শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

মলয় রায়চৌধুরী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৭


লকডাউন

ক্যাম্পারভ্যান একশো চল্লিশ কিলোমিটার এগোবার পর, আকাশে কালোমেঘ জমতে আরম্ভ করেছে, গাড়ির সবাই দেখতে পেলো কঙ্কালদের একটা বিশাল মিছিল এদিকেই এগিয়ে আসছে, তাদের মাথায় বাক্স-প্যাঁটরা, বাচ্চা কঙ্কালদের হাত ধরে আছে বয়স্ক কঙ্কাল, কোনো-কোনো কঙ্কালের কাঁধে শিশু কঙ্কাল। একটা গাড়ি ওদের দিকে এগোচ্ছে অথচ কোনও হেলডোল নেই, এগিয়েই আসছে। জীমূতবাহন ক্যাম্পারভ্যান রাস্তার বাঁ-পাশে পার্ক করল যাতে কঙ্কালগুলো ওদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। কঙ্কালগুলো যেন নাচিয়েদের মতন খুশি,  মাংস ছাড়া হাঁটতে পেরে তারা মুক্ত বোধ করছিল। মশা কামড়াচ্ছে না, তাদের চুল কাটতে হয়নি, ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত বোধ করছে না, গরম বা ঠান্ডা লাগছে না।

জীমূতবাহন জানলার কাচ তুলেছিল কঙ্কালগুলোর কারোর সঙ্গে কথা বলার জন্য, তার আগেই মাথা বের করে ভবতারিণী একজন কঙ্কালের গায়ে হাত দিয়ে, যে একটা কুকুরের কঙ্কালকে দড়িতে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল,  ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কে গো? তোমাদের দলে তো দেখছি হাজার-হাজার কঙ্কাল!

কঙ্কালটা বলল, আশ্চর্য, বাংলাতেই বলল, আমরা সবাই হঠাৎ ঘোষণা-করা লকডাউনের শিকার, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, রাস্তার ফেরিওয়ালা, দিনমজুর, হকার, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। গণছাঁটাইয়ের কারণে পরিযায়ী শ্রমিক আমরা, নিজেদের বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছি, এমনকি  মালিকপক্ষ অনেক শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরিও দেয়নি।  মজুরি ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে মাঝপথে আটকে গিয়েছি, কারণ, ফেরার ট্রেনগুলো অতিমারীর জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত আর ব্যবসাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, আর শিগগিরই এগুলো আবার স্বাভাবিক  অবস্থায় ফিরে আসার আশা খুব ক্ষীণ। এমনকি যাতায়াতের সাধারণ রুটগুলোও এলোমেলো হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঘরে ফিরছি আমরা। হাঁটতে-হাঁটতে খেতে না পেয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছি।  বহু শ্রমিক কঙ্কাল হতে না পেরে প্রাণ হারিয়েছে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে করতে মুখ থুবড়ে পড়ে পথের মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে অনেক অসহায় পরিযায়ী। নিজেকে জোয়ারের সাথে ভেসে যেতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা, ভাগ্যের প্রতি ন্যূনতম প্রতিরোধ করব, এমন ক্ষমতা ছিল না। এখন কঙ্কালের আদলেই  বাড়ি ফিরছি গো, হাজার হোক, বউ-মা-বাবা পথ চেয়ে রয়েছেন। নাও, এই বইটা পড়ো।

ভবতারিণী বলে উঠল, আরে! কঙ্কালটা এই বুকলেট ফেলে গেল, হিন্দি, লেখা রয়েছে ‘মন কি বাতকম্মো’। শঙ্খমালা বলে উঠলো, ওটা বোধহয় মন কি ভাত,  হাঙ্গার ইর‌্যাডিকেশানের পুস্তিকা।

কয়েক মিনিটেই কঙ্কালের মিছিল ওদের ছাড়িয়ে উধাও হয়ে গেল। এমনভাবে উবে গেল যে মনে হলো ওরা ধবধবে বাতাস দিয়ে গড়া।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন