কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৭ |
কৃষ্ণকুমারী
মেয়েটির গায়ের রঙ চাপা। রীতিমতো চাপা। মানে কালো। খুবই কালো। সাধুভাষায় বলা যেতে পারে, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। অথচ তার নাম রঙিলা। নামটা কে রেখেছিল, কেন রেখেছিল, কীভেবে রেখেছিল, জানা নেই। সম্ভবত জন্মমুহূর্তে মেয়েটির মনের রঙের হদিশ সে পেয়েছিল। আমার সঙ্গে মেয়েটির আলাপ হয়েছিল ঝাড়খন্ড থেকে দিল্লিগামী একটি ট্রেনের টু-টায়ার এসি বগিতে। একটু অবাকই হয়েছিলাম মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। আমার নিজের গায়ের রঙ কালো, কিন্তু কোনো মেয়ে যে এতটা নিকষ কালো হতে পারে, তা দেখে অবাক হতে হয়েছিল। শুধু হাসলে তার সুন্দর পরিপাটি সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করছিল।
মেয়েটির নাম রঙিলা। ঝাড়খন্ডে একটি এন-আই-টি কলেজের ছাত্রী। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফোর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষার পর ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। বাড়ি সে সচরাচর যায় না। ছুটিতে হস্টেলেই থাকে। কেননা তার ভয়, বাড়ির লোকেরা সুযোগ পেলেই তাকে টেনে হিঁচড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে। রঙিলার কথা শুনে থমকালাম। বললাম, কেন? তুমি তো এখনও পড়াশোনা করছ!
রঙিলা বলল, হ্যাঁ সেটাই তো কেউ বুঝতে চায় না! জানেন, আই-সি-এস-সি পাশ করার পরেই আমার জন্য ছেলে দেখতে শুরু করেছিল। প্লাস-টু আমাকে পড়তেই দেবে না! তারপর আমি একদিন বাড়ি থেকে পালালাম।
-সেকী! বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে? কোথায় ছিলে?
-একটা মন্দিরে। মন্দিরের পুরোহিত আমার দাদুর বয়সী ছিল, তাই ততটা ভয় ছিল না। তবু রাতে আমি জেগেই থাকতাম। চারদিন আমি মন্দিরের প্রসাদ খেয়েই কাটিয়েছিলাম।
-তোমার তো খুব সাহস আছে! তারপর বাড়ি ফিরলে কীভাবে?
-বাড়ির লোকেরা খুঁজে খুঁজে মন্দির থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। শর্ত ছিল, এখন আমি বিয়ে করব না। যাইহোক তারপর আমি প্লাস-টু’তে ভর্তি হলাম। পাশও করলাম। এন-আই-টি’তে ভর্তি হবার জন্য পরীক্ষা দিয়ে সিলেক্টও হয়ে গেলাম। আর তখনই বিয়ের জন্য আমাকে দেখতে বেশ কয়েকটি পাত্রপক্ষের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আমি আবার বাড়ি থেকে পালালাম।
-আবার? এবার কোথায় ছিলে?
-আমার মায়ের এক বান্ধবীর বাড়িতে। সবকথা শুনে আমাকে লুকিয়ে রাখলেন। কিছুই জানালেন না আমাদের বাড়িতে। দিন সাতেক সেখানেই বেশ ছিলাম। কিন্তু একদিন অনেক রাতে মায়ের বান্ধবীর বর চড়াও হলো আমার ওপর। ভয় দেখিয়ে বলল, আমি ইন্টারকোর্সে রাজি না হলে, আমার বাড়িতে জানিয়ে দেবে। আমি অনেক সাধ্যসাধনা করে সেদিন তাকে ঠেকিয়েছিলাম। তবু আমাকে জাপটে ধরে মুখে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়েছিল। পরদিন সকালেই সেখান থেকেও পালালাম। আমার এক স্কুলের বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম। আর সেখান থেকেই সরাসরি চলে গেছিলাম এন-আই-টি’তে। কলেজে ভর্তি হবার এবং হস্টেলে থাকার যাবতীয় খরচ বাবা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন প্রতি মাসেও টাকা নিয়মিত পাঠাচ্ছেন।
বললাম,
তুমি সত্যিই রঙিলা! জীবনে তোমার অনেক রঙ। তা এবার যে যাচ্ছ, আবার বিপদে পড়বে না তো?
রঙিলা
হাসতে হাসতে বলল, তাই যদি হয়, আবার পালাতেই হবে। অনেকদিন হলো মা-বাবা-ভাইকে দেখিনি,
তাই যাচ্ছি। কিন্তু মানতেই হবে, বিয়ের বাজারে আমার মতো কালোমেয়ের ডিমান্ডও কম নয়!
বেশ অন্যরকম একটা গল্প।ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন