার চেষ্টা করেছিল। শ্যামার পারিক মানে প্রেমিক অমুদা’র ইচ্ছেয়। ‘লিঙ্গচ্ছেদ’ করিয়ে কোতি হতে চেয়েছিল ও। কিন্তু শরীরের ওপর দিয়ে হওয়া  পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি শরীর নিজেই। মারা যায়। অমলেশ তখন যুবক। শ্যামার অমুদা। ভয়ে শেষ দেখাটাও দেখতে আসতে পারেনি ও। ওর শ্যামার শরীর হয়তো কোন ভাগাড়ে পড়ে থেকেছে অথবা কারোর দয়ায় শেষ আগুনটুকু পেয়েছে।

অমলেশ শূন্য রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছে, ওর পা দুটো রাস্তার মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে। মৃতদেহটা নিয়ে যখন হিজড়েদের দলটা এগোচ্ছে, অমলেশ দেখতে পাচ্ছে মৃতের শরীরের অর্ধেকটা যেন অমলেশ নিজে। আর মুখটা শ্যামার। ‌অমলেশ তাকাতে পারে না আর। ওর চোখ বুজে আসে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন